#অনুভবের_প্রহর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব____২৯
কোনো উত্তর এলো না। অনুভব আরো গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। মস্তিষ্ক জুড়ে লাল রঙা শাড়ির আঁচল উড়িয়ে প্রহর ছুটে চলেছে।
________
মনোরম সুন্দর এক পাহাড়ের চূড়া। চারিদিক সবুজে সবুজ। পাহাড়ের গা জুড়ে সবুজ গাছগাছালি আর হরেক রকমের বুনোফুল। একটু নিচে বেশ খানিকটা সমতল ভূমি। সেখানে শোভা পাচ্ছে কাঠের তৈরি একটা ঘর। সবেমাত্র ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আকাশ মেঘমুক্ত। তবে কিঞ্চিৎ কুয়াশাচ্ছন্ন। সেই কুয়াশা ভেদ করে ভোরের প্রথম সূর্য পুব আকাশে উঁকি দিচ্ছে। অনুভব চূড়া থেকে নিচে নেমে এলো। কাঠের তৈরি ঘরের একপাশে বুনো গাছপালা। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে। অনুভব পেছনে গিয়ে বললো,
‘তোমায় পাহাড়ী কন্যাদের মতো লাগছে প্রহর।’
প্রহর হাসিমুখে পেছন ঘুরে তাকালো। আজলা ভরা বুনোফুল হঠাৎ মুঠোভর্তি করে অনুভবের দিকে ছুঁড়ে মারলো। অনুভব হাত পেতে কিছু ধরতে পারলো। কাছাকাছি এসে সেগুলো প্রহরের খোলা চুলে গুঁজে দিতে লাগলো।
‘উপরে উঠবে প্রহর? পাহাড়ের চূড়ায়?’
‘উঁহু! ভীষণ ভয় লাগে।’
‘ধুর, আমি আছি না! ওখান থেকে সূর্য দেখার অনুভূতি অন্য রকম। যাবে?’
কিছুক্ষণ ভাবলো প্রহর। অতঃপর হাতটা এগিয়ে দিল অনুভবের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যে তারা পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে পড়লো। পুবের ত্রিভুজাকৃতির পাহাড়ের কোল ঘেঁষে একটু একটু করে সূর্য উঠছে। কুয়াশাজড়ানো সে সূর্য দেখতে অপরূপ লাগছে। প্রহর মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো। মাথাটা অনুভবের কাঁধে এলিয়ে দিয়ে বললো,
‘এখানে সারাজীবন থেকে গেলে কেমন হয়?’
‘শুধু পাহাড় বা পাহাড়ের চূড়া কেন? তোমার সাথে আমি পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে থাকতে রাজি। কারাগারেও সমস্যা নেই!’
‘কিন্তু কারাগারে তো নারী-পুরুষ একত্রে থাকতে দেয় না।’
অনুভব কপট রাগ দেখালো। সূর্যের প্রথম ঝলকানির মতোই দীপ্তোজ্জ্বল হাসি ফুটে উঠলো প্রহরের মুখে। পেছন ঘুরে অনুভবের বাহুতে অধর স্পর্শ করলো।
‘অনুভব!’
হালকা কোনো পুরুষালী কন্ঠ ভেসে আসছে। একবার, দুবার, তিনবার! ধপ করে চোখ খুলল অনুভব। কাছেই টুল পেতে নাজমুল বসে আছে। চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে কতটা ঝড় গেছে। নাজমুল আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলো,
‘এখন কেমন লাগছে অনুভব? শরীরে কোনো জটিলতা?’
অনুভব উঠে বসলো। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ হাত নেড়ে দেখলো ভালো লাগছে৷ বেশ ভালো লাগছে। শরীর ঝরঝরে মনে হচ্ছে। আচমকা স্বপ্নের কথা মনে পড়লো। মনে পড়লো প্রহরকে। পাশে তো প্রহরের থাকার কথা। নাজমুল কেন? সে ঝটপট বললো,
‘প্রহর কোথায় নাজমুল? ওকে দেখছি না তো। কতদিন ঘুমিয়ে ছিলাম আমি? আজ কি বার?’
‘আস্তে আস্তে সব বলবো। তোর শরীর কেমন সেটা বল।’
‘শরীর ভালো। দেহের ভেতর ঝরঝরে লাগছে। অনেক হালকা লাগছে নিজেকে।’
নাজমুল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। অন্তত কিছুটা দুঃশ্চিন্তা কমলো। সে অনুভবের কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা পরখ করলো। তাপমাত্রা স্বাভাবিক। এবারে মাথায় চাটি মেরে বললো,
‘শালা! টানা তিনদিন ঘুমিয়ে ছিলি তুই। এত ঘুম কোথা থেকে আসে?’
‘বলিস কি! তিনদিন? প্রহর কোথায়?’
‘আছে তিনতলায়। ওর শরীর ভালো। দুশ্চিন্তার কিছু নেই।’
অনুভব উঠে দাঁড়ালো। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেও ঠিক কুলাতে পারছে না। বুকের ভেতর ধড়ফড় করছে। প্রচন্ড বেগে শরীরে রক্ত ছুটে চলেছে। প্রহরতে স্ব চক্ষে না দেখা পর্যন্ত শান্তি মিলছে না। পায়ে জুতা পরতে পরতে বললো,
‘আমাকে দ্রুত নিয়ে চল নাজমুল। প্রহরের কাছে নিয়ে চল।’
‘হু! পায়ের জুতা উল্টা করে পরেছিস। ঠিক কর।’
______
প্রহর ঘুমিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে গভীর ঘুম। চোখমুখ ফোলা ফোলা। চোয়ালের কাছে তিনটে স্টিচ দেওয়া। ঠোঁট দুটো শুকিয়ে গেছে। বাম কানের কাছে কালশিটে দাগ। গলার কাছেও ক্ষত দেখা যাচ্ছে। দেহে মৃদু গতিতে স্যালাইন চলছে। ক্রমাগত ছটফট করতে থাকা প্রহরকে এমন নিশ্চল হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে অনুভব বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। বুকের ভেতর জ্বলতে লাগলো। হুট করে মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ ফাঁকা হয়ে গেল। প্রহর ঠিক কতটা অসুস্থ সেটা অনুধাবন করতে কষ্ট হলো না। ক্ষণিক মুহূর্তে চোখের কোণ ভিজে উঠলো। টলমল পায়ে এগিয়ে গেলো সে। মাথা ঘুরছে তার। ঝরঝরে শরীরটা পাথরের মতো ভারী মনে হচ্ছে। কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছে। পাশের টুলটা টেনে কোনো রকমে বসে পড়লো সে। ক্ষীণ স্বরে দু’বার ডাকলো,
‘প্রহর?’
প্রহর প্রতিত্তর করলো না। চোখ খুললো না। অনুভব দ্রুত বাম হাতটা প্রহরের কপালে রাখলো। গায়ের উত্তাপ বেশি মনে হচ্ছে। হাতটা কপাল স্পর্শ করে গালে রাখতে প্রহর চোখ খুললো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য হৃৎস্পন্দন থেমে গেল অনুভবের। সেই চেনা চোখ! সেই চিরচেনা চোখের গভীরতা। লুকিয়ে রাখা গভীর যন্ত্রণা আর চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। চেপে রাখা আর্তনাদের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে ওই চোখে। অনুভবের ভেতরটা হাহাকারে পূর্ণ হয়ে গেল। প্রহরের স্যালাইন মুক্ত বাহুটা দুহাতে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করলো সে। এত কষ্ট হচ্ছে কেন ভেতরে? মনে হচ্ছে বুকের ভেতর কোথায় যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে কেন?
প্রহরের ঠোঁট কাঁপছে। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও ছাড়া ছাড়া ভাবে বললো,
‘আপনি কাঁদছেন অনুভব? আমি ঠিক আছি তো।’
ঝড়ের গতিতে উঠে দাঁড়ালো অনুভব। পরক্ষণে একছুটে রুম থেকে বের হয়ে গেল। দরজার দিকে চেয়ে রইলো প্রহর। অনুভবকে সুস্থ দেখে, আবার আগের মতো হাঁটতে দেখে ভালো লাগছে তার। অকস্মাৎ ঘটে যাওয়া এই দূর্ঘটনা থেকে সে একটা জিনিস ঠিক বুঝতে পেরেছে। অনুভবকে ছাড়া সে এক মুহূর্তও এ ধরায় শ্বাস নিতে পারবে না। অনুভব নেই! তার অনুভব এ পৃথিবীতে নেই, অথচ সে আছে! ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসে তার। শুকনো ঠোঁট জোড়া পুনরায় কেঁপে উঠলো প্রহরের। চোখের কোণ বেয়ে সরু এক জলের ধারা গড়িয়ে পড়লো।
মিনিট দশেক পর অনুভব ফিরলো। প্রহরের দৃষ্টি তখনো দরজার পানে। দরজা ভিড়িয়ে অনুভব আগের জায়গা বসে পড়লো। আগের মতো প্রহরের বাহু মুঠোয় পুড়লো। মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
‘কেমন লাগছে এখন প্রহর? কোথাও কষ্ট হয়?’
প্রহর ডানে-বায়ে মাথা নাড়লো। হালকা স্বরে বললো,
‘উঁহু। আপনি কেমন আছেন?’
‘আমি একদম ঠিক আছি। দেখো কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। শরীর একেবারে পার্ফেক্ট।’
‘দেখি কাছে আসেন তো!’
অনুভব খুব সহজে মুখটা একটু এগিয়ে নিল। প্রহর হাত ছাড়িয়ে অনুভবের কপাল স্পর্শ করলো। স্পর্শ করলো মুখের সর্বত্র। আহা! সে ভেবেছিল, এ জনমে আর বোধ হয় মানুষটাকে ছুঁতে পারবে না। নিশ্চিত দুজন দুজনকে হারিয়ে ফেলবে। কি যে কষ্ট হচ্ছিল তার! সে ঢোক চিপে বললো,
‘এত শুকিয়ে গেছেন কেন আপনি?’
প্রহরের শুষ্ক ঠোঁট জোড়ায় আঙুল চেপে থামিয়ে দিল অনুভব। মাথা নেড়ে বললো,
‘কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে তো। কথা কেন বলছো? হুঁ?’
প্রহর হাসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। মুখে অসম্ভব ব্যথা। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। একটা করে শব্দ উচ্চারণ করতে তোলপাড় করা ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু শারীরিক ব্যথা কিছুই না। অনুভবের সাথে কথা বলতে আনন্দ হচ্ছে। গভীর আনন্দ! মানুষটাকে নিয়ে কত কথা জমে আছে। অনুভবকে তার কতকিছু বলার বাকি। সে আঙুলের নিচ থেকে বলে উঠলো,
‘আজ কি বার বলুন তো। মনে হচ্ছে কত বছর হলো আপনার সাথে কথা বলি না।’
‘আজ মঙ্গলবার। গত মঙ্গলবারে আমরা কক্সবাজার গিয়েছিলাম। ওখানে দুদিন ছিলাম। শুক্রবার ফেরার পথে দূর্ঘটনা হয়েছিল। মনে আছে? সে সময় একসাথেই ছিলাম। এরপর মোটামুটি চার-পাঁচ দিন কেটে গেছে।’
‘এতদিন কেটে গেছে? পাঁচ পাঁচটা দিন হলো আপনার সাথে কথা বলি না? সর্বনাশ! সেজন্যই তো মনে হচ্ছে……. ‘
‘হুঁশ! কথা বলতে বারণ করেছি না?’
চোখ ছোট ছোট করলো অনুভব। প্রহর মিইয়ে গেল। উচ্ছ্বাসের সমুদ্রে ভাটা পড়লো। অনুভব বুঝতে পারলো। বাম হাতটা প্রহরের চোখে রেখে বন্ধ করলো। ঠোঁটের উপর থেকে আঙুল সরিয়ে চুমু খেল। লজ্জায় প্রহরের গাল রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। অনুভব তার চোখের উপর থেকে হাত সরালো না। তার নিজেরও ভীষণ লজ্জা লাগছে। সে চাপা স্বরে বললো,
‘ঘুমিয়ে পড়ো প্লিজ। আমি পাশে আছি। কোথাও যাব না।’
_________
দিন দশেক পর প্রহরকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিল। শুক্রবারের বিকেল তখন। ইরতাজ উদ্দিন তাকে নিজের বাসায় নেওয়ার কথা বললেন। অনুভব একবাক্যে রাজি হয়ে গেল। প্রথম বারের মতো কোনো প্রকার দ্বৈত মতের সৃষ্টি করলো না। প্রহরের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। একসময় তাকে একা পেয়ে জানতে চাইলো। সে ওখানে যাওয়ার পর অনুভব যাবে কি না তা জিগ্যেস করলো বার বার। অনুভব মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। প্রহর তবুও বিশ্বাস করতে চাইলো না। শেষমেশ অনুভবকে শপথ করতে হলো যে সে সত্যি যাবে। শপথ করুক বা না করুক। এটা চিরসত্যি যে প্রহরকে ছাড়া সে একটা মিনিটও দূরে থাকতে চায় না।
প্রহরের প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস কিনে সন্ধ্যার পর অনুভব বড় এক বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। আজ দিয়ে চতুর্থ বারের মতো আসা। এর আগে কখনো আধ ঘন্টার বেশি থাকা হয়নি। কিন্তু এবারে থাকতে হবে। গেটের উপরের দিকে তাকালো সে। সবুজ রঙের অসংখ্য ছোট ছোট বাল্ব জ্বলছে। তার ভেতরে লেখা, ‘কুঞ্জবিথী’। নামটা প্রহরের দেওয়া। অনুভব জানে সেটা। প্রহরের পাঠানো চিঠিতে একবার সে উল্লেখ করেছিল।
প্রহরের জন্য এরকম একটা বাড়ি বানানোর ইচ্ছে ছিল তার। ঠিক এরকম না! এতবড়ও না। ছাদওয়ালা দুই রুমের ছোট্ট এক বাড়ি। ছাদের উপর থাকবে চিলেকোঠার ঘর। সেই ঘরে থাকবে বইয়ের সমাহার। অনুভবের বই পড়ার অভ্যাস নেই। কিন্তু প্রহর বই পড়তে পছন্দ করে। প্রহর বই হাতে নিয়ে এলোচুলে পড়তে থাকবে। সেই বইপড়ুয়া প্রহরকে দেখে সে দু চারটে সন্ধ্যা কাটিয়ে দিবে। পড়ার ঘরটা অবশ্যই অনেক সুন্দর থাকবে। একপাশে কাচের দেয়াল থাকবে। ঘর অন্ধকার করলে সেই কাচ দিয়ে রাতের আকাশের তারা দেখা যাবে। উপরে ছাউনি থাকবে টিনের। বৃষ্টির রাতটা মাঝে মাঝে চিলেকোঠায় কাটিয়ে দিবে। ছাদের বাকি অংশ জুড়ে থাকবে বুনোফুল আর চারাগাছ। সাদা গোলাপ প্রহরের ভীষণ পছন্দের। একপাশ জুড়ে শুধু সাদা গোলাপ……..
পকেটে রাখা ফোন বাজছে৷ অনুভবের চিন্তার ঘুড়িতে টান পড়লো। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো প্রহরের কল। মেয়েটা নিশ্চয়ই ছটফট করছে। সে আসবে কি না তা নিয়ে ভয়ে আছে হয়তো। অনুভব আর দেরি করলো না। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলো।
(চলবে)