#জীবনের জলছবি
#পর্ব ৩০
বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর থেকেই চুপ করে বসে ছিলো টুসি, মনের মধ্যে উথাল পাথাল চলছে। বাবা মা কি কোনো দিনও বুঝবে না ওকে! ওর ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনো দাম নেই! ইচ্ছে করছে ওরা আসার আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে, মা যে সব জেনেও ওকে ইচ্ছা করেই কিছু বলেনি সেটা ও বুঝতেই পারছে এখন। তাই সেদিন ঘর গোছানো নিয়ে অতো রাগারাগি করলো! ইস! ও যদি বুঝতে পারতো তখন! আজই তো বিরাট সুযোগ ছিলো ওর কাছে, সব রাগ অভিমান ভুলে ও তপু দা কে বলে দিতো ওর মনের কথা! কথা গুলো বলে দিলে তপু দাও আর রাগ করে থাকতে পারতো না তখন।
সন্ধ্যে সাত টা নাগাদ ভদ্রমহিলা, তাঁর স্বামী আর ছেলেকে নিয়ে এলেন, ভদ্রলোক বাবার ক্লাবের মেম্বার, পূর্ব পরিচিত, তাই সব কিছু যে অনেকটাই এগিয়ে গেছে, অন্য ঘর থেকে কথোপকথন শুনেই বুঝতে পারছিলো টুসি। খুব অসহায় লাগছিলো ওর, কি করা উচিৎ আর কি উচিত নয়, সবটাই গুলিয়ে ফেলছিল ও।
ও জানতোই বাবার কথাগুলো শুধুই কথা নয়, এই হুমকি যে শুধু মুখে তাই নয়, বাবা ইচ্ছা করলে কাজে করেও দেখাতে পারে। ওর তপু দার জন্য মন খারাপ হচ্ছিলো খুব, কিন্তু তপু দা তো আর ওকে কিছু বলেই না নতুন করে, একবারও কথা না বলে ওই বা কি করে বলবে বাবাকে কিছু।
ও যদি একবারও জানতো এইরকম কিছু হতে পারে এত তাড়াতাড়ি, তাহলে তপু দা কে একবার বলতো, কিন্তু ও ভেবেছিলো ওর হাতে এখনও সময় আছে, তপু দার বলার জন্য অপেক্ষা করছিল এত দিন। যদিও ও জানেই কি বলতে চায় তপু দা, বাবার হসপিটালে থাকাকালীন তপু দাদের বাড়িতে বা দার্জিলিং বেড়াতে গিয়ে তপু দার মনোভাব ও খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছে, তাও একবার সরাসরি কথা না বলে কিছু ডিসিশন নিতে এই মুহূর্তে পারবে না ও।
এই উটকো বিপদ টা কে কি করে এড়াবে এখন, আপাতত এটাই মাথায় ঘুরছিল টুসির। খুব বলে দিতে ইচ্ছা করছিলো ওর বাবা কে, কিন্তু সেটা বললেই তার পরে যা হতে পারে সেগুলো ভেবেই পিছিয়ে এলো শেষ পর্যন্ত।
তপু দার সঙ্গে কালকেই কথা বলতে হবে, ওর হাতে যে খুব বেশি সময় নেই সেটা স্পষ্টই বুঝতে পারছিল টুসি। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে তপু দার সঙ্গে যা গন্ডগোল চলছে! আপাতত ওর শিওরে সমন, এই ছেলেটার সঙ্গে কি ভাবে কথা বলবে ঠিক করে উঠতে পারছে না কোনো মতেই। খারাপ ব্যবহার করা যাবেনা, তাহলে বাবা মা অপমানিত হবেন, আবার ভালো ব্যবহার করলে সেটা কে ওর ভালো লাগা ভেবে নিতে পারে, কি করবে ভাবতে ভাবতেই ওর ভেতরে ডাক পড়লো।
সবচেয়ে বিরক্তিকর লাগছিলো শাড়ি টা, একটুও শাড়ি পড়ার ইচ্ছে ছিলনা ওর, কিন্তু মা আজ সম্পূর্ন অন্য রকম মুডে আছে, যেই ও বলতে গেলো ওমনি বাবাকে ডেকে বললো,
দেখো তোমার মেয়ের সঙ্গে কথা বলো, ও শাড়ি পরতে চাইছে না।
বাবাও যেনো আজ শুধু টুসি কে জব্দ করবেন বলেই বসে আছেন, ঘরে ঢুকেই বললেন
খুব মডার্ন হয়েছ দেখছি, বাঙালি মেয়ে শাড়ি পড়তে অসুবিধা হচ্ছে, এটা ভাবতেও অবাক লাগছে।
অগত্যা মা যা বললো সবটাই আর কোনো তর্ক না করে করলো ও, বুঝতেই পারছিলো আজ এই বাড়িতে ওকে বোঝার মত কেও নেই।
ঘরে ঢুকে ছেলেটির মা বাবা কে প্রণাম করলো টুসি। বাবা পিঠে হাত দিয়ে বললেন
আয় বোস,
ওর বাবার ওপর রাগ হচ্ছিলো খুব, এমন ভঙ্গি করছে বাবা, যেনো আজ সারাদিনে কিছুই হয়নি বাড়িতে, ও কোনো কথা না বলে চুপ করে বাবার সামনের চেয়ারে গিয়ে বসে পড়লো।
ভদ্রমহিলা ওকে দেখেই বললেন
সেদিন তো আমার ছেলে তোমাকে ওখানে দেখেই আমাকে বললো তুমি যখন আমার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখছো, তখন এই মেয়েটিকে দেখতে পারো,
মনে মনে ছেলেটা কে গালাগালি দিয়ে দাঁতে দাঁত পিষলো টুসি। কেনো যে ও গেলো ওখানে, নিজের ওপরই রাগ হচ্ছিলো এবার।
সবাই কত হই চই করছিলো, অথচ আপনার মেয়ে কি সুন্দর এক জায়গায় বসে ছিল, কি শান্ত, ভদ্র, বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন মহিলা।
নিকুচি করেছে শান্ত, ভদ্রের, আগে যদি জানত ওর ঐ বিরক্ত হয়ে বসে থাকাই কাল হবে, তাহলে না হয় শাড়ি গয়নার গল্পই শুনত ও।
এই যে আমার ছেলে, কথা বলো তোমরা, বলেই ছেলের দিকে ইশারা করলেন ভদ্রমহিলা।
ছেলেটা হাত জোড় করলো টুসির দিকে তাকিয়ে, অগত্যা টুসিকেও করতে হলো। যখনই কোনো বন্ধুদের দিদিদের দেখতে আসার গল্প শুনেছে তখনি মনে মনে ভেবেছে, ওকে বোধহয় সারা জীবনে কোনো ছেলের সামনে বসতে হবেনা ইন্টারভিউ দিতে, আজ সেটাও হলো।
তপু দার মুখটা ভেসে উঠছিল চোখের সামনে, আর এই মুহূর্তে কোনো মিরাকলের আশা করছিলো ও। কিন্তু কোনো কিছুই হলনা,
আমি একটু আলাদা কথা বলতে চাই, ছেলেটার গলা শুনে চমকে উঠে তাকালো ও।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, যা ওকে ছাদে নিয়ে যা,
মা বলে উঠলো পাশ থেকে, অগত্যা ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে ছাদে উঠে এলো টুসি।
সেদিন তোমাকে ওখানে দেখে খুব ভালো লেগেছিলো আমার, তাই মা কে বলেছিলাম,
টুসির দিকে তাকিয়ে বললো ছেলেটা।
তোমার নাম আমি জানি, আমার নাম অঞ্জন, তুমি জানতে কি?
মাথা নাড়লো ও, মনে মনে বললো জানার কোনো ইচ্ছেই নেই আমার, এখান থেকে চলে যেতে পারলে বাঁচি এখন। একবার মনে হলো ছেলেটা কে বলে দিই সব কথা কিন্তু বাবার মুখটা মনে পড়ায় আর কিছু না বলে চুপ করে থাকলো শেষ পর্যন্ত।
ছেলেটা বেশ মিশুকে, নীচে বসে বুঝতে পারেনি কিন্তু এখন ওপরে এসে কথা বলে খারাপ লাগছিলো না খুব একটা। যদি না বিয়ের ব্যাপার থাকতো এর মধ্যে তাহলে ছেলেটার সঙ্গে গল্প করাই যেতো বেশ মনে মনে ভাবছিলো টুসি।
শুনলাম তুমি গ্র্যাজুয়েশন করতে চাও, সেতো ভালোই, এক্ষুনি বিয়ের তো কোনো তাড়া নেই আমাদের ও, আর যদি বিয়ে হয়েও যায় তাহলেও পড়াশুনা চালাতে কোনো অসুবিধা হবেনা আমি এটুকু কথা দিতেই পারি তোমাকে,
নিজেই বলে যাচ্ছিলো ছেলেটা।
ও যেনো ধরেই নিয়েছে বিয়েটা হচ্ছেই, আর টুসির যে কিছু মতামত আছে সেটা জানার কোনো চেষ্টাও করছে না বুঝতেই পারছিলো টুসি।
একবার মরিয়া চেষ্টা করলো টুসি,
বিয়ের পরে আর কিছু হয়না, আমি গ্র্যাজুয়েশন শেষ না করে বিয়ের কথা ভাবতে চাইছিলাম না,
ছেলেটা কে বলেই ফেললো শেষ পর্যন্ত, ছেলেটা একটু চুপ করে থেকে বললো
সে ক্ষেত্রে আরেক টা অপশন আছে আমার কাছে,
কি সেটা?
খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো টুসি, কোথাও যেনো এক টুকরো আশা র আলো দেখতে পাচ্ছিলো ও।
রেজিস্ট্রি টা করে রাখতে পারি আপাতত, পরে তোমার পড়াশোনা শেষ হলে না হয় বাকি টা হবে,
টুসির সব আশা জলাঞ্জলি দিয়ে বললো অঞ্জন। আর কিছুই করার নেই বুঝে শেষ পর্যন্ত সবটা বলে ফেলার ডিসিশন নিয়ে নিলো ও।
বাবা কথা দিলেও আমি এই বিয়েটা করতে পারবো না, আমি অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাই, কিন্তু বাবা এটা জানেন না, আপনিও কিছু বলবেন না প্লীজ, আপনি কোনো অজুহাতে এই বিয়ে টা ক্যান্সেল করে দিন।
অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা অঞ্জনকে ছাদে রেখেই সিঁড়ি তে পা দিলো টুসি। অঞ্জন ওর পেছন পেছন নেমে এসে ঘরে ঢুকলো, টুসির বুকের ভেতর টা ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো কেমন যেন। ভগবান, ছেলেটা যেনো কিছু বলে না দেয়! মনে মনে বলতে থাকলো ও, এই মুহূর্তে সবার দৃষ্টি ওদের দুজনের ওপরেই, ওকে শুকনো মুখে বসে থাকতে দেখে মা একটু অবাক মুখে তাকালো।
কথা হলো তোদের?
মায়ের কথার উত্তরে শুধু ঘাড় টা একটু নাড়লো অঞ্জন, টুসি নিজেকে শক্ত করে বসে ছিলো। মা রান্না ঘরে যেতে যেতে টুসি কে ডাকলো
একটু এদিকে আয়, প্লেট গুলো নিয়ে যা,
প্লেটগুলো যে আসল উদ্যেশ্য নয় সেটা টুসি জানে, মা আসলে অঞ্জনের গম্ভীর মুখটা লক্ষ্য করেছে, তাই আর ধৈর্য্য রাখতে পারছে না!
কি কথা হলো? ছেলেটা ওই রকম গম্ভীর হয়ে গেছে কেনো? কিছু বলেছিস তুই?
না মা, আমি কিছু বলিনি,
একদম অম্লান বদনে মিথ্যে বলে দিলো টুসি, যা হবে পরে দেখা যাবে!
ক্রমশ