#ধারাবাহিকগল্প
#লড়াই
পর্ব-দুই
মাহবুবা বিথী
সায়মার মা শেফালী বেগম শাশুড়ী আর সায়মাকে নিয়ে কাঁঠাল বাগানে একটা বস্তিতে ঘর ভাড়া নেয়। সায়মার বয়স তখন পাঁচ বছর। ওর দাদীর চোখে ছানি পড়ার কারনে ভালো মতো দেখতে পেতো না। তাই প্রতিদিন সকালে ভিক্ষা করতে যাওয়ার সময় সায়মা ওর দাদীর সাথে যেতো। ওর মা সকাল বেলা বাসা বাড়িতে কাজে চলে যায়। এইভাবে কোনরকমে ওদের জীবনের সময় পার হতে লাগলো।
সেদিন ওর দাদী ভিক্ষা করতে যাওয়ার সময় প্রতিদিনের মতো সায়মাকে সাথে নিয়ে যায়। দুপুরের দিকে চৈত্র মাসের গরমে ওর দাদীর খুব পানির পিপাসা লাগে। ওরা তখন একটা চা এর দোকান থেকে পানি চেয়ে খায়। দুপুরের সময় দোকানের চারপাশ খুব নিরিবিলি থাকে। দোকানদার এই সুযোগে সায়মাকে বিস্কুট দেওয়ার লোভ দেখিয়ে দোকানের ভিতরে ডেকে নেয়। তারপর ওকে জাপটে ধরে গালে কামড় বসিয়ে দেয়। ও দোকানদারের চোখে হাতের আঙ্গুল দিয়ে আঘাত করে বের হয়ে আসে। এরপর দাদীকে নিয়ে তাড়াতাড়ি ওখান থেকে চলে যায়। দাদী ওরে বলে,
—-বুবু তোক মুই ডাক দিনু। তুই কতা কলুনা ক্যান?
—-দাদী মানুষ কি কুত্তার মতো কামড়ায়?
—-বুবু তুই এ কতা কলু ক্যান?
—-তুই যে দোকানটাত পানি খালু ঐ দোকানদার মোর গালত ক্যানবা কামড়াইল।
সায়মার দাদী আঁতকে উঠে বললো
—-বুবু এই কতা তোর মাক কইস না। মন খারাপ করিবে এলা। আসলে বইন মানুষও জানোয়ার হয়। তা নইলে ঐ হানাদার হামাক পাখির মতো গুলি করি মারিল। মোর চোখের সামনত তোর দাদার বুকত গুলি করিল। তোর বাপ যুদ্ধ করিবার যেয়া শহীদ হইল। মোর সোনার সংসারটা ধ্বংস হয়া গেইল। আইজ তোর মাক মাইনষের বাড়ি কাজ করা নাগে। আর মুই ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ঘুরি বেড়াও। ঐ হানাদারগুলা কত মাইয়ার ইজ্জত লুট করছে। এখনও দেশটায় শিয়াল কুকুর ঘুইরা বেড়ায়। তাই তোর মতন একটা বাচ্চা মানুষও ওদের হাত থেকে রেহাই পায় না।
সেদিন সায়মা ওর দাদীর কথার কোনো অর্থ বুঝে নাই। কিন্তু জীবন ওকে আস্তে আস্তে সব বুঝিয়ে দিয়েছে। সায়মা হঠাৎ ওর দাদীকে বললো,
—-দাদী মুই নেকা পড়া শিকিম।
দাদীও নাতনীকে বললো,
—-কাইল থাকি তোক মোর সাথত আনিম না। তুই সক্কালবেলা মোক বড় রাস্তার ফুটপাতে বসে দিয়া আসবু। সইন্ধাবেলা আবার মোক নিয়া আসবু। তোর মাক কইম তোক যেন স্কুলত ভর্তি করি দেয়।
রাতে শোয়ার সময় সায়মার দাদী সায়মার মাকে বলে,
—-সায়মা নেকাপড়া শিখিবার চায়। বৌ অক তুই স্কুলত ভর্তি করি দে। দেখবু নেকাপড়া শিকি সায়মা তোক কামাই করি খাওয়াবে। তোর আর কোনো দুঃখু থাকিবে না।
—-আম্মা মুই এতো টাকা কোনটে পাইম। অক ছাড়া তোমরা আবার কেমন করি ভিক্ষা করিবেন। তোমরাতো আবার চোখত দেখিবার পান না।
—সক্কালবেলা মোক বড় রাস্তার ফুটপাতে সায়মা বসে দিয়া আসিল। আবার সইন্ধাবেলা নিয়া আসিল। অক মোর সাথত থাকিবার দরকার নাই।
পরদিন সকালবেলা সায়মা ওর দাদীকে বড় রাস্তার ধারে ফুটপাতে পৌঁছে দিয়ে মায়ের সাথে কাজে গেলো। ওর মা এক প্রফেসরের বাসায় কাজ করে। স্বামী স্ত্রী দুজনেই কলেজের শিক্ষক। ওরা নিঃসন্তান দম্পতি। সায়মাকে দেখে বেগম সাহেব ওর মাকে বললো,
—শেফালী তোমার মেয়েটা দেখতে বেশ ফুটফুটে। ওকে স্কুলে ভর্তি করে দাও। লেখাপড়া শিখলে ও তোমাকে রোজগার করে খাওয়াবে। তখন আর লোকের বাড়িতে কাজ করতে হবে না।
—-সব তো বুঝি আপা। নেকাপড়া শিকিবার গেইলে অনেক ট্যাকা লাগে। মুই কোনটে এতো ট্যাকা পাও।
প্রফেসর আছিয়া খাতুন বললেন,
—-আজ থেকে ওর লেখাপড়ার দায়িত্ব আমার। সায়মাকে কাছে ডেকে আছিয়া খাতুন আদর করে দিলেন।
শেফালী বেগমের দুচোখ দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। চোখের পানি আড়াল করতে ওনাদের সামনে থেকে শেফালী বেগম কিচেনে চলে গেলো। আর অন্তরের অন্তস্থল থেকে আল্লাহপাকের কাছে ওনাদের মঙ্গলের জন্য দোয়া করলো।
সায়মার স্বামী প্রফেসর রাজ্জাক স্ত্রীর কথায় খুশী হয়ে বললো,
—-খুব ভালো একটা কাজ করলে তুমি। আখেরে তোমাকে আল্লাহপাক অনেক নেকী দান করবেন।
সায়মার দাদীও এখবর শুনে খুব খুশী হলো। আসলে লেখাপড়া ছাড়া বেঁচে থাকার জন্য সায়মার জীবনে আর কোন অপশন খোলা নেই সেদিন ওই অশীতিপর বৃদ্ধাও উপলব্ধি করেছিলেন। যদিও সায়মার জীবনের পরিপূর্ণ সাফল্য হয়ত দেখে যেতে পারেননি কিন্তু শুরুটা দেখেছিলেন।
সায়মার এসএসসি পরীক্ষার সময় ওর দাদী বেঁচে ছিলেন না। সায়মা চারটা লেটার সহ স্টার মার্ক পেয়ে এসএসসি পাশ করেছিলো। প্রফেসর আছিয়া খাতুন খুব খুশী হয়ে ছিলেন। এর কিছুদিন পর বাসায় সায়মা একা ছিলো। ওর মা বাসাবাড়ির কাজে গেছে। বস্তির মালিক ভাড়া তুলতে বস্তিতে এসেছিলো। সায়মা দরজা ভেজিয়ে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলো। মালিক আক্কাসমিয়া দরজার ফাঁক দিয়ে অষ্টাদশী সায়মাকে দেখে নিজের লোলুপ দৃষ্টি সংবরণ করতে পারলো না। আস্তে করে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে সায়মাকে শক্ত করে মুখে হাত দিয়ে ধরে রাখলো। ও যেন চিৎকার করতে না পারে। হিংস্র শ্বাপদের মতো ওর কামনা চরিতার্থ করতে উদ্ধত হলো। সায়মা হাত পা নাড়া চাড়া করতে গিয়ে হঠাৎ হাতের কাছে রুটি বানানো বেলনিটার নাগাল পায়। বেলনি খুব সাবধানে ধরে জানোয়ারটার মাথায় জোরে বাড়ি দেয়। শয়তানটা ব্যথা পেয়ে সায়মাকে ছেড়ে দেয়। সায়মা ঘর থেকে বের হয়ে একদৌড়ে প্রফেসরের বাসায় পৌঁছে যায়। ওকে আলুথালু বেশে দেখে ওর মা আঁতকে উঠে জিজ্ঞাসা করলো,
—-তোর এ অবস্থা কেমন করে হলো মা?
মেয়েকে জড়িয়ে ধরে শেফালী বেগম পাগলের মতো বিলাপ করতে লাগলো।
মা মেয়ের এই অবস্থা দেখে সায়মার কাছে সব বৃত্তান্ত শুনে প্রফেসর আছিয়া খাতুন উনাদেরকে বললেন,
—-শেফালী তুমি সায়মাকে নিয়ে বস্তিতে আর যেও না। ঐ বস্তির মালিক তোমাদের ছেড়ে দিবে না। হয়ত প্রতিশোধ নিতে পারে। তাই আজ থেকে আমার বাসাতেই থেকে যাও। আল্লাহর অশেষ রহমতে মেয়েটা অনেক বড় বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছে। তোমার স্যার মারা যাওয়ার পর আমি তো বাসায় এখন একাই থাকি। তোমরা দুইজন থাকলে আমার ভাল লাগবে। সেই থেকে সায়মা আর ওর মা কাঁঠাল বাগানে এই প্রফেসরের বাসায় থেকে গেলাে। সায়মা ঢাকা ভার্সিটি থেকে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স সহ মাস্টার্স হালিমা খাতুন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে প্রভাষক হিসাবে জয়েন করে। এই কলেজে আছিয়া খাতুন আর ওর স্বামীও চাকরি করতো। ভাগ্য ভাল ছিলো বিধায় সদ্য ভালো রেজাল্ট সহ পাশ করা সায়মার সহজে চাকরি হয়ে গেলো। সেদিন খুশীতে আছিয়া বেগম আর ওর মা শেফালী বেগমের চোখের পাতা নোনা জলে ভিজে গেলো। সায়মার ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখলো আছিয়া খাতুন ফোন দিয়েছে। সায়মা ওর মা আর আছিয়া খাতুনকে নিয়ে সব সময় টেনশনে থাকে। দুজনের শরীর প্রায় অসুস্থ থাকে।
চলবে