একটুখানি_সুখ #আনিশা_সাবিহা পর্ব ১৯

0
527

#একটুখানি_সুখ
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৯

অন্ধকার ঘর। আশপাশটাতে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ও ভয়াবহতা বিরাজ করছে। ল্যাম্পশিট শুধু জ্বলছে আর নিভছে। ঘরে থাকা বড় লাইটটাও এমনভাবে ভেঙে ফেলা হয়েছে যেন সেটা আর কোনোদিন জ্বলতেই পারে। ল্যাম্পশিটের আলোর সুইচে বারংবার কেউ জ্বালিয়ে দিচ্ছে আবার নিভিয়ে দিচ্ছে। বড় ঘরের আধুনিক সব জিনিসপত্রের একটি জিনিসও ঠিক নেই। কোনোটা ভেঙে ফেলা আবার কোনোটা অগোছালো। ল্যাম্পশিটের পাশে বসে আছে এক যুবক। হাতের পিঠ থেকে টপটপ করে রক্ত পড়ে যাচ্ছে তার সেদিকে কোনো হুঁশই নেই। যুবকটির মুখ থেকে গুনগুনিয়ে গানের আওয়াজ আসছে।
“O lekhdi tera nam
jindari zaaniye
Bas rehna
tere naal ve zuriye
rehna tu…”

পুরোটা বলতে বলতে কন্ঠে হিংস্রতা চলে আসে সেই যুবকের মাঝে। কাঁপতে থাকে সে। রক্তাক্ত হাত দ্বারা আঘাত করে ল্যাম্পশিট ছুঁড়ে ফেলে দিতেই ঘরটা আরো অন্ধকারে পরিণত হয়। ওপরে শুধু জ্বলছে লাগিয়ে রাখা লাল রঙের সফট লাইট। দরজা খোলার আওয়াজ পেতেই রক্তচক্ষু নিয়ে তাকায় সে। হুংকার ছেড়ে বলে ওঠে,
“মরতে না চাইলে কেউ ঘরে আসবি না।”

সেখানেই দরজা থেমে যায়। বাহিরে থরথর করে কাঁপতে থাকে ডক্টর আর নার্স। ভেতরে ঢোকা মানে মৃত্যুকে আহ্বান করা। যেটা তারা করতে চায় না।
ঘরের ভেতরে থাকা যুবকটি বেশ মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করে তার হাত থেকে রক্ত পড়ছে টপটপ করে। তারপর অদ্ভুত হাসি দিয়ে আয়নার ভাঙা কাঁচের টুকরা হাতে নেয় সে। সেখানে রক্ত দিয়ে একটা একটা করে অক্ষর লিখতে থাকে। তৎক্ষনাৎ খুলে যায় বাহিরে থেকে দরজা। অতিরিক্ত আলো পেয়ে বড্ড রেগে যায় যুবকটি। আশেপাশে কিছু খুঁজতে থাকে সেদিকে ছুঁড়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু পায় না। সব ভেঙে একাকার করে ফেলেছে সে। বেশ রেগেমেগে তাকায় সে। একটা কড়া কন্ঠ ভেসে আসে কানে।
“এসব কি করছিস সৌমিত্র?”

দরজা দিয়ে তড়িৎ গতিতে ভেতরে ঢুকে আসে আরেকজন যুবক। গায়ে চকলেট কালার শার্ট তার। সেই চেনা ধূসর বর্ণের চোখের মনিতে ভীতিকর ছাপ। যেই ভীতিটা কেটে গিয়ে ধীরে ধীরে রাগের ছাপ স্পষ্ট দেখা গেল। রাগ দমাতে না পেরে এগিয়ে এসে হালকা নিচু হয়ে এক কষিয়ে এক থাপ্পড় মেরে বসে সৌমিত্র নামক যুবকটিকে। সৌমিত্র ছিটকে গিয়ে পড়ে টি টেবিলের কাছাকাছি। ধূসর বর্ণের চোখজোড়ার মালিক এগিয়ে এসে সৌমিত্রের টিশার্টের কলার ধরে টেনে তুলে তাকে ঝাঁকিয়ে বলে,
“পাগল তুই পাগল। অসুস্থ মস্তিষ্কের ছেলে তুই। তোকে বলেছিলাম ঘরে এসব জিনিসপত্র রাখতে দেব না। একপ্রকার জেদ করে রাখিয়েছিস। এখন ভাঙচোর করে নিজের এই অবস্থা করে খুব শান্তি পাচ্ছিস?”

বলে আবারও একটা থাপ্পড় পড়ল সৌমিত্রের গালে। ফর্সা গালটাতে পাঁচ আঙ্গুলের দাগ পড়ে গেল সহজেই। আরো মারতে চাইলো সৌমিত্রকে আঘাত করা ব্যক্তিটি। কিন্তু তড়িঘড়ি করে দরজা পেরিয়ে ঘরে ঢুকে এসে একজন মহিলা তার হাত চেপে ধরে বলে,
“তুইও পাগল হয়ে গেছিস স্বচ্ছ? নিজের ছোট ভাইয়ের গায়ে হাত তুলছিস? এই নিয়ে দুইবার ওর গায়ে হাত তুললি তুই।”

সৌমিত্রকে আলতো ধাক্কা ছেড়ে দেয় স্বচ্ছ। বড় শ্বাস নিয়ে সে নিজেকে শান্ত করে। পাশেই তার মা মিসেস. রেবা বেশ অস্থির ভঙ্গিতে সৌমিত্রের কাছে গিয়ে তার গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
“খুব লেগেছে বাবা?”

“মম, তোমার বড় ছেলে আজকাল তার ছোট ভাইয়ের গায়ে হাত তুলতে শিখেছে। কার জন্য? আমি জানি সেটা। কারণটা মোহ তাই না ভাইয়া?”

স্বচ্ছ রেগে তাকায়। কিছু বলতে গিয়েও বলেনা সে। মিসেস. রেবা স্বচ্ছের দিকে দৃষ্টিপাত করে কাঠকাঠ গলায় বলে,
“ঠিকই তো স্বচ্ছ। কেন মারছিস ওকে? তুই তো জানিস তোর ভাইকে। ও কেমন তোর জানা।”

“জানা তাতে কি মা? তোমার ছোট ছেলে নিজের লিমিট ক্রস করে ফেলছে। আর শুধু আমি ওকে মেরেছি না নয়। সেও আমাকে মেরেছে। এমন মার আমি মারিনি ওকে সেটা ওর ভাগ্য।”

“কারণ তু…তুমি মোহকে চাও। নাহলে মোহের ঘরে ওতো রাতে সেদিন কি করতে গিয়েছিলে? তুমি খবর পেয়েছিলে আমি বেরিয়ে গেছি এই চারদেয়াল থেকে। তুমি সবার আগে মোহের কাছে ছুটে গিয়েছিলে। একটা কথা শুনে রাখো ভাইয়া আমি ওকে অনেক অনেক পছন্দ করে ফেলেছি। আর এসব আসবাবপত্র তো ওর জন্যই। বিয়ের পর আমার ঘরে আসবে। মেয়েদের এসব না হলে তো চলে না।”

স্বচ্ছ কিছুক্ষণ চুপ থেকে সৌমিত্রের প্রতিত্তোরে বলে,
“নিজেকে আমার কাছে চেনাতে আসিস না ভাই। তোকে আমি রগে রগে চিনি। যখন তোর পছন্দ ফুরিয়ে যাবে তার সঙ্গে তুই ঠিক কি কি করতে পারিস সেটা আমি জানি।”

“তো? সেটা তো ওর দোষ যে আমার ওর ওপর থেকে নিজের পছন্দ উঠে গেছে। আমার তো দোষ না। আমার দোষ কোথায় এখানে?”

স্বচ্ছ হতাশায় বড় নিশ্বাস ফেলে। এটাই হচ্ছে সৌমিত্রের সমস্যা। নিজের ভুল কখনো দেখে না সে। সে জানে সে কখনো ভুল করতে পারে না। যা করে সেটা ঠিক আর বাকি সকলের প্রাপ্য। ফ্লাশ লাইট অন করে ফ্লোরে তাকায় সে। সব জিনিস ভেঙেচুরে নিচে পড়ে আছে। তার দৃষ্টি আঁটকায় একটা কাঁচের টুকরাতে। সেখানে রক্ত দিয়ে লিখা ‘মোহ’ নামটি। হৃদয়ে ক্ষীণ যন্ত্রণা সৃষ্টি হয় তার। মনটাও অদ্ভুত। আজব আজব পাগলামিতে মাতে। এই মূহুর্তে স্বচ্ছের মনটা ভাবছে, ‘কেন থাকবে সৌমিত্রের ঘরে এই নাম? এই নামে যেন শুধু স্বচ্ছেরই অধিকার।’
এমন আজগুবি প্রশ্ন করে এই মন। স্বচ্ছ জানে সৌমিত্রের এই পাগলামি ক্ষণিকের। প্রতিবারই এমন করে সে। অতঃপর…! তার ঘোর কাটে সৌমিত্রের প্রশ্নে।

“মম শুনেছি ভাইয়ার সাথে মোহের বিয়ে হবে? মোহ রাজি হয়েছে? তাহলে কিন্তু আমি কিন্তু সবটা ধ্বংস করে দেব। তুমি কেন ভাইয়ার সঙ্গে ওর বিয়ে ঠিক করেছো বলো?”

“এটা নামেই তোর ভাইয়ার সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছি। কিন্তু মোহকে তোর কাছেই এনে দেব। এটা বিশ্বাস রাখ।”

“এর অন্যথা হলে ইউ উইল অলসো পানিশড মাই ডিয়ার মম।”
বলে একটা হিংস্র হাসি দেয় মৌমিত্র। মিসেস. রেবা ফ্যাকাশে মুখে ছেলেকে দেখে। স্বচ্ছের কপালের রগ দপদপ করছে। কিন্তু কেন? রাগে? তার মন হয়ত চাইছে না মোহকে অন্যকারো কাছে দিতে। কোনোদিন চাইবেও না। সে দেরি না করে বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা ডক্টরকে ইশারা করে ভেতরে আসতে বলে। ডক্টর গুটিগুটি পায়ে ভেতরে আসে। বাহিরে চলে আসে স্বচ্ছ। ভেতরে থাকলে কি করে ফেলত সেটা সে নিজেই জানে না। কি হবে এসবের পরিণাম?

রাত হয়েছে বেশ। খোলা জানালা দিয়ে শাঁ শাঁ করে বাতাস ভেতরে প্রবেশ করছে। বেডে উপুড় হয়ে শুয়ে কলম কামড়াচ্ছে মোহ। মাথায় তার খোঁপা। তবুও কিছু কিছু চুল বেরিয়ে আসাতে বেশ বিরক্তবোধ করছে সে। সামনে খাতা আর বই। পড়াশোনা করার মন নেই তার। তবুও জোর করে পড়ছে। একসময় সোজা হয়ে শুয়ে পড়ল সে। মুখটা চুপসে গেল তার। কারণ সেই আগন্তুকের দেওয়া চিঠিটা সে হারিয়ে ফেলেছে। আর পাচ্ছে না। পুলিশ অফিসারের কাছে জমা দেওয়ার কথা ছিল চিঠিটা। কিন্তু সেটা যেন কর্পূরের মতো উবে গিয়েছে। চিঠিটা কি চুরি হয়ে গেল? মোহ তন্নতন্ন করে পুরো ঘর খুঁজেও পায়নি চিঠিটা।

“আচ্ছা চিঠিটা কে নিতে পারে? আমার ঘরে কি কেউ এসেছিল? কে আসবে আমার ঘরে? কেউ না। যারা এসেছে তারা তো আমার বিশ্বস্ত। আর…”

বলেই থামল সে। চোখজোড়া সরু হয়ে এলো তার। হঠাৎ করে মাথা এলো স্বচ্ছের কথা। স্বচ্ছ তো এসেছিল। ও আসার পরেপরেই তো চিঠির কথা ভুলেই গিয়েছিল মোহ। সে ফট করে বলে ওঠে,
“তাহলে উনি?”
বলে থমকায় সে। কেন স্বচ্ছ হবে? স্বচ্ছ কেন তাকে এসব লিখবে। মাথায় আর কিছু আসছে না তার।

“আপু আসব?”
কন্ঠস্বর উল্টো হয়ে শুয়ে দরজার দিকে তাকায় মোহ। তৃণা কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিসেস. নিরাকে আজকেই ডিসচার্জ দেওয়া হয়েছিল হসপিটাল থেকে। তারপর থেকে তৃণা আর তিহান দুজনেই এই বাড়িতে আছে। আর কয়েকদিন থাকবেও তারা। তৃণাকে দেখে বালিশ নিয়ে উঠে বসে মোহ। আর একটা হাসি দিয়ে বলে,
“আরে তৃণা এসো!”

তৃণা ধীর পায়ে মোহের ঘরে প্রবেশ করে। আর ধীর গলায় বলে,
“পড়ছিলে? ডিস্টার্ব করলাম বুঝি?”

“উঁহু, না। আমার পড়া আর না পড়া সমান। পড়তে ইচ্ছে করছিল না। এতো রাত হয়েছে ঘুমাওনি?”

“মায়ের কাছে ছিলাম। ঘুম আসছিল না। ভাবলাম তুমি ঘুমিয়েছো কিনা দেখে আসি।”

“না। আমি আরো দেরিতে ঘুমাবো।”
তৃণা জোর করে হাসে। বেডের একপ্রান্তে বসে পড়ে সে। তারপর নিশ্চুপ হয়ে যায়। মোহ কিছুটা সন্দেহের সাথে তাকায় তৃণার দিকে। প্রশ্নাত্মক কন্ঠে বলে,
“কি হয়েছে? কিছু বলবে মনে হচ্ছে?”

তৃণা থতমত খায়। অতঃপর নিজেকে ধাতস্ত করে বলে,
“না তেমন কিছু না। শুনলাম তোমার আর স্বচ্ছ ভাইয়ার বিয়ে কথা।”

বেশ কিছুটা লজ্জা পায় মোহ। ও কি করে শুনল? সকালের কথা ভাবতেই বেশ অস্বস্তিতে পড়ে সে। কিসব আজেবাজে লিখেছিল স্বচ্ছ নামক লোকটাকে। লোকটা কি সবাইকে সব জানিয়ে দিল নাকি? কন্ঠে গম্ভীরতা টেনে বলে,
“কোথায় শুনলে?”

“মাকে তো মামা ফোন করেছিল। তোমার আর স্বচ্ছ ভাইয়ার বিয়ের কথা বলল। বলল যে মিথ্যে হক বদনাম যখন হয়েই গিয়েছে আর মামি তো তোমায় নাকি প্রস্তাব দিয়ে দিয়েছিল বিয়ের। তুমি হয়ত তখন রাজি হওনি। এখন চাপে পড়ে হলেও যখন রাজি হচ্ছো তখন নাকি বিয়েটা ফেলে রাখতে চাইছে না কেউ।”

শ্বাস আঁটকে যায় মোহের। শ্বাস ফেললেও যেন লজ্জায় মরে যাওয়ার সম্ভবনা আছে তার। তার মানে যাকে সে জীবনে কখনো নিজের প্রিয়মানুষের তালিকায় রাখেনি তাকে নিজের জীবনসঙ্গী বানাতে যাচ্ছে? কেমন হবে তার সঙ্গে পথচলা? ভাবতেই লজ্জায় কুঁকড়ে যায় মোহ। আবারও তার মাথায় আসে আয়মানের কথা। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে কালো মেঘ হানা দেয়। সেই কালো মেঘে আছে অসংখ্য মন খারাে। তৃণা কিছুটা ভার কন্ঠে বলল,
“কাল বোধহয় তোমার সঙ্গে ভাইয়ার বিয়ের ডেট ফাইনাল করতে আসবে।”

“আচ্ছা তৃণা আমার না ঘুম পাচ্ছে। একটু ঘুমোতে চাই। কাল সকালে তোমার সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে। হ্যাঁ?”

তৃণা যেন কিছু বলতে চাইলো। তবুও কেন যেন পারল না। তার গলাতেই কথা আঁটকে থাকল। কিছুটা অসহায় দৃষ্টিতে মোহের দিকে তাকালো সে। কিন্তু মোহ এখন নিজে কোথায় মুখ লুকাবে তার জায়গা খুঁজতে ব্যস্ত। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বেরিয়ে পড়ে তৃণা। তার ছোট মনে রাজ্যের কথা কাউকে বলতে পারছে না।

তৃণা চলে যেতেই বালিশ জড়িয়ে শুয়ে পড়ে মোহ। আসলে তার কেমন রিয়েক্ট করা উচিত বুঝছে না সে। স্বচ্ছকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত কি ঠিক নাকি ভুল? আর আয়মান? যাকে নিয়ে সে নিজের জীবন সাজাতে চেয়েছিল? আয়মান কি তার একটুও খোঁজ নিবেনা? একবারও জানতে চাইবে না আসল ঘটনা? সব মিলিয়ে লজ্জা আর বিষণ্ণ দুটো সংমিশ্রণ মনে নিদ্রায় তলিয়ে গেল মোহ।

চলবে….

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। রহস্য অনেকটা ক্লিয়ার করে দিয়েছি। এতো দ্রুত ক্লিয়ার করার কারণ আমার সামনে পরিক্ষা। গল্পটা দ্রুত শেষ করতে হবেই হবে। 😑 গল্পটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক এর বাস্তবে কোনো ভিত্তি নেই।]

লেখিকার গল্পের গ্রুপ : আনিশার গল্পআলয় (সাবির পাঠকমহল)🤍

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here