#কহিনুর_দ্বিতীয়_খণ্ড,পর্ব:৩৫
কলমে: ইয়াসমিন
সুউচ্চ বিল্ডিংয়ের ছাদে পা ঝুলিয়ে বসে আছে কহিনুর। দুদিন আগে ও জামসেদের সঙ্গে রাজধানীতে এসেছে। সঙ্গে সাঈদকে নিয়ে এসেছে। ছেলেটা বেশ কাজের। রাতের প্রথম প্রহর চলছে, আকাশে চাঁদ উঠছে।জামসেদ এখানে তেমন থাকবে না। এই ফ্লাটে ওর সাঈদ থাকবে। কহিনুরের মন খারাপ। বাবা মায়ের থেকে দূরে থাকতে ভালো না লাগলেও কিছু করার নেই। তাছাড়া কিছু পেতে হলে কিছু ছাড়তে হয়।কথাগুলো আনমনে ভাবছিলো কহিনুর।সাঈদ পাশে বসে আছে।কিছু একটা ভেবে হঠাৎ নেমে আসলো কহিনুর। সাঈদ ভ্রু কুচকে ওর পিছু নিলো। জামসেদ ল্যাপটপ নিয়ে বসে ছিল হঠাৎ কহিনুরকে আসতে দেখে ও মাথা তুলে বলল,
> কি ব্যাপার মন খারাপ?
কহিনুর বাঁকা হাসলো। মাথার ওড়নাটা খানিকটা তুলে নিয়ে বলল,
> দীর্ঘ রজনী উত্তাল ধরণী,গৃহে বন্দী এক রূপবতী রমনী। অমৃত গরল ডাকছে তাকে যেতে হবে দুয়ার ভেঙে।বাঁধা দেবে কে আর তাঁকে? কি বুঝলে চাচ্চু?
জামসেদ শব্দ করে হেসে ফেলল। ল্যাপটপ বন্ধ করে বলল,
> দারুন বাংলা রপ্ত করেছো। তোমার মা তো বাংলা ইংরেজি আর জার্মান ভাষার মিশ্রণে কথা বলে। গুরুচণ্ডালী দোষে দুষ্ট সে। তবুও তোমার উচ্চারণ বেশ দারুণ। এই জন্যই আমার মা একদম আলাদা। যাইহোক বাইরে কেনো যেতে চাইছো কিছু দরকার হলে বলো আনিয়ে নিবো।
জামসেদের চোখেমুখে খুশীর আবেশ। মেয়েটাকে নিজের কাছে আনতে পেরে ভীষণ খুশী। কহিনুর ওর পাশে বসতে বসতে বলল,
> চাচ্ছু আধারকে চিনো? পুরো নাম নির্জন খান আধার। বেচারা আমাকে হঠাৎ ভূলে গিয়ে বেশ সুখে আছে কিন্তু আমার যে সহ্য হচ্ছে না। ভাবছি যায় দেখা দিয়ে আসি।
কহিনুরের কথা শুনে জামসেদের মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে গেলো। দ্রুত কহিনুরের হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ছলছল চোখে বলল,
> ওর সঙ্গে দেখা না করলে হয়না? ওরা ভালো না। আমি ওকে আগে চিনতাম না। একদম বাজে ছেলে। একাধিক মেয়ের সঙ্গে মেলামেশা করে।
কহিনুর হাসলো। চাচুর মুখের দিকে তাঁকিয়ে বলল,
> ভয় থেকে পালিয়ে বেড়ালে ভয় আমাদের আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরবে। নিশ্বাস বন্ধ করে দিতে চাইবে। শত্রুরা আমাদের দিকে এগিয়ে আসার আগেই আমরা শত্রুদের দিকে এগিয়ে যাবো। ভয় নেই আমি আছি না? তোমাদের কহিনুর শত্রুর হৃদপিণ্ড ছি/নিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। ইউনিক কিনা।
জামসেদ জোরকরে হাসলো। কিছু একটা ভেবে বলল,
> পাথর কিন্তু ভালো ছিল। ওর সঙ্গে কাজটা কি উচিত হয়েছে? সুলতান পরিবারের মেয়েদের কিন্তু জীবনে শুধুমাত্র একবার বিয়ে হয় দুবার না। তাছাড়া উত্তম সঙ্গী ছাড়া জীবনে সুখ পাওয়া যায়না। ছেলেটা ভালো ছিল বিধায় আমি ওর সঙ্গে তোমার বিয়ের কথা ভেবেছিলাম। কৌশল অবলম্বন করেছিলাম। তুমি ওর পরিচয় জানো?
কহিনুর থমথমে মুখ করে বলল,
> বিশ্বাস রাখো আমার উপরে। যা করেছি এক বিন্দু ভুল করিনি। এখন যেতে হবে।
জামসেদ কহিনুরের মাথায় হাত রেখে বলল;
> সাবধানে থাকবে। বিপদ দেখলে পিছিয়ে আসবে। কোনো ঝামেলা করবে না। সাঈদকে সঙ্গে রাখবে। আর দেখো হুটহাট কারো হৃদপিণ্ড নিয়ে টানাটানি করো না। বয়স হচ্ছে এসব ভাবলেও ভয় করে।
জামসেদ শেষের কথাগুলো বেশ মজা করেই বলল। কহিনুর বুঝতে পেরে বলল,
> তোমাকে দেখলে কে বলবে এতবড় একটা মেয়ে আছে তোমার? যেকোনো রমনীর হৃদয়ে প্রথম দেখাতেই বসতি গড়ে তোলার মতো সুদর্শন তুমি।
কহিনুর কথাটা বলতে বলতে কক্ষে ঢুকে পড়লো। পছন্দের সাদা রঙের গাউনটাতে নিজের সজ্জিত করে বেরিয়ে আসলো। কোমর অবধি চুলগুলো খোপা করে ওড়না দিয়ে ঢেকে নিলো। আপাতত এটাই অনেক। কহিনুর মিররে নিজের দেখে নিয়ে বেরিয়ে আসলো।
*************
মিউজিকের তালে তালে উদ্দাম নেচে চলেছে তরুণ তরুণীদের এক অংশ। আশেপাশের কে কি করছে কারো দিকে নজর দেওয়ার সময় নেই। মনে হচ্ছে মিউজিক শেষ হলে জীবনের সব কিছু শেষ। কেউ তালে বা কে বেতালে কোমর দুলিয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে গ্লাস থেকে তরল অমিত শুধা গলাই ঢেলে নিয়ে তৃপ্তি মিটিয়ে নিচ্ছে। নাইট ক্লাবের সেরা সুন্দরী তফসিল মেরির বিশ তম জন্ম দিন উপলক্ষে ওর পক্ষ থেকে আজ সবাইকে ট্রিট দেওয়া হচ্ছে। এমনটা খুব কমই হয়ে থাকে। হৈচৈ আরও দ্বিগুণ করতে তফসিল হাত নাড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। মেয়েটার ফর্সা শরীরের সঙ্গে অর্ধ নগ্ন পোশাক ওকে বেশ আকর্ষণীয় করে তুললেও দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবক ঘৃণাই মুখ ঘুরিয়ে নিলো। তফসিল নিজের মতো ড্যান্স করতে করতে কেকের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। মুখে তৃপ্তির হাসি। কেট কাটা শেষে গ্লাস হাতে এগিয়ে আসলো যুবকটির সন্নিকটে। রক্তিম ঠোঁটদ্বয় নাড়িয়ে উচ্চারণ করলো,
> চলো ড্যান্স করি? তোমার বাহুদ্বয়ে আবদ্ধ হতে আমি উতলা প্রিয়। তোমার হৃদয়ের অতল গহীনে আমি ডুবে মরতে চাই প্লিজ ফিরিয়ে দিওনা।
মেয়েটার কথা শুনে ছেলেটা ছিটকে আসলো। দাঁতে দাঁত রেখে বলল,
> আমার থেকে দূরে থাকো। আমার হৃদয়ের দখলদারী অনেক আগেই হয়ে গেছে। সেখানে ডুবতে গেলে পুড় যাবে। ভস্মীভূত হয়ে বিলীন হয়ে যাবে পৃথিবী থেকে।
তফসিল গ্লাসে চুমুক দিয়ে হেসে ফেলল। কোনোরকমে ঢোক গিলে বলল,
> তোমার মতো যুবকের সঙ্গে একটা মূহুর্তে কাটাতে পারলেও শান্তি। আফসোস হবে না। দিবেনা তোমার উষ্ণতা? প্লিজ না করো না। সামান্য একটু খানি অবদান রাখতে পারবে না?
ও একদমে কথাগুলো বলে থামলো। তারপর পাশ ফিরে চমকে গেলো সেখানে কেউ নেই। ছেলেটা গেলো কোথায় খুঁজছে গিয়ে নিরাশ হলো। এই ছেলেটাকে বশ করতে না জানি আরও কতকিছু করতে হয়। দাদুর উপরে বিরক্ত হলো তফসিল। ঠিক সেই সময় আধারের উপরে ওর নজর পড়লো। দৌড়ে গিয়ে বলল,
> ভাইয়া তুমি এখানে?
আধার ওর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল,
> এদিকের কি খবর? সব ঠিকঠাক?
তফসিল মুখ ভার করে উত্তর দিলো,
> কিসের ঠিকঠাক? সামান্য দেখলো না পযর্ন্ত। এভাবে হয়নাকি? বিয়ে তো বহুদূর।
আধার কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
> লেগে থাক। আসছি আমি।
তফসিল মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে পড়লো। আধার গটগট করে হেঁটে গিয়ে নিজের জন্য নির্ধারিত কক্ষের সামনে গিয়ে উপস্থিত হলো। কিছুক্ষণ আগেই এক রমনিকে কক্ষে অপেক্ষা করতে বলে গিয়েছিল। আজকের রাতের কথা ভেবেই মনে দক্ষিণা বাতাস বইতে শুরু করলো। লক খুঁলে ভেতরে প্রবেশ করে ও থমকে গেলো। সুমিষ্টি ঘ্রাণে কক্ষ মৌ মৌ করছে। ক্যান্ডেল জালিয়ে রাখা হয়েছে রক্ত রাঙা গোলামের পাপড়ির উপরে। এইটুকু সময়ের মধ্যে এতো আয়োজনে সত্যি ও মুগ্ধ হয়ে গেলো। পালঙ্কের উপরে মেয়েটা চুপচাপ বসে আছে।যাকে দেখতে নতুন বউয়ের মতো লাগছে। আধার ধীরগতিতে মেয়েটা পাশে গিয়ে ওর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিতেই দরজা হাট করে খুঁলে গেলো। প্রচণ্ড বিরক্ততে ওর মুখটা কুচকে গেলো। কিন্তু পাশ ফিরতেই ও চমকে উঠলো। তারপর হন্তদন্ত হয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়লো। সামনে কহিনুর দাঁড়িয়ে আছে। কি শুভ্র আর লাবণ্যময় মুখশ্রী। আধার সামনে এগিয়ে গিয়ে চাপা কণ্ঠে বলল,
> তুমি এখানে?
কহিনুর হাসলো। চোখের পাপড়ি নাড়িয়ে বলল,
> দেখা করতে এলাম। উফফ আপনার রোমান্টিক মোমেন্টের বারোটা বেঁজে গেলো। সরি সরি এখন আসছি।
আধারের চোখেমুখে বিস্ময় খেঁলা করছে। কহিনুরের কথার ধরণ পরিবর্তন হয়েছে। আগের দিনের মতো কর্কশ নয়। তারমানে সুযোগ পাওয়া যাবে? তাছাড়া এতো সহজে ওকে পেয়ে যাবে ভাবতে পারেনি। আধার খানিকটা এগিয়ে গিয়ে বলল,
> কোথাও যাবে না তুমি। তুমি শুধুমাত্র আমার। আমি যেতে দিবো না। জোর করবো, দরকার হলে বেঁধে রাখবো।
কহিনুর শব্দ করে হেসে উঠে দরজার বাইরে পা রাখলো। আধার ওকে বাঁধা দিতে পিছু নিলো কিন্তু পেলোনা চোখের নিমিষে মেয়েটা হারিয়ে গেলো। অধারের শরীর জ্বলছে।রাগে ও চিৎকার করে চোখ বন্ধ করলো তারপর ভেতরে ঢুকে মেয়েটার হাত ধরে টানতে টানতে বাইরে বের করে দরজা বন্ধ করে দিলো। নিজের নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সব কিছু ভাঙার শুরু করলো। এই মেয়েটা ওকে পাগল করে দিবে। মনে যা আসলো তাই বলে কহিনুরকে বকতে থাকলো। দুদিন আগে এই মেয়েটা ওকে ছুরিকাঘাত করেছিল সেটা পযর্ন্ত দাদুকে জানাতে পারেনি। এভাবে কতদিন চলবে? না এবার ভয়ঙ্কর কি করতে হবে।
*******
খান প্রাসাদের গেটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে কহিনুর। সাঈদের চোখেমুখে বিস্ময় খেলা করছে। এই বাড়িতে মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ। খান সাহেব মোটেই সুবিধার না। সাঈদ খুব ভালো করে জানে এই বাড়ির প্রতেটা বালুকণাতে পাপের ছোঁয়া আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। কহিনুর এখানে ঢুকলে আর বের হতে পারবে না। কিভাবে মেয়েটাকে বোঝাবে আল্লাহ ভালো জানে। সাঈদ ফিসফিস করে বলল,
> এই রাতের বেলা চুপিচুপি কারো বাড়িতে প্রবেশ করা কি ঠিক হবে?
কহিনুর ভ্রু কুচকে বলল,
> আম্মিকে চাইলে চুপচাপ আমাকে অনুসরণ করবে। কথা বলবে না। আর শুনো এখনে তুমি অদৃশ্য থাকতে পারবে না। ধরা পড়লে সোজাসুজি উপরে। বুঝেছো?
সাঈদ ঢোক গিলল। ভয় করছে ভীষণ। কিন্তু আম্মির কথা ভেবে ও সাহস করলো। কহিনুরের পিছনে পিছনে চললো। বিশাল প্রসাদের সামনে নানারঙের ফুলের বাগান।এখানে সামনের দিকটা দেখতে যতটা সুন্দর পেছনের দিকটা ততটা নোংরা। প্রাসাদের পেছনে গহিন অরণ্য। সেই অরণ্যের ভূমিতে পড়ে থাকা প্রতিটা বৃক্ষ পল্লবের উপরে উষ্ণ রক্তিম তরলের ফোটা। নর ক/ঙ্কাল আর পাঁচে যাওয়ার শরী/রে অংশ ছিটিয়ে আছে। কহিনুর সেদিক দিয়ে ভেতরে আসতে পারেনি। পা ফেললেই যেনো যন্ত্রণায় কাতরানো মানুষের চিৎকার কানে বেঁজে উঠে। কহিনুর কিছুতেই পারেনি সেখানে নিজের পদ যুগল রাখতে। সামনে থেকেই এসেছে। এই বাড়িতে কোনো যাদু বিদ্যা কাজে আসেনা। শয়/তানের উপাসনালয় এখনে শুভ শক্তির কোনো প্রভাব খাটবে না। কহিনুর সাঈদকে বাগানে রেখে ভেতরে ঢুকে পড়লো। আশেপাশে তাঁকিয়ে সোজা দৌড়ে গেলো। দাদু আজ এখনে নেই। বাইরে পার্টি চলছে সেখানেই আজ সব আড্ডা বসিয়েছে। কহিনুর ভেতরে প্রবেশ করে নিরাশ হলো। প্রতিটা কক্ষের দরজা বন্ধ। কহিনুর ইচ্ছে করলে দরজা খুঁলতে পারবে কিন্তু জানে দরজাই হাত লাগালে শয়/তান গুলো হাজির হয়ে যাবে। ও চুপচাপ সিঁড়ির পাশে গিয়ে উপরের দিকে তাঁকিয়ে কিছু একটা ভেবে সিঁড়ির নিচের দিকে এগিয়ে গেলো। ফ্লোরে চারকোনা বক্স টাইপের হাতল লাগানো একটা কাঠের চওড়া তক্তা রাখা। কহিনুর আলগোছে সেটা সরিয়ে ফেলতেই চারদিক কেমন দুলে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে সদর দরজা খোঁলর আওয়াজ আসলো। কহিনুর চোখ বন্ধ করে নিজের উপরে বিরক্ত হলো। ধরা পড়া এখন শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। শেষ চেষ্টা ভেবে দৌড়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ একটা কক্ষে দরজার সামনে থেকে কেউ একজন ওকে ভেতরে টেনে নিলো। বলিষ্ঠ পুরুষালী একটা হাত ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। কহিনুর চোখ বন্ধ করেই বলল,
> ছেড়ে দিন এসবের মানে কি?
> এখানে কি করতে এসেছো? দেখতে এসেছো আমি মা/রা গেছি কিনা? তাঁকাও!
কহিনুর পিটপিট করে চোখ খুলতেই দুজনের মধ্যে চোখাচোখি হয়ে গেলো। পাথর ওর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে। কয়েক মূহুর্ত এভাবেই পার হয়ে গেলো। পৃথিবী থমকে গেলো। বাইরের কারো পায়ের শব্দ শুনে পাথর দ্রুত ওকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। একজন পাহারাদার দরজা খুঁলে ভেতরটা দেখে আবারও বেরিয়ে গেলো। পাথর ওকে ছেড়ে দ্রুত গিয়ে দরজা বন্ধ করে কহিনুরের কাছে ফিরে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
> এখনে কেনো এসেছো? কি খেলাই মেতেছো বলো আমাকে?
কহিনুর চোখের পাপড়ি নাড়িয়ে বলল,
> শত্রুর বিনাশ ।
পাথর নিজেকে শান্ত করলো। রাগ হচ্ছে প্রচণ্ড। সেদিন এই মেয়েটা ওকে সমুদ্রের তীরে ফেলে এসেছিল তারপর এই বাড়ির একজন ওকে এখানে এনে সুস্থ করে তুলেছে। দুদিন জ্ঞান ছিল না। স্ত্রী হয়ে নিজের স্বামীকে হ/ত্যা করতে যে মেয়ের হাত কাঁপেনা সেই মেয়ের সাহস নিয়ে প্রশ্ন আসেনা। ইচ্ছে করছে একে ধরে আচ্ছা করে ধোলাই করতে। এ কেমন বউ জুটলো কপালে? পাথর রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বলল,
> বয়স কতো তোমার? কহিনুর স্পেশাল আমার জানা আছে তবুও অভিজ্ঞতা বলতে একটা বস্তু আছে। কথায় কথায় মানুষের হৃদয়ের উপরে হামলা করা এবার বন্ধ করবে।
কহিনুর ওকে ইগনোর করে বলল,
> আমি বাধ্য হতে শিখিনি। বুদ্ধি দিয়ে ধণ্য করুন। এই বাড়ির গুপ্ত কক্ষের সন্ধান কিভাবে পাওয়া যাবে?
পাথর দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
> পারবো না। আমার সঙ্গে এখুনি তুমি ফিরে যাবে। সবটা আমি সামলে নিবো।
পাথরের চোখ লাল হয়ে আছে। রাগে শরীর জ্বলছে। এই মেয়ের উপরে রাগ করাও যায়না আবার চুপচাপ সহ্য করাও যায়না। কি যে এক যন্ত্রণা। কথাটা ভেবে পাথর ওকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে আসলো বেলকনি দিয়ে। প্রাসাদ থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে ছেড়ে দিয়ে থমথমে মুখ নিয়ে বলল,
> চুপচাপ ফিরে যাবে। সঙ্গে যেই পেত্নীটাকে জুটিয়েছো ওকে বলবে আমি রেগে গেলে ওকে বোতলে পুরে সমুদ্রের ভাসিয়ে দিবো। আজীবন বন্ধি হয়ে থাকতে হবে।
কহিনুর হাসলো। ওড়না কিছুটা সামনের দিকে টেনে নিয়ে বলল,
> ভয় পাচ্ছি না কি করবেন আমাকে? শুনুন আমাকে নিয়ে না ভেবে বরং আপনি নিজেকে নিয়ে ভাবুন। কিভাবে পেলেন এমন শক্তি? কি তাঁর উৎস? আপনার বাবা হঠাৎ আপনার মাকে ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলেন কেনো? প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা শুরু করুন আশাকরি আপনার মঙ্গল হবে।
কহিনুর ওর চোখে চোখ রেখে কথাগুলো বলে থামলো। পাথর কিছুটা চমকে গেলো কহিনুর কিভাবে এসব জানলো ভেবে তবুও উত্তর দিলো না। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল,
> শুনো মেয়ে তোমার সঙ্গে অযথা কথা বলতে আমার ইচ্ছা করছে না। ভূলে যায়নি দুদিন আগেই তুমি আমার প্রাণ নিতে চেয়েছিলে। আমি তোমাকে ভালোবাসতাম তার সুযোগ নিয়েছো কিন্তু এখন আমি জানি তুমি নিষ্ঠুর হৃদয়ের নারী। তোমার থেকে আমি কিছুই পাবো না। তোমাকে ভূলে যেতে চাইছি। দূরে থাকবে আমার থেকে।
পাথর একদমে এলোথেলো কথাগুলো বলে নিশ্বাস ফেলল। ভাবলো কহিনুর বুঝি চমকে যাবে কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। বরং কহিনুর ঠোঁট উল্টে বলল,
> সুলতান জুবায়ের ফারুকীর কন্যা সুলতানা কহিনুর ফারুকী হাজারো যুবকের হৃদপিণ্ডের ক্ষতচিহ্নের কারণ। তাকে এসব বলে থামানো যায় না। নতুন কিছু ট্রাই করুন। যাইহোক আসছি দেখা হবে।
কহিনুর চলে আসতে গিয়ে কিছু একটা ভেবে পেছনে ঘুরে বলল,
> এই যে আমাদের দেখা হলো তাঁর একটা চিহ্ন থাকা উচিৎ তাইনা?
কহিনুরের বলতে দেরি হলো কিন্তু পাথরের বুকে নিজের নক বিধিয়ে দিয়ে দেরী হলো না। পাথর ব্যাথা পেলো কিন্তু শব্দ করলো না। দুফোটা তরল গড়িয়ে পড়লো বুকের উপরে। পাথর খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে বলল,
> ডাকাত একটা।
কহিনুর শুনলো কি না বোঝা গেলো না।সাঈদকে ডেকে বাতাসের গতিতে দৌড়ে চললো। মূহুর্ত্তের মধ্যে পাথরের চোখের আড়ালে চলে গেলো। দূর থেকে বহুদূরে। পাথর চোখ বন্ধ করলো। মনের মধ্যে তোড়পাড় করছে। এক মন খান সাহেবের কথা শুনতে চাইছে আরেক মন কহিনুরের জন্য পুড়ছে। খান সাহেব খুব করে বলেছেন কহিনুরকে হ\ত্যা করা জরুরী। এই মেয়েটা অন্যায়ভাবে ভালো মানুষের ক্ষতি করছে। নিজের স্ত্রী বলে ওকে ছাড় দেওয়া হলে নিরীহ মানুষের উপরে অবিচার করা হবে। কোন দিকে যাবে কিছু ভাবতে পারছে না। মেজাজ খারাপ হচ্ছে। শরীরের ভেতরে থেকে পশুশক্তিটা বেরিয়ে আসতে চাইছে। পাথর ওকে নিয়ন্ত্রণ করে নিলো। সত্যি মিথ্যার বেড়াজালে ও জড়িয়ে পড়েছে। কহিনুর অশুভ শক্তির আধার। পৃথিবীর জন্য ক্ষতিকর। খান সাহেবের বলা কথাগুলো কানে প্রতিধ্বনি হচ্ছে।
**********
গহিন অরণ্যের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবক। সাদা পাঞ্জাবীর বুকে লেগে আছে টাটকা রক্তিম তরলের চিহ্ন। চোখের সামনে পড়ে আছে এক যুবতীর অচেতন শরীর। লা/শের দিকে কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে যুবকটা আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো,
> চন্দ্র ফিরে এসো, এখানে আমার হৃদয়ে। তোমার শরীরের উষ্ণতা দিয়ে আমাকে আগলে নাও। তোমার জন্য আমি সব পারি। এসে যাও প্লিজ। এই বিরহের অনলে আমি জ্বলেপুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছি। কবে ফিরবে? শুধুমাত্র তোমার জন্য সামান্য থেকে আমি অসামান্য হয়ে উঠেছি তবুও এতো অভিমান তোমার? আর কতটা লা\শ দেখলে তুমি আমার কাছে ফিরবে?
প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসলো সেই যুবককে আওয়াজ। চারদিকে থমথমে হয়ে পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ থেমে গেলো। লোকটা চোখ বন্ধ করে হাতের লাঠিটার দিকে তাঁকিয়ে বাঁকা হাসলো।তারপর নিজেকে নতুন রূপে পরিবর্তন করে নিয়ে হেলেদুলে লোকালয়ের দিকে পা বাড়ালো।
চলবে