#কহিনুর_দ্বিতীয়_খণ্ড,পর্বঃ৩৬
কলমে: ইয়াসমিন
খান সাহেবের সম্মুখে বসে আছে তফসিল মেরিন। নারীর শরীর আর হৃদয়ের উষ্ণতার থেকে নেশা পৃথিবীর আর কোনো মাদকদ্রব্যে নেই। ছলাকলা আর রূপের যাদুতে নারীরা ইচ্ছে করলেই পুরুষের হৃদয়কে ক্ষতবীক্ষত করতে পারে। একবার যদি এই নেশায় আসক্ত করা যায় তবে তাঁর থেকে ফিরিয়ে আনা কঠিন। খান সাহেব এটাই এতোক্ষন বুঝিয়ে বলছিলেন তফসিলকে। মেয়েটা রূপবতী সুন্দর সঙ্গে বুদ্ধিমতি। ওকে কাজে লাগিয়ে পাথরকে হাতে রাখতে উনি দারুণ একটা পরিকল্পনা করেছেন। সেদিন রাতে উনি সমুদ্রের তীর থেকে পাথরকে অচেতন অবস্থায় নিয়ে এসেছেন। হাকিম দিয়ে চিকিৎসা করে সুস্থ করেছেন। ছেলেটার মধ্যে যে শক্তির অস্তিত্ব উনি অনুভব করেছেন সেটা উনি নিজের কাজে ব্যবহার করতে চাইছেন। এই প্রজেক্টে তফসিল হচ্ছে উনার তুরুফের তাস। এই ঝামেলার জন্য উনি নিজের প্রাসাদ ছেড়ে বাইরে আছেন। নীরবতা ভেঙে তফসিল চমৎকার করে হেসে বলল,
> দাদু আমার উপরে ভরসা রাখো ওর হৃদয়ে আমি ঝড় তুলে ছাড়বো। আমার সঙ্গে একটুখানি কথা বলার জন্য ছেলেরা লাইন ধরে বসে থাকে। সেখানে আমি নিজে যেচে ওই ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাইছি ও কিভাবে আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখবে বলো? ওর সাধ্য নেই আমাকে উপেক্ষা করার। আমার রূপের আগুনে ও পুড়বে, ভয়ং/করভাবে পু/ড়বে।
তফসিল একদমে কথাগুলো বলে থামলো। খান সাহেব বিরক্ত হচ্ছেন তা উনার মুখের আকৃতি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। উনি অতিরিক্ত কথা বলা পছন্দ করেন না। হাতের গ্লাসটা সামনে রেখে উনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
> কহিনুরকে দেখেছো কখনও? কহিনুর যার মধ্যে আছে এক মহাশক্তির বলয়। তুমি সুন্দরী তাঁতে সন্দেহ নেই তবে তোমার একবার অন্তত ওর সামনে যাওয়া জরুরী। ঠিক তখন তোমার মনোবল কেমন থাকবে সেটাই আমার জানার বিষয়। তাছাড়া পাথর কিন্তু আমাদের বংশের অন্যসব ছেলেদের মতো নয়। সে আলাদা পিতার ন্যায় পবিত্র। ওকে বশে আনা এতোটা সহজ হবে না। তোমার উপরে আমার ভরসা আছে তবুও সাবধানে এগোবে। কোনো ভুল করলে কিন্তু আমি তোমাকে ক্ষমা করবো না।
খান সাহেব শেষের কথাগুলো প্রায় হুমকি দেওয়ার মতো করেই বললেন। পরিকল্পনার শুরুতেই উনি ব্যার্থ হতে চাননা। তফসিল কিছুটা ভেবে নিয়ে বলল,
> কহিনুরের সঙ্গে ওর কি সম্পর্ক দাদু? আগে তো বলোনি। তাছাড়া এখানকার সবাই জানে আমার চাইতে সুন্দরী কে আর আছে? তুমি জানো আমার সৌন্দর্যের কারণ তবুও বলছো? আমার পরিচয় তোমার অজানা নেই। ওই পরিবারের মেয়েদের রূপের তুলনা করার সাহস কেউ রাখেনা তবুও?
খান সাহেব ভ্রু কুচকে বললেন,
> সুলতান জুবায়ের ফারুকীর একমাত্র কন্যা হচ্ছে সুলতানা কহিনুর ফারুকী। তার সৌন্দর্যের তুলনাও আশাকরি তুমি নিজের সঙ্গে করবে না। আর গুরুত্বপূর্ণ নিউজ হচ্ছে কহিনুর পাথরের অর্ধাঙ্গী। বুঝতে পারছো কি বলছি? এরা স্বামী স্ত্রী দুটোই কিন্তু ধারা/লো খ/ঞ্জরের ন্যায় খতরনাক। ওদের সঙ্গে টেক্কা দিতে তোমাকে রেডি করেছি এমনি এমনি না। শত্রুকে দুর্বল ভাবা বোকামি।
তফসিল থমকে গেলো। ভেবেছিল পাথর ছেলেটাকে নিজের দখলে আনা শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা।তাছাড়া ও জানতো না ছেলেটা বিবাহিত। বিবাহিত মানেই অন্য একটা মেয়ে এই সুদর্শন পুরুষের মালকিন। কিভাবে সহ্য করবে নিজের পছন্দের ছেলেকে অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে? প্রচণ্ড হিংসা হচ্ছে ওর।মেজাজ খারাপ হলো পাথরের উপরে। ছেলেটা আগেই বিয়ে করে ফেলেছে এই জন্যই গতকাল ওকে পাত্তা দেয়নি। বারবার নিষেধ করেছে স্পর্শ করতে। তাছাড়া অনুষ্ঠান শেষের আগেই চুপিচুপি ফিরে গেছে। আজতো নিজের বাড়িতে পযর্ন্ত চলে গেলো। এভাবে সম্ভব না। তফসিল সিদ্ধান্ত নিলো পাথরের বাড়িতে গিয়ে ওর বাবা মায়ের সঙ্গে থাকতে হবে। তাছাড়া সবাইকে রাজি করিয়ে ফেললে নিশ্চয়ই পাথর ওকে মানবে। কোনো পুরুষের সামনে যদি কোনো নারী বারবার আসে তবে তাঁর চরিত্র এলোমেলো হতে সময় লাগে না। কোনো এক সময় মন থেকে মেনে নিবে। নিজের পরিকল্পনাতে নিজেই বাহবা দিলো তফসিল। কহিনুর যেমনি হোক ও কখনও পাথরের হৃদয়ে নিজের স্থান করতে পারবে না। কি আছে ওই মেয়ের? রূপ সেতো তফসিলেরও কম নেই। কথাগুলো ভেবে ও মৃদু হেসে দাদুর থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসলো। আসার সময় বিশেষ রকমের ওষুধ সঙ্গে নিলো। যেটা ওর অর্ধেক কাজ অনায়াসে হাসিল করতে সাহায্য করবে।
*****************
দীর্ঘদিন পরে অফিসে এসেছে পাথর। মন মেজাজ ঠিক নেই। নিজের মধ্যে অন্য কিছুর অস্তিত্ব আছে সেটা জানার পর থেকে ভীষন রকম হীনমন্যতায় ভুগছে তারপর জুটেছে ভয়ং/কর একটা বউ।যা নজর মানুষের কলিজার উপরে। গতকাল যাওয়ার সময় বুকের বাম পাশে আচড় কেটে দিয়ে গেছে। নিজের তো যন্ত্রণা কমাবে না শুধুমাত্র বাড়ানোর তালে থাকে। প্রশ্ন জাগলো,আচ্ছা বউরা কি এমনিই হয়? কথাগুলো ভেবে ও বেলালকে ডাকলো। ছেলেটা একা হাতে অফিসের কাজকর্ম করছে। এক মিনিটের মাথায় বেলাল ফাইল হাতে ভেতরে প্রবেশ করলো। পাথর ওর দিকে তাঁকিয়ে কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
> বেলাল বউ নিয়ে বিশ লাইনের একটা বক্তব্য দাও তো। শুরু করো।
পাথরের কথা শুনে বেলাল চোখ বড়বড় করে ফেলল। ভেবেছিল নতুন প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলবে কিন্তু না বিয়ে করে স্যারের মাথায় সমস্যা হয়ে গেলো নাকি? বেলালকে চুপচাপ দেখে পাথর পুনরায় বলল,
> দ্রুত বলো সময় নষ্ট করছো কেনো? আমার হাতে সময় নেই।
বেলাল ভাঙা গলাই বলল,
> স্যার কি বলছেন আপনি? আপনি ঠিক আছেন? বউ তো আপনার বাংলাদেশে আছে। আপনি কি ম্যামের কাছে যেতে চাইছেন? মানে উনাকে মিস করছেন?
পাথর বিরক্ত হয়ে ভ্রু কুচকে বলল,
> এতো কথা বলো কেনো তুমি? চুপচাপ কিছু বলো নয়তো যাও অন্য কাউকে পাঠাও যে ভালো বলতে পারবে। যার ভালো অভিজ্ঞতা আছে তাকেই কিন্তু।
বেলাল গলা ঝেড়ে বলল,
> বউ হচ্ছে এমন একটা প্রাণী যার সঙ্গে থাকতে হলে কোনো সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় বাধা নিষেধের বেড়াজাল থাকে না। যখন ভালোবাসার সিজেন চলে তখন মুখ দিয়ে মধু বর্ষণ হয় আর তখন ঝগড়া চলে তখন…
> চুপ করো বেলাল। তুমি যাচ্ছেতাই একজন মানুষ। তোমাকে দিয়ে কিছুই হবে না। যাও কাজ করো।
পাথরের ধমক শুনে বেলাল চুপসে গেলো। টেবিলের উপর থেকে ফাইলটা নিয়ে তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে গেলো। পাথর চোখ বন্ধ করে রাগ নিয়ন্ত্রণ করছে। নিজের বুদ্ধিতে নিজেই বিরক্ত। বেলাল টাই বা কি। এতোদিন ধরে মনে হচ্ছে জোর করে সংসার করছে। কোনো ভালো অনুভূতি নেই। বিরক্ত হয়ে ভাবলো কহিনুরকে নিয়ে ওর আর ভাবছে না। মেয়েটা যেমন আছে থাক ওর কি? বিয়ে করেছে বলে কি মাথা কিনে নিয়েছে। এবার আঘাত করতে আসলে হয় মজা দেখাবে। কথাটা ভেবে ও বুকের উপরে কাটা স্থানে হাত বুলিয়ে চোখ বন্ধ করলো। গতকালের এই আঘাতে কি ছিল ভালোবাসা নাকি নিষ্ঠুরতা? কেনো জানি হঠাৎ এক রাশ ভালোলাগা ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরলো। ভালোবাসা সেতো কঠিন তপস্যা। এতো সহজে ধরা দিলে সেতো সস্তা হয়ে উঠবে। কথাগুলো ভেবে ও কাজে মনোযোগ দিলো।ওর বাবা ফিরে এসেছে উনি বাড়িতে আছেন। পাথর উনাকে কাজকর্ম করতে নিষেধ করেছে। তবুও টুকটাক বাড়িতে বসে এটা ওটা করে থাকে।
*************
সুলতান হাউজের দাঁড়িয়ে আছে জামসেদ। কহিনুরকে একা রেখে কিছুতেই কাজে মন বসছে না। দাদু আর ড্যাডের জন্যই ওর ফিরে আসা। দুজনে সমানে ফোন করে বিরক্ত করেছে। মীরার সঙ্গে দেখা করতে মন চাইছে। কতকাল পরে দেখা হলো তবুও কত বাধা। কবে সব ঠিকঠাক হয়ে ভয় ছাড়া সংসার করবে সেটাই ভেবে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ দাদুর ডাকে ওর ধ্যান ভাঙলো। ভদ্রলোক ভ্রু কুচকে বললেন,
> কহিনুর জার্মানিতে আছে আর আমাদের হাতের নাগালের মধ্যে তবে ওকে ধরতে পারছো না কেনো? নাকি চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছো। ভাবছো অভি/শাপ মুক্ত হয়েছি কোনো শয়/তানের উপাসনা করতে হবে না। জীবন সুন্দর হয়ে উঠেছে তবে এটা তোমার ভুল ধারণা। নিজের বোনরা বিদ্রহ করে বসেছে। ওরা অর্ধমানবদের সঙ্গে আর থাকবে না। নিজের মতো থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভাবছো সামনে কি অপেক্ষা করছে? অর্ধমানবেরা আমাদের ছেড়ে দিবে ভাবছো?
দাদু অন্য দিনের তুলনায় আজ বেশ উত্তেজিত। জামসেদ ভ্রু কুচকে বলল,
> অভিশাপ নেই তাই অর্ধনাবেরা এখন ইচ্ছে করলেও আর আমার বোনদের আশেপাশে আসতে পারবে না। তাছাড়া ওই শয়/তানদের অভিশাপ কিন্তু কাটেনি। আমি বোনদের সাপোর্ট করছি দাদু। সব ঝামেলা যেখানে মিটে গেছে সেখানে তুমি এতো উত্তেজিত হচ্ছো কেনো? ছেড়ে দাও কহিনুর যেখানে আছে থাক।
জামসেদের কথা শুনে দাদু এবার রেগে গেলেন। চিৎকার করে বলে উঠলেন,
> ওকে চাই আমার। ওকে ছাড়া আমি কিভাবে নিজের ইচ্ছে পূরণ করবো? তাছাড়া ওর পেছনে হাজারো শত্রু। কেউ না কেউ ঠিক ওকে তুলে নিবে তাহলে আমি হলে দোষের কি? জামসেদ ওকে তুলে আনো আমি কথা দিচ্ছি এই বিশাল ঐশ্বর্যের মালিক হয়ে যাবে তুমি একা। কোনো দাবিদার থাকবে না। আমি কহিনুরকে পেলে নিজের মতো চলে যাবো কোথাও। তোমাকে বিরক্ত করবো না।
দাদুর চোখমুখ চকচক করছে। জামসেদের হঠাৎ উনার এই লোভী মুখোশ্রী দেখে ভয় করে উঠলো। এই লোকটার পেছনে থাকা অবয়বের রহস্যটা কি? এই রহস্যের সমাধান করতে হলে এখানে অধরা জুবায়েকে খুব দরকার। কহিনুর ঠিক বলেছে শত্রুর থেকে দূরে থেকে না বরং কাছে থেকে মোকাবেলা করতে হয়। জামসেদ কিছু একটা ভেবে পৈশাচিক হেসে বলল,
> দাদু তুমি আমার পরামর্শদাতা। তোমার কথার বাইরে কথা বলর সাহস কোনো কালে ছিল আমার? জুবায়ের অধরা আর মীরা এক সঙ্গে আছে। ওদের খবর পেয়েছি কিন্তু কহিনুর সেখানে নেই। তুমি বললে ওদেরকে নিয়ে আসি?
জামসেদের কথা শুনি উনি ভ্রু কুচকে বিরক্ত হয়ে বললেন,
> আগে বলবে না? এখনো না এনে অনুমতি চাইছো? লোক পাঠিয়ে ওদেরকে নিয়ে আসো। বাবা মায়ের টানে মেয়ে ঠিক একদিন বাড়িতে ফিরবে কি বলো?
জামসেদ হেসে বলল,
> ঠিক বলেছো। আমি নিজের গিয়ে ওদেরকে আনবো এখুনি যাচ্ছি।
দাদু ওর উপরে ভীষণ খুশি সেটা উনার চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। জামসেদ উঠে আসলো। মীরাকে কাছে পাওয়া আর দাদুর বারোটা বাজানোর কথা ভেবেই মেজাজ ফুরফুরে হয়ে গেলো। অধরাকে ওর ভালো করে চেনা আছে। একবার কিছু নিয়ে সন্দেহ করলে তার চৌদ্দ গোষ্ঠীর খবরাখবর বের করে তবে দম নেয়। মেয়েটার এলেম আছে। দাদুর এতো শান্তি ওর সহ্য হচ্ছে না। আজকের মধ্যেই ওদেরকে নিয়ে আসবে। কহিনুর দূরে আছে দূরেই থাক। ওর এখন বহু কাজ।
**************
সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে আছে পাথর। শনশন বাতাস বইছে। হঠাৎ গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল তাই রিলিফ পেতে ছুটে এসেছে এখানে। ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে পায়ের পাতার উপরে। মৃদু মন্দ বাতাসে শরীর শীতল হলেও অশান্ত মন কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। রাগ হচ্ছে। সারাদিন অফিসের গাধার খাটুনি শেষে বাড়িতে ফিরে তফসিলকে দেখেই মেজাজ বিগড়ে গেছে। অসুস্থ অবস্থায় এই মেয়েটা ওকে সেবাযত্ন করেছিল যেটা খান সাহেব ওকে বলেছে তাই কিছু বলতে পারছে না। মানবতা দেখিয়ে সাহায্য করে এখন প্রতিদান চাইছে। পাথরের ইচ্ছে করছে প্রা/ণ নিয়ে নিতে কিন্তু পারবে না। কথাগুলো ভবে ও চোখ বন্ধ করলো। হঠাৎ রিনরিনে মেয়েলি কন্ঠের কারো ডাক শুনে ওর ধ্যান ভাঙলো। চট করে পেছনে তাঁকিয়ে দেখলো তফসিল দাঁড়িয়ে আছে। রাজধানী থেকে এতোটা দূরে এই মেয়েটা কিভাবে আসলো এটা ওর মাথায় আসলো না। মেয়েটাকে দেখেই বিগড়ানো মেজাজ আরও বিগড়ে গেলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
> তুমি?
পাথরের প্রশ্ন শুনে তফসিল মিষ্টি করে হাসলো। উন্মুক্ত চুলগুলোর কিছুটা সামনের দিকে টেনে নিলো। মেয়েটার হাটুর নিম্নভাগ দৃশ্যমান টপ যেটা পরেছে সেটা না পরলেও কিছু অসুবিধা নেই। পাথর সেদিকে আর তাঁকালো না। মেয়েটা এমন নোংরা কেনো কে জানে। নীরবতা ভেঙে তফসিল বলে উঠলো,
> তুমিও যেখানে আমিও সেখানে। তোমার হৃদয়ের সঙ্গে আমার হৃদয়ের আদান প্রদান শুরু হয়ে গেছে পাথর। আমি তোমার পাথর হৃদয়ের পুষ্পগুচ্ছ হয়ে থাকতে চাই। কেনো বুঝোনা আমাকে? একবার সুযোগ দাও প্লিজ। খুব ভালোবাসবো।
পাথর হতভম্ভ এই মেয়ের কথাবার্তা শুনে। বউয়ের যন্ত্রণায় পাগল পাগল অবস্থা সেখানে এই মেয়ে এসেছে প্রেম ভিক্ষা চাইতে। পাথর চোখ বন্ধ করে বলল,
> ভিক্ষা চাইছো তফসিল? তোমার যে এমন করুণ অবস্থা আমি তো জানতাম না। এতটা নিচে নিজেকে নামিও না। আমার কেমন লজ্জা লাগছে।
পাথর জানতো মেয়েটাকে রাগ দেখিয়ে দমন করা সম্ভব না তাই কৌশলে ঠাণ্ডা মাথায় অপমান করতে কথাগুলো বলল। তফসিল ভেতরে ভেতরে রেগে আগুন। তবুও দাদুর কথা ভেবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বলল,
> ভালোবাসার মানুষের কাছে মান অপমান বলে কিছু নেই পাথর। আমি তোমাকে মন থেকে চেয়েছি। তুমি যদি ভাবো আমি ভিক্ষা চেয়েছি তবে সেটা ভিক্ষা। তবুও তোমাকে আমার করে চাই। আচ্ছা কিছুদিন আমার সঙ্গে থাকো। তারপর যদি মনে হয় আমি তোমার অশান্তির কারণ হচ্ছি তবে ছেড়ে দিও।
পাথর দাঁতে দাঁত চেপে মেয়েটার বাজে প্রস্তাবটা হজম করলো। কতটা নিলজ্জ হলে এমন প্রস্তাব মেয়ে হয়ে কোনো ছেলেকে দেওয়া যায় পাথর ভাবতে পারছে না। লজ্জা নারীর ভূষণ এই মেয়েটা হয়তো সেটা ভূলেই গেছে। পাথর হিংস্র হয়ে উঠলো। ভেতরে পশু সত্তা বেরিয়ে এসে হানা দিতে চাইলো তাঁর আগেই তফসিল হুট করে পাথরকে জড়িয়ে ধরতে গেলো কিন্তু পারলো না। ছিঁটকে গিয়ে দূরে পড়লো। মূহুর্ত্তের মধ্যে এরকম হবে কেউ ভাবতে পারেনি।পাথর বিষয়টা বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচকে তাঁকিয়ে আছে। ঠিক তখনই পাশ থেকে খলখল হাসির ঝঙ্কার ভেসে আসলো। পাথর তাঁকিয়ে দেখলো কহিনুর দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার পরনে আজ নীল রঙের গাউন। কোমর অবধি খোলা চুল বাতাসে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কেমন পুতুল পুতুল লাগছে। এই মেয়েটাকে দেখলে বারবার প্রেমে পড়তে মন চাই। কেনো যে এমন হয় পাথর নিজেও জানেনা। কতবার নিজেকে সাহস করেছে তবুও আবারও সব ভুলে গেলো। পাথরের ধ্যান ভাঙলো দূরে তফসিলের চিৎকারে শব্দ শুনে। মেয়েটা ব্যাথাই উঠতে পারছে না বারবার ওকে ডাকছে। পাথর বিরক্ত হলো কিন্তু প্রকাশ করলো না। ততক্ষনে কহিনুর হাসি থামিয়ে নিকটে চলে এসেছে। পাথর তফসিলকে তুলতে হাত বাড়িয়ে দেবার আগেই কহিনুর বলে উঠলো,
> আরে করছেন টা কি? আমি ওকে সাহায্য করছি আপনি দূরে থাকুন।
কহিনুর এগিয়ে গেলো কিন্তু তফসিল ভ্রু কুচকে হাত গুটিয়ে নিলো । সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার পরিচয় ওর জানা নেই। তবে কিছুটা অনুমান করেছে। দাদুর কথাটা এবার বুঝতে পারলো। এতো সুন্দরী স্ত্রী রেখে পাথর ওর দিকে কেনো চাইবে? কথাটা ভেবেই ওর জিদ চাপলো তাই পাথরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। কহিনুর হাসলো। ওর মজা লাগলো তাই মিষ্টি কণ্ঠে বলল,
> ওকে তুলুন আরেকবার ঝটকা না খেলে শিক্ষা হচ্ছে না। সাবধান করলাম তবুও শুনলো না।
কহিনুরের কথা শুনে দুজনেই ভয় পেলো। তফসিল ঝাপ দিয়ে একা একাই উঠে পড়লো। শরীর এখনো ঝিমঝিম করছে আরেকবার এমন হলে প্রাণ নিয়ে টানাটানি পড়বে। পাথর কহিনুরের হাত ধরে কিছুটা দূরে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
> হেয়ালি করবে না সোজাসাপ্টা বলো ওর সঙ্গে এসব তুমি করেছো তাইনা?
কহিনুর ইনোসেন্ট ভাব নিয়ে বলল,
> আপনি অনুমতি দিয়েছিলেন আর এখন আমাকে দোষারোপ করছেন অদ্ভুত।
> কিসের অনুমতি? ওকে ফেলে দিয়েছো তুমি আবার মিথ্যা বলছো?
পাথর রেগে আছে। কহিনুরের হাতের কব্জি ওর হাতের মুঠোয় বন্দি। দুজনেই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। ওর নিশ্বাস পড়ছে কহিনুরের মুখের উপরে। কহিনুর জ্বালা ধরানোর মতো হাসলো। তারপর বলল,
> আপনি হুকুম দিয়েছিলেন আর আমি নিজের নামটা আপনার হৃদয়ের খোদাই করেছি। যেখানে আমার বসবাস,যেখানে আমি বসতি গড়েছি সেখানে অন্যরা কিভাবে প্রবেশ করতে পারে বলুন? স্পর্শ তো দূরে থাক কাছে আসাও অপরাধ। আপনি আমাকে চান বা না চান কিছু যায় আসবে না। হয় আপনি কহিনুরের সঙ্গে থাকুন নয়তো সারাজীবন একা থাকুন এটাই আপনার নিয়তি। কহিনুর নিষ্ঠুর প্রচণ্ড হিংস্র তবুও সে ছাড়া আপনার গতি নেই।
পাথর হতভম্ভ কহিনুরের কথা শুনে। এই মেয়ের মনে এসব ছিল। কি সাংঘাতিক বুদ্ধি ভেবেই ওর শরীর শিউরে উঠছে। পাথর ওকে ছেড়ে দিয়ে ছিটকে আসলো। ভ্রু কুচকে বলল,
> আমি একা থাকাই সুখের মনে করবো তবুও তোমার সঙ্গে থাকবো না। নিষ্ঠুর তুমি। নিরপরাধ মানুষের প্রাণ নিয়ে কিসের সুখ পাও তুমি? সৌন্দর্যের মধ্যে এতো নোংরা ছিঃ।
পাথর মুখ ফিরিয়ে নিলো। সেটা দেখে কহিনুর হাসলো। বলল,
> প্রমাণ ছাড়া দোষারোপ করছেন। কহিনুর কিন্তু কাউকে ছাড় দেয়না। যদি প্রমাণ করতে না পারেন তখন কিন্তু ভয়ংকর শাস্তি পাবেন। একাকিত্বের স্বাদ হাড়হাড়ে পাবেন। যাইহোক এখানে কি চলছিল বউয়ের অনুপস্থিতিতে? উনি আপনার গার্লফ্রেন্ড?
কহিনুর খোচা দিয়ে কথাগুলো বলল। পাথরকে রাগিয়ে দিয়ে আজ যেনো ও বদ্ধপরিকর। তফসিল এসে পাথরের পেছনে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটার মাথায় নানারকম প্রশ্ন ঘুরছে। তবুও কিছু বলা দরকার ভেবে কহিনুরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
> তোমার সৌন্দর্য ব্যার্থ। পাথর তোমাকে ভালোবাসে না ঘৃণা করে। কি হবে এতো রূপ নিয়ে?
তফসিলের কটাক্ষপূর্ণ বাক্যে কহিনুর খলখল করে হেসে উঠলো। দূরে সাঈদ ছিল ও এসে কহিনুরের সঙ্গে যোগ দিলো। মেয়েটা কোনোরকমে হাসি থামিয়ে বলল,
> মাথা মোটা খান সাহেবের সঙ্গে থেকে থেকে তুমিও উনার মতো বোকা হয়ে গেছো তফসিল। পোশাকের মতো নিজের বুদ্ধিও আলগা করে রেখেছো? কহিনুরের সঙ্গে লড়াইয়ে নেমেছো এই বুদ্ধি নিয়ে?।
কহিনুরের কথা শুনে তফসিল ভ্রু কুচকে ফেলল। এইটুকু একটা মেয়ে কিভাবে ওকে অপমান করলো। রাগ হচ্ছে তাই উত্তর না করে সোজা পাথরকে বলল,
> দেখেছো কেমন বেয়াদব? ওর সঙ্গে তোমার যায়না । চলো এখান থেকে।
এতোক্ষন পাথর চুপচাপ ছিল হঠাৎ তফসিলের কথা শুনে রেগে গিয়ে ধমক দিয়ে বলল,
> ওকে নিয়ে আর একটা বাজে শব্দ উচ্চারণ করো কি করি আমি। আমার বউ খারাপ, ওর সঙ্গে থাকা যায়না সে আমি বুঝবো তোমার কি? এখুনি চোখের সামনে থেকে দূর হও।
পাথরের ধমক শুনে তফসিলের চোখে পানি চলে আসলো। জীবনে প্রথমবার এভাবে অপমানিত হতে হলো। চোখ মুছতে মুছতে মনেমনে দুজনকেই আচ্ছা মতো গালি দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতেই পেছনে থেকে কহিনুর বলে উঠলো,
> খান সাহেবকে বলে দিও কহিনুরের প্রা/ণ নিতে হলে আগে প্রা/ণ দিতে হবে। কহিনুরের মৃ/ত্যু কোনো শত্রুর অপবিত্র হাতের স্পর্শে হবে না। একজন আছে সে ছাড়া কারো সাধ্য নেই কহিনুরের হৃদয়ে খ/ঞ্জর চালানোর বুঝলে?
তফসিল পেছনে ফিরলো না। চলে গেলো। পাথর নির্বাক হয়ে কহিনুরের দিকে তাঁকিয়ে আছে। কি বলল মেয়েটা? খান সাহেব ওকে মা/রতে চাই কিন্তু কেনো? এইটুকু মেয়ের সঙ্গে লোকটার কিসের শত্রুতা? কহিনুর খারাপ বলে নাকি অন্য কিছু। পাথর কহিনুরের দিকে তাঁকিয়ে আছে দেখে কহিনুর হালকা কেশে বলল,
> গার্লফ্রেন্ড নিয়ে সমুদ্রের তীরে নাইট ক্লাবে খুব তো ঘুরছেন। বেশি উড়াউড়ি সাস্থ্যের জন্য খারাপ। যাইহোক আসছি। সাঈদ চলো ফিরতে হবে।
কহিনুর চলে যেতে চাইলো কিন্তু পারলো না। পাথর ওর হাতেটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে থামিয়ে দিয়ে জিঞ্জাসা করলো,
> তুমি এখানে কি করছো? বাবা মা জানে তুমি এই ছেলেটা সঙ্গে এভাবে ডানপিটে হয়ে ঘুরে বেড়াও?
কহিনুর কিছু বলতে চাইলো তার আগেই সাঈদ বলে দিলো,
> জনাব আমি আর কহিনুর আলাদা ফ্লাটে থাকি। উনারা আলাদা থাকেন।
কহিনুর ঘাড় ঘুরিয়ে সাঈদের দিকে তাঁকালো। সাঈদকে ওর এমনিই অপছন্দ তারপর কহিনুরের সঙ্গে একা থাকে জেনে পাথর এবার ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো। কহিনুরের দুবাহু শক্ত করে ধরে বলল,
> বাড়িতে চলো। ওই ছেলেটা সঙ্গে তুমি একা একা থাকো এতো সাহস তোমার? শশুর সাহেবের সঙ্গে বোঝাপড়া পরে করবো।
কহিনুর বাধা দিয়েও পাথরকে থামাতে পারলো না। কোলে তুলে নিয়ে বাতাসের গতিতে ছুটলো নিজের বাসার দিকে।। কিছু একটা ভেবে কহিনুর বাঁকা হাসলো। একটা রহস্য জানতে ওই বাড়িতে প্রবেশ করাটা খুব জরুরী ছিল এভাবে হয়ে যাবে ভাবেনি।
চলবে
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।