#কহিনুর_দ্বিতীয়_খণ্ড,পর্ব:৩৭
কলমে:ইয়াসমিন
যেখান থেকে শুরু হয়েছিল কহিনুরের গল্প আজ আঠারো বছর পর আবারও সেখানেই ফিরছে অধরা আর জুবায়ের।সুলতান ভিলাতে পা রাখতেই পুরাতন দিনের কথাগুলো মনে পড়ে গেলো অধরার। কোনো এক ভোররাতে এই বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল ভালোবাসার মানুষটাকে বিপদের মধ্যে রেখে আজ আবারও তাঁর হাতে হাত রেখে এখানে আসতে পারবে কখনও ভাবেনি। মনে হচ্ছে সবটা কল্পনা। এই বাড়িটা ঠিক আগের মতোই আছে কিছু পরিবর্তন হয়নি। আসবাবপত্র থেকে শুরু করে বাড়ির রঙ পযর্ন্ত ঠিকঠাক। শাশুড়ি মায়ের মুখটা বড্ড মনে পড়ছে। উনার বলা কথাগুলো আর উনার দেওয়া ধাঁধার সুত্র ধরে অধরা এক সময় কহিনুরের রহস্য উৎঘাটন করতে শুরু করেছিল। সেদিন রাতে কি হয়েছিল সঠিকভাবে জানা যায়নি। ঐশ্বর্যের মায়ের কি হয়েছিল সেটাও জুবায়ের বলেনি। অধরা একপা দু’পা করে এগিয়ে যেতেই পাশ থেকে জুবায়ের ফিসফিস করে বলে উঠলো,
> এভাবে কি দেখছো?মনে পড়ছে আগের দিনগুলোর কথা? সরি আমি তোমার অপরাধী। সারাজীবন এটা ভেবেই আমি হীনমন্যতায় ভুগবো। আমি নিজের স্বার্থে তোমাকে ব্যবহার করেছিলাম। এতগুলো বছর তোমার জীবন থেকে রঙ কেড়ে নিয়ে নির্জীব করে রেখেছিলাম। তুমি বলোনা আমি কেনো তোমাকে কথায় কথায় কোলে তুলে নিই। কাছে কাছে থাকার চেষ্টা করি? তুমি ভাবতে পারো অতিরিক্ত করছি। আসলে আমি চেয়েছি তোমাকে যেই দুঃখটা দিয়েছি তাঁর কিছুটা হলেও কমাতে। আমি ভালো ছিলাম না। তোমার গায়ে হাত পযর্ন্ত তুলেছি। সেই তুলনায় আমার ভালোবাসাটা খুবই সামান্য। ভালোবাসা দিয়ে আমার পাপটাকে আড়ালে ঢাকতে চাই। তোমার সুখে আমার সুখ খুঁজে নিতে চাই।
জুবায়ের একদমে কথাগুলো বলে থামলো। অধরার মেজাজ চরম খারাপ। এই লোকটা ওকে মন থেকে না শুধুমাত্র নিজের অপরাধ কমানোর জন্য এসব করেছে। কিন্তু অধরা তো এরকম ভেবে ভালোবাসেনি। এখানে সবাইকে ব্যবহার করা হয়েছে। জুবায়ের নিজেও ভুক্তভোগী তাহলে এই কথাগুলোর মানে কি? তার মানে হচ্ছে জুবায়ের ওকে মন থেকে আজও মানতে পারেনি? ও আজও নিজের গার্লফ্রেন্ড জুহিকে ভালোবাসে? অধরাতো দেখেছিল জুবায়েরের পাগলামি। জুহির জন্য কতটা পাগল ছিল। ওকে পাওয়ার জন্য অচেনা একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিয়েছিল। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে সংসার করেছে। ভালোবাসা না থাকলে বুঝি এমনটা করা যায়? এমনিতেই মন খারাপ ছিল তারপর জুবায়েরের এধরণের কথা শুনে অধরার চোখে পানি চলে আসলো। নাক টেনে উত্তর দিলো,
> লোক দেখানো ভালোবাসার আমার কোনো দরকার নেই। আপনি নিজের মতোই থাকুন। আমি নিজেকে সামলাতে পারবো। ইচ্ছের বিরুদ্ধে কারো সঙ্গে থাকার চাইতে কষ্টের কিছু হয়না। আমি তো প্রথম থেকেই আপনাকে মেনে নিয়েছিলাম কিন্তু আপনি তো পারেননি। এবার থেকে নিজের ইচ্ছেতে চলবেন। মুক্তি দিলাম।
অধরা কথাগুলো বলতে বলতে সামনে এগিয়ে গেলো। ওর চোখে পানি চিকচিক করছে। জুবায়ের নিজের কথায় নিজেই ফেসে গেলো। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে মনে যা এসেছিল হড়বড় করে বলে দিয়ে বুঝলো কতবড় ভুলটা করে ফেলেছে। অধরাকে কষ্ট দিতে ও এগুলো বলেনি। তাছাড়া জুবায়ের মন থেকেই ওকে মেনে নিয়েছে সে অনেক আগে থেকেই। জুবায়ের ওর পিছনে পিছনে ছুটে গেলো। কিন্তু অধরা শুনলো না। সোজা নিজের কক্ষে গিয়ে ঢুকলো। কক্ষের সবটা সেই আগেই মতো সাজানো গোছানো আছে। ভূতের বাড়িতে বারবার চমকে যাওয়ার জন্য হাজারটা কারণ আছে। অধরা আলমারি খুঁলে বসে পড়লো। মায়ের শাড়িগুলো আলতো হাতের ছোঁয়া দিয়ে একটা বের করে নিলো। মা মা গন্ধটা নেই তবুও তাঁর ছোঁয়া আছে ভেবে ওয়াশরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করলো। জুবায়ের কক্ষে এসে অধরাকে পেলো না। হতাশ হয়ে সোফায় ধপ করে বসে পড়লো। কতদিন যে লাগবে মেয়েটাকে বোঝাতে ভেবেই ঢোক গিলল। নিজের উপরে নিজের রাগ হচ্ছে থাপ্পড় দিয়ে মন চাইছে। এর মধ্যেই কাজের মেয়েটা এসে বলে গেলো দাদু ওদেরকে ডাকছে। জুবায়ের চোখ বন্ধ করলো। দাদু ওদেরকে পালিয়ে যাওয়া নিয়ে কিছুই বলবে না জানা আজে। ভদ্রলোকের মাথা ভীষণ ঠান্ডা। কিভাবে গরম পরিস্থিতি নরম করতে হয় ভালো করে জানে। জুবায়ের ছুটলো দাদুর সঙ্গে দেখা করতে। মীরাকে জামসেদের কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জামসেদ বেশ বুদ্ধিমান। দাদুকে বলেছে মীরাকে আজ বিয়ে করে তবেই নিয়ে আসতে পেরেছে নয়তো আনা সম্ভব ছিল না। দাদুর অবশ্য এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। উনি চেয়েছেন ওরা বাড়িতে ফিরে আসুক। জুবায়ের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে দাদুর কক্ষে গিয়ে ঢুকলো। জামসেদ আগে থেকেই উপস্থিত ছিল জুবায়েরকে দেখে দাদু গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
> ঘর সংসার ছেড়ে স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে এভাবে ঘুরাঘুরি করার কোনো মানে হয়? তোমার স্ত্রী তো কখনও আমাদেরকে বিশ্বাস করেনা সে আর নতুন কি। কিন্তু তুমি কিভাবে পারলে ও তালে তাল দিয়ে নাচতে ? মন দিয়ে ব্যবসা করো। সুলতান পরিবারের বদনাম হলে আমি মেনে নিবো না।
জুবায়ের ভ্রু কুচকে ফেলল দাদুর কথা শুনে। জামসেদ ইনোসেন্ট মুখ করে বসে আছে। পালিয়ে যাওয়ার বুদ্ধিটা ওর ছিল কিন্তু এখন এমন মুখ করে রেখেছে মনে হচ্ছে কিছুই জানেনা। জুবায়ের বিরক্ত হয়ে বলল,
> আর কিছু বলবে দাদু? আমি ক্লান্ত ঘুমানোর দরকার। আর পালিয়েছি আমার বুদ্ধিতে আমার স্ত্রীর দোষ নেই। অযথা ওকে দোষারোপ করবে না। আমার পছন্দ না ওকে আমাদের ঝামেলার মধ্যে টানাটানি করার। নওশাদ বারি নিশ্চয়ই নিজের মেয়েকে আমার হাতে এসবের জন্য তুলে দেয়নি? কিছু বলার থাকলে বলো নয়তো যাচ্ছি।
জুবায়েরের কথাশুনে দাদু চরম বিরক্ত। এই ছেলের মুখে কিছু আটকাই না। কারো মন রক্ষার জন্য হলেও যে একটু মিথ্যা করে কোমলভাবে কথা বলা যায় সেটা এ জানে না। জামসেদ কেশে উঠে বলল,
> দাদু ওকে যেতে যাও। মাথা গরম কটুক্তি করে তোমাকে খোচা দিবে। মুখ খোলানোর দরকার নেই। জুবায়ের কক্ষে যাও। পরে কথা হবে।
জুবায়ের অপেক্ষা করলো না। বেরিয়ে আসলো কক্ষের বাইরে।ও চলে আসতেই জামসেদ কোনোরকমে মুখে হাসি টেনে বলল,
> এটা কার মতো আজও আবিষ্কার করতে পারিনি।জলন্ত উল্কার মতো। যাইহোক কিছু ভেবো না। সামনে যা হবে ভালোই হবে।
দাদু ভ্রু কুচকে বলল,
> বেয়াদব হয়েছে তোমার মমের অতিরিক্ত ভালোবাসা পেয়ে। আগেই বলেছিলাম এতোটা না করতে কিন্তু কে শুনে। যাইহোক তুমিও যাও আমি একা থাকতে চাই।
জামসেদ বেরিয়ে আসলো। মীরা কক্ষে একা আছে। মন থেকে সব খারাপ লাগা বেরিয়ে গেলো। ভালোবাসার মানুষটা আজ নিজের কক্ষে। কেউ বাধা দেওয়ার নেই। ভয় নেই কেউ দেখে ফেলার এর চাইতে সুখের কিবা আছে?
***************
নিস্তব্ধ কক্ষের সোফায় বসে আছে কহিনুর। পায়ে লম্বা সিঁকল ঝুলছে। যেই মেয়েটার হাতের ছোঁয়াতে বন্ধ কক্ষের দরজা খুঁলে যায় আজ সেই মেয়েটা সিঁকলে বন্দি। কিছুতেই খুঁলছে না। এর পেছনে দোষী পাথর নিজে। সমুদ্রের তীর থেকে ওকে ঝাপটে ধরে এনে লোকটা ওকে নিজের ফার্ম হাউজে আটকে রেখেছে। সাঈদ কোথায় আছে তার খবরও জানা হয়নি। হঠাৎ দরজা খোঁলার শব্দ শুনে ওর ধ্যান ভাঙলো। পাথর কফির মগ হাতে ভেতরে প্রবেশ করছে। ছেলেটা এসে সোজা কহিনুরের সামনের চেয়ারে বসে পড়লো। কফিতে চুমুক দিয়ে বলল,
> কি অবস্থা সব ঠিকঠাক?
কহিনুরের মেজাজ চরম খারাপ। ভেবেছিল সারা বাড়িটা তছনছ করে উল্টোপাল্টা করে কঠিন এক রহস্যের খোঁজ করবে কিন্তু কিছুই হলো না। লোকটা চালাকি করে ওকে আটকে দিলো কিছুতেই বের হতে পারছে না। রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
> আমাকে বেঁধে রাখার মানে কি? কি উদ্দেশ্য আপনার?
পাথর কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল,
> কিছুই না।ভাবছি এখানেই তোমাকে আজীবনের জন্য নির্বাসিত করবো কেমন হবে বলোতো নূর?। হৃদয় হরণকারিনীর সঙ্গে এমনটা করাই যায় বলো?
পাথরের কথা শুনে কহিনুর ভ্রু কুচকে ফেলল। যতই রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে চাই তবুও রাগ হচ্ছে। গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,
> কি লাভ আমাকে আটকে রেখে? তাছাড়া কি ভাবছেন আমি যেতে পারবো না? শুধুমাত্র শক্তি ক্ষয় হব একটু এই যা। আমি চাইছি না শরীর দুর্বল করতে। যেতে দিন নয়তো ফল ভালো হবে না।
কহিনুর ছটফট করতে থাকলো কিন্তু পাথরের দৃষ্টি ওর মুখের দিকে স্থির।ও বিমোহিত মেয়েটার শুভ্র পবিত্র মুখখানার দিকে তাঁকিয়ে। হঠাৎ কিছু একটা ভেবে ওর চোখ দুটো লাল হয়ে উঠলো। মুখটা কঠিন করে বলল,
> আমার হৃদয়ের দখলদারী নেওয়ার সময় ভাবা উচিত ছিল আমি ঠিক কেমন? তুমি নিরীহ মানুষের প্রাণ নিয়ে আপরাধ করেছো নূর আমি কিছুতেই তোমাকে ছেড়ে রাখবো না। আজীবন তুমি আমার এখানে থাকবে। বাইরে যাওয়ার নাম ভূলে যাও।
পাথরের কথা শুনে কহিনুর চরম বিরক্ত। ইচ্ছা করলো হাতের ন/খ লোকটার গলা/তে বসিয়ে দিতে। সিঁকল নাড়িয়ে মুখটা কঠিন করে বলল,
>তাহলে আপনার খান সাহেবকে ডেকে উনার হাতে আমাকে তুলে দিন। নিয়ে নিক আমার প্রা/ণ। উনি তো চেয়েছেন আমার হ/ত্যা করে আমার শক্তি নিয়ে পৃথিবীতে হাজার বছর ধরে বাঁচবেন। শয়/তানের উপাসনা করবেন। এতে আপনার লাভটাও কম হবে না। মৃ/ত্যুর থেকে রক্ষা পাবেন।আমার শক্তি নিয়ে মৃ/ত্যুর পর খান সাহেব আমার শরী/রটা তুলে দিবেন নরাধম আধারের হাতে। ওরা আমার পবিত্র শরীরে খারাপ আত্মর প্রবেশ ঘটিয়ে আমাকে কুলোষিত করবে। আমার নামে কুৎসা রটবে। সকলে জানবে কহিনুর হচ্ছে ধ্বং/সের নাম। মানব সভ্যতার হুমকির কারণ। নিয়ে আসুন আপনার প্রিয়জনদের। ওরা তো আপনারি বংশ। নিজের পরিবারের লোকজন। স্ত্রী বলে না মেনেছেন আমাকে? তবে স্ত্রীর দিকে যখন আপনার জ্ঞাতি ভ্রাতা খারাপ নজরে তাঁকিয়ে থাকবে ভোগ করবে সেটা দেখার প্রস্তুতি নিয়ে রাখুন। আমি রাজি আছি।
কহিনুর একদমে কথাগুলো বলে থামলো। এরকম রাগ ওর আগে কখনও হয়নি। জন্ম থেকে আজ অবধি এক সঙ্গে এতগুলো কথা বলতে হয়নি। ও থামতেই পাথর ছুটে এসে ওর মুখটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো। পাথরের চোখ দুটো র/ক্ত বর্ণ ধারণ করেছে। ওতো এতকিছু ভেবে মেয়েটাকে ও আটকে রাখেনি। তবে কেনো এতোটা নোংরা কথা শুনতে হচ্ছে? পাথর চেয়েছিল কহিনুরের মুখটা শক্ত করে ধরতে কিন্তু পারলো না। হাতের মধ্যে থাকা মুখটা সামান্য ধরতেই মনে হচ্ছে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। তবুও রাগের মাথায় আঙুল বসিয়ে দিয়ে বলল,
> তোমার সাহসের সত্যি প্রশংসা করতে হয়। কিভাবে পারলে আমার সামনে এসব বাজে কথা বলতে? হৃদয় কাঁপলো না? তুমি ভালো খারাপ যায় হয়ে থাকো সেতো আমারই। বলেছিলাম না যদি বেঁ/চে থাকি তবে তুমি আমার হবে? এখন থেকে তুমি শুধুমাত্র আমার একান্ত নিজের। কেউ তোমার ছায়াও মাড়াতে পারবে না। এই ঘরে আমার মৃ/ত্যু অবধি তুমি ব/ন্দি থাকবে। আমার হয়ে থাকবে। তোমার শরীর মন সবখানে আমার বিচরণ থাকবে। কথাটা ভালো ভাবে মাথায় ঢুকিয়ে রাখো।
পাথরকে উন্মাদগ্রস্ত মনে হচ্ছে। আগের সরলতার বিন্দু পরিমাণ অস্তিত্ব সেখানে নেই। আছে অর্ধমানব রূপি পাথর,যার হৃদয় সত্যিই পাথর দিয়ে তৈরি। কহিনুর বিচলিত হলো না। আগে থেকেই জানা আছে এমনটা হবে। তাই মৃদু হেসে বলল,
> এই ঘরে আমাকে বন্দি করে আপনার মৃ/ত্যু পযর্ন্ত অপেক্ষা করার সৌভাগ্য আপনি অর্জন করতে পারেননি। আমি আপনার মতো অর্ধমানব নয়। আমি মানুষ। আমার যেমন জন্ম হয়েছে তেমনিভাবে মৃত্যু হবে।কিন্তু আপনি অভিশপ্ত। আপনার অভিশাপে আমার মৃ/ত্যু এমনিতেই হবে। ঠিক আপনার মায়ের মতো। বিশাল পৃথিবীতে আমি ছাড়া আপনি বেঁচে থাকবেন সঙ্গী ছাড়া। আমার কিন্তু নিজের মৃ/ত্যু নিয়ে একটুও চিন্তা হচ্ছে না। বরং মজা লাগছে। আপনি আমার বিরহের অনলে পুড়বেন। আমার মৃত্যুর পরে সৃষ্টিকর্তা ঠিক কোনো না কোনোভাবে তার সৃষ্টি থেকে খারাপ শক্তির ধ্বংস করে ফেলবেন। আমার জন্ম শুধুমাত্র আপনার জন্য হয়নি পাথর। যে আপনি ইচ্ছে করলেই আমাকে এখানে আটকে রাখবেন। আমি ইচ্ছা করলে প্রাণ ত্যা/গ করতেই পারি। আবারও জন্ম হবে আমার সেখানে আপনি থাকবেননা আমার জীবন সঙ্গী হিসেবে। ভেবে দেখুন কি করবেন। তাই আমাকে ছেড়ে নিজের জন্ম রহস্য নিয়ে ভাবুন।
পাথর দ্রুত কহিনুরের মুখটা ছেড়ে দিলো। চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো, “আমি অভি/শপ্ত, আমার জন্য তোমার মৃ/ত্যু হবে। চাইনা এমন জীবন। কে দিলো আমার মধ্যে এমন খারাপ শক্তি? আমি মুক্তি চাই মুক্তি।” কহিনুর এক দৃষ্টিতে পাথরকে দেখছে। লোকটার উপরে কালো শক্তির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। পুরোপুরিভাবে না পড়লেও হালকা প্রভাব তো পড়বেই। অভিশপ্ত জীবন ওর। পূর্বপুরুষের চিহ্ন বহণ করছে এইটুকু তো হবেই। কহিনুর চোখ বন্ধ করে ফেললো। এ কেমন জীবন ওর। কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছেড়ে কিভাবে লোকটাকে ভালোবেসে নিজের করে নিবে? সম্ভব নয়। কিছুতেই না হোক সে স্বামী। সৃষ্টির থেকে সত্যি কিছু নেই। মানুষের সঙ্গে মানুষের ছাড়া অপ্রকৃতিস্থ কিছুর মিলন সম্ভব নয়। কহিনুর নিজেকে শক্ত করে বলল,
> একা থাকতে চাই এইটুকু নিশ্চয়ই আশা করতে পারি? সাঈদ বাইরে ঘুরছে। আমার জন্য ওর কিছু হলে নিজেকে ক্ষমা করা সম্ভব হবে না।
কহিনুরের কথা শুনে পাথর উত্তর দিলো না। চুপচাপ উঠে চলে আসলো বাইরে। মনের উপর দিয়ে ঝড় চলছে। নিজের পরিচয় জানাটা ওর কাছে খুব জরুরী। খান সাহেবের মুখোমুখি হতে হবে। কথাটা ভেবে ও বেরিয়ে পড়লো খান ভিলার উদ্দেশ্যে।
****************
নিস্তব্ধ কক্ষে বসে আছে অধরা। মন মেজাজ ভালো নেই। জুবায়েরের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ। মেয়ের খোঁজ পাচ্ছে না। ফোন করেছিল সাঈদ মিনমিন করে কি সব বলে রেখে দিয়েছে। অধরা জানে ছেলেটা কিছু লুকানোর চেষ্টা করছে। ইচ্ছে করছে মেয়েকে নিয়ে বহুদূরে চলে যেতে। সেখানে সুলতান বা খান পরিবার কারো অস্তিত্ব থাকবে না। জীবনে একটু যদি সুখের মুখ দেখেছে তবে দুঃখ এসেছে তার ডাবল হয়ে। এভাবে আর কতদিন? কিছুক্ষণ আগে জুবায়ের দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে ছিল হয়তো ফিরে গেছে। অধরা শাশুড়ির রুমটাতে আছে। কতদিন আসা হয়নি। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ও জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। এই রুমের কোনো বেলকনি নেই। আছে বিশাল দুটো জানালা। আনমনে জঙ্গলের দিকে তাঁকিয়ে ও ভ্রু কুচকে ফেলল। সাদা পাঞ্জাবী পড়ে কেউ একজন সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পেছন থেকে দাদুর মতোই দেখতে। অধরা অপেক্ষা করলো না। দ্রুত কক্ষ থেকে বেরিয়ে পড়লো। লম্বা বারান্দা ধরে হাঁটতে হাঁটতে পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে দৌড়ে গেলো জঙ্গলের দিকে। দাদু বেশি দূরে যেতে পারেনি। অধরা লোকটার পিছু নিলো। একটা দুপা করে ওরা গহীন অরণ্যে প্রবেশ করলো। আকাশে চাঁদ আছে। গাছের ফাঁক দিয়ে আলো এসে পড়ছে মাটিতে। আবছা আধার । কিছুদূরে গিয়ে অধরা থমকে গেলো রুমঝুম নুপুরের শব্দে। দূরে একটা গাছের নিচে দাদুও থমকে গেছে। নুপুর আর কাচের চুড়ির রুমঝুম ছন্দে মুখোরিত আরণ্য। অধরা ভ্রু কুচকে আছে। কিছুটা ভয় আর উত্তেজনাই শরীর মৃদু কাঁপুনি দিচ্ছে। অধরার ধ্যান ভাঙলো হঠাৎ সাদা পোশাকের এক রমনির আগমনে। মেয়েটার কোমর অবধি কুকড়ানো চুল।পরণে ভারি অলঙ্কার আর চাওয়া লাল পেড়ে সাদা শাড়ি। দেখে রানীর মতোই লাগছে। মেয়েটা ঝঙ্কার দিয়ে হেসে ছমছম নুপুরের আওয়াজ ফেলে দাদুর নিকটবর্তী হয়ে দাঁড়ালো। তারপর কিছুটা দুরুত্ব রেখে বলল,
> এসেছো প্রিয়? তোমার জন্য আমি উতলা হয়ে আছি। আমাকে পূণরায় ফিরিয়ে নিবে না তুমি বলো?
অধরা দাদুর মুখটা দেখতে পারছে না। পেছনের দিকটাই দেখলো। উত্তরটাও শুনতে পেলো না। হঠাৎ পেছনের দিকে কিছুর আওয়াজ পেয়ে ও চমকে গিয়ে পেছনে ফিরে আবার সামনে তাঁকিয়ে হতবাক। সেখানে কেউ নেই। নির্জন অরণ্য। হঠাৎ ওর পা ভারি হয়ে উঠলো। মনে হলো কেউ ওকে ঝাপটে ধরে র/ক্ত খেয়ে নিবে। অধরা আজ মায়ের কালো শাড়িটা পরেছে। আচলটা ঘোমটার মতো করে পেছনে ফিরে আরেক দফায় চমাকে উঠলো। পেছনে জুবায়ের দাঁড়িয়ে আছে। অধরা বুঝলো একে দেখেই দাদু আর সেই মহিলা অদৃশ্য হয়ে গেছে। সব রাগে গিয়ে পড়লো জুবায়েরের উপরে। অধরা গটগট করে জুবায়েকে পাশ কাটিয়ে চলে আসতে চাইলো কিন্তু হলো না। জুবায়ের ওর হাতটা টেনে ধরে নিজের কাছে নিয়ে নিলো। মুখটা করুণ করে কমল কন্ঠে বলল,
> সরি বলছি তো তবুও ক্ষমা করবে না? কি করলে ক্ষমা করবে বলো তাই করবো।
অধরা ওকে ছাড়িয়ে দিয়ে উত্তর দিলো,
> আপাতত নিজের মতো থাকতে চাই। আমাকে ফলো করা বন্ধ করুন। এইটুকু করলেই কৃতজ্ঞ থাকবো।
কথাটা বলে ও পা বাড়ালো। জুবায়ের চোখ বন্ধ করে নিজেকে গা/লি দিলো। নিজের মৃ/ত্যু কামনা করলো। এমন ভয়ংকর শাস্তির চাইতে মৃ/ত্যু ভালো মনে করলো। তারপর অধরা একা ভেবে ওর পিছু নিলো। পেছনে পড়ে থাকলো হাজার বছরের রহস্যের পাতা।
**************
খান সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে আছে পাথর। চোখে হাজারো প্রশ্ন। কিন্তু খান সাহেব খুব স্বাভাবিক। হয়তো জানতো এরকমটা হবে। নীরবতা কাটিয়ে পাথর প্রশ্ন করলো,
> আমার পরিচয় কি আপনি জানেন? কি কি জানেন বিস্তারিত বলুন প্লিজ।
খান সাহেব পাথরের কাধে হাত রেখে বলল,
> সম্পর্কে আমি তোমার দাদু,কথাটা বিশ্বাস হয় তোমার? যদিও আমার ছেলে আর বউমা জীবিত নেই। আমি তো জানতাম না তোমার কথা। যখন তোমার মধ্যে আমাদের বংশের চিহ্ন দেখলাম তখন বুঝলাম তুমি আর কেউ না আমারই র/ক্ত। সেদিন ওই নিষ্ঠুর মেয়েটা তোমাকে মে/রে ফেলতে চেয়েছিল কিন্তু আমি তোমাকে কিভাবে ম/রতে দিতে পারি বলো? ও যে আমাদের শত্রু। ওর জন্য তোমার চাচুরা আজ পরিবার ছাড়া হতে চলেছে। আমাদের উপরে এক অভি/শাপের জন্য আমরা নারীদের এড়িয়ে চলি। আমরা পবিত্র কিন্তু ওই মেয়ে আমাদের কোলোষিত করতে চাইছে। ধ্বং/স করতে চাইছে আমাদের। তুমি ওকে আমার হাতে তুলে দাও পাথর।
খান সাহেব পাথরকে নিজের মতো বুঝিয়ে দিলো। পাথর সেসব শুনোলো কি বোঝা গেলো না তবে বিড়বিড় করে বলল,
> ও আমার স্ত্রী দাদু। আমার বেঁচে থাকার কারণ। ওকে আগলে রাখার শপথ নিয়েছি। ওর জন্য দরকার হলে নিজের অভি/শপ্ত জীবনের মুক্তির পথ খুঁজবো।
পাথরের কথা শুনে দাদু চমকে গেলেনা। খান বংশের ধ্বং/স কি তবে এসে গেলো? উনি দ্রুত কণ্ঠে বললেন,
> কহিনুরের মৃ/ত্যুতেই হবে তোমার আমার মুক্তি। তাছাড়া উপাই নেই। ওকে মে/রে তবে মুক্তির পথে এগিয়ে যাও।
পাথর হাতের মুঠো শক্ত করে উত্তর দিলো,
> তবে চাইনা মু/ক্তি। এভাবেই চলুক। আমি আসছি। মনে হচ্ছে আপনি কিছু লুকিয়ে গেলেন তবে চিন্তা নেই আমি ঠিক জেনে যাবো।
পাথর উত্তরের অপেক্ষা করলো না। বেরিয়ে আসলো। পথিমধ্যে আধারের সঙ্গে দেখা হলো তবে কথা হলো না। আধার ওকে তীক্ষ্ণ নজরে দেখলো। এই ছেলেটার নামে ও হাজারটা রিপোর্ট শুনেছে। পাথর ঘৃণাতে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। কহিনুরের দিকে নজর দিয়েছে ভেবেই ইচ্ছে হলো খু/ন করতে কিন্তু পারলো না। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ফার্ম হাউজে ফিরে আসলো। কহিনুরের খাবার নিয়ে উপরে গিয়ে ও হতভম্ভ হয়ে গেলো। রক্তা/ক্ত অবস্থায় মেয়েটা পড়ে আছে ফ্লোরে। পেটে ধারা/লো খ/ঞ্জর বিঁধে আছে। পাথরের হাত থেকে থালাটা ঝনঝন করে মেঝেতে পড়ে গেলো। কি করবে দিশেহারা অবস্থা। যার শরীরে ফুলের টোকা দিতেও মায়া হয় আজ তাঁর শরীরে খ/ঞ্জর বিঁ/ধে আছে। এমন নিষ্ঠুর কাজ কে করতে পারে?
চলবে