হঠাৎ_তুমি_এলে #লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা #পর্ব-২৪,২৫

0
491

#হঠাৎ_তুমি_এলে
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-২৪,২৫

কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে রইলাম।কারণ চা টা এত তেঁতো ছিল যে মুখে বর্ণণা করার মত কোন শব্দ পাচ্ছি না এখন।আমি তো আমার শত্রুকেও কোনদিন এ চা খাওয়াব না।কারণ এ চা খেলে তেঁতোর চুটে যে কেউ অক্কা পাবে। ঝিম ধরে মনে মনে ভাবতে লাগলাম কোন ক্লাসে জানি পড়েছিলাম

“তিতুমীর তেঁতো ঔষধ খেত অনেক আনন্দ করে।”

আজকে তিতুমীর যদি বেঁচে থাকত আর এ চা খেত তাহলে সেও ওয়াক করে ফেলে দিত।আমার ঝিম ধরে বসে থাকা দেখে আঙ্কেল বলল

“কী হয়েছে বাবা? কোনো সমস্যা?”
“নাহ আঙ্কেল এমনিতে। ”
“আচ্ছা তুমি চা খাও।আমি একটু রুমে গিয়ে বিশ্রাম নিই।চা খাওয়া শেষ হলে চলে যাওয়ার সময় আমাকে বলে যেও।আমার মাথাটা কেমন জানি ব্যাথা করছে।”

আমি আঙ্কেলকে আমার বুকের ব্যথা কী করে বুঝায়।আঙ্কেল চলে গেলে এ চা রূপা আমাকে পুরোটা খাওয়াবে।মনে মনে বলতেছিলাম দয়াকরে যাবেন না।কিন্তু আমাকে তো ভদ্রতা বজায় রাখতে হবে।তাই নিজেকে সামলিয়ে মুখে একবিন্দু মিথ্যা হাসি এনে বললাম-

“আচ্ছা আঙ্কেল যান।একটু বিশ্রাম নিলেই মাথা ব্যথা কমে যাবে।আর যদি না কমে তাহলে একটা নাপা ট্যাবলেট খেতে পারেন।”
“নাহ বাবা ট্যাবলেট লাগবে না।সারাদিন অনেক কাজ করেছি তো একটু বিশ্রাম নিলেই চলে যাবে।”

বলেই আঙ্কেল চলে গেল।আর এদিকে রূপা এসে আমার সন্মুখে বসল।খুব অসহায় লাগছিল তখন।চাতক পাখির মতো অসহায় চিত্তে রূপার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললাম-
“আজকে শরীরটা ভালো লাগছে না।এ চা টা আজকে খেতে পারছি না।কিছু মনে করো না।কষ্ট করে বানিয়েছ এতেই আমি খুশি।”
“কেন খাবে না শুনি?আমি এত কষ্ট করে তোমার জন্য কালোজিরা দিয়ে স্পেশাল চা বানিয়েছি তুমি না খেলে হবে নাকি?এখনি খাও।এ চা খেলে একদম মন মেজাজ ফুরফুরা হয়ে যাবে।না খেলে খবর আছে।”

এ বলে রূপা আমার দিকে তেড়ে আসার উপক্রম।চা তেঁতো হওয়ার কারণটাও বুঝলাম এখন।কালোজিরার স্পেশাল চা।বাপ জনমেও এমন চায়ের রেসিপি শুনি নি।আমি চুপ হয়ে বসে রূপাকে সামাল দেওয়ার জন্য চা টা নিয়ে নাক চেপে এক চুমুকে পুরোটা সাবাড় করে ফেললাম।খাওয়ার পর মনে হচ্ছিল চোখটা বেশ ঝাপসা লাগছে।মাথাটাও বেশ ঘুরপাক খাচ্ছে।উপরে পাখার দিকে তাকিয়ে মনে হলো পাখাটা উল্টো ঘুরছে।সেই সাথে কেমন জানি হেঁচকি আসছে।তবে হেঁচকিটা গলাতেই আটকে রইল।ঝাপসা চোখে রূপার দিকে তাকিয়ে দেখলাম রূপা হাসছে।রূপার হাসিটা দেখে মনে স্বস্তি পেলাম।তার মানে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছুই ঘটছে না।এর মধ্যে কী যে হল জানি না।হুট করে চোখ মেলে মোবাইলটা হাতে নিয়ে নিজেই চমকে গেলাম।খেয়াল করলাম রাত আটটা বাজে।অথচ আমার রূপার বাসা থেকে বিদায় নেওয়ার কথা ছিল সন্ধ্যা ছয়টায়।দুই ঘন্টা কী করে পার করলাম ব্যাপারটা বেমালুম ভুলে গেলাম।এর মধ্যেই আমার প্রিয়তমা রূপার আগমণ। রূপা এসে বলল
“অরন্য ঘুম কেমন হয়েছে তোমার? বলেছিলাম না চা টা খেলে একদম ঠিক হয়ে যাবে। চা টা খেয়েছ বলেই ফ্রেশ একটা ঘুম দিতে পেরেছ। তোমার তো একদম সাড়া শব্দ ছিল না। কতবার ডেকেছি তোমাকে। এত ভালো ঘুম হয় এ চা টা খেলে বুঝতে পারি নি। এখন একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলে ফেলি কী বলো?”

রূপার কথা শুনে বুঝতে পারলাম যে রূপার স্পেশাল চা টা খেয়ে আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম।আর আমার প্রিয়তমা ভেবেছিল আমি আরাম পেয়ে অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছি।হায়রে এ কোন উভয় সংকটে পড়লাম।একদিকে রূপার চা অন্যদিকে রূপা।নিজের কষ্ট বুকে চেপে রূপাকে হাসি মুখে বললাম
“হ্যাঁএবার চাইলেই তুমি একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলতে পারো।অনেক ভালো হবে।যাদের ঘুম হয় না তারা তোমার স্পেশাল চা খেয়ে ঘুমাতে পারবে।”

রূপা একটু হাসি দিয়ে নীচে তাকাল।বুঝায় যাচ্ছিল প্রশংসা শুনে বেশ লজ্জা পাচ্ছিল।

“মেয়েদের একটা স্বাভাবিক বৈশিষ্ট হচ্ছে তাদেরকে যদি কেউ প্রশংসা করে তাহলে তারা সেটা সহজে বিশ্বাস করে নেয় হোক সেটা সত্যি অথবা মিথ্যা।মেয়েদের পটানোর একটা বড় অস্ত্র হচ্ছে প্রশংসা।তবে মাত্রা অতিরিক্ত প্রশংসা মেয়েদের হজম হয় না।”

রূপার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটল।একটু প্রশংসা পেয়ে একদম লজ্জায় লাল হয়ে গেল রূপা।

“মেয়েদের লজ্জা মাখা মুখটা দেখতে অনেকটা ফুটন্ত গোপালের মতো।মেয়েদের চেহারায় তার সৌন্দর্য তখনেই ফুটে উঠে যখন মেয়েরা লজ্জা পায়।লজ্জা মেয়েদের দেয় এক অদ্ভূত সৌন্দর্যের ছোঁয়া।”

রূপার দিকে কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রূপার লজ্জা মাখা মুখটা অবলোকন করলাম।অতঃপর মনে মনে ভাবলাম এখনেই উত্তম সময় রূপার স্পেশাল চা পুনরায় খাওয়ার আগে কেটে পড়া।যে ভাবনা সে কাজ। রূপাকে বললাম-

“রূপা আমি এবার গেলাম।অনেক সময় পার করে ফেলেছি।এখন বাসায় গিয়ে কাজ করতে হবে।কালকে সকালে আবার ডিউটি আছে।”

আসার জন্য বের হতে নিলে রূপা হাতে দুইটা বাটি দিয়ে বলল-
“এখন আর গিয়ে কষ্ট করে রান্না করে খেতে হবে না। টিফিন বাটিতে খাবার দিয়ে দিয়েছি।খেয়ে নিও।”

রূপার এ বিষয় টা আমার খুব ভালো লাগে।কী করে জানি রূপা সব বুঝে ফেলে।

“মেয়েরা এক মায়ার চাঁদর।সে তার মায়ার চাঁদরে সব আগলে রাখতে পারে।মায়া দিয়ে সে বিশ্ব জয় করতে পারে।নরীর মায়ার কাছে সবকিছু পরাজিত হতে বাধ্য।”

রূপার শত পাগলামির মধ্যেও আমাকে সে তার মায়ার চাঁদরে জড়িয়ে রাখে।সব ভুলে গেলেও আমার কখন কী লাগবে সে ঠিকেই বুঝে যেত।আমি টিফিন বাটিটা নিয়ে রূপার বাসা থেকে হাঁটতে হাঁটতে আমার বাসায় আসলাম।বাসায় এসে বাটি দুটো খুলার পর খাবারের গন্ধে মনটা ভরে গেল।রূপার হাতের রান্নার স্বাদেই আলাদা। রূপার স্পেশাল চা ব্যতীত রূপার হাতের রান্না যে কেউ চেটেপুটে খাবে।আমি বাটিতে খেয়াল করলাম গরুর মাংসের ভুনা করে দিয়েছে।খাওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে বাটিটা খুলেই সাথে সাথে খেতে বসে পড়লাম।খাওয়ার সময় রূপা কল দিয়ে বলল-

“আরে ইয়ার তোমাকে তো আমি স্পেশাল আরেকটা চা বানিয়ে বোতলে করে রেখেছিলাম দিতে ভুলে গিয়েছি। ”

রূপার স্পেশাল চায়ের কথা শুনে আমার খাবার গলায় আটকে উঠল।ভাত মনে হয় খাদ্য নালি দিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে পথ ভুলক্রমে শ্বাস নালিতে চলে গিয়েছে।নাকে মুখে দিয়ে ভাত বের হওয়ার অবস্থা হলো।ফলে আমি জোরে জোরে কাশি দিতে লাগলাম।রূপা কাশির শব্দ পেয়ে বলল-

“অরন্য পানি খাও তাড়াতাড়ি। এভাবে মুখে ভাত নিয়ে কেউ কথা বলে নাকি।খাবার টা শেষ করে কলটা ধরবে তো, কী যে করো না।এখনেই পানি খাও।”

আমি পানি খেয়ে একটা দম নিলাম।মনে মনে ভাবলাম ভালোই হয়েছে ভুলে গিয়েছে।না হয় ভিডিও কল দিয়ে আমাকে খেতে বলত।যে পাগল মেয়ে।মনে মনে একটু খুশি হলাম যে রূপা চা টা দিতে ভুলে গিয়েছে।রূপাকে এখন স্বাত্ত্বণা দেওয়া দায়িত্বের মধ্যে পড়ে গিয়েছে।রূপাকে স্বাত্ত্বণা দিয়ে বললাম

“রূপা থাক না তোমার স্পেশাল চা আর দিতে হবে না।তুমি যে আমার জন্য খাবার দিয়েছ এটাই অনেক।আজকে না হয় ঐ স্পেশাল চা টা তুমিই খেয়ে নাও।”

বুঝতেই পারছিলাম রূপার মনটা খুব খারাপ সে চা টা না দিতে পেরে।তাই ভারী গলায় মন খারাপ করে বলল-

“কী যে বলো না তুমি তোমার জন্য বানিয়েছি। এ চা কী আমার গলা দিয়ে নামবে।আমি চা টা রেখে দিচ্ছি তুমি কালকে আসলে খেতে দিব।না হয় তোমার বাসায় সকালে নিয়ে আসব। ”

কালকে আবার স্পেশাল চা খেতে হবে সেটা শুনেই আমার গলায় আবার ভাত আটকাল।আবার কাশি দিতে দিতে বললাম
“এখন রাখি খাওয়া শেষ করে কল দিব। ”

কালকে আবার রূপার স্পেশাল চা খেতে হবে এটা ভেবেই কান্না পচ্ছিল।তবুও নিজেকে সামলে খাওয়া শেষে রূপার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে ঘুমিয়ে গেলাম।সাকালে উঠে নাস্তা তৈরী করে খেয়ে বের হয়ে গেলাম হাসপাতালের উদ্দেশ্য।ভাগ্য ভালো রূপা তার স্পেশাল চা নিয়ে আসে নি।মনে মনে শুকরিয়া করতে করতে হাসপাতালে গেলাম।ডিউটি করতে লাগলাম মাঝে মাঝে রূপার সাথে কথা সব মিলিয়ে ভালোই যাচ্ছিল দিনটা। এর মধ্যে বিসিএস রেজাল্ট দিল আমি বিসিএসে টিকেও গেলাম।রূপাকে প্রথম খবরটা দিলাম।রূপা খবরটা পেয়েই বলল-

“তোমাকে আজকে আমি স্পেশাল চা খাওয়াব৷ কাজ শেষ করে বাসার মোরে এসে আমাকে কল দিও।আমি চা সাথে নিয়ে আসব আর সরাসরি তোমার বাসায় যাব।”

স্পেশাল চায়ের কথা শুনে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হল।সে সময় আমি সবে মাত্র পানি মুখে দিয়েছিলাম।তাই পানিটা স্পেশাল চায়ের কথা শুনে নাকে মুুখে দিয়ে বের হচ্ছিল।মনে হচ্ছিল এখনেই বেঁহুশ হব আমি।কিন্তু সে সুযোগ দিল না আমার প্রিয়তমা রূপা।রূপার সুরেলা কন্ঠে বলতে লাগল

“আরে ইয়ার কথা বলছো না কেন?কখন থেকে হ্যালো হ্যালো করেই যাচ্ছি।কথা তো বলো।কি হয়েছে অরন্য?”

আমি বেঁহুশ হওয়ার উপক্রম থেকে নিজেকে হুঁশে এনে বললাম
“নাহ রূপা তেমন কিছু হয় নি। তোমার স্পেশাল চা খাওয়াবে তো সেটা নিয়েই ভাবছিলাম।”

“কী ভাবছিলি শুনি?”
“ঐ যে তোমার চা কত মজা। তুমি ইউটিউব চ্যানেল খুললে একদিনেই ফেমাস হয়ে যাবা তখন আমার কি হবে এসব ভাবছিলাম।তখন যদি আমাকে ভুলে যাও।”
“কী যে বলো না। তবে আজকের চা টা খেলে তুমি সত্যিই বুঝবা আমি কত ভালো চা বানাই।”

রূপার কথা শুনে মনে মনে ভাবতে লাগলাম সে তো আমি হারে হারে টের পাচ্ছি।ইউটিউব চ্যানেল খুললে আর ফেমাস হওয়া লাগবে না ভাইরাল হবে আর কী। আস্তে আস্তে এসব বিড়বিড় করতে লাগলাম।এমন সময় রূপা চেঁচিয়ে উঠল

“সমস্যা কী অরন্য কতক্ষণ পরপর একদম চুপ হয়ে যাচ্ছ।কথা বলছো না কেন? ”

রূপার চেঁচামেঁচিতে হতচকিয়ে নিজেকে স্থির করে বললাম-
“আচ্ছা সন্ধ্যায় আমি মোরে আসব। আগেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। আমি কল দিলে এসো।”
“আচ্ছা এখন রাখি।আমি আমার স্পেশাল চা টা বানাই আগে।”

আমি অসহায় গলায় বললাম আচ্ছা।এ মুহূর্তে আবরার এসে আমার পিঠে একটা চাপর দিয়ে বলল-

” কী রে ট্রিট কোথায়?তোর রেজাল্ট দেওয়ার পর তোকে খুঁজে পাওয়ায় যাচ্ছে না। ইদানিং অনেক ব্যস্ত মনে হয়।আমাকে তো একদম ভুলে গিয়েছিস।ঐ মেয়েটাকে নিয়ে বেশ ঘুরাফেরা হচ্ছে।ব্যপার কী শুনি।”
“মেয়েটাকে ভীষণ ভালো লাগে।”
“এখন তো চাকুরি পেয়ে ফেলেছিস এখন না হয় বিয়েটা করে ফেল।কথা বলা লাগলে বলিস।তোর তো কোনো অভিভাবক দেশে নেই।আমার বাবা, মা না হয় তোর অভিভাবক হয়ে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেল।”

আমি আবরারের এমন কথা শুনে একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম।কারণ যে আমি মেয়েদেরকে তেমন দেখতে পারতাম না সে আমি আজকে একটা মেয়েকে এত ভালোবাসি ভাবলেই যেন নিজেকে অচেনা লাগে।আবরারের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললাম-

“আমি রূপার সাথে কথা বলে তোকে জানাব।আর ট্রিট না হয় একবার বিয়েতেই দিব।”
“ট্রিট ফাঁকি দিলে কিন্তু বিয়ে হবে না।”

এ বলে আবরার হাসতে হাসতে ডিউটিতে চলে গেল।এদিকে আমি সবকাজ শেষ করে সন্ধ্যার দিকে রূপার বাসার মোরে গিয়ে রূপাকে কল দিলাম।কল দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই রূপা হাজির।রূপার হাতে একটা বোতল দেখেই বুঝতে পারছিলাম এটা রূপার স্পেশাল চা।রূপা এসেই আমাকে কানে একটা আকস্মিক চিৎকার দিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা করল।আমি তার আকস্মিক চিৎকারে বাধ্য ছেলের মতো ভয় পাওয়ার অভিনয় করে বললাম-

“ওরে আল্লাহ্ কী করো।অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”

এ মিথ্যা ভয় পাওয়ার পেছনে একটা সরল কারণ ছিল রূপার হাসি।এ কথাটা বলার পর রূপা একটা অট্ট হাসি দিবে আর আমি সেটা অবলোকন করব এটাই আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল।ঠিক যা ভেবেছিলাম তাই হয়েছে।রূপা আমার কথা শুনে একটা হাসি দিল আর আমি সে হাসিটা দৃষ্টিপাত করছিলাম।খানিকক্ষণ হেসে রূপা আমার চোখের সামনে আঙ্গুল দিয়ে তুড়ি বাজিয়ে বলল-

“আরে ইয়ার এভাবে তাকিয়ে আছ যে কোথায় হারিয়ে গেলে।”

আমি রূপার তুড়ির আওয়াজ শুনে বাস্তবে ফিরলাম রূপার হাসির সাথে সাথে যেন আমি সবসময় স্বপ্নের রাজ্যে চলে যাই।এবারও তার ব্যতিক্রম হল না।বাস্তবে ফিরে এসে রূপাকে বললাম-
” নাহ ঐরকম কিছু না।তবে তোমাকে তো তোমার বাবা সন্ধ্যার পর বের হতে দেয় না।আজকে বের হলে কীভাবে?”

রূপা আমার হাতে একটা চিমটি কেটে বলল

“ঘুমের ঔষধ আছে কী জন্য?বিকেলের চা এ একটা কড়া ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দিয়েছি।আজকে রাতে আর উঠতে পারবে না। চলো এবার তোমার বাসায় চলো।”

এ পাগলিটাকে যে কবে মানুষ হবে কে জানে।অদ্ভুত অদ্ভুত কান্ড করে বসে।আমি বিস্ময়কর দৃষ্টিতে রূপার দিকে তাকিয়ে বললাম-
” চলেন মহারানী এবার চলেন। কবে যে মানুষ হবে আর পাগলামি কমাবে আল্লাহ্ মালুম।”

রূপা আমার পাশ থেকে আমার সম্মুখ বরাবর এসে আমার চোখে চোখ রেখে বলল-

“কেন আমার পাগলামি কী তোমার ভালো লাগে না?
রূপার দিকে তাকালে কেন জানি না আমার সকল বিরক্তি চলে যায়।কেন জানি না আমি ওর চোখে ভালোবাসার ছন্দ খুঁজে পাই।”

“ট্রেনের বগি যেমন একটার সাথে আরেকটা সংযুক্ত হয়ে ঝিকঝিক করে ছন্দাকারে যেতে থাকে।তেমনি রূপার চোখের দিকে তাকালে আমার ভালোবাসার ট্রেনটা ঝিকঝিক করে চলতে থাকে”।

রূপার চোখের মায়া কাটিয়ে উঠা অনেক কঠিন।

” মেয়েরা যে মায়াবতী হয় সেটা তাদের চোখের প্রমাণ দেয়।”

রূপার চোখের দিকে তাকিয়ে রূপার প্রতি কোন অভিযোগ আসলো না।রূপাকে শান্ত গলায় বললাম –

“পাগলিটার এ পাগলামিগুলোই তো আমার বেশ ভালো লাগে।”

রূপা একটু হাসি দিয়ে আমার সম্মুখ থেকে সরে পুনরায় পাশে দাঁড়িয়ে বলল –
” এজন্যই তো আমি এত পাগলামি করি।”
পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বাসায় চলে আসি।রূপা বাসায় এসেই তার স্পেশাল চা আমাকে দিয়ে বলল-
“নাও এবার এটা খাও।”

রূপার স্পেশাল চায়ের কাপটা দেখেই আমার কেন জানি গা গুলাতে লাগল বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল তবুও নিজেকে সামলিয়ে রূপার হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে ভয়ে ভয়ে চায়ে চুমুক দিলাম।চায়ে চুমুক দেওয়ার সাথে সাথে চমকে গেলাম।এত মজার চা আমি কখনও খেয়েছি বলে মনে হয় না।চায়ে চুমুক দিয়ে রূপার দিকে তাকালাম।রূপা একটা দুষ্ট হাসি দিয়ে বলল-

“এবার বলো আমার ইউটিউব চ্যানেল খুললে কেমন হবে।আমি কেমন চা বানায় বলো।”

আমি বুঝতে পারছিলাম রূপা আমার সাথে চা নিয়ে একটা মজা করেছে। রূপার অভ্যাসেই এমন মজা করা।আমি বেশ শান্ত গলায় রূপাকে বললাম-

“তার মানে তুমি আমার সাথে মজা করেছ?এটা করা কী ঠিক হয়েছে। কী বিদঘুটে স্বাদের চা তুমি খাইয়েছো আমাকে তোমার কোনো ধারণা আছে?”

রূপা আমার কথা শুনে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়ে বলল-
” ইচ্ছা করেই এমন চা বানিয়েছিলাম।”

এটা শুনার পর আমি একটা বালিশ নিয়ে রূপার দিকে তেড়ে গেলাম আর রূপা দৌড় দিয়ে বেলকনিতে চলে গেল।বেলকনি তে গিয়ে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।মনে হয় বাইরের আকাশটা রূপার ভালো লেগে গিয়েছে।না হয় এমন দৌড়ে গিয়ে চুপ হয়ে থাকার মেয়ে রূপা না।বাইরে থেকে বাতাসে রূপার খোলা চুল গুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে।আমি বালিশটা হাত থেকে ফেলে রূপার দিকে এগিয়ে গেলাম।খেয়াল করলাম রূপা বেলকনির গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে।বাইরে থেকে হালকা বৃষ্টিফোঁটা বেলকনির গ্রিল দিয়ে আসছে।আমি রূপার কাছে গিয়ে রূপার হাত দুটোর উপর হালকা হাত দিতেই রূপা আমার বুকে মাথা এলিয়ে দিল।আমি রূপা

“কী দেখছো ঐ আকাশের দিকে।”

রূপা তার মাথাটা আমার বুকে এদিক ওদিক হেলাতে হেলাতে বলল-
“আকাশটা অনেক সুন্দর লাগছে না? সত্যি বলতে

“আকাশের বিশালতা অনুভব করা অনেক কঠিন ব্যপার।কিন্তু আকাশের দিকে তাকালেই এর গভীরতায় নিমিষেই হরিয়ে যাওয়া যায়।জানো অরন্য ভালোবাসাটাও ঠিক একরমেই।ভালোবাসাটা শব্দটা চারটা অক্ষরের হলেও এর বিস্তৃতি অনেক।ভালোবাসার বিস্তৃতিটা একবার উপলব্ধি করতে পারলে খুব সহজেই ভালোবাসার গভীরে ডুবে যাওয়া যায়।”

রূপার হাতটা শক্ত করে গ্রিলে চেপে ধরে বললাম-
” আজকে কী কবি হয়ে গেলে নাকি এত সুন্দর করে ছন্দাকারে কথা বলছো যে।”

রূপা আমার হাতে স্পর্শ পেয়ে আমার বুকে তার মাথাটা আরও চেপে ধরে বলল-
“অরন্য একটা কথা বলব। ”
“হ্যাঁ বলো কী বলতে চাও। অনুমতি নেওয়ার কী আছে?”
“চলো এখন বিয়ে করে ফলি।আমার লুকিয়ে বিয়ে করার খুব ইচ্ছা।লুকিয়ে বাবাকে ফাঁকি দিয়ে সংসার করার অনেক ইচ্ছা।”

রূপার আকস্মিক এমন বিয়ের কথা শুনে একটু চমকে গিয়ে বললাম –
“ধুর পাগলি কী যে বলো না।লুকিয়ে কেন বিয়ে করতে হবে।তুমি চাইলে আমি আবরারের বাবা মা কে আমার অভিভাবক হিসেবে তোমার বাবার কাছে কালকেই পাঠাব।”
“আমার ভীষণ ইচ্ছা লুকিয়ে বিয়ে করার চলো না এখন বিয়ে করে ফেলি।”
“রাত আট টা বাজে এখন কীভাবে বিয়ে করব।কালকে সকালে করি?”
” তোমার বন্ধু আবরারকে বলো কাজী অফিসে আসতে।আর আমি আমার একটা ছেলে বন্ধু আছে ওকে বলতেছি।ওরা সাক্ষী হবে তারপর তুমি আর আমি বিয়ে করে ফেলব। ”

রূপার একরোখামি যখন উঠেছে তখন সেটা বিয়ে না করার আগ পর্যন্ত নামবে না বেশ ভলোই বুঝতে পারছিলাম।রূপার কথা মতোই আবরারকে আসতে বললাম।আবরার অবশ্য রূপার সম্পর্কে ভালোই জানে।রূপা কেমন স্বভাবের সেটাও জানে।তাই এরকম আকস্মিক বিয়েতে আবরার তেমন চমকায় নি।দুজন সাক্ষী নিয়ে কাজী অফিসে গেলাম।
অবশেষে রূপা আর আমি রাত নয়টায় বিয়ে করে আবরার আর রূপার বন্ধুকে বিদায় দিয়ে আমার বাসায় আসলাম।ভালোবাসার মানুষটাকে সারাজীবনের জন্য এক বন্ধনে আবদ্ধ করে নিলাম।এ ছিল আমাদের প্রেমিক-প্রেমিকা থেকে স্বামী -স্ত্রী হওয়ার গল্প।

তারপর শুরু হয় আমাদের নতুন গল্প।সেদিন রাতে রূপা আর আমি বেলকনিতে অনেক সময় কাটিয়েছি।অদ্ভুত সুন্দর মায়া ভরা একটা রাত ছিল।চারদিকে ধমকা বাতাস বইতেছিল।আর রুপা আমার বুকে তার মাথা হেলিয়ে আকাশটার বিশালতায় মিশে যাওয়ার চেষ্টা করছিল।আমি রূপার কপালটা আমার কাছে এনে একটু ভালোবাসার স্পর্শ একে দিলাম।নিমিষেই রূপা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।রূপা ঠিকেই বলেছিল ভালোবাসটা উপলব্ধি করলে সত্যিই এর গভীরে হারিয়ে যাওয়া যায়।আমিও কিছুক্ষণের মধ্যে রূপার ভালোবাসার গভীরতায় ডুবে গেলাম।রূপার সাথে একদম মিশে গেলাম।দীর্ঘ নিঃশ্বাস গুলো যেন ভালোবাসার সাক্ষী দিচ্ছিল।কখন যে ভালোবাসার চাঁদরে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম খেয়াল নেই।সকালে রূপার ধাক্কায় ঘুম ভাঙ্গল।ঘুম থেকে রূপাকে অদ্ভুত বেশে দেখে চমকে গেলাম।সত্যিই বুঝি না এ মেয়ের মনে কী চলে।

#পর্ব-২৫

খেয়াল করলাম রূপা আমার শার্ট কেটে কিরকম জানি অদ্ভুত একটা জামা বানিয়ে পরে আছে। জামার ডিজাইনটা কীভাবে বর্ণণা করলে সেটা সঠিক ভাবে উপস্থাপন হবে তা বুঝতে পারছি না।রূপার এরকম তাজ্জব জামা দেখে যতটা না চমকে গিয়েছিলাম তার চেয়ে বেশি হাতাশ হয়েছিলাম রূপা আমার পনেরশ টাকা দিয়ে কেনা নতুন শার্ট টা কেটে ফেলেছে।রূপাকে দেখে হতাশ হয়ে বললাম-

“আমার শার্টের এ দশা করলে কেন?বেচারা শার্টটাকেও তোমার অত্যাচার থেকে রেহাই দিলে না?”

রূপা আমার কথায় রাগ হয়ে গাল ফুলিয়ে বসে রইল।মেয়েটার এ এক বাজে অভ্যাস কিছু বললেই গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে।যতক্ষণ না ওর প্রশংসা করব ততক্ষণ এ গাল ফুলানো বহাল থাকবে।রূপার গাল ফুলানো দেখে আস্তে করে রূপাকে ধরে বললাম-

“আরে পাগলি তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে।শুধু শুধু গাল ফুলিয়ে বসে আছ কেন?”

কথাটা বলার সাথে সাথে রূপার গালে একটা হাসি ফুটে উঠল।

“মেয়েরা একটা আবেগের খনি।যখন কেউ একটু ভালোবাসা ছুয়ে দেয় তখন সে খনি বিগলিতে হয়ে হাসি হয়ে মুখে ভেসে উঠে।”

রূপার হাসিমাখা মুখটা দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম।ঠিক তখন রূপা আমার সামনে হাত দিয়ে তুড়ি বাজাতে বাজাতে বলল-

“আরে ইয়ার এভাবে কী দেখছো।আমাকে এখনেই যেতে হবে।না হয় বাবা ঘুম থেকে উঠে আমাকে না দেখলে ঝামেলা করবে।”

এবলে রূপা তড়িগড়ি করে ঝড়ের বেগে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কাপড় পাল্টে চলে গেল।রূপা চলে যাওয়ার পর রেখে যাওয়া ছেড়া শার্টটা হাতে নিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম।বাসায় গিয়ে আমাকে কল দিয়ে বলল-

“অরন্য ঐ বাসাটা পাল্টাও এবার।একটা কাজ করো এখন তো তোমার হাসপাতালে যাওয়া লাগে না।চাকুরিতে জয়েনের আগে তোমার বাসায় উঠে পরো।”

রূপার কথা শুনে মনে হলো যে, সত্যিই এটা করা দরকার। এতে করে রূপাকে নিয়ে কোনো ঝামেলা হবে না।আর এ বাসায় যেকোনো সময় রূপাকে নিয়ে ঝামেলা হওয়ার সম্ভবনা আছে। তাই রূপার কথা মতোই কেয়েকদিন পর বর্তমানে যে বাসায় থাকি সে বাসাটাতেই রূপাকে নিয়ে উঠেছিলাম।রূপা প্রথম দিন উঠেই যা যা লাগবে সবকিছুর একটা তালিকা করল।রূপার তালিকা দেখে আমি হতবাক।এত বড়ো তালিকা করেছে কি বলব।আমি তালিকা দেখে রূপাকে বললাম-

“এতকিছু আনতে হবে নাকি।অল্পকিছু হলে হয় না।”
“যা আনতে বলেছি কালকের মধ্যে তাই আনবে।বাসা অর্ধেক গুছানো শেষ, বাকিটা কালকে গুছাব।এখন আমি আমার বাসায় যাব।আজকে বাবা রান্না করবে না।তাই তাড়াতাড়ি গিয়ে রান্না করতে হবে।না হয় বাবাকে না খেয়ে থাকতে হবে।”

এবলে রূপা বাসা থেকে বের হয়ে গেল।আর আমি রূপার লম্বা তালিকাটা হাতে নিয়ে ধপাশ করে শুয়ে পড়লাম।এতকিছু যে কখন নিয়ে আসব জানি না।আজকে সারাদিন চলে যাবে এসব আনতে আনতে।তার উপর কালকে যদি এসে দেখে ঠিকঠাক মতো সব আনতে পারি নি তাহলে রূপার মাথার ব্যাঁমোটা বাড়বে।আমি নিজেকে একটু শান্ত করে বাজারে গেলাম।তালিকা অণুযায়ী সব কিনে আনলাম।সারাদিন কেটে গেল আমার এসব কিনে আনতে আনতে।রাতে এসেই হালকা কিছু খেয়ে রূপার সাথে অল্প কথা বলে ঘুমিয়ে গেলাম।সারারাত কড়া একটা ঘুম হলো।সকালে কলিং বেল এর আওয়াজে আমার ঘুম ভাঙ্গল। ঘুমঘুম চোখে ঘঁড়ির কাটায় তাকিয়ে দেখলাম সকাল নয়টা বাজে।আমি হুড়মুড়িয়ে উঠলাম কারণ এসময় শুধু আমার প্রিয়তমা রূপারেই আগমন ঘটবে।আর আমাকে এভাবে ঘুমাতে দেখলে তার মুখের থেকে কয়েকখানা ভুলভাল ইংলিশ বকা শুনতে হবে।

একটা কথাতো বলায় হল না।(রূপা ছাত্রী হিসেবে মোটেও ভালো ছিল না। ভালো একটা বিষয় নিয়ে পড়লেও পড়াশোনায় মন ছিল না ।কোনোরকমে পাশ করে অনার্স তৃতীয় বর্ষে উঠেছে। আর ইংলিশে বেশ কাঁচা।প্রায় সময় ইংলিশ বানান ভুল করত এবং যখন আমার সাথে ইংলিশে কথা বলত তখন হাজার টা ভুলভাল ইংলিশ বলত।আমি ভুলভাল ইংলিশ শুনে একটু হাসলেই গাল ফুলিয়ে বসে থাকত।তবে তার ইংলিশ বলাটা আমার কাছে বেশ লোভনীয় বিনোদন মনে হত।শত মন খারাপ হলেও তার ইংলিশের বাহার শুনে আমার মন ভালো হয়ে যেত আর হেসে লুটোপুটি খেতাম।তাই আমি এ অধ্যায়ের নাম দিয়েছি লোভনীয় রঙ্গমঞ্চ।)

যাইহোক কাহিনীতে আসি। ঘুমটাকে কোনোরকম নিবারণ করে দরজাটা খুলতেই আমার প্রিয়তমার মিষ্টি কথা ভেসে আসলো।প্রিয়তমা দরজায় একহাত দিয়ে হেলান দিয়ে বলল

“কি ব্যপার চোখ দেখে তো মনে হচ্ছে ঘুমাচ্ছিলে।এত দেড়ি হল কেন দরজা খুলতে শুনি।”

এ বলে চোখ দিয়ে ইশারা করতে লাগল।আমি রূপার হাতটা টান দিয়ে রুমে এনে বললাম-

“হয়েছে এখন আর তোমাকে শাসন করতে হবে না।দেখো সব আনা হয়েছে নাকি।না হয় আবার আনতে যাব।”

রূপা খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বলল-

“আপাতত বাজারে থেকে সবজি আর মাছ আনো।সকালের নাস্তা তো খাও নি।বাইরে গিয়ে এক কাপ চা খেয়ে নিও।

এরমধ্যে আমি বসাটা গুছাতে থাকি।তোমার বাজার আনা হলে একসাথে রান্না করব।তারপর খানদানি ভোজন পর্ব সাড়ব।”

আমি বেশ জোরে হেসে বললাম

“সবজি আর মাছ দিয়ে খানদানি ভোজন করবে?আমি তো জানতাম গরু আর খাসি দিয়ে মানুষ খানদানি ভোজন করে।”

রুপা ভ্রুটা কু্চকে জবাব দিল

“তোমাকে এত কিছু ভাবতে হবে না।যাও তো তাড়াতাড়ি যাও।রূপার সবজি আর মাছেই হল খানদানি ভোজন।রূপার হাতে রান্না কি খারাপ নাকি। খুলব নাকি একটা ইউটিউব চ্যানেল।নাম দিব রূপার রান্নাবান্না।”

“এসব বাদ দিয়ে এবার পড়ায় মন দাও।না পড়লে হবে নাকি।”

পড়ার কথা শুনলেই রূপার মাথা গরম হয়ে যায়।এবারও তার ব্যতিক্রম হল না।রেগে গিয়ে কপাল কুঁচকে বলল-

“বাজার আনতে বলেছি বাজার আনো।আমাকে নিয়ে এত ভাবতে হবে না।আসছে বিদ্যাসাগর।”

রূপার গর্জন শুনে তাড়াতাড়ি বাজার করতে গেলাম।
বাজার থেকে অনেক ক্লান্ত হয়ে ফিরে দরজায় নক করলাম।রূপা পাকা বিশ মিনিট পর দরজা খুলল। শরীরটা রাগে গিজগিজ করছিল তবুও রাগটাকে সামাল দিয়ে রূপাকে জিজ্ঞেস করলাম

“কোথায় ছিলে এতক্ষণ।”
“কাজ করছিলাম।”
“দরজাটা খুলেও ও কাজ করতে পারতে।”
“দরজা খুলতে আসলে ঐ কাজটায় মনোযোগ চলে যেত।”

আমি রাগরাগ গলায় রূপাকে বললাম-
” এবার বাজারগুলো ঘরে নিয়ে আমাকে উদ্ধার করো।মাছের ব্যাগ টা ধরে দাঁড়াও একটু।”

এ বলে মাছের ব্যাগটা রূপার হাতে দিয়ে বাজারগুলো দরজার সামনে রেখে রুমে এসে সোফায় শুয়ে পড়লাম।খানিকক্ষণ পর খেয়াল করলাম রূপা মাছের ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়েই আছে।রূপার দিকে তাকিয়ে বললাম-

“কী ব্যাপার রূপা এখনও মাছের ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছো যে।”

” তুমিই তো বলেছিলে মাছের ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে।কই ঘরে আসতে তো বলো নি।আমি তো তোমার কাথায় শুনছিলাম। ”

খুব ভালো বুঝে গিয়েছিলাম।রূপা বাকি বাজারগুলো আমাকে দিয়েই আনাবে।তাই রূপার কাছে গিয়ে, বাকি বাজার গুলো দরজার সামনে থেকে ঘরে ঢুকিয়ে রূপাকে বললাম-

“এবার মাছের ব্যাগটা নিয়ে ঘরে এসে আমাকে উদ্ধার করো।এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে আজকে আর রান্না করতে হবে না।”
” হুহ আসছি তো।তোমার কথা শুনলেও দোষ, না শুনলেও বলো কথা শুনি না।আমি তো উভয় সংকটে পড়েছি।এদিকে গেলেও দোষ ওদিকে গেলেও দোষ।”

রূপাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম-
“হয়েছে আর কথা বলতে হবে না।এখন কথা বলতে গেলে বোম ফাটবে।আমাকে কী করতে হবে বলেন মহারাণী। ”

এবলে রূপাকে টেনে আমার কাছে নিয়ে আসলাম।রূপা আমার থুতুনিটা টেনে বলল-
” এখন কিছুই করা লাগবে না।শুধু বসে বসে টেলিভিশন দেখেন।আমি রান্না করে নিয়ে আসতেছি।রান্না শেষ হলে না হয় আসতে বলব।আমাকে এবার যেতে দিন।”

আমি রূপাকে ছেড়ে দিলাম।এবার আমার নজর গেল ঘরের দিকে।রূপা অল্পক্ষণের মধ্যে অনেক পরিপাটি করে গুছিয়ে ফেলেছে।রূপার সবদিক একদম স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকলেও, পড়ালেখার দিকটা অর্ধ স্বয়ংসম্পূর্ণ। বেচারিকে পড়ার কথা বললেও রেগে যায়।তাকে যদি বুঝানো হয় পড়ালেখা ছাড়া দুনিয়াতে কিছু সম্ভব না ঠিক তখনি রূপা বিভিন্ন নামিদামি মানুষের উদাহরণ দিবে যারা না পড়ে অনেক বড়ো কিছু হয়েছে।রূপার সাথে চাপায় কখনও পারা যায় না।মেয়েটার এ দিকটা ব্যতীত সব দিকগুলোই ঠিক ছিল।রূপার মাথায় কী যে চলে কে জানে।আমার একসময় ইচ্ছা ছিল যে একটা ক্যারিয়ার ভালো ডাক্তার মেয়ে বিয়ে করার।কারণ আমার কাছে সবসময় যোগ্যতাটা অনেক বড়ো কিছু ছিল।কিন্তু উপর আল্লাহর ইচ্ছা মনে হয় ভিন্ন ছিল।তাই হয়তো আমার জীবনে রূপার আগমন হয়েছে।

“সত্যি বলতে মন থেকে কাউকে চাইলে কখনও আল্লাহ আলাদা করেন না।বরং চাওয়ার মধ্যে যদি ঘাপলা থাকে তাহলেই আল্লাহ বিভিন্ন অজুহাতে আলাদা করে দেন।অর্থাৎ আল্লাহর কাছে যখন চাইতে হয় তখন সৎভাবে হালাল নিয়্যাতে চাইতে হয়।”

রূপাকে নিয়ে মাঝে মাঝে আবরার বলত-
“অরন্য দেখ রূপা ননমেডিকেল তার উপর ন্যাশনালে পড়ে।ওর সাথে তোর মিলবে বলে মনে হয় না।কিছু করার আগে ভেবে করিস।”

কিন্তু রূপার সাথে মিশে মনে হয়েছে।ওর সাথে ছাড়া আর কারও সাথে আমার মিলার কথা না।একমাত্র ওর সাথেই আমার সবচেয়ে বেশি মিলে।ও যেভাবে আমাকে যত্ন নেয় অন্য কেউ পারবে বলে মনে হয় না।প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মানুষকে যোগ্য করে তুলে সমাজের জন্য কিন্তু মানবিকতা সেটা নিজেকেই গড়ে তুলতে হয়।আর রূপার মধ্যে সেটার কমতি ছিল না।তাই নন মেডিকেল হলেও রূপার সাথে চলতে মোটেও কষ্ট হচ্ছে না

“কখনও প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা দিয়ে কাউকে বিচার করা উচিত না যে সে কেমন।প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জরুরি তার চেয়ে বেশি জরুরি একজন যোগ্য মানুষ হওয়া।যোগ্যতা অর্জন করা আর যোগ্য মানুষ হওয়ার মধ্যে অনেক তফাৎ। ”

এর মধ্যেই রান্নার একটা সুন্দর সুঘ্রাণ নাকে আসলো।আমি এর সুঘ্রাণ আহরণ করার লোভটা সামলাতে পারলাম না।দৌঁড়ে গেলাম রান্না ঘরে।রান্না ঘরের দরজার সামনে যেতেই রূপার দিকে চোখ গেল।রূপার একটা অভ্যাস বলব নাকি বদ অভ্যাস বুঝে উঠতে পারছি না।অভ্যাসেই বলা যাক।রূপার একটা অভ্যাস সব কাজেই ছটফটিয়ে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে করবে।তাকে কাজ করতে দেখলে মনে হয় সবচেয়ে কষ্টকর কাজটাও অতি সহজ।দরজার সামনে দাঁড়িয়ে না থেকে রূপার কাছে গেলাম।রূপার কাছে গিয়ে রূপাকে সিনেমার নায়কের মতো পিছন থেকে যখনেই ধরতে যাব ঠিক এ মুহুর্তে রূপা বলে উঠল-

“আরে আরে ধরতে আসবে না।যাও তো যাও। এখানে এসে এখন ঢঙ করতে হবে না।”

আহারে আমার হিরো সাজা আর হলো না যে ঝাড়ি খেয়েছি তার পর হিরো সাজতে গেলে কপালে মাইর জুটবে।তাই রান্না ঘর থেকে চলে আসলাম।খানিকক্ষণ পর রূপা গোসল করে আমার কাছে এসে তার চুলগুলো পাখার নীচে রেখে শুকাচ্ছিল।রূপার চুল থেকে এক অদ্ভুত সুবাস আসছিল।আমি রূপার কাছে গিয়ে চুলের সুবাস আহরণ করতে করতে বললাম-

“তোমার চুলের সুঘ্রাণ সত্যিই লোভনীয়।”
“ডাভ শ্যাম্পুট সুঘ্রাণ এটা।”

আমি একটু হেসে রূপাকে জড়িয়ে ধরে বললাম –
“সে যাইহোক একটা কথা কী বলব?”
রূপা আমার উপর গা এলিয়ে দিলে বলল-
“কী বলতে চাও।”
আমি রূপার ঘাড়ে চুমু দিয়ে বললাম-
” তোমাকে খুব ভালোবাসি।”
“আমিও তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি।”

ভালোবাসা,খুঁনসুটি,ঝগড়া সব মিলিয়ে আমাদের জীবন বেশ ভালোই চলছিল।বিবাহিত হয়েও দুজন থাকতাম ব্যাচেলরের মতো।সবাই জানত আমরা সিনগেল কিন্তু প্রকৃত পক্ষে ছিলাম পুরোপুরিভাবে মিনগেল।বলা যায় বিবাহিত ব্যাচেলর।বিবাহিত তার উপর ব্যাচেলর দুইটা পরস্পর বিপরীতার্থক শব্দ হলেও বেশ সুখেই ছিলাম আমরা।এভাবে কেটে গেল আরও তিনটা মাস।

রূপাকে বারবার বলছিলাম এবার আঙ্কেল কে বলে তোমাকে তুলে আনি।কিন্তু কেন জানি রূপা ঐ সময়টাতে একদম পাল্টে গিয়েছিল।আগের মতো তেমন কথা বলত না।সবসময় চুপ হয়ে থাকত।কিছু জিজ্ঞেস করলেও কোনো জবাব দিত না।আগের মতো বাসায় আসত না।কল দিলেও ঠিক করে ধরত না।রূপার এরকম আচরণ আমাকে বেশ কষ্টও দিচ্ছিল।এরকম চুপ হয়ে যাওয়াটা মোটেও স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল না। সব নিয়ে একদিন রাতে রূপাকে কল দিলাম।কল দেওয়ার পর রূপাকে জিজ্ঞেস করলাম-

” কী হয়েছে রূপা তুমি এত চুপ হয়ে গেলে যে।কথা বলো না ঠিক করে।কল দিলে ধরতে চাও না।সারাক্ষণ কিসের মধ্যে ডুবে থাকো।তুমি কী জানো না তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসি।তোমার এ ব্যবহার গুলো আমাকে কষ্ট দিচ্ছে।নাকি আবার লেডি হিমু হতে চাচ্ছ। কিছুতো বলবা।তুমি কী জানো তোমার এসব পাগলামিতে আমি বিরক্ত।আমাকে রেহাই দাও।”

কিন্তু রূপা আমার কথা শুনে তেমন কোনো পাত্তা না দিয়ে কল টা কেটে মোবাইলটা বন্ধ করে ফেলল।তখন রাত একটা বাজে।ঠিক এসময় খেয়াল করলাম আবরার কল দিয়েছে।আবরারের কল ধরার সাথে সাথে আবরার বলল-

“অরন্য তুই ঠিক আছিস তো।”
“কী হয়েছে?আমার কী হবে?আমি তো ঠিকেই আছি।”

তারপর আবরার যা বলল আর আমি যা দেখলাম তা দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।আবরার বলল-

“দোস্ত রূপার একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।একটু দেখ আমি তোকে লিংক পাঠাচ্ছি।”

আমি প্রথমে ভেবেছিলাম রূপা কোনো রেসিপির ভিডিও হয়তো দিয়েছে আর সেটা নিয়ে হয়তো অনেকে মজা করছে তাই রূপাও এ বিষয়ের জন্য চুপচাপ হয়ে আছে।এ ভেবে যখন ভিডিওতে ক্লিক করলাম তখন তা দেখে আমি চমকে গেলাম।রূপার অর্ধ উলঙ্গ গোসলের ভিডিও আমার সামনে।খেয়াল করলাম ভিডিওটার ভিউ হয়ে গিয়েছে অনেক।কতশত নোংরা কমেন্ট।রূপার উপর চরম রাগ হলো।রূপাকে কল দিলাম।খেয়াল করলাম রূপা মোবাইল অন করেছে।অনেকক্ষণ কল দেওয়ার পর রূপা কলটা ধরার সাথে সাথে বললাম-

“ছিঃ এত নোংরা একটা ভিডিও করতে লজ্জা লাগল না তোমার।কতটা নোংরা হয়ে গিয়েছ চিন্তা করতে পারছো।এজন্যই তো আমাকে ভালো লাগে না তাই না।তোমার তো একজন দিয়ে হবে না।নোংরামি করতে এত মজা লাগে তাই না।কী করেছিলাম আমি?কোনোকিছুর অভাব তোমাকে দেই নি তবুও এভাবে কষ্ট দিতে পারলে?”

“অরন্য ভিডিওটা আমি করে নি।”

রূপা আরও কিছু বলতে যাবে এ মুহুর্তে রূপার কথা আটকে দিয়ে বললাম-

“তোমার গোসলখানায় আরেকজন ভিডিও করেছে এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলতেছ।লজ্জা হওয়া উচিত।এ মুখ দেখানোর চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।”

তারপর আরও কিছু বলতে নিব খেয়াল করলাম মোবাইলটা বন্ধ।দশ মিনিট মোবাইলে কল দিলাম।প্রতিবারেই বন্ধ পেলাম।রূপার বাবাকে কল দিলাম বললাম রূপাকে দিতে।আঙ্কেল অবাক হয়ে বলল

“রূপা ঘরে নেই।”

আমি কথাটা শুনার সাথে সাথে রূপার বাসায় গেলাম।আঙ্কেল মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।কোনো কথা বলছে না।আমি সারা বাড়ি খুঁজেও রূপাকে পেলাম না।রূপার টেবিলের উপর রূপার লাল মোলাটের ডায়রিটা পেলাম।ডায়রিটায় কাঁপা কাঁপা করে লেখা ছিল-

প্রিয় অরন্য, “আমার ভালোবাসার ইচ্ছেডানা”

তুমি না জিজ্ঞেস করেছিলে আমার কী হয়েছে?আমি এত চুপচাপ কেন।কারণটা তোমার সামনে ইতিমধ্যে চলে এসেছে।
কিন্তু জানো সবচেয়ে বেশি কষ্ট কখন পেয়েছি যখন তুমি অন্য সবার মতো আমাকে ভুল বুঝেছিলে।সত্যিই ভিডিওটা আমি করি নি।ভিডিওটা সৌরভ কৌশলে ধারণ করেছিল।কারণ আমি ওকে মোটেও পাত্তা দিতাম না।সে রাগটা আমার উপর তুলল।
আমাকে ভাইরাল করে দিল।আর গালিগুলো আমার কপালেই জুটল।ভিডিও করার পর বিভিন্নভাবে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করত।আমি যেন তার সাথে শারিরীক সম্পর্কে রজি হই নাহয় আমাকে ভাইরাল করে দিবে।
আমি কিন্তু রাজি হয় নি অরন্য।আমি বিষয়টা কাউকে বলতে পারছিলাম না। তুমিও আমার উপর রেগে শুধু বকাবকি করতে তাই তোমাকে আরও বলতে পারি নি।অপরদিকে সৌরভ অনেক বলেও যখন কোনো পাত্তা পাচ্ছিল না তখন এ কাজ টা করেছে।তবে দোষী আর অপরাধী আমিই হলাম।অপরাধ টা কী আমার ছিল?সবাই যে কমেন্ট বক্সে আমাকে গালাগাল দিচ্ছে কতটা অপরাধী আমি ছিলাম।ভাইরাল করতে পারাটা সবার মাথায় বসে গিয়েছে।কেউ এর আড়ালের দৃশ্যগুলো দেখে না।
নিজের এ মুখটা দেখাতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে।তাই লোকালয়ের থেকে আড়ালে গিয়ে নিষ্ঠুর পৃথিবীতে থেকে বিদায় নিলাম।

ইতি তোমার লেডি হিমু
রূপা।

আমি চিঠিটা পড়েই দৌঁড়ে বের হয়ে গেলাম রূপাকে খুঁজতে।সারারাত খুঁজলাম পেলাম না। আর যখন পেলাম তখন….

এ বলেই অরন্য অনেক কাঁদতে লাগল।তুলি অরন্যকে ধরে বলল
“তারপর কী হয়েছে বলুন। কাঁদবেন না দয়াকরে।”

অরন্যের কান্না দেখে তুলির চোখটাও ছলছল করতেছিল।তবে তুলি তার চোখের জলটাকে আড়াল করে অরন্যকে স্বাত্ত্বণা দিতে লাগল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here