#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
লাবিবা ওয়াহিদ
| সূচনা পর্ব |
——————–
সদ্য এইচএসসি পাশ করা নওরির সাথে তাঁর সৎ মা ৪৫ বছর বয়সী আধ বুড়োর সাথে বিয়ে ঠিক করেন। এমতাবস্থায় বিপত্তি হয় আরেক দিকে। নওরির বড়ো বোনের প্রেমিকের মা নওরির জন্যে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। নওরি পরেছে এবার দুই পরিবারের মাঝখানে। মহিলা এসেই তাঁর ক্ষমতার জোর দেখিয়ে সেই আধ বুড়োকে ভাগিয়েছে। এবং সরাসরি নওরির সৎ মায়ের উদ্দেশ্যে বলেছে,
–“যতো টাকা লাগে আমি দিবো, তাও নওরি আমার ছেলের বউ হবে।”
নওরি বুঝলো না সে মেয়ে নাকি হাটের কোনো ক্রয়-বিক্রয়ের পশু? এই পরিবারের থেকে সে যথেষ্ট অবহেলা পেয়েছে। তাই বলে যে কেউ তাঁদের বাসায় এসে নওরিকে কুরবানির পশুর মতো দর-দাম করবে? এটা কোথাকার নৈতিকতা?
বড়ো আপার প্রেমিককে চিনে নওরি। তাঁদের এলাকার-ই আকবর সাহেবের ছেলে। যথেষ্ট ভালো মানুষ সে। বড়ো আপাকেও ভীষণ ভালোবাসে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে আজ কী হলো? সেই প্রেমিকের মা কি না নওরির হাত চাইছে? বড়ো আপার নয়ন ভেঁজা ব্যতীত নওরির চোখে আর কিছুই পরলো না। সেই থেকে দরজা আটকে রেখেছে। বের হচ্ছে না।
নিজেকে বড্ড একা লাগছে নওরির। সেই মহিলা তাঁর হাতে মোটা এক জোড়া বালা পরিয়ে দিয়ে গেছে। সময় কতটা প্রতিকূলে আজ। এই বালা জোড়া পরার কথা ছিলো বড়ো আপা রাফিয়ার আর পরলো নওরি। নিজেকে নিজের কাছেই বড্ড ছোট লাগছে তাঁর।
নওরির বাবা দুই বিয়ে করেছেন। নওরি আর রাফিয়া আপা হচ্ছে তাঁর প্রথম পক্ষের সন্তান। অর্থাৎ নওরির মা মারা যাওয়ার পরপর-ই বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন যেন দুই বোন একাকিত্বে সময় পার না করে, তাদের কেউ আগলে রাখে।
কিন্তু ছোট বেলায় নওরির গায়ের রঙ ছিলো একটু চাপা। তাই সৎ মা খুব একটা কাছে টানতো না তাকে। নিজের সন্তান না থাকায় এবং রাফিয়া বেশ ফর্সা হওয়ায় সৎ মা তাকেই বেশি ভালোবাসতেন। নিজের মেয়ের মতো ভাবতেন।
নওরি তখন থেকেই থাকত অবহেলিত। সৎ মায়ের ভালোবাসায় আপাও যেন নওরিকে ভুলে গেছিলো। সে যেন আলাদা কোনো দুনিয়ায় বসবাস করছিলো, সবসময় হাসি-খুশি আবদারের মাঝে থাকতো সে। আর নওরি রুমের এক কোণায় পরে থাকত, কেউ খবরও নিতো না।
একসময় সৎ মায়ের চোখে বি!ষ হয়ে দাঁড়ালো সে। নওরিকে দেখলেই নাকি মনে পরে নওরি তাঁর সতীনের মেয়ে। বিষয়টা অদ্ভুত শোনালেও সৎ মায়ের চিন্তা-ভাবনা ছিলো একদম ভিন্ন। ওদের দুই বোনকে সবসময় আলাদা নজরে দেখতো।
বাবাও একসময় আদর করা ছেড়ে দেয় তাকে, মুখ ফিরিয়ে নেয় নওরির থেকে। কতটা আকুল হয়ে থাকতো এক বাবার জন্যে, কিন্তু সেই বাবা একবার জিজ্ঞেসও করতো না,
–“মা কেমন আছো?”
ছোট থেকেই গা’ধার খাটুনি খাটত নওরি। বাড়ির সব কাজ সৎ মা নওরিকে দিয়ে করাতো। কতবার যে স্কুল গ্যাপ গেছে তাঁর ইয়াত্তা নেই।
এর মাঝে সৎ মা হঠাৎ সক্ষম হয় সন্তান জম্মদানে। সৎ মায়ের আগেও বিয়ে হয়েছিলো কিন্তু সে সন্তান জম্ম দিতে অক্ষম থাকায় তাঁর ডিভোর্স হয়ে যায়। তাই হয়তো সেই হিসেবে বড়ো আপাকে আপন করে নিয়েছিলো সে। সন্তান জম্ম দেয়ার পর সৎ মা আপাকেও ভুলতে শুরু করে দেয়। সবসময় নিজের মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
তখন আপাও নওরির কাছে চলে আসে, তাকে সঙ্গ দেয়। ধীরে ধীরে কলেজে উঠলো। আর রাফিয়া আপা ভার্সিটিতে উঠলো। দু’জনের পড়াশোনা ভালোই চলছিলো। রাফিয়া নওরিকে সৎ মায়ের থেকে আগলে রাখত সবসময়।
সৎ মা আজও রাফিয়াকে কিছু বলতে পারে না। কারণ, প্রথম মাতৃস্নেহ সে রাফিয়াকেই দিয়েছিলো। তাই অ!ত্যাচার কিছুটা নওরির কমে এসেছিলো।
একদিন জানতে পারলো রাফিয়া প্রেম করছে। রাফিয়া-ই জানায় নওরিকে। রাফিয়া ছবিও দেখিয়েছে ছেলেটার। প্রেমে পরার পর থেকেই রাফিয়ার মুখে সবসময় ঝুলতো লাজুক হাসি। রাফিয়াকে দেখলে নওরির উদাসীন মন সবসময়ই ভাবতো,
–“আচ্ছা, প্রেমের রঙ কী এতটাই সুন্দর? প্রেম মানে কী আকাশচুম্বী সুখ?”
উত্তর মিলতো না নওরির প্রশ্নের। তবে রাফিয়া সেই ছেলেকে নিয়ে অনেক গল্প করতো তাঁর সাথে। নওরি বুঝতে পেরেছিলো তাদের মধ্যে বেশ জমেছে। রাফিয়া বড়ো হয়ে আরও সুন্দরী হয়েছে। আর নওরি বড়ো হলে তাঁর চাপা রঙটা বিলুপ্ত হয়ে কিছুটা শুভ্রতে পরিণত হয়। নওরি আবার তাঁর আপার মতো আহামরি সুন্দরী নয়।
তাহলে কেন ওই মহিলা আপাকে ছেড়ে নওরিকে তাঁর ছেলের বউ করার জন্যে উঠে পরে লেগেছে? এর উত্তর অবশ্য নওরি পেয়েছিও। ড্রইংরুমে মহিলা যখন সৎ মায়ের সঙ্গে কথা বলছিলো তখন নওরি আড়ালে দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনেছিলো সেই মহিলার কথা। মহিলার কথাগুলো ছিলো এমন,
–“আমার ছেলের জন্যে আমি কম বয়সী মেয়েকেই নিতে চাই। এরা ভদ্র এবং স্বামীভক্ত হয়। সব মুখ বুজে মেনে নিতে পারে। এছাড়া আমি তো শুনেছি-ই আপনাদের কর্মকান্ডের কথা। মেয়েটার উপর দিয়ে তো কম ঝড় তুলেন না। তাইতো আজ এক বুড়োর সাথে ওইটুকুনি মেয়ের বিয়ে ঠিক করলেন। লজ্জা করলো না?”
রাফিয়া নওরির বড়ো হওয়া সত্ত্বেও নওরিকে বাদ দিয়ে সৎ মা নওরিকে বিয়ে দেয়ার জন্যে উঠে পরে লেগেছে। রাফিয়াকেও বিয়ে দিতে চেয়েছিলো কিন্তু নওরির বাবা আহ্লাদী স্বরে প্রতিবাদ জানিয়েছিলো বারবার। তিনি মেয়েকে বিয়ে দিবেন না, বরং মেয়ে পড়ছে, পড়ুক। এমনটাই ছিলো তার জবান। তাইতো রাফিয়া পড়ছে।
কিন্তু নওরির বেলায় সবসময়ই ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটে এই পরিবারে। নওরির বেলায় বাবা ছিলো নিশ্চুপ। তাঁর প্রতিবাদ কখনোই নিজের জন্যে শুনেনি।
এসব ভাবতে ভাবতেই নওরির চোখে জল ভীড় করলো। অনেকক্ষণ নিজেকে শক্ত রেখেছিলো। কিন্তু আর কতো? আর সম্ভব না তাঁর পক্ষে।
নওরির ভাবনার মাঝেই সুরভী অর্থাৎ সৎ মায়ের সেই মেয়ে নাচতে নাচতে নওরির রুমে আসলো। মেয়েটি বর্তমানে ক্লাস সিক্সে পড়ছে। নওরিকে মাথা নত করে বসে থাকতে এক গাল হাসলো। হাসি বজায় রেখে ঠাট্টার সুরে বললো,
–“কী গো আপু! তোমার তো বুড়োর সাথে বিয়ে হচ্ছে। আচ্ছা, ওই আঙ্কেলকে কী চাচা ডাকবা নাকি খালু? বয়সে তো অনেক বড়ো তোমার। নাম ধরে তো ডাকতে পারবে না।”
সুরভী এবার ফিক করে হেসে দিলো। যেন নওরিকে খোঁচা মে’রে সে বেশ আনন্দ পাচ্ছে। সুরভীর কান্ডে নওরি বেশ বুঝেছে, তাঁর সৎ মা সুরভীকে বিয়ে ভাঙ্গার কথা জানায়নি। নয়তো সুরভীর এভাবে উড়ার কথা না। নওরি আগের মতোই চুপ করে রইলো। বরং নিরব থাকাটাই শ্রেয় মনে করলো।
এতে সুরভী ভাবলো বেদনায় নওরির মুখে কুলূপ এঁটেছে। সুরভী নওরিকে তুচ্ছ করে হাসতে হাসতে প্রস্থান করলো। সুরভী চলে যেতেই নওরি হাতের উল্টোপিঠে তার ভেঁজা গাল এবং চোখ মুছলো।
বিকাল হয়ে এসেছে। নওরি এদিক সেদিক তার পোষা বিড়ালটাকে খুঁজলো। একটা অদ্ভুত শব্দ পাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরেই। তবে বিষয়টা মনোযোগ দেয়নি নওরি। হঠাৎ দেখলো পর্দা বেশ নড়চড় করছে। ব্যাপার কী? জানালা তো বন্ধ। এছাড়া বাতাস আসলেও এভাবে নড়ে নাকি পর্দা?
নওরি গিয়ে পর্দা টান দিতেই দেখলো ফ্রিশা জানালার লোহার শিকের সাথে ঝুলে আছে। এতক্ষণে বুঝলো অদ্ভুত শব্দের উদয় কোথা থেকে হয়েছে? ফ্রিশা নওরির পোষা বিড়ালের নাম। ছাই এবং সাদার কম্বিনেশনে বিড়ালটির গায়ের রঙ। গায়ের লোমও তাঁর অতিরিক্ত। নওরি এক নিমিষেই ফ্রিশাকে কোলে নিয়ে বলে,
–“তোর বড়ো নখ দিয়ে কাঁচে ঘঁষলেও কাজ হবে না। ওই জানালা খুলবে না।”
–“মিঁয়্যাও!”
–“মাছের গন্ধ আমিও পেয়েছিলাম। তাই বলে তুই কাঁচে হামলা দিবি? তোরে মাছ খাওয়াই না?”
ফ্রিশা চোখ-মুখ গম্ভীর করে রইল। এতে নওরির মুখে স্মিত হাসি ফুটলো।
——————
রাতে হঠাৎ রাফিয়া নওরির রুমে আসলো। রাফিয়াকে দেখে নওরি বেশ চমকালো, ভড়কালো। সারাদিন তো রাফিয়া রুম থেকে বের হয়নি তাহলে হঠাৎ তাঁর রুমে কী করছে? তাও নওরি কিছুটা স্বস্তিবোধ করলো এই ভেবে যে তাঁর আপা রুম থেকে বেরিয়েছে।
নওরি জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো। নওরি বসে ছিলো বিছানায়। রাফিয়া নওরির সামনে মূর্তির মতো করে দাঁড়ায়। নওরি আপাদমস্তক রাফিয়াকে পর্যবেক্ষণ করে বলে,
–“আপা, তুমি ঠিকাছো?”
উত্তর নেই রাফিয়ার পক্ষ থেকে। সে একমনে নওরির হাতের সোনালী বালা জোড়ার দিকে তাকিয়ে আছে। রাফিয়ার সেই শান্ত দৃষ্টিতে নওরি ভড়কালো। মন বলছে রাফিয়ার এরূপ শান্ত ভঙ্গি বিরাট কোনো ঝড় বইয়ে আনছে। ঠিক হলোও তাই।
রাফিয়া হঠাৎ নওরির হাত থেকে জোর করে সেই বালাগুলো খুলতে লাগলো। বেকায়দায় চুড়িগুলো খোলার চেষ্টা করার কারণে নওরি হাতে কয়েকবার চাপ খেলো। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে সে। সেদিকে রাফিয়ার খেয়াল নেই। সে মুখশ্রী লাল করে বারংবার কয়েকটি বাক্যই আওড়াচ্ছে।
–“অধিকার নেই, কোনো অধিকার নেই তোর এসব পরার। এগুলো আমার অধিকার। তুই আমার অধিকার কেড়ে নিতে পারবি না। আমি বেঁচে থাকতে তো একদমই না। দে এগুলো, খুল!”
ব্যথায়, যন্ত্রণায় নওরির চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। নওরি অনুনয়ের স্বরে বলছে,
–“আপা ছাড়ো। আমি ব্যথা পাচ্ছি। খুলে দিচ্ছি আমি তাও আমায় ছাড়ো। দোহাই লাগে।”
নওরির কাতর কন্ঠের অনুনয় শুনেনি রাফিয়া। নিজে জোর করে বালা দু’টো খুলেই তবে ক্ষান্ত হয়। নওরির হাতে লালচে দাগ পরেছে।
নওরি ফোঁপাচ্ছে আর তার হাত জোড়াকে উল্টে পাল্টে দেখছে। সে কোনো দোষ না করা সত্ত্বেও কেন এতো কষ্ট পাচ্ছে? কেন এত শা!স্তি পাচ্ছে? ব্যথায় যন্ত্রণায় নওরির চিৎকার দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। রাফিয়া বালাগুলো নিজ হাতে পরে নিলো। অতঃপর কী মনে করে থমথমে গলায় বললো,
–“তুই পালিয়ে যা নওরি।”
[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
———————–
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
[সকলে রেসপন্স করবেন যাতে অন্য পাঠকদের নিউজফিডেও গল্পটি পৌঁছাতে পারে। ভালোবাসা🌸]
বিঃদ্রঃ আসসালামু আলাইকুম। আবারও ফিরে আসলাম নতুন গল্প নিয়ে। এটা কিছুটা বাস্তবসম্মত লিখা। জানি না কতটুকু ফুটিয়ে তুলতে পারবো, তবে আই উইল ট্রাই মাই বেস্ট। প্রথম পর্ব হওয়ায় কিছুটা ছোট হলো। আপনাদের রেসপন্স আসলে ইন-শা-আল্লাহ বাকি পর্বগুলো বড়ো করার চেষ্টা করবো। আপনাদের গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় থাকলাম। আপনাদের রেসপন্সের উপর ভিত্তি করছে পরবর্তী পর্ব।