#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ১৮ |
———————
পড়া শেষে স্টিলের স্কেল দিয়ে ছোট সাইজের আমটিকে দু’ভাগ করলো নিদ্র। নওরি গোল গোল চোখে দেখেই গেলো সবটা। নিদ্র অর্ধেক ভাগ নওরির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
–“এটা তোমার কাছে গিফট। এই আমের জন্যেই আমি পায়ে ব্যথা পেয়েছিলাম।”
–“পেলে কোথায়?”
–“গুলতি মে!রে আদায় করেছি। চুরি করে আম খেতে মজাই আলাদা।”
নওরি হাসলো। চোখের সামনে ভেসে ওঠে সোনালী দিনগুলো। ছোটবেলায় সেও মাঝে মধ্যে ঢিল ছুঁড়ে আম চুরি করে খেতো। আম চুরিতে মজাই আলাদা। সাথে লবণ, মরিচ হলে তো কথাই নেই। নওরি সৌজন্যতার সাথে আমের টুকরোটা নিজের হাতে তুলে নিলো। নিদ্র এক গাল হাসি দিয়ে বলে,
–“দাঁড়াও আমি লবণের ব্যবস্থা করছি!”
–“মরিচের গুঁড়োও আনো!”
–“ও হ্যাঁ। অপেক্ষা করো!”
নিদ্র যেতে নিলে নওরি নিদ্রকে আটকায়।
–“প্রয়োজন নেই। আমি গিয়ে আনছি৷ তুমি রেস্ট করো!”
নিদ্র বাধ্য ছেলের মতো বসে রইলো। ফ্রিশা চট করে নিদ্র’র কোলে গিয়ে উঠলো। নওরি ওদের রেখে বেরিয়ে এলো। কিচেনে যেতেই দেখলো নূরজাহান তাঁর বড়ো ছেলে তুষারের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত। নওরি তাঁর পাশ কাটিয়ে লবণের বয়াম নিতে গেলে তুষার তাকে দেখে ফেলে। কিছু মুহূর্ত মুগ্ধ নয়নে চেয়ে হঠাৎ বলে ওঠে,
–“ওটা নওরি না? হেই নওরি। কী অবস্থা?”
পুরুষালি কন্ঠস্বর শুনে নওরি চমকে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো। নূরজাহান হাসি হাসি মুখ করে ফোনের ক্যামেরা নওরির দিকে ঘুরিয়ে দিতেই নওরি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মাথায় কাপড় দিলো। নূরজাহান বেশ চমকে বলে,
–“ওহ দুঃখিত। নাও, তুষারের সাথে কথা বলো।”
নওরি হ্যাঁ, না কিছুই বলার সাহস পেলো না। হালকা শুকনো ঢোঁক গিললো। নূরজাহান মোবাইল নওরির হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো। নওরি তৎক্ষণাৎ ক্যামেরায় আঙুল দিয়ে বন্ধ করে রাখলো। অস্বস্তিতে তাঁর ঘনঘন নিঃশ্বাস পরছে। মোবাইলের স্ক্রিনে ফুটে আছে এক অচেনা পুরুষের প্রতিচ্ছবি। তাঁর চাহনি বড্ড অস্বস্তিকর নওরির জন্যে। কোনো পুরুষের সাথে সে কমফোর্ট ফিল করে না। তুষার স্ক্রিনে তাকিয়ে বলে,
–“নওরি? ঠিক আছো? ক্যামেরা বন্ধ করলে কেন?”
নওরি আমতা আমতা করে সালাম দিলো তুষারকে। তুষার এবার হাসলো। হাসি বজায় রেখে সালামের উত্তর দিয়ে বললো,
–“কেমন আছো?”
–“ভালো। আপনি?”
–“ভালো। অন্ধকার কেন? তোমায় দেখা যাচ্ছে না যে?”
নওরি চুপ করে রইলো। ফোনের ওপাশে উত্তরের অপেক্ষায় তুষার বসে রইলো। নওরির সাড়াশব্দ না পেয়ে তুষার কল কেটে দিয়ে আবার কল করলো। নওরি কল রিসিভ করার সাহস পর্যন্ত পেলো না। চুপ করে ফোন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ টুংটাং শব্দে মেসেজ আসলো। নওরি মেসেজটা ওপেন করতেই দুইশো ভোল্টের ঝটকা খেলো।
–“আনকমফোর্ট হচ্ছিলে নওরি? আরে আমরা আমরা-ই তো। কথা বললেই কমফোর্ট ফিল করবে। এছাড়া তোমার কন্ঠও খুব মধুর। এই কন্ঠস্বর আড়ালে রাখতে নেই। মন খুলে কথা বলবে।”
এরূপ মেসেজ দেখে নওরির তীব্র এক ইচ্ছা জাগলো মেসেজের উত্তর দেবার। উত্তর হিসেবে বলতে ইচ্ছা করছিলো,
–“অচেনা পুরুষের সাথে মন খুলে কথা বলতে পারি না আমি, আর না পারতে চাই৷ আপনি সারিফার বড়ো ভাই, এর চাইতে কোনো পরিচয় বা কথাবার্তার প্রয়োজন নেই৷”
নওরি মেসেজ টাইপ করতে গিয়েও করলো না। উল্টো তুষারের মেসেজটি ডিলিট করে নওরি লবণ-মরিচের গুঁড়ো নিতে ব্যস্ত হয়ে পরলো।
———————
আজ ইরা’দকে নিয়ে মৌসুমি মেয়ে দেখার জন্যে যাওয়ার কথা ছিলো৷ ইরা’দ কাজের ছুঁতোয় বেরিয়েছে সেই সকালে। অথচ এখন বিকাল হয়ে গেলো ইরা’দের আসার কোনো খবর নেই৷ মৌসুমি চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ফুঁসছে। মেয়েদের বাড়িতে লাঞ্চের সময় পৌঁছানোর কথা ছিলো। এখন আছরের আযান দিবে। কেমন লাগে? ইরা’দের সব চ্যালা, বন্ধুদের কল দিয়েছে সে। কিন্তু অ!পদার্থগুলো একটায়ও কল রিসিভ করেনি। সবার ফোন বলেছে ব্যস্ত। অপ!মানে রীতিমতো গা জ্বালা দিয়ে উঠছে মৌসুমির। রি রি করছে সবার্ঙ্গ। যত্তোসব ব্যস্ততা আজকের দিনে-ই হলো? মৌসুমি শেষমেষ ক্লান্ত হয়ে ভেতরে ঢুঁকে গেলো।
মৌসুমি ভেতরে যেতেই নওরি সিঁড়ি দিয়ে নেমে পরলো। পাক্কা পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে ছিলো সে। কারণ একটাই, মৌসুমি অর্থাৎ ইরা’দের মা। মহিলার ব্যবহার এবং চাহনি বড্ড অস্বস্তিজনক। সেদিন যা নমুনা দেখেছে, কাউকে বিশ্বাস নেই। তাইতো আড়ালে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হলো। নওরি আর অপেক্ষা না করে দ্রুত ভঙ্গিতে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলো। বড্ড তাড়া তাঁর। মৌসুমির চোখের সামনে না পরার তাড়া। বলা তো যায় না, আবার কখন বেরিয়ে আসে।
প্রতিবারের মতো আজও রিকশা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো নওরি। নওরি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে অন্য রিকশা নিয়ে চলে গেলো। ভুলক্রমেও তাঁর জন্যে নির্ধারিত রিকশায় সে উঠলো না। নওরি এবং তাঁর রিকশা চোখের আড়াল হলে টঙ থেকে ইরা’দের বিশ্বস্ত দু’জন কর্মী বেরিয়ে এলো। ওরাও ইরা’দের সাথে রাজনীতিতে যুক্ত। একজন তাঁর পাশের জনের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
–“কী চালু এবং ত্যাড়া স্বভাবের এই মেয়ে।”
–“মুখ সামলে কথা বল। ভাবী হয় আমাদের। তোর জবানে এসব শুনলে ইরা’দ ভাই তোর জিহবা টেনে ছিঁ!ড়বে।”
–“আচ্ছা আর বলব না। কিন্তু সত্যি-ই তো বললাম।”
অপর ছেলেটি হেসে তাঁর সহকারীর কাঁধে হাত দিয়ে বলে,
–“আমাদের ইরা’দ ভাইয়ের বউ তাঁর মতোই তো হবে নাকি? তুইও না বেশি বেশি!”
নওরি রিকশা থেকে নেমে স্টুডেন্টের বাসায় ঢুকতেই দেখলো সিঁড়ির সাথে হেলান দিয়ে ইরা’দ দাঁড়িয়ে আছে। নওরি প্রথমে অপ্রস্তুত হলেও পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিলো। ধীর গলায় বললো,
–“আপনি?”
ইরা’দ সেসব নিয়ে কিছু বললো না। সোজা-সাপটা প্রশ্ন ছুঁড়লো নওরির উদ্দেশ্যে।
–“রিকশায় উঠেননি কেন?”
–“ও। এর মানে এসব আমার কীর্তি?”
–“উত্তর জানতে চেয়েছি আমি।”
–“আমিও জানতে চাই। রিকশা কেন ঠিক করেছেন? কেন ওই ছেলেগুলো আমার পিছু নেয়?”
–“তোমায় প্রটেক্টের জন্যে।”
–“সারিফাকে তো এত প্রটেক্ট করেন না, তাহলে আমার বেলাতেই কেন? প্রয়োজন নেই আপনার এই সুরক্ষার!”
ইরা’দ প্রশস্ত হাসলো। অমায়িক কন্ঠে শুধায়,
–“আপনি আমাদের স্পেশাল গেস্ট। সারিফা নয়। আর স্পেশাল মানুষদের স্পেশাল সুরক্ষা তো দিতেই হয়। আগামী থেকে খেয়াল রাখবেন। আমি রিকশা পাঠালে রিকশায় চড়বেন। ভাড়া আপনি দিলেও কোনো সমস্যা নেই। তবে সমস্যা হলো, আপনাকে আমার করা নির্ধারিত রিকশাতেই উঠতে হবে।”
–“জোর করছেন?”
–“না, আমার সিদ্ধান্ত জানাচ্ছি।”
–“আপনি কে?”
–“হৃদয়ের আয়না।”
–“মানে?”
–“বুঝবেন না!”
–“আমার অস্বস্তি হয়।”
–“নতুন শহরে নিজের জন্যে এইটুকু ত্যাগ করলে কিছু হয় না! অস্বস্তি ত্যাগ করুন।”
–“আপনার কথা যদি না শুনি?”
–“এর উত্তর আমার কাছে নেই নৌরি ফুল। তবে আমি এইটুকু বলতে পারি, আমি ভয়া!নক রেগে যাব। আসছি!”
বলেই নওরির পাশ কাটিয়ে চকে আসতে নিলে ইরা’দ হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়৷ নওরির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
–“অতিরিক্ত কথা বলা আমি পছন্দ করি না নৌরি ফুল। আমার তো আপনার সেই শান্ত, ভীত সুলভ স্বভাবটি-ই চমৎকার পছন্দ।”
বলেই নওরির মাথায় ফুঁ দিয়ে ইরা’দ চলে গেলো। নওরি তো কতক্ষণ ওখানেই হ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে রয়। শূণ্য দৃষ্টিতে সামনের দিকে চেয়ে সবকিছু বোঝার চেষ্টা করলো। অতঃপর সম্পূর্ণ ঘটনা মস্তিষ্কে নাড়া দিতেই নওরি চমকে পিছে ফিরে তাকালো। ততক্ষণে ইরা’দ তাঁর দৃষ্টি সীমানার বাহিরে চলে গিয়েছে। কিছুক্ষণ রাস্তার দিকে তাকাতেই হঠাৎ মনে পরলো, আজ তো ইরা’দের মেয়ে দেখতে যাবার কথা। নূরজাহান আন্টির থেকে শুনেছে মৌসুমির ইচ্ছের কথা। যদি তা-ই হয় তাহলে ইরা’দ তাঁর সাথে কী করছে? অদ্ভুত ছেলে তো!
———————–
রাত প্রায় দশটা বেজেছে। ইরা’দ এখনো বাড়ি ফিরেনি। লোকমুখে শোনা গেছে পাশের এলাকার গার্লস স্কুলের দিকে ছোটখাটো ঝামেলা হয়েছে। মা!রা-মারি পর্যায়ের নয় অবশ্য। তাও হুলস্থুল লেগেছে। এই ঘটনা শুনেই মৌসুমি কেঁদে-কেটে হয়রান। তাঁর ভয় নিশ্চয়ই বড়ো কিছু ঘটেছে। এজন্যই তাঁর ছেলে বাড়ি ফিরেনি। এসব হাঙ্গামায় নওরি পড়তে পারলো না। নিচ থেকে চাপা কান্নার সুর ভেসে আসছে। নওরির পাশে নিদ্র নেই। নির্ঘাত দো’তলাতেই গিয়েছে। নওরি বিরক্ত না হলেও তাঁর মাথা ব্যথা করছে। তাঁর জানা নেই কেন এত সোড়গোল, চাপা কান্নার স্বর কানে আসছে। জানার ক্ষীণ আকাঙ্খা জাগলেও তা নিজ দায়িত্বে মাটি চাপা দিলো সে। রুম থেকে বের হতেই দেখলো নিদ্র সদর দরজা দিয়ে বের হচ্ছে।
নওরি পিছু ডাকলো। নিদ্র থেমে পিছে ফিরে তাকালো। নওরি এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,
–“ফ্রিশা কই?”
–“আম্মুর রুমে ঘুমোচ্ছে।”
–“নিচে কী হচ্ছে নিদ্র? এত সোড়গোল?”
–“বড়ো চাচী কাঁদছে। কোথায় নাকি নিদ্র ভাইয়া ঝামেলা করেছে। হয়তো ঢিশুম ঢিশুমও হয়েছে। আচ্ছা তুমি থাকো, আমি দ্রুত গিয়ে দেখে আসি নিদ্র ভাইয়া এসেছে কিনা!”
বলেই নিদ্র চলে গেলো। নওরির আর ফ্রিশাকে দেখতে যেতে ইচ্ছে হলো না। ভীষণ খারাপও লাগলো তাঁর। এত বড়ো দামড়া ছেলে কী না মা!রামারি করে বেড়ায়? অথচ বাড়িতে দেখো! মা কেঁদে অস্থির। কে বলে এসব রাজনীতি করতে?
পরক্ষণে বিকালের ঘটনা মনে পরতেই নওরির সর্বাঙ্গ শিথিল হয়ে গেলো। সে সুস্থ, সাবলীল থাকার পরেও কী করে ইরা’দ তাঁর কাছে আসলো? সে কেন ওইরকম একটা অবস্থায় নিজের সব হতবুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছিলো? নিজের প্রতি-ই রাগ হতে শুরু করলো নওরির।
নওরির এখন একটু শান্তির প্রয়োজন। সোড়গোলে নওরির মাথা ব্যথা বাড়ছে বৈ কমছে না। কী তীব্র ব্যথা। নওরি উপায়ন্তর না পেয়ে ছাদে যাবার সিদ্ধান্ত নিলো। যদিও রাত বেড়েছে। কিন্তু বাহিরের ব্যস্ততা এখনো কমেনি। তাই ভয় পাওয়ারও কারণ নেই। সারিফার কাছে শুনেছে ছাদে আলোর ব্যবস্থা রয়েছে। তাই নওরি মাথায় চটজলদি ঘোমটা পরে ছাদে চলে গেলো। যাওয়ার পূর্বে দরজা ভালোভাবে ভিড়িয়ে দিতে ভুললো না। হতেও পারে, ফ্রিশা ফাঁকফোকর পেলেই বেরিয়ে যাবে।
ছাদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে ইরা’দ যেই সিগারেট জ্বালালো ওমনি তাঁর পাশ থেকে কেউ একজন বলে ওঠে,
–“ছিহ!”
————————-
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
রিচেক হয়নি। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় থাকলাম। সকলকে রেসপন্স করার অনুরোধ।