#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ২১ |
———————–
–“আপনি কেন আমায় “আপনি” সম্বোধন করেন? ধারণা করছি আপনি আমার থেকে প্রায় দশ-এগারো বছরের বড়ো! এত বড়ো ছেলে হয়ে আমার মতো পিচ্চি মেয়েকে “আপনি” সম্বোধন করছেন। এটা বড্ড অস্বস্তিকর আমার জন্যে!”
ইরা’দ বিস্তর হাসি দিলো। নওরি পিটপিট করে চেয়েই রইলো। ইরা’দ হাসি থামিয়ে বলে,
–“আমি চাই না অনুমতি ছাড়া “তুমি” সম্বোধন করে অ!সভ্য, অ!ভদ্র খেতাব পেতে। আপনার ক্ষেত্রে তো একদমই নয়।”
–“কেন? অন্যদের থেকেও অনুমতি নেন বুঝি?”
–“না তেমন কিছু নয়।”
–“তাহলে?”
ইরা’দ এবার গভীর নজরে তাকালো। সেই চাহনি যেন চৌম্বুকের মতো টানছে নওরিকে। নওরি দ্রুত চোখ নামিয়ে ফেললো। ইরা’দ অধর বাঁকিয়ে হেসে বলে,
–“সবক্ষেত্রে অনুমতি নিতে হয় না আবার হয়ও। অনুমতির জন্যে আপনি নাহয় হলেন স্পেশাল মানুষ। তাতে কী? তবে আপনার অনুমতি ছাড়া আমি “তুমি” তে আসতে পারব না।”
–“আপনি আমার কোন কথার অনুমতি নেন শুনি? সবই তো নিজ ইচ্ছাতেই করেন!”
বাক্য দুটি নওরির খুব করে বলতে চাইলেও গলার স্বর তাকে প্রত্যাখান করলো৷ নওরি অস্বস্তিতে অধর ভিঁজিয়ে নিলো। কম্পিত কন্ঠে আওড়ায়,
–“অনুমতি দিলাম!”
–“কিসের? বিয়ের?”
নওরি চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো ইরা’দের পানে। ইরা’দ খিলখিলিয়ে হাসলো। হাসি থামিয়ে আবারও বলে,
–“জাস্ট কিডিং!”
নওরি মুখশ্রী ঘুচে জবাব দেয়,
–“তুমি সম্বোধনের।”
——————-
দিনটা সোমবার। বিকাল চারটা বেজে পাঁচ। এডমিশনের আর মাত্র কিছুদিন বাকি। নার্ভাসনেস এবং পড়ার চাপে নওরির বেহাল অবস্থা। পারা জিনিসগুলো ভুলে যাচ্ছে। এ বিষয়টি বড্ড বিরক্তিকর। নওরি ঠিক এ সময়টাতেই কেমিস্ট্রির এক জায়গায় আটকালো। মাথায় এলো আরও পড়া আছে, একটা বিষয় নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। বিরক্তি ঠেলে নওরি বই নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ইরা’দ নিশ্চয়ই এ সময়ে বাসায় আছে। তাকেই লাগবে এখন। নওরি প্রথমে ইরা’দকে কল দেয়। একবার, দু’বার, তিনবার। কিন্তু ইরা’দ কল রিসিভ করেনি। নওরি এবার আগে পিছে না ভেবে দ্রুত ছুটলো ইরা’দের বাসার উদ্দেশ্যে। বৈঠকঘর অতিক্রম করতেই নূরজাহানের পিছুডাক শ্রবণ হলো। তড়িৎ থমকে দাঁড়ায় নওরি। নূরজাহান কিচেন থেকে এগিয়ে এসে বলে,
–“কোথাও যাচ্ছো?”
–“জ্বী আন্টি। পড়া বুঝছি না, তাই দো’তলায় যাচ্ছি।”
–“ওহ! তাহলে তো বেশ ভালো। একটু দাঁড়াও আমি যাবো আর আসবো!”
নূরজাহানের দাঁড় করানোর মানে বুঝলো না নওরি। নূরজাহান নওরির হ্যাঁ, না; না শুনেই কিচেনের দিকে ছুটলো। এক বাটিতে কতগুলো পিঠা নিয়ে ফেরত এলো। নওরি পিঠার নাম না জানলেও এইটুকু মাথায় এলো এগুলো তেলের পিঠা। নওরি মূলত এই নামেই চেনে। কিন্তু এই গরমে পিঠা? হাস্যকর লাগলেও নওরি প্রকাশ করলো না।
নূরজাহান নওরির দিকে পিঠা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
–“ইরা’দের নাকি হঠাৎ পিঠা খেতে ইচ্ছা হয়েছে। তাই সবার জন্যে বানিয়েছি। তুই যেহেতু যাচ্ছিস-ই সেহেতু এটাও নিয়ে যা!”
নওরি সপ্তপর্ণে পিঠার বাটিটা নিয়ে বলে,
–“ঠিকাছে!”
নওরি এক মুহূর্তও দেরী না করে নিচে চলে গেলো। দুই হাত ভর্তি থাকায় সদর দরজা লাগাতে ভুলে গেলো। কলিংবেল বাজিয়ে নওরি একমনে দরজায় লাগানো লুকিং গ্লাসের দিকে তাকিয়ে রইলো। নিশ্চয়ই মৌসুমি আন্টি নওরিকে এখান দিয়ে উঁকি মেরে দেখবে। ভাবনাটা মাথায় আসতেই নওরি কিছুটা অস্বস্তিবোধ করলো। এক হাতে ক্ষণে ক্ষণে ঘোমটা আরও টেনে আনছে। ঘোমটা টানতে টানতে কপাল ছুঁয়েছে৷ তাও যেন নওরির কাছে লাগছে ওড়নাটা এখনই পরে যাবে। মিনিট পাঁচেক পর আবার কলিংবেল চাপতেই সাথে সাথে দরজা খুলে গেলো৷ নওরি চোখ তুলে তাকাতেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। ইরা’দ টাউজার পরিহিত অবস্থায়। গায়ে এক পট্টি জামার অংশ নেই; উম্মুক্ত৷ গলায় ঝুলানো তোয়ালের এক অংশ দিয়ে মাথার চুল মুছতে মুছতে ইরা’দ বলে,
–“স্যরি মা, আমি আসলে গোসলে ছিলাম। ভে…”
ইরা’দ তখনো লক্ষ্য করেনি নওরিকে। চোখ তুলে তাকাতেই ইরা’দ নিজেও অপ্রস্তুত হলো। নওরির চোখ জোড়া ততক্ষণে যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে। ইরা’দ তৎক্ষণাৎ নওরির মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলো। ভেতর থেকে দৌড়-ঝাপের শব্দ আসছে। ঘটনা সব এত দ্রুত ঘটলো যে নওরির মাথার উপর দিয়ে গেলো। মিনিটখানেকের মধ্যে আবারও দরজা খুললো ইরা’দ। তবে এবার খালি গায়ে নয়। টি-শার্ট পরেছে। তাও পেশিবহুল হাত গুলোর দিকে তাকালে সেই দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে আসছে নওরির। হৃদপিন্ড তাঁর ওঠা-নামার শব্দ বাড়ালো। ঢিপঢিপ শব্দ। নওরি দৃষ্টি পদতলের দিকে নিক্ষেপ করে কম্পিত হাতে পিঠার বাটিটা এগিয়ে দিলো। ইরা’দ বুঝতে পারছে নওরি ভীষণ অস্বস্তিতে ভুগছে।
ইরা’দের নিজের উপর-ই রাগ হচ্ছে। বিরক্তিতে কপালে ভাঁজ পরেছে। নওরিকে নিজের সাথে সহজ করতে বহুত কাঠখড় পোহাতে হয়েছে। এমতাবস্থায় আজকের এই অপ্রস্তুত ঘটনায় নওরির মস্তিষ্কে আবারও পুরানো অস্বস্তিটা ফিরবে! ফিরেও গিয়েছে নির্ঘাত! ইরা’দ নিচু স্বরে বলে,
–“স্যরি! আমি ভেবেছিলাম মা এসেছে! হঠাৎ আসলে যে?”
–“আসলে,”
নওরির কথা গলাতেই বারবার আটকে যাচ্ছে। শুকনো ঢোঁকে কয়েকবার গলা ভেঁজানোর মিথ্যে প্রচেষ্টা চালালো। ইরা’দ উৎসুক নজরে তাকিয়ে আছে নওরির পানে; উত্তরের অপেক্ষায়। নওরি আমতা আমতা করে বললো,
–“পড়া বুঝি না। কলও দিয়েছিলাম আপনাকে, কিন্তু রিসিভ করেননি!”
বলেই ইরা’দের দিকে কিছুটা নজর উঠিয়ে দেখতেই বিষম খেলো। ইরা’দের কপাল ভেঁজা চুলগুলো বিচরণ করছে। এক দুই বার চুল চুইয়ে সূক্ষ্ম পানির বিন্দু পরেছে৷ নওরি সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে ফেলে। ইরা’দ বলে, “ও আচ্ছা!”
ইরা’দ হঠাৎ ভেতরে চলে গেলো। নওরি ভাবলো হয়তো এখানেই তাকে পড়াবে। নওরির ভেতরে যাওয়ার সাহস হলো না। তাও পড়ার খাতিরে ভেতরে প্রবেশ করতে নিবে ওমনি ইরা’দ এসে হাজির। দরজা ধরে এমন ভাবে দাঁড়ালো যেন নওরি প্রবেশ করতে না পারে। এটা নওরি সহজেই বুঝে ফেললো। সাথে পরলো একরাশ লজ্জায়। কী বো!কামি করতে নিয়েছিলো সে। নিজেকে নিজেই গাল-মন্দ করলো। আর ইরা’দের-ই বা কী সমস্যা? ভদ্রতা বজায় রেখে ভেতরে আসার কথা একবারও তো বললো-ই না উল্টো ভেতরে যেতেও দিচ্ছে না। নওরির ভাবনায় জোরালো ছেদ ঘটিয়ে ইরা’দ বলে ওঠে,
–“আমাকে অ!ভদ্র ভেবো না। বাসায় কেউ নেই। তোমাকে নিয়ে ফাঁকা বাসায় থাকাটা দৃষ্টিকটু।”
নওরির মনে পরলো একটু আগে যখন ইরা’দ দরজা খুলেছে তখন ভুলবশত “মা” এর কথা বলছিলো। এত সহজে মাথা থেকে ব্যাপারটি বেরিয়ে গেলো। নওরি নিজের হাতে নিজেই চিমটি কাটলো। নওরি যেন আপাদমস্তক বো!কামীর ভান্ডার। তবে এক মুহূর্তের জন্যে ইরা’দের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাবোধ বাড়লো। নওরি তড়তড় করে বলে ওঠে,
–“না, না। ভাবিনি। আমি বুঝতে ভুল করেছি।”
–“রাগ করেছো?” ইরা’দের কন্ঠস্বর কিছুটা করুণ শোনালো। নওরি চোখ বড়ো বড়ো করে ফেলে।
–“রাগ করবো কেন? আপনি আসুন বাসায়, আমি যাচ্ছি।”
নওরি সিঁড়িদ দিকে চলে গেলো। ইরা’দ নওরির যাওয়ার পানে তাকিয়ে মিনমিন করে বলে,
–“যেদিন আমার বউ হবে, সেদিন তুমি নির্দ্বিধায় আমার সাথে একা থাকতে পারবে নৌরি ফুল। আমি চাই না আমার এই সতেজ ফুলের গায়ে কোনোরূপ দাগ লাগুক, তাঁর স্নিগ্ধ, সুগন্ধীময় পাঁপড়ি ঝড়ে পরুক। অন্তত এই ইরা’দ ঝড়তে দিবে না। সপ্তপর্ণে আগলে নিবে!”
বলেই ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। সিঁড়ি দিয়ে কারো নামার শব্দ শুনে ইরা’দ ভেতরে গিয়ে দরজার লাগিয়ে দিলো। দরজা লাগিয়ে পেছনে ফিরতেই দেখলো ফ্রিশা আয়েশ করে বসে ইরা’দের দিকে তাকিয়ে আছে। ক্ষণে ক্ষণে লেজ নাড়াতেও ভুলতে না। ইরা’দ ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকে বলে,
–“ও হ্যালো! আপনার ম্যাডাম আমার কাছে নেই। এখানে কী চাই?”
ফ্রিশা কোনো পতিক্রিয়া দেখালো না। নিশ্চয়ই ইরা’দের কথা বুঝতে পারেনি। সে আগের মতোই বসে আছে। এক প্রকার চোখ দিয়ে গিলছে!
——————-
ইরা’দ যেদিকেই যাচ্ছে ফ্রিশা তাঁর পিছু পিছু হাঁটছে। ইরা’দ এবার মজা বিরক্ত। অলরেডি দুবার পুরো বাসা টহল দেয়া শেষ। তাও এই বিল্লুরাণী তাঁর পিছুই ছাড়ছে না। ছায়ার মতো তাঁর পিছে পরে আছে। একসময় হাঁপিয়ে গিয়ে ধপ করে সোফায় বসে পরলো। ফ্রিশাও সময় বিলম্ব না করে এক লাফে ইরা’দের কোলে গিয়ে বসলো। ইরা’দের যেন নিজেকে সবচেয়ে অসহায় মনে হলো। ইচ্ছে করছে দুই চিমটিতে ধরে জানালা দিয়ে ফেলে দিতে। কিন্তু কিছুই করার নেই। তাঁর নৌরি ফুলের বিড়াল বলে কথা। ইরা’দ একসময় বিরক্ত হয়ে চেঁচালো,
–“এই তুই ছেলে নাকি মেয়ে? আমার পিছে লেগেছিস কেন?”
ফ্রিশা ঘাড় বাঁকিয়ে ইরা’দের বিরক্তিমাখা মুখমন্ডলের দিকে তাকালো। ইরা’দের আরও কাছ ঘেঁষে আহ্লাদী হয়ে মাথা ঘঁষতে ঘঁষতে বললো,
–“মিঁয়্যাও!”
–“মিউমিউ আমার সাথে চলবে না। সর, নিজের পথে যা!”
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।