নাইওরি পর্ব ১০
মৌরি মরিয়ম
ছোটবেলা থেকেই জেসমিন কিছুটা আলসে। কোহিনূর বানু বকাবকি করে তাকে দিয়ে সব কাজই শিখিয়েছে কিন্তু নিয়মিত করাতে পারেনি। যখন থেকে ভাবিরা এসেছে তখন থেকে তো সে রান্নাঘরের মাটিও মাড়ায়নি। কোহিনূর বানু বলতেন, ঘোরা দেখে খোঁড়া হয়েছে মেয়ে! সেই মেয়েকে কিনা শ্বশুরবাড়ি এসে এখন মসলা বাটতে হচ্ছে! রাতে বাড়িতে কুটুম আসবে। তাই বাহারী রান্নার আয়োজন হচ্ছে। সকালের নাস্তার পরেই কতগুলো করে আদা, রসুন, জিরা, ধনিয়া, হলুদ ও মরিচ বাটতে দিয়েছে শাশুড়ি। জেসমিন যখন এসব বাটছে তখন রান্নাঘরে এলো রঞ্জু। জেসমিনের পাশে বসে বলল,
“তোমার কষ্ট হচ্ছে ফুল?”
জেসমিন হেসে বলল,
“সব কামেই কষ্ট আছে। তয় শাশুড়ি যখন কাম দিছে করতে তো হইবেই। মায় দিলে না কইরা পারা যায়।”
“ইশ আমি বুঝতে পারছি তোমার কষ্টটা! আমাদের বাড়িতে এসব করার কত লোক আছে। মা তোমাকে কেন দিল?”
“তোমাগো বাড়িতে কেউ নাই। হেরা পাশের বাড়িত্যা আহে কাম করতে। আইজ আইতে পারবেনা কেউ। এল্লিগা আমারে দিছে।”
“আমার পড়া শেষ হলে যখন চাকরি করব তখন তোমাকে ঢাকা নিয়ে যাব। তখন আর তোমার এত কষ্ট করা লাগবে না।”
“ঢাকা গেলে বুঝি এইসব করা লাগবে না? আরও বেশি করা লাগবে। সবই একলার করা লাগবে হেকালে।”
“যেসব রান্না করতে মসলা বাটা লাগে তার কোনোটাই আমরা খাব না।”
জেসমিম হেসে বলল,
“বাডা মসল্লা ছাড়া কোনো রান্নাই হয় না। এত কষ্ট বুঝলে বাইট্যা দাও।”
“আচ্ছা বেটেই দেই বরং। তুমি দরজায় পাহাড়া দাও। মা যদি দেখে তোমাকে মসলা বেটে দিচ্ছি, তুফান নামাবে।”
জেসমিন ফিক করে হেসে বলল,
“মায় এহন আইবেনা। তবু পাহাড়া দেই। নাইলে যদি দেইখ্যা হালায় আমারে দজ্জাল বউ কইবে।”
রঞ্জু হেসে দিল। জেসমিন আবার বলল,
“মরিচ বাডা লাগবে না। হাত জ্বলবে। আমি পরে বাডমু। তুমি অন্যগুলান বাডো যেদ্দুর পারো।”
“তোমার হাত জ্বলবেনা?”
“আমি তো আগেও বাডছি। টেকনিক জানি ক্যামনে হাত না লাগাইয়া বাডতে অয়। আর জ্বললেও সহ্য করতে পারমু। তুমি পারবা না।”
জেসমিম উঠে গেল। পাশে বসে দরজায় পাহাড়া দিল। রঞ্জু সত্যিই সত্যিই মসলা বাটতে শুরু করে দিল।
জেসমিন রঞ্জুর বিয়ের পর তিন চার মাস সময় নিলেন হারুন ব্যাপারী। ততদিনে রঞ্জুর ইউনিভার্সিটি খুলে গেছে। সে ঢাকা যাবে, যাওয়ার আগে জেসমিন তার বাপের বাড়িতে নাইওর যাবে। রঞ্জুই দিয়ে আসতে চেয়েছিল যাতে রঞ্জু চলে গেলে তার একা না লাগে। কিন্তু জেসমিন কেঁদেকেটে একাকার করলো। সে জানালো রঞ্জু যতক্ষণ আছে, সে ততক্ষণ কোথাও যাবে না। রঞ্জু ঢাকা যাওয়ার পর সে শ্বশুরের সাথে বাপেরবাড়ি যাবে।
রঞ্জু চলে যাওয়ার পর হারুন ব্যাপারী জেসমিনকে নিয়ে কেশবপুর গেলেন। জেসমিনকে দেখামাত্র তার ভাবিরা খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলো, আমাগো নাইওরী আইছে!
হারুন ব্যাপারীর আতিথেয়তার জন্য বিরাট আয়োজন করা হলো। খাওয়াদাওয়ার পর তারা যখন বাহির বারান্দায় পান নিয়ে বসলনে তখন হারুন ব্যাপারী কথাটা তুললেন,
“চেয়ারম্যান সাহেব কালিসুরির জমিটার কী করবেন? কতগুলা নগদ টাকা দিয়া জমি কিনেছিলাম! আপনি বিচক্ষণ মানুষ, এখন আবার পরম আত্মীয়। আশা করি আপনি ব্যাপারটা ভেবে দেখবেন।”
মুহূর্তের মধ্যেই টনক নড়ল জয়নাল মির্জার। এবার সে বুঝতে পারলো সে যে চিন্তা করে জেসমিন রঞ্জুর বিয়েতে খুশি হয়েছিলেন ঠিক একই চিন্তা করে হারুন ব্যাপারীও বিয়ের প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন। এখন মনে হচ্ছে সে হারুন ব্যাপারীর ফাঁদে পড়েছেন। ইচ্ছে করেই কি সে জেসমিনের পেছনে তার ছেলেকে লেলিয়ে দিয়েছিল? জয়নাল মির্জার মেজাজ তখন সপ্তম আসমানে। সে বলল,
“ব্যাপারী কি এই কারণেই ছেলে বিয়া করাইয়া আত্মীয়তা করছেন?”
হারুন ব্যাপারী হেসে বললেন,
“কী যে বলেন চেয়ারম্যান সাহেব! ছেলে-মেয়ের ভালোবাসার মর্জাদা দেয়ার জন্যই তো এই বিয়ে। ছেলেমেয়ের ভালোবাসা আমাদের ব্যক্তিগত সমস্যার সাথে জড়ানোর কথা চিন্তাও করতে পারিনা।”
“চিন্তা কইরেনও না। ভুলেও না। ছেলে-মেয়েরে আমরা তাদের জায়গায় রাখি আর নিজেগো নিজের জায়গায়। এতেই তারা এবং আমরা ভালো থাকমু। এইসব জমিজিরাতের ভেজালে তাগোরে আইন্যা তাগোর বিপদ ডাকনের দরকার কী?”
চেয়ারম্যানের সুক্ষ্ম হুমকি সাথে করে বাড়ি ফিরলেন হারুন ব্যাপারী। তিনি আজ এটা বুঝে গেলেন যে, জেসমিন রঞ্জুর বিয়ে তার একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। তিনি যেই চিন্তা করে এই বিয়ে দিয়েছিলেন সেটা সম্ভব নয়।
চলবে…
আগের পর্ব,
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=550994386391329&id=100044423166701