মেঘলা আকাশে রুদ্রই ভরসা
উম্মে হাবিবা তনু
পার্ট:৪৮
ভারী বর্ষণ থেকে থেকেই বাড়ছে।সকাল থেকে রোদের দেখা মিলেনি একবারও।আজ দুইদিন ধরে বৃষ্টি হয়েই চলেছে।ক্ষানিক ক্ষণের জন্য বর্ষণ বিরতি দিলেও আকাশটা বিবর্ণ।ধূসর মেঘ ছেয়ে আছে আকাশ।বর্ষণমুখর দিন বুঝি একেই বলে।
মাহা এমন বর্ষণমুখর দিন আগে কখনো দেখেনি।জানালার পাশে বিরস মুখে কফির মগ নিয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে।বৃষ্টি দেখতে ভীষণ ভালো লাগছিলো তবে এই মুহূর্তে বৃষ্টির উপরই ভীষণ বিরক্ত।আজ যদি বৃষ্টি না হতো তাহলে ওদের প্ল্যানিং ক্যান্সেল হতো না।পাপা বলেছে মাত্র এক সপ্তাহের জন্য এসেছে।এর মধ্যে দুইদিনের সব প্ল্যানিং ক্যান্সেল!বিরক্তির সাথে বেশ মন খারাপও হচ্ছে।ঠান্ডা হয়ে আসা কফির মগে চুমুক দিতেই বিরক্তির মাত্রা আরেকদফা বেড়ে গেল।কিছুই ভালো লাগছে না এই মুহূর্তে।দেশে এসে ভাবলাম কত আনন্দ করবো,গল্প করবো,মাম্মা পাপার গল্প শুনবো।আরও কত কি ভেবে রেখেছি।তা আর হলো কই!
মামনি এই বৃষ্টির মধ্যেও এনজিও তে বেরিয়ে গেছে।বাড়িতে বসে ছুটি শেষ করতে চাইছে না।কোথাও না গেলেও ঘরে বসে তো আমাকে সময় দিতে পারতো!!
নানুমনী রান্না করছে,কড়া বারণ দিয়ে গেছে যেনো রান্নাঘরে না যাই।নানাভাই সেতো এখন নিউজপেপার নিয়ে বসেছে।সামনে পেলেই সেসব নিউজ নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করবে তাতে বিরক্তি কমবে বৈ বাড়বে।আর পাপা!বাংলাদেশে পা দেয়ার পর থেকেই কোথায় যে হারিয়ে যাচ্ছে কে জানে,কিসব ভাবনায় বিভোর থাকে বুঝা যাচ্ছে না।আজ জিজ্ঞেস করবো কি এত ভাবনা পাপার।
অনেক ভেবে মাহা রুদ্রর রুমের দিকে পা বাড়ালো।
রুদ্রর রুমের দরজা হালকা ভিজানো।ভিতর থেকে গুনগুন শব্দ শুনা যাচ্ছে।মাহা দরজা হালকা ধাক্কা দিয়ে বাইরে থেকে উকি দিয়ে দেখলো জানালার পাশে দাড়িয়ে ওর পাপা গুনগুন করে গান গাইছে।কি যে ভালো লাগছে ওর।পাপার গান শুনতে ভীষণ ভালো লাগে ওর।মন ভালো করতে এইতো ডের।
দরজায় মৃদু আওয়াজ হতেই গুনগুন থেমে গেল।পিছন ফিরে মাহাকে দেখে মনটা আবার বিষাদে বিষিয়ে গেলো।মনে পড়ে গেল ওর একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে।আজ দুইদিন হতে চললো তবুও কিছুতেই পারছে না বলতে।কিভাবে বললো,কোথা থেকে শুরু করবে,মাহা কিভাবে নিবে??এইসব ভাবনায় মগ্ন হয়ে নিজেকে একপ্রকার ঘর বন্দী করে রেখেছে।থিতিয়ে যাওয়া মুখে হাসার চেষ্টা করল।আদোতে সেটাকে হাসি বলে না যদিও।
এই তো বেশ গান করছিলে,আমাকে দেখে কেনো থেমে গেলে আর মুখটা এমন করে রেখেছ কেনো??
নিজের মুখভঙ্গি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বললো,কই আর গান করছিলাম??
আমি শুনেছি পাপা।
তুই আমার গান শুনবি মা??
শুনবো না আবার!!তোমার গান শুনলেও মন ভালো হয়ে যায়।
তোর কি আজ মন খারাপ?
মাহা মাথা উপর নিচ করে বুঝলো তার মন খারাপ।
খুব বেশি??
হুমম….
হটাৎ এত মন খারাপের কারণ কি??
এই মেঘলা দিন গো পাপা এই মেঘলা দিনের জন্য….বিছানায় বসতে বসতে মাহা বললো।
রুদ্র অবাক চোখে তাকিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলল,মেঘলা দিনের জন্য!!
হ্যাঁ তো পাপা।আজ এমন দিন না হলে তো আর ঘুরতে যাওয়া ক্যান্সেল হতো না।
এই জন্য আমার বুড়িটার মন খারাপ!
হুমম…
মেঘলা দিন না থাকলে কি করে বুঝবি রোদেরও প্রয়োজন হয়।
আচানক এমন কথার মানে বুঝতে না পেরে প্রশ্নাত্বক চোখে তাকিয়ে রইল।
বুঝলি না তো??
উহু..
রোদের দেখা তো সচরাচর পাই ই…তখন কিন্তু রোদের তাপে বিরক্ত হয়ে যাই।আর যখন মেঘলা দিন আসে তখন মনে এক পশলা রোদের দেখা পেলেও তো হতো…
তাহলে তো পাপা এইটাও বলতে হয় রোদের পরে মাঝে মাঝে মেঘলা দিনেরও প্রয়োজন!
হুঁ,প্রয়োজন।একনাগাড়ে রোদ যেমন সহনীয় নয় তেমন একনাগাড়ে মেঘলা দিনও ভালো লাগে না।দুটোর সমন্বয়েই পৃথিবী সুন্দর হয়।
যেমন আমার মাম্মা আর পাপা।তাদের সমন্বয়েই আমি মাহা মানে সুন্দর…মাহার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল।
রুদ্র গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
তোর মন ভালো হয়ে গেছে।
মাহা ঠোঁট উল্টে বললো,তুমি একটা গান শুনাও মন আরও ভালো হয়ে যাবে।
রুদ্র হাসলো।আমার বুড়িটা বলেছে আমি শুনবো না তা কি হয়??
মাহাও হাসলো।তাহলে এইবার শুনাও।
শুনবো।তার আগে ছাদে চল।
এত বৃষ্টির মধ্যে ছাদে??ভিজে যাবো তো…
বৃষ্টিতে ভিজায় কি ভালো লাগা আছে সেটা বুঝতে হলে ভিজতে হবে।চল…
মাহা ওর পাপার হাত ধরে ভিজতে চলে গেলো রিনিঝিনি বৃষ্টিতে।
বৃষ্টি ফোঁটা গায়ে পড়তেই একরাশ ভালো লাগারা যেনো ছুঁয়ে দিয়ে গেলো মাহাকে।ছাদের কার্নিশের রেলিং ঘেঁষে দুহাত প্রসারিত করে আকাশ পানে তাকিয়ে বৃষ্টি ফোঁটাগুলো অনুভব করতে চাইছে।প্রতিটি ফোঁটা যতবার ছুঁয়ে যাচ্ছে ততবারই নিজেকে মনে হচ্ছে শুদ্ধ,পবিত্র।মনে হচ্ছে জগৎ সংসারের যত পাপ,গ্লানি,অপবিত্রতা আছে সব ধুয়ে নিয়ে পবিত্র করে দিচ্ছে।
রুদ্র মুখ টিপে হাসছে।আসলেই মায়ের মত হয়েছে।মাহার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।কোনো ভূমিকা ছাড়াই বললো,
তোর মায়ের বৃষ্টি খুব পছন্দ ছিল।
অনেকবার বলেছ পাপা।তবে আজ বুঝতে পারছি মাম্মাহ কেনো বৃষ্টি পছন্দ করতো।
মেঘলা চেয়েছিল তুই আমার হোস কিন্তু দেখ কোনো না কোনোভাবে তোর মায়ের ভালো লাগার সাথে তোর সব মিলে যাচ্ছে।তুই দেখতে যেমন মেঘলার মত বাদ বাকি সবও।
মোটেও না পাপা।দেখতে মাম্মার মত হলেও আমি তোমার মত সবাই বলে।আমার ফ্রেন্ডরাও।তবে পাপা…
রুদ্র কপাল ভাঁজ করে মাহার দিকে তাকালো।মিটমিট করে হাসছে।বেফাঁস কিছু না বলে বসে।
সেদিকে কোনো পাত্তা না দিয়ে মাহা বলে উঠলো,মাম্মার যা যা ভালো লাগতো,পছন্দ ছিল সেসব কিছুই এখন তোমার ভালো লাগে।মনে দাড়াচ্ছে তুমি মাম্মা এর মতো হয়ে গেছ আর আমি তোমার মত।কিন্তু ওই যে তুমি মাম্মা এর মত হয়ে গেছ সেটা তুমি বুঝো না বা কাউকে বুঝেও বুঝতে চাও না বলে তোমার মনে হয় আমি মাম্ম এর মত।বুঝেছো??হাহাহা……
সব বুঝে গেছিস তুই??
তা নয়তো কি??দাদুমনি বলেছে তো তোমার বৃষ্টি ফিষ্টি পছন্দ ছিল না আর ভিজা তো দুঃস্বপ্ন।আর দেখো সেই তুমিই বৃষ্টিতে ভিজছ তাও আমাকে নিয়ে।জ্বর ঠান্ডা যে লাগতে পারে তাও কিন্তু ভাবছো না।
এই বৃষ্টি থেকেই তো তোর মাম্মার প্রতি ভালো লাগাটা শুরু হয়েছিল।মিটিমিটি হাসিতে মুখ চেয়ে গিয়েও মিলিয়ে গেল।মনে মনে বলে উঠলো,সর্বগ্রাসী ধ্বংসের শুরু এইখানেই….
সত্যি??এত সুন্দর সময়ে তোমার আর মাম্মা এর শুরুটা?বৃষ্টি থেকে?
আমাদের দুইজনের না আমার একার ভালো লাগার শুরু।আমি তোর মাম্মাকে ঠকিয়েছি।রুদ্রর গলা ধরে আসছে।
তুমি কেনো ঠকাবে??কি সব বলছো??
……
পাপা….
…….
ও পাপা চুপ করে আছ কেনো??
……
পাপা….
গান শুনবি না??
বলতে চাচ্ছো না??
ধরে আসা গলাটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বললো,তুই পুরোপুরি মেঘলার মত না।
মাহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ক্ষানিকটা সরে দাঁড়ালো।বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দই শুনা যাচ্ছে না।
চোখ নৃসিত অশ্রু গাল গড়িয়ে বৃষ্টির সাথে হারিয়ে গেলো।রুদ্র নিজেকে সামলে নিতে চাইছে।আকাশের দিকে তাকিয়ে গান ধরার চেষ্টা করে বারবার ব্যর্থ হয়ে থেমে যাচ্ছে।
পাপা মাম্মাম এর সম্পর্কের জটিলতা আজও বুঝে উঠতে পারলো না মাহা।সবাই ধোঁয়াশা রাখে সবসময়।যেনো এই বিষয়ে কথা বলাই ঠিক না।পাপার নির্লিপ্ততা,হটাৎ হটাৎ গুমরে গুমরে থাকা থেকে বুঝে তাদের সম্পর্কে কোনো অস্বাভাবিকতা ছিল।তাই আর জোর করে পাপাকে কষ্ট দিতে চায় না।
মাহা পাপার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
রুদ্রও একহাতে মেয়ের কাধ জড়িয়ে ধরলো।
বারকয়েক চেষ্টার পর এবার গান ধরলো রুদ্র।
বৃষ্টির ছন্দের সাথে মিশে যাচ্ছে এক সুরের লহমা।
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে,
তোমারে দেখিতে দেয় না
মোহমেঘে তোমারে।
অন্ধ করে রাখে, তোমারে দেখিতে দেয় না।
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই,
চিরদিন কেন পাই না।
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই,
চিরদিন কেন পাই না।
ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে
তোমায় যবে পাই দেখিতে।
ওহে ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে
তোমায় যবে পাই দেখিতে।
ওহে হারাই-হারাই সদা হয় ভয়
হারাই-হারাই সদা হয় ভয়, হারাইয়া ফেলি চকিতে
আশ না মিটিতে হারাইয়া, পলক না পড়িতে হারাইয়া,
হৃদয় না জুড়াতে হারাইয়া ফেলি চকিতে।
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই,
চিরদিন কেন পাই না।
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই,
চিরদিন কেন পাই না।
ওহে কী করিলে বল পাইব তোমারে,
রাখিব আঁখিতে আঁখিতে।
ওহে কী করিলে বল পাইব তোমারে,
রাখিব আঁখিতে আঁখিতে।
ওহে এত প্রেম আমি কোথা পাব, নাথ
এত প্রেম আমি কোথা পাব, নাথ,
তোমারে হৃদয়ে রাখিতে
আমার সাধ্য কিবা তোমারে-
দয়া না করিলে কে পারে-
তুমি আপনি না এলে কে পারে হৃদয়ে রাখিতে
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই,
চিরদিন কেন পাই না।
ওহে আর-কারো পানে চাহিব না আর,
করিব হে আজই প্রাণপণ-
ওহে আর-কারো পানে চাহিব না আর,
করিব হে আজই প্রাণপণ।
ওহে তুমি যদি বল এখনি করিব
তুমি যদি বল এখনি করিব
বিষয় -বাসনা বিসর্জন
দিব শ্রীচরণে বিষয়- দিব অকাতরে বিষয়-
দিব তোমার লাগি বিষয়-বাসনা বিসর্জন
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই,
চিরদিন কেন পাই না।
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে,
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে-
তোমারে দেখিতে দেয় না।
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই,
চিরদিন কেন পাই না।
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই,
চিরদিন কেন পাই না।
বাবা মেয়ের এমন দৃশ্য দেখে দুচোখ ভরে উঠেছে সাবিবা।কারো সাথে কারো কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই অথচ ওদের আত্মার সম্পর্ক কত গভীর।
এনজিও থেকে তাড়াতাড়ি ফিরেছে মাহাকে সময় দেওয়ার জন্য।যতদিন ওরা আছে যতটা পারে ওদেরকে সময় দিবে।
কিন্তু যার জন্য ফিরা তারই খবর নেই।বৃষ্টির মধ্যে কোথায় গেলো?
নাকি মেয়েটা ওর মায়ের মত বৃষ্টি প্রেমী??ছাদে গিয়ে ভিজছে না তো? জ্বর ঠান্ডা না বাধায়।এক্ষুনি নিয়ে আসতে হবে।সে ভেবেই ছাদে আসা।কিন্তু এখন আর ডাকতে ইচ্ছে করছে না।নীরবে সেখান থেকে সরে গেল।
চলবে…….
গল্পটা শেষের দিকে।আপনাদের গঠনমূলক মন্তব্য জানাবেন।ধন্যবাদ😊