মেঘলা আকাশে রুদ্রই ভরসা উম্মে হাবিবা তনু পার্ট:৪৯

0
495

মেঘলা আকাশে রুদ্রই ভরসা
উম্মে হাবিবা তনু

পার্ট:৪৯

বৃষ্টি দমক কিছুটা থেমে এসেছে।তবুও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ফোঁটা পড়ছে।হালকা বাতাসও দিচ্ছে,তবে তাতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে।শীত শীত লাগছে।অনেকটা সময় ভিজার কারণেই হয়তো এমন লাগছে।কিন্তু তারচেয়েও শীতল বাতাস বইছে মাহার মনে।মনে হচ্ছে এক্ষুনি সে শীতলতায় বরফে পরিণত হবে আর না হয় এইটা কোনো দুঃস্বপ্ন।দুঃস্বপ্নে এমন কিছু শুনার কথা না তবুও মানা যাবে।

গানটা শেষ হতেই মাহার মনে হচ্ছে এইটা হয়তো ওর মাম্মকে উদ্দেশ্য করে গেছে।হয়ত খুব মিস করছে।ওর সাথে তো পাপা কখনোই মাম্মকে নিয়ে কিছু বলে না।তাদের সম্পর্কটাও কেমন একটা ধোঁয়াশা ওর কাছে।আজ অনেক বেশি কিউরিসিটি থেকে একটা প্রশ্ন করেই ফেললো।
তোমার আর মাম্মামের সম্পর্কটা খুবই রহস্যজনক…
রুদ্র মাহার দিকে তাকালো।তার দৃষ্টি শূন্য।তাতেই মাহা কথা ঘুরিয়ে নিতে চাইলো।আর যাই হোক যা ওর কাছে বলতে চায় না তা ও মোটেও জোর করে শুনবে না।
না মানে পাপা আমি বলতে চাইছি…
আমি তোর নিজের পাপা নই।রুদ্রর কণ্ঠ আজ খুবই শীতল।
মাহা থমকে গেলো সে কণ্ঠ শুনে,সে কণ্ঠ নিঃসৃত বাক্য শুনে।
পাপা!!!
এইটাই সত্যি আর এইটাই সব রহস্যের কারণ।
রুদ্র আর দাড়ালো না।তৎক্ষণাৎ সে নেমে গেলো ছাদ থেকে।আর পিছনে ফেলে গেলো দ্বিধান্বিত মাহাকে।

মনের মধ্যে প্রায়ই এইধরনের কত প্রশ্নই তো উকি দেয় কখনো প্রকাশ করা হয় না।আজ হটাৎ মুখ ফুটে বেড়িয়ে গেলো।তাই বলে এমন একটা উত্তর দিবে??হয়তো পাপা রেগেই উত্তর দিয়েছে।কিন্তু রাগার মত কিছু বলিনি তো।ছোট্ট একটা কথা বললাম….

দুপুর গড়িয়ে বিকেল গেলো আর এখন রাত।বৃষ্টি আবার বেড়েছে প্রলয়ংকরী রূপে।রুদ্র এখনো ফিরেনি।অনেকবার কল করার পরও তাকে পাওয়া যায়নি।কিভাবে যাবে সেতো ফোন নিয়ে যায়নি।ভিজা কাপড়েই সেই যে ছাদ থেকে নেমে গেছে এখনো ফিরেনি।মাহার মুখটাও থমথম করছে।মেয়েটাও দুপুর থেকে খায়নি।খাবার নাড়াচাড়া করে উঠে গেছে।তার ক্ষিধে নেই নাকি।সবাই ভাবলো বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর এসেছে তাই হয়তো খেতে চাচ্ছে না।তবে চিন্তার বিষয় রুদ্রতো এমন করে না কোথায় গেলো সে??বাবা মেয়েতো সকাল থেকে ঠিক ছিল।তাহলে কি মাহা সব জেনে গেলো??

রাত বাড়ার সাথে সাথে সবার মুখে চিন্তার রেখা গাঢ় হচ্ছে।
হাড় কাপিয়ে জ্বর ঝেকে ধরলো মাহাকে।জ্বরের ঘোরে কি সব বিড়বিড় করছে।

এইদিকে রুদ্রর কোনো খবর নেই।
মুবিন হাসান ছাতা হাতে বেরিয়ে পড়লেন।ফার্মেসি থেকে ডক্টরকে নিয়ে আসতে চাইলেন।
কিন্তু এত বৃষ্টিতে যেতে রাজি হল না।বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর এসেছে এত সিরিয়াস কিছু না।গা হাত পা মুছে কিছু খাইয়ে নাপা খাওয়ালেই নাকি কমে যাবে।তাও না কমলে মাথায় পানি ঢালতে বললেন।পরে সকালে না হয় দেখে আসবেন।
মুবিন হাসান খুব বিরক্ত হলেন।সামান্য বৃষ্টির জন্য রোগী দেখতে যেতে পারে না আবার ডক্টর সেজে বসে আছে।যদিও বা সে ডক্টর নয় হাতুড়ে ডাক্তার।সামনে কিছু না বললেও মনে মনে বেশ কিছু গালমন্দ করলেন।তারপর পকেট থেকে ফোন বের করে সাবিবাকে সবটা বুঝিয়ে বললেন।এইবার তিনি যাবেন রুদ্রের সন্ধানে।

পুরো এলাকা মোটামুটি খোঁজা শেষ।রুদ্রদের পুরনো সেই বাড়ির দিকেও গেলেন।কিন্তু কোথাও তাকে পাওয়া গেলো না।তাই ফিরে আসছিলেন তিনি।কিন্তু বাড়ির কাছাকাছি আসতেই থেমে গেলেন।মনে হলো বাড়ির পাশের দিকটা তো দেখা হলো না।আবার সেদিকে পা বাড়ালেন।তিনি যা ভেবেছিলেন তাই হলো।মেঘলার কবরের পাশে বসে আছে রুদ্র।ধীরস্থিরভাবে সেদিকে এগিয়ে গেলেন।আলতো করে রুদ্রর কাধে হাত রাখতেই বুঝলেন সে কাপছে।তবে কি সে কাদছে।এতবছরের পুরনো ক্ষত আজও এত তাজা??এত গভীর??

সাবিবা মাহার সারা শরীর মুছে দিলো।মমতা হাসান এক বাটি সুপ করে আনলেন।কিছুতেই খেতে চাইছে না।
দুইজন মিলে খুব জোর করে অল্প একটু খাইয়ে দিয়ে ওষুধ খাওয়াল।
তারপর আবার শুইয়ে দিলো।
কিন্তু মাহার বিড়বিড় আরোই বেড়ে চলেছে।
মুখের কাছে কান নিয়ে সাবিবা শুনার চেষ্টা করল,কি বলছে!
তু..মি..ই..আ..মা..র..বা..বা…
এই একটা কথাই বারবার বিড়বিড় করছে।
এইবার যেনো সব পরিষ্কার হতে লাগলো।দুহাতে মাহাকে বুকে চেপে ধরল।অনুভব করলো তার বুকটাও ভারী হয়ে আসছে।তার মেয়েটার যে কষ্ট হচ্ছে।অতীত এত কষ্টের কেনো হয়?

হাতের ছোঁয়া পেতেই পিছন ফিরে তাকাল।মুবিন হাসানকে দেখেই ঝরঝর করে কেঁদে উঠলো।করুন সুরে বলল,কেনো এমন হলো আঙ্কেল??কেনো এতো অভিমান হলো আগে??কেনো অতীতটা এত নির্মম??কেনো মাহা আমার নিজের সন্তান নয়??
এত কেনোর ভীড়ে কোনো উত্তর নেই মুবিন হাসান এর মুখে।মেয়ের কবরের সামনে দাড়িয়ে চোখের কোণে অশ্রুর অস্তিত্ব বেশ টের পাচ্ছেন।বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।ছোট ছোট ভুল থেকে দীর্ঘমেয়াদি কষ্ট কেনো দিচ্ছেন আল্লাহ!!এতবছরেও অতীত কেনো পিছু ছাড়ছে না??

রুদ্র যখন বাড়ি ফিরলো তখন অনেক রাত।সারা গায়ে কাদায় মাখামাখি।মুবিন হাসানই নিয়ে এসেছে।
বাড়ি ফিরে কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা নিজের ঘরে ডুকে গেল।লম্বা একটা শাওয়ার নিল।অনেকটা সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে ডাইরিটা হাতে নিল।
মাহার মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে।জ্বর কিছুতেই কমছে না।
সবার দৃষ্টির আড়ালেই ডাইরিটা মাহার বালিশের পাশে রেখে রুদ্রও মাহার পাশে বসল।আলতো করে ডাকলো।
মাহা…..
মাহা পিটপিট করে তাকালো।
রুদ্র আবার ডাকলো।
এইবার খুব ক্ষীণস্বরে মাহা বললো,পাপা এসেছ…
ভিতরটা খা খা করছে।তবুও বললো,এইতো মা আমি এসেছি।
মাহা উঠে বসার চেষ্টা করছে।সাবীবা বাঁধা দিতে চাইলে রুদ্র বারণ করল।পাশ থাকা টাওয়েলটা মাহার মাথায় পেঁচিয়ে দিলো।তারপর ধীরে ধীরে ওকে তুলে বালিশে হেলান দিয়ে বসলো।
রুদ্রর হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,পাপা তুমিই আমার পাপা।
হ্যাঁ তো আমি আমার প্রিন্সেস এর পাপা।কিন্তু সে বলায় কোনো জোর ছিল।
পাপা…
হ্যা মা বল…
তুমি তখন দুষ্টুমি করছো??
রুদ্রর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।কি বলবে ও??
পাপা চুপ করে থেকো না।অঝোরে মেয়েটা কেঁদেই চলেছে।
…….
তোমার প্রিন্সেস কষ্ট পাচ্ছে পাপা…
….
ও পাপা…..
…….
আমাকে একটু আদর করে দেওয়া না।
রুদ্র আলতো করে এক হাত মাহার মাথায় রাখলো।
রুদ্রর বলার মত অবস্থা নেই।সে চুপ করেই রইলো।
সাবিবা মাহার পাশে বসে বললো,এইভাবে কাদিস না মা।তোর শরীর আরো খারাপ করবে তো।সব ঠিক হয়ে যাবে,কাদিস না।
তাহলে মামনি তুমি কাদছ কেনো??নানাভাই নানুমণী কাদঁছে কেনো??

মমতা হাসান এইসব সহ্য করতে পারছেন না।দুটো দিন বেড়াতে এসে কেনো তার পুরান কথা শুনা লাগবে?কেনো বাচ্চা মেয়েটাকে সবাই মিলে কষ্ট দিচ্ছে??তিনি আঁচলে মুখ গুজে কাদতে কাদতে বেরিয়ে গেলেন।মুবিন হাসানও আর পারছেন না সেখানে থাকতে।তিনি বেরিয়ে যাওয়ার আগে সাবিবাকে সাথে নিয়ে গেলেন।
ওদের বাবা মেয়েকে একটু সময় দে,ওদেরও তো সবটা সামলে নিতে হবে।আমরা না হয় পরে আসবো।
সাবিবাও বিনা বাক্য ব্যয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো।মেয়েটাকে পেটে ধরেনি ঠিকই জন্মের পর থেকে চার বছর ওর বুকে আগলে রেখেছে।তার কষ্ট কি করে সইবে??

পাপাকে কাছে পেয়ে যেনো মেয়েটা একটু স্বস্তি পেল।রুদ্রর কোলে মাথা রাখতেই দুচোখে ঘুম এসে ভর করছে।রুদ্রও আলতো হাতে চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।সব স্বস্তি আর ভরসারা একসাথে জড়ো হয়েছে যেনো মাহার কাছে।

চলবে…….

আগের পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/140699218169611/posts/379725044267026/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here