মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤ #পর্বসংখ্যা_৩৩.

0
2150

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৩৩.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

গাড়ি ছাড়ার শব্দ হতেই সদর দরজা ধরে দাঁড়িয়ে পরলো মেহনূর। চোখের সামনে যে দৃশ্যগুলো দেখতে পেলো তাতে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে ওর। দৌড়ের জন্য একটুও স্বাভাবিক হতে পারছে না সে, বুকের হৃদপিন্ড যেনো লাফ দিয়ে গলায় বসে গেছে। বারবার ঢোক গিলেও খসখসে গলাটা সিক্ত করতে পারছে না, নিশ্বাসের টানে বারবার বুক ফুলিয়ে হাঁপাচ্ছে। আরো জোর খাটিয়ে দৌড়ানো দরকার, মাহতিমকে আটকানোর জন্য শেষ শক্তিটুকু খরচ করতে কুণ্ঠিত নয় মেহনূর। কিন্তু এতখানি দৌড়ে এসে গলাটা নিশ্বাসের টানে ছিড়ে যাচ্ছে যেনো, ঢিপঢিপ করে কাঁপছে বুকটা, শরীরটা এমন হতবিহ্বল-শক্তিশূণ্য লাগছে তাতে মনেহচ্ছে জ্বর থেকে কেবল উঠেছে মেহনূর। কাঠের আভিজাত্য দরজায় হাত রেখে ফ্লোরের দিকে মাথা নুয়ালো মেহনূর, মুখ হা করে জোরে-জোরে শ্বাসকার্য চালাতেই শাড়ির কুচিগুলোর অবস্থা এলোমেলো দেখতে পেলো। পায়ের কাছে কুচিগুলো খানিকটা নিচে নেমে গেছে, একপা এগুতে গেলেই উষ্টা খাওয়ার সম্ভাবনা আছে। মেহনূর জোরে-জোরে দম নিতেই দরজা থেকে হাতটা ধীরেসুস্থে নামিয়ে ফেললো, উষ্টার হাত থেকে বাচার জন্য কুচিগুলো উচুঁ করে ধরলো। বড় বড় দুটো গভীর নিশ্বাস নিতেই সামনের দিকে তাকালো মেহনূর। ওমনেই নিশ্বাসটা ছাড়ার সুযোগ হলো না, স্থিরদৃষ্টিতে থমকে গেলো মেহনূর। এতোক্ষন যেই ঝড়টা টের পায়নি, হঠাৎ সেটা এমনভাবে গ্রাস করলো তখন আর স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না মেহনূর। চোখদুটো টলমল করে উঠলো ওর, তীব্র জোয়ারের মতো উত্থাল-পাত্থাল হয়ে গাল জুড়ে অশ্রু গড়াতে লাগলো। হেড কোয়ার্টার থেকে আসা চকচক সাদা গাড়িটা চলে যাচ্ছে, বেগতিক স্পিডে এগিয়ে যাচ্ছে বাড়ির মেইন গেটের দিকে। তীব্র ক্ষোভে তাকিয়ে মেহনূর ছিলো, ভেবেছিলো একবিন্দু কাঁদবে না, নিজের মনকে বারবার বুঝ দিচ্ছিলো ওরকম নিষ্ঠুর ব্যক্তির জন্য কষ্ট পাওয়া যাবেনা। গাড়িটা যখন মেইন গেটের বাইরে চলে গেলো, যেতেই বায়ে বাক নিয়ে হারিয়ে গেলো, তখনই দু’পাটি দাঁত শক্ত করে ডুকরে কেদেঁ উঠলো মেহনূর। ফিসফিস আওয়াজে চোখ বন্ধ করে মাথা নিচু করে ফেললো, সমস্ত শরীর কান্নার হিড়িকে কাঁপতে লাগলো ওর। ঘুমে ছিলো বলে এতো বড় শাস্তি দিলো? কে জানতো চোখের পাতায় ঘুমের যুদ্ধটা হানা দিবে? মেহনূর যদি জানতো মাহতিম ওকে না জানিয়ে চলে যাবে, তাহলে মেহনূর ঘুমাতোই না। সারারাত যেই মানুষটার হাত টেনে ঘুমালো, তার বিদায়কালে একটাবারও দেখা মিললো না, দেখা হলো না তার হাসিমাখা মুখটা। পেছন থেকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো বৃদ্ধ সিরাজ। তিনি মাহতিমকে বিদায় জানিয়ে মাত্র রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়েছিলো, ওই মূহুর্তে অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় মেহনূরকে দেখে কিছুটা অবাক হয় সে। পরক্ষণে যখন আসল ব্যাপারটা ধরতে পারে ততক্ষণে গাড়িটা ছেড়ে দিয়েছে। মেহনূরকে সদর দরজার সামনে ওভাবে ফুপিয়ে কাঁদতে দেখে প্রচণ্ড উদাস হয়ে গেছে সিরাজ, নিজের বয়সটা যদি আগের মতো ক্ষমতাবলে থাকতো তাহলে সাইকেলের প্যাডেল হাঁকিয়ে থামাতে যেতো গাড়িটা। খোলা দরজার বাইরে একপলকের জন্য দৃষ্টি দিলো সিরাজ, হেড কোয়ার্টার থেকে আসা বিশেষ গাড়িটা দৃষ্টিসীমার মধ্যে নেই। নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে গাড়িটা চলে গিয়েছে। একবুক হতাশা নিয়ে সশব্দে নিঃশ্বাস ছাড়লো বৃদ্ধ, মেহনূরকে অসহায়ভাবে কাঁদতে দেখে তার মনটা আরো গুমিয়ে যাচ্ছে। নিরুপায় সিরাজ মন শক্ত করে পুনরায় কাজের দিকে রওনা দেওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে যেতে নিলো, কিন্তু হুট করে কি যেনো ভেবে সদর দরজার বাইরে দৃষ্টি দিলো, ওমনেই বৃদ্ধ প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে স্বর গুলিয়ে ফেললো! থরথর করে কাঁপতে থাকা হাতটা মেহনূরকে ডাকার জন্য উঠালো কিন্তু বৃদ্ধ একটুও কথা বলতে পারলো না। বিষ্ময়ের ঘোরে মুখে হাত চাপা দিলো বৃদ্ধ! একবার কান্নারত মেহনূরের দিকে তাকালো, আরেকবার বাইরে তাকালো নির্বাক দৃষ্টি দিয়ে। বাড়ির বাইরে থাকা সৌভিক, মারজা, নীতি, প্রীতিরা চরম আশ্চর্য হয়ে ভ্রুঁ কুঁচকে ফেলেছে! মারজা কৌতুহল দমাতে না পেরে সঙ্গে-সঙ্গে বলে উঠে,

– এ কি অবস্থা! গাড়ি যে ফিরে আসছে?

মারজার কথা শেষ না হতেই সাদা গাড়িটা ইউ-টার্ণ স্টাইলে ঘুরে এলো। নীতি-সহ সবার মনে কৌতুহল জাগিয়ে তুমুল স্পিডে ভেতরে ঢুকতে থাকলো গাড়িটা। সবার সামনে দিয়ে ধূলো উড়াতে-উড়াতে ড্রাইভারের বিশেষ দক্ষতায় গাড়িটা সদর দরজার কাছে গিয়ে একদম সিড়ি ঘেঁষে থামলো। কয়েক সেকেন্ডের ভেতর যে দাপুটে খেলা চললো, সেই খেলা দেখে বোকার মতো তাকিয়ে আছে সবাই। যেই মেহনূর ক্ষতবীক্ষত মন নিয়ে কাঁদছিলো, সে এখন সদ্য থামা গাড়িটার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সাদা রঙের গাড়িটা নতুনের মতো চকচক করছে, চকচক করছে গাড়ির প্রতিটি কাঁচের জানালা। ভেতরে যে ব্যক্তিটি বসে আছে, তাকে বদ্ধ জানালার জন্য দেখা যাচ্ছে না। গাড়িটার দিকে অবাকের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সবাই, সবার মধ্যে আকাশসমেত কৌতুহল কাজ করছে। মাহদি বাদে সবাই তখন নিজেদের মধ্যে চাওয়াচাওয়ি করছে। মারজা কপাল কুঁচকে সদ্য স্থির হওয়া গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেলো, মারজাকে দেখতে পেয়ে জানালার কাঁচ একটু যেনো নামলো। কৌতুহলী মেহনূর দূর থেকে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। ফাঁক হওয়া জানালার মধ্য দিয়ে কি ধরনের কথাবার্তা হচ্ছে কেউ জানে না। মিনিট দুয়েক কথা বলার পর মারজা যেনো স্বাভাবিক হলো, তাঁর কৌতুহলী মুখটা যেনো সব প্রশ্নের জবাব পেয়ে শান্ত হয়ে গিয়েছে। মারজা কিছু খোলাখুলি না বলে সৌভিকদের ইশারা দিয়ে ভেতরে যেতে বললো, সৌভিকরা আরো আশ্চর্য হয়ে গেলো, কিন্তু মারজার অমান্য করলো না কেউই। বিষয়টা প্রথম-প্রথম কেউ বুঝতে পারেনি কেউ, কিন্তু নীতি যখন ছোট্ট একটা ইঙ্গিত বুঝালো, তখন সবার কাছে পানির মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। মেহনূরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সবাই যেনো মিচকি-মিচকি হাসছে, মেহনূর ওদের হাসির কারণটা তখনও ধরতে পারেনি। হতবাক মেহনূর অবুঝের মতো তাকিয়ে-তাকিয়ে সবার যাওয়া দেখছিলো, এরই মধ্যে ধরাস করে খুলে গেলো দরজা। অন্যমনষ্ক মেহনূর দরজা খুলার প্রবল আওয়াজে মৃদ্যুভঙ্গিতে শিউরে উঠলো, তৎক্ষণাৎ মাথা ঘুরিয়ে গাড়িটার দিকে দৃষ্টি দিলো। সঙ্গে-সঙ্গে দেখতে পেলো, গাড়ির সামনের সিট থেকে অদ্ভুত পোশাকের লোক বেরিয়েছে। লোকটাকে ড্রাইভার বলা বললেও তার পোশাক-আশাক মোটেও স্বাভাবিক ড্রাইভারের মতো না। মেহনূর বড় বড় চোখ তুলে ড্রাইভারকে দেখতে লাগলো তখন। মেহনূর মনে করতে লাগলো সেই ছোটবেলার স্মৃতিগুলো। গ্রামে একবার সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা সরকারি কাজে এসেছিলো, তাদের পড়নে ছিলো অদ্ভুত রঙের পোশাক। সেই পোশাকটা দেখার পর বাচ্চা মেহনূর দাদাভাইয়ের হাত ঝাঁকি দিয়ে প্রশ্ন করেছিলো, লোকগুলো কারা? প্রত্যুত্তরে হান্নান শেখ মুচকি হাসি দিয়েছিলেন, নাতনীর ছোট-ছোট আঙ্গুলগুলো আদরে আগলে ধরে বলেছিলেন, দাদুভাই ওরা সেনাবাহিনীর মানুষ। ওরা দেশের জন্য কাজ করে। দাদাভাইয়ের মুখ থেকে ওমন উত্তর শুনে অবুঝ মেহনূর আবার তাদের দিকে তাকায়। তাদের প্রত্যেকের কাছে থাকা বিশাল-বিশাল বন্দুকগুলো দেখতে পেয়ে ভীষণ ভয় পায়। সেই বন্দুক দিয়ে প্রচুর মানুষ মারা যায় এমন ঘটনা দাদার মুখ থেকে শুনেছিলো মেহনূর। সেই থেকেই তাদের দেখলে ভীরুতা কাজ করে ওর। মনেহয়, তাদের কাছে গেলেই বন্দুক ঠুকে মেরে ফেলবে। আজ একই পোশাকের মানুষ দেখে মেহনূরের পুরোনো ভয়টা মনের উঠোনে ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছে। মাঝে-মাঝে ধাক্কা দিচ্ছে হাতুড়ির মতো ধুকধুকনিটা। মেহনূরকে কাঁচুমাচু করতে দেখে ড্রাইভার একটু অপ্রস্তুত হলো ঠিকই, কিন্তু অফিসারের বউকে সম্মান দেখানোর উদ্দেশ্যে মাথাটা নিচু করে সালাম ঠুকলো। ড্রাইভারকে ওরকম অবস্থায় দেখার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলো না মেহনূর, এদিকে যে কুচির অবস্থা নাজেহাল হয়ে গিয়েছে সেদিকেও যেনো বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই ওর। ড্রাইভার নিজের কাজ সমাপ্ত করে সোজা বাড়ির অন্যদিকটায় চলে যেতে লাগলো, এমনভঙ্গিতে যেতে লাগলো যেনো আগেই যথা-আজ্ঞা পেয়ে গেছে ড্রাইভার। পাখির কিচিরমিচির ডাক ছাড়া দ্বিতীয় কোনো শব্দ ছিলোনা তখন। পরিবেশটা সোনালী রোদের আলোয় ঝলমল করছিলো খুব, সোনালী আলোটা কাঁচের জানালায় তীর্যকভাবে পরতেই মেহনূরের চোখ ধাঁধিয়ে উঠলো। তৎক্ষণাৎ চোখদুটো ছোট-ছোট করে আধবোজা করে ফেললো মেহনূর, চট করে ডানহাতটা চোখের উপর রেখে তীর্যক আলোটা আড়াল করার চেষ্টা করলো। চোখের উপর ছায়া পেতেই চোখদুটো খুললো মেহনূর, আঙ্গুলের প্রতিটি ফাঁক দিয়ে দৃষ্টি চলে গেলো গাড়ির চকচকে জানালায়। কাঁচটা ধীরগতিতে নিচে নামছে এখন, যতই নিচের দিকে নামছে ততই বেড়ে যাচ্ছে বুকের ধড়ফড়-ধড়ফড় অবস্থা। মেহনূর নিজের সবটুকু চাহনি দিয়ে জানালার ভেতর স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো, চোখের সামনে ওই মানুষটার মুখ যত পরিদৃষ্ট হচ্ছে ততই বাঁহাতের মুঠোয় ধরা কুচিগুলো ভয়ঙ্করভাবে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিষ্ময়ে বড় হচ্ছে চোখের চক্ষুতারা, নির্বাক হচ্ছে মুখের ভাবভঙ্গি। জেল দিয়ে সেট করা চুলগুলো আজ অন্যান্য দিনের তুলনায় স্মার্টলি ব্রাশ করা, গালদুটোর অবস্থা ক্লিন-সেভ দেখা যাচ্ছে, চোখে ব্রাউন স্ট্যান্ডার্ডের সানগ্লাস লাগানো তার, মুখে কোনো হাসি নেই। সজাগ চাহনিটা আজ চশমার জন্য দেখা যাচ্ছে না, মুখটা কেমন শক্ত-কঠোর করে রেখেছে, দেহভঙ্গিতে প্রকাশ পাচ্ছে আলাদা গাম্ভীর্য মূর্তি, যা ছিলো না কোনোভাবে। ব্রাউন গ্লাসটার ভেতর দিয়ে তীক্ষ্মদৃষ্টিটা সোজা মেহনূরের দিকে পরলো এবার, মেহনূর সেকেন্ডের ভেতর থতমত খেয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো। জোরে একটা ঢোক গিললো, লম্বা একটা নিশ্বাস নিলো, আবারও হতবিহ্বল চাহনি নিয়ে মাহতিমের দিকে তাকালো। মেহনূরের হাঁশফাশ অবস্থা দেখে গম্ভীর মুখে ধীরে-ধীরে কিরণফোঁটার মতো হাসি ছলকে উঠলো মাহতিমের। মুচকি হাসিতে হেসে দিলে মাথাটা ডানে-বামে হালকাভাবে নাড়াতে লাগলো সে। খট করে দরজাটা খুলে বাইরে পা রাখলো মাহতিম, সিট থেকে বাইরে বেরুতেই হা করে চোয়াল ঝুলালো মেহনূর। আশ্চর্য দৃষ্টিতে মাহতিমের দিকে চোখ বুলাতেই চশমার দুই ডাট ধরে সানগ্লাস খুললো মাহতিম। মেহনূরের দিকে এগিয়ে আসতেই হাতটা পেছনে ঘুরালো সে, সিটের দিকে হাতটা তাক করতেই চালান দিলো চশমাটা, ওমনেই চশমাটা গদিতে বারি খেয়ে একটু দূরে ছিটকে পরলো। মেহনূর ক্ষণকালের জন্য মাহতিমের পেছনে থাকা চশমাটার দিকে নজর দিয়ে তাকালো, এদিকে মাহতিমের তীক্ষ্মদৃষ্টি মেহনূরের উপর পর্যবেক্ষণ চালাচ্ছে। বিদায় না দেওয়ার জন্য অবস্থা কেমন খারাপ হয়েছে সেটাই দেখতে পেয়ে বাঁকা হাসছে মাহতিম। নাকের মাথাটা রক্তিম দেখে ঠোঁটের হাসিটা বেড়ে গেছে ওর, চোখের অবস্থা কতটা নাজেহাল হয়েছে সেটা আর বলার প্রয়োজন রাখে না। মাহতিম ডানেবামে একবার চোখ ঘুরালো, আশেপাশে কোনো কাক-পক্ষিও নেই সেটার হিসেব বুঝে ভালোভাবে আশ্বস্ত হলো। মেহনূর উজবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে মেহনূরের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো মাহতিম। চোখের পলকেই দুহাত এগিয়ে মেহনূরের খুলে আসা চুলগুলো খোপা পাকাতে থাকলো। কুচি ধরা হাতটা বৈদ্যূতিক শক খাওয়ার মতো ঝট করে ছেড়ে দিলো মেহনূর, কুচিগুলোও একের-পর-এক পরে গিয়ে পায়ের কাছে জড়ো হয়ে গেলো। খোপা পাকা থাকা মাহতিম খানিকটা আশ্চর্য হয়ে নিচের দিকে তাকালো। কুচিগুলো যে ওর জন্যই নষ্ট হয়ে গিয়েছে সেটা বুঝতে পেরে খিলখিল করে হেসে উঠলো মাহতিম। হাসিটুকু ঠোঁটে রেখে মেহনূরের দিকে তাকিয়ে বললো,

– তুমি কি চাচ্ছো কালরাতের মতো আবারও তোমাকে স্পর্শ করি?

মেহনূর উত্তর দিলো না কোনো। চোখের সামনে শুভ্র পোশাকের ব্যক্তি দেখে হৃদযন্ত্র বেকায়দায় ধকধক করছে ওর। গলা শুকিয়ে কাঠ ফাঁটা মাঠের মতো খাঁ খাঁ করছে যেনো। বুকটায় যেহারে ধকধক ছন্দের তাল উঠেছে, প্রচণ্ড উৎকন্ঠায় হাঁশফাশ করতে-করতে পিছিয়ে যাচ্ছে মেহনূর। কালরাতেও যে মানুষটা স্বাভাবিক ব্যক্তির মতো শুয়েছিলো, যার হাতটা টেনে নিজের অবুঝ মনকে শক্ত করেছিলো, আজ তাকে অন্য বেশে দেখে তালগোল পাকিয়ে ফেলছে মেহনূর।বলিষ্ঠ দেহে আষ্টেপৃষ্টে ঢেকে আছে সাদা টানটান পোশাক, সাদা শার্টের নিচে ঢেকে আছে গতরাতের প্রশস্ত বুকের জায়গাটা, সাধারণ প্যান্টের বদলে আজ দেখা যাচ্ছে সাদা রঙের প্যান্ট। কোমরের বেল্টটাও যেনো অদ্ভুত রকমের আজ, ইন-করা শার্টটা সুকৌশলে বেল্ট দিয়ে আঁটকে রেখেছে মানুষটা। বুকের ডান-পকেটে লেগে আছে বিভিন্ন ধরনের ব্যাজ, সেই ব্যাজ যে একেকটা দূধর্ষ অর্জনের চিহ্ন সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নেই। প্রতিটি ব্যাজের দিকে একবার-একবার করে চোখ বুলালো মেহনূর, শরীরের রক্ত যেনো টগবগ করে ছুটে যাচ্ছে তার।

হৃদপিন্ডের দ্রুতক্রিয়ায় বিবশ লাগছে নিজেকে। মেহনূরকে অবসন্ন দেখে বিষয়টা ধরতে পারে মাহতিম। তৎক্ষণাৎ আর দেরি না করে হাতটা খাবলে ধরে ওর। যতোটা দূরে গিয়েছিলো মেহনূর, সেটা ধূলোর মতো ঘুচিয়ে দিয়ে কাছাকাছি আনলো তাকে। ফর্সা চিবুকটা ডানহাতে ছুঁয়ে মুখটা নিচে নামালো মাহতিম, ঠোঁটদুটো এগিয়ে মেহনূরের কপালে গাঢ় চুমু দিতে গিয়ে থেমে গেলো। মেহনূর তীব্র উৎকন্ঠায় ক্ষণিকের জন্য শ্বাস আটকে রেখেছিলো, সেই ক্ষণিকের মূহুর্ত যখন আর সম্পণ্ণ হলো না তখন বাধ্য হয়ে চোখ খুললো মেহনূর। সাথে-সাথে মাহতিমের মুখটার দিকে তাকানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু কিছুই দেখা গেলো না। যতবার জোরে-জোরে দম নিচ্ছে ততই নাসাপথে সুগন্ধ পারফিউমের সুভাস প্রবেশ করছে। নিজেকে অন্যভুবনে আবিষ্কার করতেই হঠাৎ যেনো কানে শান্তসুরটা ভেসে এলো,

– তুমি কি একা থাকতে পারবে মেহনূর? রাতে যে আমি থাকবো না কিভাবে থাকবে? কালরাতে একটুও আশা করিনি, বিশ্বাস করো তোমার পেটে আমার হাত ছিলো, মানে তুমি আমার হাত টেনে ঘুমিয়েছো। তুমি আমাকে কতখানি বিশ্বাস করো এবার বুঝতে পেরেছো? তুমিতো নিরবেই তোমার সবটুকু বিশ্বাস আমায় দিয়ে দিয়েছো। এখন কি থাকতে পারবে?

কোনো উত্তর নেই মেহনূরের। বুক ফুলিয়ে জোরে দম নিতেই নিচের ঠোঁটটা উপরের ঠোঁট দিয়ে আবদ্ধ করলো সে। একবার মাহতিমের প্রশ্নসূচক দৃষ্টির দিকে তাকালো, এরপর দৃষ্টি ঘুরালো মাহতিমের বুকের বাঁপাশটার দিকে। সেখানে সূর্যের আলোতে চকচক করছে কালো-সোনালীর আয়তাকার নেমপ্লেটটা। নেমপ্লেটের প্রতিটি অক্ষর নিঃশব্দে ঠোঁট নাড়িয়ে পরতে লাগলো মেহনূর। M. ANSARI – ইংরেজি বর্ণমালায় লিখা চারকোণা নেমপ্লেটটার উপর থেকে দৃষ্টি সরালো মেহনূর। এদিকে মাহতিম নিরবে নিজের হাতদুটো নামিয়ে ফেললো। মেহনূর বাকহীন ভঙ্গিতে তাকিয়ে ছিলো,মাহতিমের প্রতি বিন্দুমাত্র বিশেষ অভিব্যক্তি প্রকাশ না করে ঝাপসা চোখে তাকালো সে। রাগে-ক্ষোভে-অভিমানে তীব্র আক্ষেপে বলতে লাগলো,

– আপনার আসল পরিচয়টা আগে জানলে আমি হয়তো কোনোদিন আপনাকে চাইতাম না, চাইতাম না, কোনোদিন চাইতাম না। আপনি চলে যান। আপনি এখুনি চলে যান। আপনাকে চাই না। চলে যান।

অদ্ভুত ভঙ্গিতে কথাগুলো বলতেই হু হু করে কেদেঁ উঠলো মেহনূর। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে আছে মাহতিম। বাক্য ফুরিয়ে শব্দ হারিয়ে মূঢ় হয়ে গেছে সে। হতবাক-নির্বাক অবস্থাটা না কাটাতেই বাঁহাতের কবজিটায় টিকটিক করা ঘড়ির দিকে সময় পরোখ করলো। এখনো হাতে যতটুকু সময় আছে, সেটা ওর জন্য যথেষ্ট সময় নয়, ফ্লাইট মিস হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তবুও হাতেনাতে রিস্কটা নিয়ে ধাম করে গাড়ির দরজাটা পা দিয়ে আঁটকালো মাহতিম। মাহতিমের পরিবর্তিত রূপ দেখে বিচলিত হলো মেহনূর, ভাববার সময় না পেতেই ডান কবজিটা চোখের পলকে মাহতিমের হাতের বলয়ে চলে গেলো। মাহতিম বেপরোয়াভাবে কোলে তুললো মেহনূরকে, আশেপাশে দৃষ্টি না দিয়ে গ্যারেজটার দিকে হনহন করে এগিয়ে গেলো। এদিকে দরজার পাশ থেকে উঁকিঝুঁকি চালাচ্ছে মাহতিমের ভাইবোন ও বন্ধুর দল। দুপাশের সদর দরজার চিপায় লুকিয়ে-লুকিয়ে দুজনের অবস্থা দেখছিলো ওরা, মিয়া-বিবি মিলে কি সিন-সিনারি দেখায় সেটার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলো। অথচ মাহতিমের ওমন যাওয়া দেখে সবক’টা হতাশ হলো। মাহতিম কি টের পেলো নাকি এখন সেটা নিয়েই চিন্তা হচ্ছে। যদি মাহতিম সত্যি-সত্যিই টের পেয়ে যায় তাহলে একটারও গায়ে চামড়া থাকবে না। ছাল তুলে খাল বানিয়ে সেখানে কুমির চাষ করবে মাহতিম। ভয়ে সবার বুকটা দুরুদুরু করছে। নীতি ওদের সঙ্গ দেওয়ার জন্য এখন নিজের নির্বুদ্ধিতার উপর লজ্জাবোধ করছে। যদি মাহতিম নীতিকে ধরে ফেলে তাহলে কানটা ছিড়ে কোথায় ভাসিয়ে দিবে কে জানে। দরজার দু’দ্বারের চিপা থেকে সবগুলো বেরুল তখন, সবার মুখের উপর ভয়ের ছায়া নেমে এসেছে। মুখগুলো কালো হয়ে ভয়ের আশঙ্কায় উশখুশ করছে। সিয়াম ছিঃ ছিঃ ভঙ্গিতে মাথায় হাত দিয়ে বললো,

– তোরা কি নাস্তার সময় আমার পানিতে কিছু মিশাইছিলি? আমি কি নেশা করছি? লা হাওলা — এইটা কি করলাম? এখন যদি মাহতিম ধইরা ফেলে আমার মান-ইজ্জত কই থাকবো? কি মুখ নিয়া ওর সামনে বন্ধু পরিচয় দিমু? শা’লা’রপুতে তো আমারে লাইত্থায়া শেষ করবো।

সিয়ামের কথা শেষ না হতেই রাগী সুরে সৌভিক বললো,

– আমি বারবার তোদের না করছিলাম, বারবার বলছিলাম এমন শয়তানি করিস না। ওরা জামাই-বউ, ওদের প্রাইভেসিটা এ্যাটলিস্ট ছেড়ে দে। তোরা কি ভুলেও আমার কথা শুনছিলি? এখন ভয় পাস কিসের জন্যে?

সৌভিকের কথায় চটে উঠলো তৌফ। সাথে-সাথে সৌভিকের পিঠে দুম করে এক ঘা বসিয়ে ছাড়লো। সৌভিক চোখ রাঙানি দিয়ে তাকালে টগবগে রাগটা আরো দুদফা দেখালো তৌফ, তখনই তৌফের কাজে বাধা দিয়ে হায়হায় কন্ঠে বললো সিয়াম,

– আরে ভাই থাম তোরা। প্লিজ এমন করিস না। আপাতত থাম, আগে দেখ মাহতিম গ্যারেজে ঢুকছে নাকি। ওর ভাবসাবে তো মনে হইলো ভাবীরে গলা টিপা ধরবো।

সিয়ামের কথাটা শেষ করতে দেরি, ওমনেই পেছন থেকে শান্ত-শক্ত কন্ঠ ভেসে এলো। সবাই একযোগে সেদিকে তাকালে তখনই মাহদিকে দেখতে পেলো । মাহদির হাতে মারজার এন্ড্রয়েড ফোনটা দেখে সবাই সরু দৃষ্টিতে তাকালো। মাহদি চুপচাপ হেঁটে আসতে-আসতেই ফোনটা থ্রি-কোয়াটার প্যান্টের ডান পকেটে পুরলো। সিয়ামের ভীত মুখটার দিকে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে বলতে লাগলো,

– তোমরা যে একেকটা বোকা এটা নিয়ে সন্দেহ নেই। দরজাটার চিপায় না লুকিয়ে জানালার পাশেই লুকাতে পারতে। ভাইয়া তোমাদের দেখেনি বুঝছো? ভাইয়ার এ্যাটেনশন এখন আমার বউয়ের দিকে। আমার বউ যে বিদায় না দিতে পেরে কেদেঁছিলো, সেটার জন্য ভাইয়া এসেছে। এখন হাট-পাট গুটিয়ে নিজেদের রুমে যাও। তাদের বিরক্ত করো না।

মুরুব্বির মতো বয়ান দিয়ে আবার ফোনটা বের করলো। পাবজির গেমটা বের করে সেটা স্টার্ট করতে-করতে রুমে চলে গেলো মাহদি। নিজেদের বোকামির ধরণটা সামান্য একটা পুচকে ছেলে ধরিয়ে দিচ্ছে এর চেয়ে লজ্জার ব্যাপার হয়? সবাই নিজেদের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করলো, নিজেদের গাধামির অবস্থা দেখে তখন সবাই একসাথে নিশ্বাস ছাড়লো। মাহতিমের রাগ দেখে সবাই মনে-মনে চিন্তায় ভুবে আছে। নীতি অসহায় দৃষ্টিতে মুখ তুলে সবার দিকে চোখ বুলাতে-বুলাতে বললো,

– কি বি’পদ হলো এটা? কেনো হলো? ভাইয়ার এই মূহুর্তে রেগে যাওয়াটা শুভ লক্ষণ নয়। আমরা যেটা নিয়ে ভয় পেয়েছিলাম সেটাই কেনো হলো? যদি মেহনূর রজনী মামীর ভাগ্নীর ব্যাপারে জেনে যায় তখন কি হবে? আর কতো ঝামেলা হবে রে ভাই? কেউ কি এ ব্যাপারে ভেবেছো? আমরাও তো থাকছিনা, তোমরাও চলে যাচ্ছো। মেহনূর তো একটুও শান্তি পাবেনা সৌভিক ভাই। আমি আর ভাবতে পারছি না। সামনে কি হবে কেউ তো বলো? টেনশনে আর থাকা যাচ্ছে না।

– চলবে

#FABIYAH_MOMO

( নোটবার্তা : ট্যাবের চার্জ হুট করে শেষ হয়ে যাওয়াতে প্রচুর দেরিতে দিলাম। বারবার এমন বিড়ম্বনার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। আমি পরিস্থিতির কাছে নত💔 দুঃখিত।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here