#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৬১.
#ফাবিয়াহ্_মমো .
দিনের শুরুটা ইলশেগুঁড়ির বৃষ্টিতে বাধা পরলো। কাদায় ভরে উঠলো নির্জন আস্তানা। গ্রামের মানুষ ভয়ে যার-যার বাড়িতে লুকিয়ে আছে। থেমে-থেমে চলছে গো:লাগু:লির শব্দ। পুরো গ্রামটা মানবশূন্য হয়ে আছে, যেনো কোথাও কোনো প্রাণের অস্তিত্ব নেই। ইতিমধ্যে বাতাসে-বাতাসে খবর পৌঁছে গেছে মোল্লাবাড়িতে গুলিবর্ষণ হচ্ছে। একদল সশ:স্ত্র বাহিনী গ্রামের প্রবেশমুখটা বন্ধ করে দিয়েছে, মোল্লাবাড়ির চারিদিকে ঘিরে আছে ব:ন্দুকধারী মানুষ। কি হচ্ছে, কেনো হচ্ছে আপাতত এই প্রশ্ন নিয়ে গ্রামবাসীরা উত্তেজিত। প্রাণের ভয়ে কেউই বাড়ির বাইরে পা দিচ্ছে না। আকাশে চেহারা সকাল থেকেই করুণ, সেটা কয়লা মতো অন্ধকার হয়ে আছে। আবহাওয়ার অবস্থা দেখলে ভয়ে গা শিরশির করে, নিরবতা চিঁড়ে একটু পরপর প্রচণ্ড জোরে শব্দ হচ্ছে, কেউই স্বস্তিতে নিশ্বাস নিতে পারছেনা। গ্রামের বুকে এমন অভিজ্ঞতার শিকার হবে ভাবতে পারছেন না বৃদ্ধা। নাম রোজিনা বানু, বয়স বাষট্টি। এগারো মাসের নাতিকে বুকের মধ্যে চেপে রেখেছেন, বড়-বড় দুটো নাতনী ওপাশের রুমে জড়াজড়ি করে মায়ের কাছে বসে আছে। সবার বুকেই ভয়, সবার মধ্যেই প্রচণ্ড উদ্বেগ কাজ করছে। রোজিনা বানু টিনের দেয়ালে ছোট্ট একটা ছিদ্রের কাছে চোখ রেখেছেন, চুপচাপ বাইরের অবস্থা দেখার চেষ্টা করছেন। দাদীকে ওভাবে দেখতে দেখে পেছন থেকে মেজো নাতনী বলে উঠলো,
– দাদী, দাদী শোনো। ও দাদী,
মেজো নাতনীর কন্ঠ শুনে চোখ ঘুরালেন রোজিনা। চিন্তাগ্রস্থ অবস্থার ভেতর প্রশ্ন করে বললেন,
– কিছু কবি?
জোরে-জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বললো নাতনী। দাদীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্নের ঝুড়িটা খুলে দিলো,
– হ কমু। তুমি না কইছো যুদ্দের সময় এইরম শব্দ হইছিলো? এহন যেই কান ফাডাইন্না শব্দ হইতাছে তহনো কি এইরম শব্দ হইতো?
রোজিনা বানু স্মৃতির ইতিহাস টেনে-টেনে বর্তমানে খুঁজে আনলেন। কোলের নাতিকে দুহাতের ভেতর মৃদ্যুভাবে দুলাতে-দুলাতে বললেন,
– হ হইতো। তহন আরো জোরতে শব্দ হইতো। এই শব্দ হেই শব্দের কাছে কিছুই না।
ভ্রু কুঁচকে নাতনী বললো,
– কি কও এডি? তাইলে কি বাইরে অহন যুদ্দ লাগেনাই?
রোজিনা বানু নাতনীর অকপটভাবে বলা দেখে হেসে ফেললেন। ফোকলা দাঁতে হাসি দিয়ে বললেন,
– যুদ্দ লাগবো ক্যা রে মা:গী? যুদ্দ লাগোনের কিছু হইছে? দ্যাখ গা পুলিশে আইছেনি। পুলিশ যখন চুর খুঁইজ্জা পায় তহন এমনে আহে। চুর ধইরা-বাইন্দা লইয়া যায় গা।
নাতনীর মুখটা হঠাৎ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। নিভু-নিভু কন্ঠে বললো,
– দাদী, আমার বাপজান কি আর আইতো না?
হঠাৎ জীর্ণ হাতদুটো থেমে গেলো। ফ্যালফ্যাল করে অবুঝ নাতনীর দিকে তাকালেন বৃদ্ধা। কোলের শিশুটা আরাম হারিয়ে কেঁদে উঠতেই আবার হাত দুলাতে শুরু করলেন। চোখের সামনে মৃত ছেলের স্মৃতিটা এখনো স্পষ্টভাবে মনে আছে। কে বা কারা যেনো মেরে ফেলেছে, এ নিয়ে হান্নান মোল্লার কাছে বিচারের জন্য গেলেও মোল্লা সাহেব সুরাহা করতে পারেননি। খুব শীঘ্রই অপরাধী ধরা পরবে এমন একটা কথা বলে পাঠিয়ে দেন, কিন্তু আজ পযর্ন্ত খুনের হদিস মেলেনি। কানাঘুসোয় শুনতে পেয়েছেন তার ছেলে নাকি চড়া সুদে টাকা নিয়েছিলো। এ তল্লাটে কে এমন টাকার ব্যবসা করে তা কেউই জানে না। এমনকি অজ্ঞাত সেই ব্যক্তিটা কে, এটাই ঠিক অস্পষ্ট। সবার ধারণা যার কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলো, সেই ব্যক্তি লোক মারফত খু:ন করে দিয়েছে। ব্যক্তিগত সহিংসতা থাকলেও সেটা যে এমন পর্যায়ে পৌঁছাবে, ভাবা মুশকিল! রোজিনা বানু এটুকু অনুমান করতে পারেন এ গ্রামে ক্ষমতাপ্রাপ্ত লোক একজনই আছে। সেই লোক আরো দশটা গ্রামকে ক্ষমতাবলে পিষিয়ে রাখতে পারে। আজ যদি মোল্লাবাড়িতে গো:লাগু:লি হয়েই থাকে, তাহলে কি উক্ত ব্যক্তি ধরা পরেছে? গম্ভীর মুখে বুকভর্তি দম নিলেন রোজিনা। বামে মুখ ঘুরিয়ে বদ্ধ জানালার দিকে দৃষ্টি রাখলেন। ডান চোখে হালকা মতোন ছানি পরলেও অন্য চোখটা ভালো। এই ছানি কাটানোর জন্য একমাত্র ছেলে কোত্থেকে টাকা ধার করেছিলো তিনি জানেন না। ছেলেকে অনেক জিজ্ঞেস করেও নামটা জানতে পারেননি। শহরে গিয়ে চোখের ছানি কেটে এলেও অন্য চোখেরটা কাটাতে পারেননি। একটা চোখের পিছনে সবটুকু ধারের টাকা শেষ হয়ে যায়, আজ সেই ছেলে নেই। কিন্তু ধারের টাকায় ডানচোখটা ফকাফকা পরিষ্কার। এখন নির্ঝঞ্ঝাট দৃষ্টিতে তিনি দেখতে পারেন। আজ দৃষ্টির পাশাপাশি শ্রবণেন্দ্রীয় সচল। তিনি যে গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন, তার মাতৃমন জানান দিচ্ছে আজ প্রতিশোধের ষোলকলা পূর্ণ হবে। বাতাসে-বাতাসে মৃ:ত্যুর মিছিল আজ বহুদিন পর সমাপ্তি টানবে।
.
টিভি চ্যানেল গুলো থেমে নেই। প্রতিটা চ্যানেলে-চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ যাচ্ছে। সবকটা চ্যানেলে শীর্ষ সংবাদটা ফলাও করে দেখানো হচ্ছে। রিপোর্টদের কল্যাণে কিছু শট ক্যাপচার করে লাইভ টেলিকাস্ট হয়েছে, কিন্তু নিরাপত্তার জন্য কাউকে কাছে ভিড়তে দেয়নি। দূর থেকে জুম করে যতটুকু পেরেছে টিভির পর্দায় এনেছে, বাকিটা আর সম্ভব হয়নি। উন্মুখ জনগণ সর্বশেষ তথ্য পাওয়ার জন্য টিভির চ্যানেল বারবার ঘুরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ‘ সর্বশেষ ‘ নামক তথ্য পাওয়া যায়নি। সবার মধ্যে উত্তেজনার দশা তিলতিল করে বৃদ্ধি পাচ্ছে, ‘ কি হবে সামনে ‘ একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, চিন্তায় অনেকের মধ্যে উদ্বেগপূর্ণ অবস্থা। বহুল আলোচিত পলাতক আ:সামীকে ঘিরে ধরেছে নিরাপত্তাবাহিনী, কিন্তু এখনো দূধর্ষ গোলাগুলি থামেনি। মহিমপুর গ্রাম থেকে একের-পর-এক হদিস বের করেছে, উদ্ধার করেছে কয়েক টন ড্রা:গস্, ট্রাকভর্তি নারী-যুবক-শিশু এবং সর্বশেষ অভিযান চালিয়ে বিপুল সংখ্যক অ:স্ত্রের সম্ভার উদ্ধার করেছে। দলের তত্ত্বাবধানের থাকা উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা এতোদিন পর সূত্র বের করেছে। উদ্ধার কার্য শেষ হয়েছে ঘন্টা খানেক হলো। কিন্তু ফেরারি আসামী এখনো নিজেকে আত্মসমর্পণ করেনি। ভেতরে একদল দক্ষ-প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফোর্স ঢুকেছে ঠিকই, এখনো তাদের কাছ থেকে আপডেট আসেনি। সবাই স্ব-স্ব স্থানে সতর্কতা অবলম্বন করছে, কেউই ব্যাপারটা হালকা ভাবে নেয়নি। গ্রামের সহজ-সরল, খেটে খাওয়া মানুষগুলো ভীতিকর অবস্থায় ঠেকে আছে। কেউ বাড়ির বাইরে বেরুনোর সাহস দেখাচ্ছে না। মোল্লাবাড়িতে অবস্থানরত মানুষরা কোথায় আছে, এ নিয়ে নানা মতবিরোধ চলছে, তর্ক হচ্ছে, কিন্তু কেউই সঠিক জবাব দিতে পারছে না। সাধারণ মানুষের কাছে টিভির পর্দায় এমন খবর দেখাটা লোমহর্ষক বটে! বহুদিন পর এমন একটা অভিযান চলছে, সেটা সত্যিই দমফাটা উত্তেজনার কাছাকাছি। নিরাপত্তাবাহিনী এখনো চুপ করে আছে, কোনো সলিড তথ্য রিপোর্টারের কাধে দেয়নি। তাদের কাছে খবর এসেছে, অভিযান শেষ হলে ব্রিফে আসবে তারা। সেখানে সকল প্রশ্নের যাবতীয় উত্তর দেওয়া হবে। কিন্তু এই মূহুর্তে কি হচ্ছে সেটা জানানোর জন্য অনেকটাই উন্মাদ আচরণ করছে রিপোর্টাররা। তাদের পুরো দলটাকে থামিয়ে রেখেছে নিরাপত্তা বাহিনী, স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছে অভিযান শেষ না পযর্ন্ত কিচ্ছু জানানো হবেনা।
টিভির পর্দায় ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে আছে সৌভিক। তার সম্পূর্ণ চিন্তা কেবল মাহতিমকে ঘিরে। এই অভিযান যে মাহতিমের আন্ডারে লিড হচ্ছে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু মাহতিম কি ঠিক আছে? বারবার বলছে গো:লাগু:লি এখনো শেষ হয়নি, তার মানে মাহতিম এখনো ডেন্ঞ্জার জোন ছাড়েনি? অফিসের কেবিনে বসে প্রচণ্ড চিন্তায় ছটফট করছে সৌভিক। সকালের নাস্তাটা এখনো হোয়াট ডেস্কের উপর পরে আছে। যখন থেকে খবর পেয়েছে মাহতিম ওদের রেসোর্টে পাঠিয়ে দিয়েছে, তখন থেকেই ভয়াক্রান্ত। কবজির কাছ থেকে গ্রে স্লিভটার বোতাম খুললো সৌভিক, ডানহাতে স্লিভটা ভাঁজ করতে-করতে কনুইয়ে এসে রাখলো। এখন লান্ঞ্চ টাইম শুরু হয়েছে, কিন্তু টেনশনে পেটের খিদা ম:রে গেছে। অপর হাতটার স্লিভ ফোল্ড করে রকিং চেয়ার থেকে উঠে গেলো, চেয়ারটা পাক খেয়ে গোল-গোল ঘুরতে থাকলে সৌভিক হেঁটে এসে জানালার কাছে দাঁড়ালো। দিনের বেলা হলেও টিমটিমে লাইট জ্বলছে। রুমটা এয়ার কন্ডিশন্ড। জানালা গুলো সব বন্ধ। কিন্তু ভেতরের ছটফটানির জন্য জানালা খুলতে বাধ্য হলো। জানালাটা আনলক করে স্লাইডিং গ্লাসটা বাম দিকে ধাক্কা মারলো, তখনই মুষলধারে বৃষ্টিপাতটা চোখে পরলো। আকাশটা কালো হয়ে আছে, ঝমঝম শব্দে শহর মাতিয়ে বৃষ্টি পরছে। মুখ ঘুরিয়ে টিভির দিকে তাকালো সৌভিক, মাইক হাতে রিপোর্টারটা একই খবর বলে যাচ্ছে। কিন্তু সেখানকার আবহাওয়া অন্ধকার হলেও বৃষ্টি ঝিরিঝিরি। দেশের এই প্রান্তে ধুমছে বৃষ্টি হলেও অন্যপ্রান্তে সেরকম বৃষ্টি নামেনি। টিভির দিকে চাইতেই জায়গাটা চিনতে পারলো সৌভিক। এটা গ্রামের পন্ঞ্চায়েত বসার অংশ। সেই বটগাছটা দূর থেকে দেখতে পাচ্ছে সে। তার মানে সাংবাদিকের দল মোল্লাবাড়ির কাছে যেতে পারেনি। শানাজকে কল দিতে খুব ইচ্ছা করলো, কিন্তু অবস্থা খারাপ বলে কল দিলো না। এসির হাওয়া ক্রমশ জানালা ডেঙিয়ে চলে যাচ্ছে, কিন্তু বৃষ্টির ঠান্ডা প্রকৃতি অদ্ভুত কারণে ভয় লাগছে। কে জানে গ্রামের মাটিটা লাল হয় কিনা, নিষ্ঠুর মানুষের রক্তের পাশাপাশি নির্দোষ মানুষের র:ক্ত উজাড় হয় কিনা। ভারী নিশ্বাস নিয়ে আস্তে-আস্তে ছাড়লো সৌভিক, সব চিন্তা দুমড়ে-মুচড়ে পকেট থেকে ফোন বের করলো। আগে-পিছে চিন্তাভাবনা না করে শানাজকে কল করলো, বৃষ্টির দামাল চোটে ছাঁট এসে জানালা দিয়ে ঢুকলো। চোখদুটো বন্ধ করলো সৌভিক, ডানহাতটা বাড়িয়ে দিয়ে থাই গ্লাসটা টেনে দিলো। নিজের ডেস্কের কাছে ফিরে আসতেই রকিং চেয়ারে বসলো। কলটা ওপাশ থেকে শেষ মূহুর্তে রিসিভ করলে কথা আগালো সৌভিক,
– হ্যালো, শানাজ?
নেটওয়ার্কের জন্য ঘ্যারঘ্যার জাতীয় শব্দ শুনতে পেলো। কিন্তু তখনই শানাজের কন্ঠটা কেটে-কেটে ভেসে এলো,
– হ্যাঁ বলো, কেমন আছো?
ভণিতা করলো না সৌভিক। সোজাসুজি মূল কথায় চলে এলো,
– ওখানে টিভি আছে?
শানাজ কৌতুহল হয়ে পালটা জিজ্ঞেস করলো,
– কেনো? টিভিতে তুমি এসেছো? হঠাৎ টিভির খবর নিচ্ছো কেনো?
স্বাভাবিক হলো সৌভিক। শানাজ যেহেতু এখনো জানে না, তার মানে কেউই জানে না। ওকে এখুনি জানানো দরকার। ব্যাপারটা আগ বাড়িয়ে খারাপের দিকে যাওয়ার চাইতে সময় মতো দেখা দরকার। সৌভিক শান্ত হয়ে বললো,
– তোমাদের বাড়িতে গো:লাগু:লি হচ্ছে। তুমি যদি টিভি —
কথাটা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে কথা আওড়ালো শানাজ,
– আমি এ ব্যাপারে জানি সৌভিক। আম্মা আমাকে সব বলেছে।
সৌভিক চকিতে চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলো। আশ্চর্য হয়ে বললো,
– কার আম্মা? মানে? তুমি কি বলছো শানাজ? এ ব্যাপারে তুমি কিভাবে, মানে কি করে, ওহ্ মাই গড্! তুমি কি সব জানো? ভাবীকে জানিয়েছো?
সৌভিকের অশান্ত গলা শুনে আশ্বস্ত করলো শানাজ। অস্থির সৌভিককে শান্ত করে বললো,
– মেহনূরকে ভুলেও জানাবো না। ও শুনলে কি করবে কে জানে। আম্মা বলে দিয়েছে আপাতত চুপ থাকতে। আমি নিজেই স্তব্ধ হয়ে আছি। জানিনা মেহনূর শুনলে কি অবস্থা হবে। ও ব্যাপারটা একদমই নিতে পারবে না। ছোট থেকে দাদাজান ওকে বেশি আদর করতো। আমাদের চেয়ে দাদাজানকে বেশি মানতো সৌভিক। তুমি হয়তো জানো না, দাদাজান যদি মাহতিম ভাইয়ার ব্যাপারে অমত করতো, তাহলে ও চুপচাপ সেটা মেনে নিতো, আজ হয়তো ওদের বিয়েই হতো না। আম্মার কথাটা শোনার পর মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে। শুধু আল্লাহ্-আল্লাহ্ করছি ভাইয়া যেনো ফিরে আসুক, এখানে ভাইয়ার কোনো দোষ নেই। আমাদের চোখে যুগ-যুগ ধরে পট্টি পরানো ছিলো, এখন যখন খুলে গেছে সেটা মানতে আমাদের কষ্ট হবেই। কি করবো সৌভিক? আমরা কার কি ক্ষতি করেছিলাম যে আজ আমাদের এমন দিন দেখতে হলো?
সৌভিক চুপ থেকে ঠান্ডা ভাবে বুঝিয়ে বললো,
– তোমরা কারো ক্ষতি করোনি। ইন ফ্যাক্ট, তোমাদের দাদা যে বাটপার, এটাও তোমরা জানতে না। তোমাদের কাছে সবই লুকানো ছিলো শানাজ। মাথা ঠান্ডা করো, টেনশন কোরো না। বাকিরা সবাই জেনেছে?
শানাজ নিরুদ্বেগ ভাবে বললো,
– আম্মা শুধু আমাকে জানিয়েছে। আমাকে সোজাসাপ্টা বলে দিয়েছে, আর কেউ যেনো না জানে।
সৌভিক সম্মতির সুরে বললো,
– এখন কিছু বোলো না শানাজ। আল্লাহ জানে, মোল্লাবাড়িতে কি হচ্ছে। তোমাদের বাড়িতে এখনো গোলাগুলি অফ হয়নি। মাহতিমটা যে কেমন আছে,
কন্ঠে বিষাদ নেমে এলো। সৌভিক আর কথা বাড়াতে পারলো না। চোখদুটো টিভির দিকে স্থির থাকলেও মনটা মাহতিমের জন্য অস্থির হয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে ডেস্কের দিকে তাকালো সে, হালকা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
– তোমার মা কি আমাকে মেনে নিবে? আমার কিন্তু গার্ডিয়ান নেই। কাকার ব্যবসায় খাটাখাটনি করি, এটুকুই সম্বল। আমার যা আয়-রোজগার তা কিন্তু শৌখিন ভাবে চলার মতো না। সংসার করতে গেলে যতটুকু দরকার সবটুকু পূরণ করতে পারবো। কিন্তু,
বাকি কথাটা শোনার জন্য তাড়া দিলো শানাজ,
– কিন্তু কি? বলো? চুপ করে আছো কেনো?
সৌভিক রকিং চেয়ারে পিঠ ছেড়ে বললো,
– আমার নিজের কোনো বাড়ি নেই। তুমি বিয়ে করলে তখন একটা ফ্ল্যাট কিনে নিবো। কিন্তু, বাড়ি কবে করবো জানি না।
শানাজ রাগ দেখিয়ে বললো,
– তুমি আমাকে দূরবস্থার হিসাব বুঝাচ্ছো কেনো? তুমি কি আমাকে বিয়ে করতে চাও না। আমি কি কখনো আবদার করেছি? এটা চাই, ওটা চাই করেছি?
শানাজের রাগত সুর শুনে হাসলো সৌভিক। ব্যাপারটা ঠান্ডা করার জন্য অন্য প্রসঙ্গ টেনে বললো,
– রাগ কোরো না, আমি এমনেই কথাগুলো বললাম। আমার তো আবার কথা বলার মানুষ কম, এজন্য তোমাকেই বলেছি। আমাকে একটা কথা বলবে শানাজ? ভাবী প্রথম-প্রথম চুপ থাকতো কেন? মাহতিম ম্যাটারটা জেনেছে, কিন্তু ও আমার কাছে শেয়ার করার সুযোগ পায়নি। ভাবী সেই মিস্টিরিয়াস আচরণের কারণ কি শানাজ? ব্যাপারটা কি খোলাখুলি বলবে?
শানাজ ফোনটা কানে চেপে ক্ষণকালের জন্য চুপ থাকলো। ব্যাপারটা সৌভিকের কাছে বলার পূর্বে কথাগুলো সাজিয়ে নিলো। পুরোনো দিনের কথা হলেও এতে গূঢ়তা লুকিয়ে আছে। সুরাইয়ার কানে পৌঁছে গেলে ফের কেলেঙ্কারি হতে পারে। শানাজ একটু সতর্ক হয়ে বলতে লাগলো, অনেকটা শিক্ষিকার মতো ভঙ্গি ধরে বললো,
– প্রথমত এসব বিষয় নিয়ে দ্বিতীয় কারোর কাছে বলতে যেও না। যদি মাহতিম ভাইয়া নিজে থেকে তোমাদের জানায়, তাহলে সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু এমনিতে যদি না জানায়, তাহলে তুমি এ বিষয়ে কাউকেই বোলো না। আমি তখন ছোটই ছিলাম। আমার বয়স ঠিক কত ছিলো মনে নেই। মেহনূরও তখন ছোট। আমরা চারবোনই স্কুলে যেতে শুরু করেছিলাম, আমাদের আনা-নেওয়ার কাজ করতো ফজলু কাকা। উনি গোয়ালঘরের কাজ করতো, আবার দাদাজানের নানা কাজে সাহায্য করতো। দাদাজানের পরে ফজলু কাকার সাথে ওর খুব ভালো মিল ছিলো। কাকাও ওকে এতো আদর করতো, মেহনূর স্কুলে যা-যা শিখতো সব এসে কাকাকে বলতো। আমরা সবাই সেদিন স্কুলে গিয়েছিলাম, মেহনূর তখন ভালোই চটপটে ছিলো। বিশ্বাস করো সৌভিক! ওইদিন যদি একবার জানতাম মেহনূরের চটপটে ভাবটা আজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলবো, তাহলে জীবনেও ওকে একা ছাড়তাম না। ও আমাদের সঙ্গ ছেড়ে কখন ক্লাসের দিকে ছুটে গিয়েছে আমরা টের পাইনি। স্কুল ছুটির সময় এতো ভীড় ছিলো যে ওকেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমি খুঁজতে-খুঁজতে হয়রান হওয়ার পর সাবা, সুরাইয়াকে নিয়ে গেটের বাইরে চলে যাই। সেখানে ফজলু কাকাও ছিলো না। ভয়ে আমার অবস্থা আরো নাজেহাল হয়ে গিয়েছিলো, একা-একা রৌদ্রের ভেতরে তাড়াতাড়ি বাড়িমুখো হই। দাদাজানের কাছে খবর পাঠাই, দাদাজানও পাগলের মতো সব ফেলে এসে মেহনূরকে খুঁজতে লাগে। কিন্তু দাদাজান আর আমি যখন স্কুলে পৌঁছাই, তখন —
তীব্র উত্তেজনায় ফেটে পরলো সৌভিক! শানাজকে চেঁচানির সুরে তাড়া দিলো,
– তখন কি? তখন কি হয়েছিলো? প্লিজ শানাজ!
সৌভিক শুনতে পেলো শানাজ ফিসফিস শব্দ করছে। শানাজ কি কাঁদছে? ঘটনার চূড়ান্ত মূহুর্তে কি এমন হয়েছিলো? আবারও তাড়া ঠুকলো সৌভিক, অস্থিরচিত্তে উশখুশ করে বললো,
– খারাপ কিছু?
প্রশ্নটা শুনে তেড়ে আসার মতো মুখ খুললো শানাজ। এক চিৎকার দিয়ে চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে বললো,
– অবুঝ একটা পিচ্চিকে বাথরুমে নিয়ে যায় কেনো, জানো? পুরো স্কুল মাঠ খালি ছিলো, কেউ ছিলো না। শুধু বাথরুমের দুটো দরজা বন্ধ ছিলো। দাদাজান ওইদিকে যাওয়ার আগে হঠাৎ একটা দরজা থেকে খুব কান্নাকাটি শুনতে পায়। এরপর যখন দরজা ভেঙ্গে ঢুকি, তখন দেখি ফজলু কাকা ওই বাথরুমে। কাকা ততত-খ-ন, কাকা তখন একা ছিলো না। কাকার সাথে সোনালী নামের আরেকটা মেয়ে ছিলো, ওই মেয়ের পুরো শরীর র:ক্তা —
সৌভিক স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। কথাটা পুরোপুরি না বললেও বাকিটা বোঝা শেষ। কতক্ষণ চুপ করে ছিলো জানা নেই, শানাজের মৃদ্যু স্বরের কান্নায় সৎবিৎ ফিরলো ওর। স্বাভাবিক হওয়ার তীব্র চেষ্টা করে শানাজকে শান্ত হতে বললো, শানাজ একটু বিরতি নিয়ে আবার বলতে শুরু করলো,
– মেয়েটা মেহনূরের ক্লাসে পড়তো। মেহনূর যে তখন পাশের বাথরুমে ছিলো, এটা কাকা জানতো না। বাথরুমের দেয়ালে একটা সরু চিড় ছিলো, যেটার জন্য ওই বাথরুমে কেউ যেতো না। এজন্য বাথরুমটা পরিষ্কার ছিলো, মেহনূর এটা ভালো করে জানতো বলে সেদিন ওই বাথরুমে ছুট দেয়। আর তখনই বাইরে থেকে ভুলবশত ছিটকিনি আঁটকে যায়, এরপর ওই চিৎকার শুনে যখন চিড়ের ফাঁকে তাকায়, তখন সবকিছু — । ওর চোখের সামনেই একটা ফুলের মতো মেয়ে দূষিত হয়ে যায় সৌভিক। চারটা ঘন্টা বাথরুমের ভেতর আঁটকা ছিলো, আমরা যখন উদ্ধার করি তখন পুরোনো মেহনূরকে খুঁজে পাইনি। টানা ছয়দিন টাইফয়েডের জ্বরে ভুগে, সুস্থ হতে-হতে মাস খানিক সময় লাগে। আর অন্যদিকে সোনালী ধুকতে-ধুকতে মা:রা যায়। সোনালীর পুরো স্মৃতিটা মেহনূরের ভেতরে গভীরভাবে আঁচড় কেঁটে দেয়, ও প্রায়ই ঘুমের মধ্যে চমকে উঠতো। ভয়ে সারারাত ঘুমাতো না। খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, পড়া সবকিছু নষ্ট হতে থাকে, ধীরে-ধীরে ও অস্বাভাবিক ভাবে চুপ হয়ে যায়। দাদাজান ছাড়া ভুল করেও কোনো ছেলে মানুষের সামনে যেতো না, সবসময় লুকিয়ে-লুকিয়ে থাকতো। নিজের মধ্যে থাকতে-থাকতেই কবে অন্য স্বভাবে চলে যায়, নিরব হয়ে যায়, আমরা বুঝতে পারিনি। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলাও একপর্যায়ে ছেড়ে দেয়। ওর জীবনটা শুধু একটামাত্র ঘটনার জন্য পালটে যায় সৌভিক, এরপর থেকে ও আর স্বাভাবিক মেয়েদের মতো আচরণ করে না। ওকে নিয়ে মানুষ প্রচুর নাক ছিটকাতো, কিন্তু আমরা তো জানি ওর ভেতর দিয়ে কিসের ঝড় বয়েছে। ওর বিশ্বাস ভেঙ্গেছে, আস্থা ভেঙেছে, মানুষকে ‘ মানুষ’ বলে চেনার ইচ্ছাও ম:রে গেছে। বিশ্বাস ভাঙ্গলে মানুষই পালটে যায় সৌভিক, মানুষ আগের মতো থাকতে পারে না। যদি দাদাজানের সত্যটা জেনে যায়, তখন যে আবার — .
সৌভিক দুপাটি দাঁত শক্ত করে চোখ বুজে ফেললো। শানাজের অসম্পূর্ণ কথা এবারও বুঝা শেষ। কি হবে এখন? সত্য জানতে আর মাত্র কিছু সময় বাকি। যদি হান্নান শেখের ব্যাপারটা জেনে আবার বাক হারিয়ে ফেলে, তখন কি — । ভাবতে পারলো না সৌভিক। এখন শানাজের মতো তারও মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে।
চলমান .
#FABIYAH_MOMO .