#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৬৫.
#ফাবিয়াহ্_মমো .
অংশ – শেষ .
গভীর রাতে তন্দ্রা ভাঙ্গলো। চোখ খুলে দেখলো মাহতিম নেই! অস্থির হয়ে আশেপাশে তাকাতে লাগলো মেহনূর, পুরো রুম খালি! ব্যাপারটা স্বাভাবিক হলেও অজানা আশঙ্কায় ভয় জেঁকে ধরেছে। রাত চারটা বাজে, অথচ মাহতিম উধাও? ওয়াশরুমের দিকে চোখ ফেললো মেহনূর। সুইচবোর্ডের লাইট বন্ধ। দ্রুত বিছানা ছেড়ে নামলো সে, সোজা দরজা খুলে বেরুলো। পুরো বাড়িটা অন্ধকারে ছেয়ে আছে। একটা সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ যদি একা-একা বের হয়, তাও তার সাহসে কুলোবে না, নির্ঘাত সে ভয় পাবে! দুরুদুরু বুকে পা চালালো মেহনূর। সে নিজেও জানেনা মাহতিমকে কোথায় খুঁজবে। একবার চিন্তা করলো, বাড়ির বাতিগুলো জ্বালানো যাক! পরক্ষণে এটাও ভাবলো, সবাই জেগে যাবে। সুতির আঁচলটা টেনে পিঠ ঢেকে নিলো, গায়ে হালকা-হালকা শীত লাগছে। একে-একে নীতি-ফারিন-মাহদির রুম পেরিয়ে সিঁড়ির কাছে আসলো। মাহতিম কোথায় থাকতে পারে, সেটা নিয়ে দ্বিধায় পরে গেলো। একদম গোড়া থেকে চিন্তা স্টার্ট করলো মেহনূর। যে যে জায়গায় থাকতে পারে, তন্মধ্যে দুটো জায়গা নির্দিষ্ট! প্রথমটা হচ্ছে বাড়ির ছাদের দিকে, অন্যটা হচ্ছে বাড়ির লন। মেহনূর মুখ তুলে ছাদের সিঁড়িটা একবার লক্ষ করলো, বিনা বাক্যে নিঃশব্দে সিঁড়ির ধাপে পা ফেললো। শাড়ির কুচিগুলো ডানহাতে সামলে প্রতিটি ধাপে পা ফেলে এগুলো। ছাদের আধ-ভেজানো দরজার দিকে যতো অগ্রসর হচ্ছে, ততই অচিন্তনীয় ভাবনায় ডুবে যাচ্ছে সে। মনেহচ্ছে, মাহতিম এখানেই! এখানেই আছে! কিছু সাংঘাতিক ঘটনার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে, সেটা কি খুবই ভয়ানক হবে? আধ-ভেজানো দরজা দিয়ে একফালি আবছা আলো সিঁড়ির উপর পরেছে, ওইটুকু আলো সঙ্গী করে নিঃশব্দে হাঁটছে মেহনূর। দরজাটায় আলতো ধাক্কা দিতেই বিশাল ছাদটা দৃষ্টিগোচর হলো। হুহু অশান্ত বাতাসটা গা ছুঁড়ে দিলো। কনকনে শীতের মতো কেঁপে উঠলো মেহনূর। আঁচলটা দিয়ে জবুথবু হয়ে গা ঢাকা দিতেই মাথা নিচু করে ছাদে ঢুকলো। নিরব ছাদ, ঝিম ধরানো নিঃসাড় রাত। একা-একা খালি ছাদে সত্যিই ভয় করছে। শরীরটা ভয়ের কারনে মৃদ্যু দমকে কেঁপে উঠছে। মেহনূর একবার বামে চোখ ঘুরালো, ওখানে কেউ নেই। রেলিংয়ের কাছ থেকে পুরো খালি। বামদিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে ডানদিকে তাকাতে নিলো, তখনই পিলে চমকে উঠার মতো শিউরে উঠলো সে! রেলিংয়ের কাছে লম্বা মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে! কালো ছায়াটার অবয়ব দূর থেকে গা কাঁপিয়ে দিচ্ছে! ছায়াটার পাশে ওটা কি? ছোটোখাটো আরেকটা মূর্তি? মেহনূর অস্বাভাবিক হারে নিশ্বাস নিতেই স্থির চোখে পিছাতে লাগলো। একপা-একপা করে পিছাতে নিলে হঠাৎ সংবিৎ ফেরার মতো থমকে গেলো। যাকে সে ভয়ংকর কিছু ভেবে চলছে, সেটা ওই কাঙ্ক্ষিত মানুষটা না? কিন্তু পাশে ওটা কে? ঠিক নারীমূর্তির মতো বোঝা যাচ্ছে! কে ওটা? কে হতে পারে?
রেলিংয়ের উপর দৃষ্টি ফেলে দাঁড়িয়ে আছে। মধ্য রাতের প্রশান্তিময় হাওয়া পৃথিবীর বুকে জায়গা নিয়েছে। দূর-দূরান্ত থেকে শোরগোলের শব্দ নেই। রাতটা নিঝুম-নিঃশব্দ-নিস্তেজ। ঠান্ডা হাওয়ায় কালো টিশার্টটা বুকের ভেতর দোল দিচ্ছে। মাথার ঝলমলে বাড়ন্ত চুলগুলো প্রফুল্লচিত্তে উড়ছে। সাদা ট্রাউজারের পকেটে হাতদুটো গুঁজে রাখা। বুদ্ধিদীপ্ত মুখটা চাপা বিষাদের ছায়ায় লেপ্টানো। যেনো কতকাল সেই মুখে হাসির ছোঁয়াটা লাগেনি। এতো ভার, এতো বিমর্ষ চেহারা দেখে দুঃখ পেলেন মারজা। পাশ থেকে ম্লান দৃষ্টিতে তাকিয়ে চুপ করে আছেন। যেই ছোট্ট মাহতিমকে বুকে-পিঠে মানুষ করলেন, সেই মাহতিম আজ জোয়ান, টগবগে, প্রতিষ্ঠিত মানুষ। একসময় ছোট্ট নরম আঙ্গুলগুলো মারজার শক্ত তর্জনীটা খপ করে ধরতো, বিজয়ীর মতো উচ্ছল খুশীতে কি পবিত্র হাসিটাই না দিতো! চোখদুটো যখন কান্নার আয়োজন করতো, তখন নিষ্পাপ-পবিত্র শিশুসুলভ চোখদুটো আরক্তিম লাল হয়ে যেতো। চোখের ভেতর স্তুপ করে পানি জমতো, লাল টকটকে নিচের ঠোঁটটা পুরোপুরি উল্টে দিতো। আসন্ন কান্নার জন্য থুতনি কাঁপাতো ঠিকই, কিন্তু হাউমাউ না কেঁদে আদুরে মুখে ফুলে-ফুলে উঠতো। তখন ছোট্ট অবুঝ মাহতিমের প্রতি সেকি আদর, সেকি চুপ করানোর বায়না! ভাবতেই-ভাবতে এমন দুঃসহ সময়ে মুচকি হাসলেন মারজা। ছেলেটা চোখের সামনেই তরতরিয়ে কবে বড় হলো, ভাবতে পারছেন না মারজা। এইতো সেদিন প্রসব বেদনার যন্ত্রণা সহ্য করে নবজাত শিশুর চিৎকার শুনলেন। কোলের ভেতর ছোট্ট ছানার মতো উষ্ণতা দিলে আদর করলেন। অথচ মনেই হয়না, আজ দেখতে-দেখতে ত্রিশটি বছর ফাঁকিবাজি করে পেরিয়ে গেছে। সেই অবুঝ প্রাণটা বাড়-বাড়ন্ত দৈহিক গঠন নিয়ে সকলের সামনে সুপুরুষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাদা অফিশিয়াল পোশাকটা পরে যখন টুপি হাতে দাঁড়ায়, বিদায় নিতে হাসি দেয়, বাঁ চোখটা টিপ মেরে বলে, ‘ আসি তাহলে? ছুটি হলেই আবার চলে আসবো ‘, তখন প্রাণটা তৃপ্তিতে ভরে যায়। চোখটা বন্ধ করে মাথাটা বামে কাত করলেন মারজা, ধীরে-ধীরে ওড়না দেওয়া মাথাটা ছেলের শক্ত বাহুর কাছে ঠেকালেন। ডান বাহুতে ভার অনুভব করলো মাহতিম। সেদিকে দৃষ্টি না দিলেও মায়ের প্রৌঢ় শরীরটা বলশীল হাতে আগলে ধরলো। মায়ের নিচু মাথাটায় নিজের ডান গাল রেখে আকাশে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ নিরব থাকার পর শূন্য কন্ঠে বললো,
– আমি বিয়েটা করে ভুল করেছি মা। আমার মতো মানুষের বিয়ে করাটা ঠিক হয়নি। তুমি সেদিন ফোর্স না করলে আমি জীবনেও ওই গ্রামে পা ফেলতাম না। যদি একবার আমার কথাটা শুনতে, যদি ভুলবশত যাওয়াটা ক্যানসেল করতে মা! সেদিন তুমি আমার একটা কথাও শোনোনি।
মারজা সাথে-সাথে ছেলের দিকে মুখ তুললেন। আশ্চর্য গলায় বললেন,
– মাহতিম, চুপ কর! এসব কি ধরনের কথা বাবা? মাথা খারাপ হয়ে গেছে? ওখানে যাওয়ার সাথে পাল্লা দিচ্ছিস কেন?
মাহতিম চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস ছাড়তে-ছাড়তে বললো,
– ওর সাথে দেখা না হলে আমি কোনোদিনই বিয়ে করতাম না। তুমি জানো, আমি আজ পযর্ন্ত কোনো মেয়ের দিকে তাকাইনি। শহরে কি কম মেয়ে ছিলো? পাত্রীর ছবিও তো কম আনোনি। তবুও কোনোভাবে আমাকে রাজী করাতে পেরেছো? অনাও তো কোনোদিক দিয়ে কম না। অনা নিজেই মারাত্মক সুন্দরী। রজনী মামী নিজেই ওর জন্য সম্বন্ধ করতে চেয়েছিলো, আমিই নারাজ ছিলাম। সেই আমিই কিনা গ্রাম থেকে ঢ্যাং ঢ্যাং করে বউ আনলাম?
মাহতিমের কথাগুলো রাগ, নাকি স্বগোতক্তি বুঝতে পারলেন না মারজা। নিজের কাধ থেকে মাহতিমের হাতটা সরিয়ে দিয়ে সোজাসুজি তাকালেন। কথার মারপ্যাঁচ ধরার জন্য তিনি কাষ্ঠ গলায় বললেন,
– শোন মাহতিম, কপালের লিখন না-যায় ভাঙন, না-যায় খণ্ডন। এই কথাটা কোনো সময় ভুলবি না। তুই আজ পরোক্ষভাবে মেহনূরকে দোষ দিচ্ছিস। কথায়-কথায় বারবার বিয়ের ভুল ধরছিস, সেদিন কিন্তু তোর ইচ্ছাতেই বিয়েটা হয়েছিলো। আমি একথাও অস্বীকার করবো না, ওই বাড়ির ছোট মেয়েকে আমার ভালো লাগতো না। কিন্তু মনে রাখবি! আমি নিজের মর্জি তোর উপর কোনোদিন খাটাইনি, মা হিসেবে তোর উপর অবশ্যই আমার হক ছিলো। চাইলে তোকে ধরে-বেঁধে ঠিকই বিয়ে পড়াতে পারতাম, আমি ওইসব ধার দিয়ে যাইনি। তোর বাপের নেচার আমার সামনে দেখাতে আসবি না। ওই বাপ ম:রা মেয়ের উপর জুলুম করলে তোর কপালে শনি আসতে দেরি নেই। এতিমের উপর কষ্টের ঘা দিতে যাস না। তুই যদি আদর-সোহাগে রাখিস, আজীবন একটা সৎ বউয়ের সঙ্গ পাবি। তোর আজকের কথাবার্তা কিন্তু আমার কাছে সোজা লাগলো না। মনে-মনে যেটার আশঙ্কা করছি, ওটা ভুলেও করবি না মাহতিম।
তীব্র ক্ষোভে উত্তরটা দিতে গিয়ে নিজেকে সামলালো মাহতিম। মায়ের দিকে সেও ঝাঁজালো দৃষ্টিতে তাকালো। ঢোক গিলে সবটুকু ক্ষোভ ভষ্ম করেও শান্ত হলো না সে। ভেতরের দপদপানি রাগটা মুখ ফসকে বাজে ভাবে বেরুলো, যেটার দূরদর্শিতা সম্বন্ধে মাহতিম কল্পনাও করতে পারলো না! মাহতিম বুঝতেই পারলো না, অজান্তেই কতো বড় দূর্ভোগ সে নিজের প্রতি টানলো! সে ক্রোধের গলায় রোখা মেজাজে বলে বসলো,
– ওই মোল্লাবাড়িতে না গেলে শান্তিতেই থাকতে মা! তোমার জন্যে ওই বাড়ির —-
ভ্রুঁ কুঁচকে থমকে গেলো মাহতিম। মারজার মুখ ও দৃষ্টি এখন ছাদের দরজার দিকে স্থির। মায়ের অমনোযোগ অবস্থা দেখে ক্ষুদ্ধ হলো সে, মা কিসের জন্য দরজায় তাকিয়ে আছে? তার কথা শুনছে না কেন? কি দেখছে ওইদিকে? সেটা দেখতে গিয়ে নিজেও সেদিকে মুখ ফেরালো মাহতিম। তৎক্ষণাৎ প্রচণ্ড বিষ্ময় ও আশ্চর্যে চোখ বড় করে ফেললো! ভীষণ ঘাবড়ে গেলো সে। একবার মায়ের ভীতিগ্রস্থ মুখটার দিকে তাকালো, এরপর তাকালো দূরের দরজার দিকে। অন্ধকার হলেও দরজা ধরে যে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে চিনতে পেরে ঢোক গিললো মাহতিম। খুবই দূর্বল ভঙ্গিতে ছেলের দিকে মুখ ঘুরালেন মারজা। ছেলের নিষ্কম্প দৃষ্টি দেখে অতি নিচু সুরে বললেন,
– ও যদি কাঁদে মাহতিম, তোর কপালে নিশ্চিত দূর্গতি আসবে! তুই যেই কথাগুলো বললি, ভুলার মতো না।
শাসানো বাণী নিক্ষেপ করে গটগট পায়ে চলে গেলেন মারজা। যাওয়ার অভিমুখে পা থামিয়ে মেহনূরের দিকে তাকালেন, লজ্জায় নতমুখে মেহনূরের মাথায় হাত রাখলেন তিনি। নিচু সুরে নরমভাবে হাত বুলিয়ে বললেন,
– দাঁড়িয়ে থাকবি? ঘুমাবি না?
কতখানি সময় পেরিয়ে গেছে, জানা নেই মেহনূরের। বুকের ভেতর চাপা নিশ্বাস পৃষ্ট করে দাঁড়িয়ে ছিলো সে। কথা শোনার ইচ্ছে না থাকলেও সব কথা শুনেছে। মেহনূর রাগত ভঙ্গিতে রক্তিম চাহনিতে মাহতিমের দিকে তাকালো, কেবল একপলকের জন্য দেখলো, এরপর দৃষ্টি নামিয়ে অবান্তর চিন্তা থেকে শান্ত হলো সে। প্রশ্ন শুনে ফিকে হাসি দিয়ে বললো,
– ঘুম তো আসার কথা না মা। আমাকে মাফ করবেন। না চাইতেও আপনাদের কথাগুলো শুনে ফেলেছি। যতদূর বুঝলাম, এই বাড়ির জন্য আমি দূর্ভাগা কপাল এনেছি। এই কপাল কাউকে সুখে থাকতে দেয়নি, কাউকে শান্তিতে বাঁচতে দেয়নি, আবার —
কথাটা বলেই থামলো মেহনূর। সরাসরি কথাটা জায়গামতো ছুঁড়ে ফের বলতে শুরু করলো,
– আবার, এটাও ইঙ্গিত পেলাম আমি অন্যের কাজে ঝামেলা বাড়াচ্ছি। এসব শোনার পর আমি কিছুই বলবো না। আপনি যদি মনে করেন, আমার জন্য এসব কিছু হচ্ছে, আপনি সোজাসাপ্টা বেরিয়ে যেতে বলবেন। আমি চুপচাপ আম্মা আর বড়মার সাথে চলে যাবো।
পা ঘুরিয়ে ছাদের সিঁড়িতে পা রাখলো মেহনূর। ছাদের উঠোনে কাউকে হন্যে হয়ে খুঁজার চিন্তা আপাতত শেষ। দ্রুতপায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছিলো মেহনূর, একবারও পেছন ফিরে তাকালো না। দেখলো না, দুটো মানুষ কিভাবে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রচণ্ড জেদ, একবুক রাগ, অত্যধিক ক্ষোভ নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামলো মেহনূর। শাড়ি ধরে একদৌঁড় দিয়ে রুমের ভেতর এসে ঢুকলো। চোখ থেকে ঝরঝর করে তপ্ত ফোঁটা পরলেও রাগে সবকিছু অসহ্য লাগছে। সবকিছু তছনছ করার প্রবল ইচ্ছা জেগেছে। এমন পৈশাচিক ইচ্ছার উদয় কখন-কিভাবে জেঁকে ধরলো বুঝতে পারেনি মেহনূর। সমস্ত রাগ মনের ভেতর গুটি পাকিয়ে সোজা বিছানায় এসে বসলো। দুই মিনিট ড্রিম লাইটের আলোতে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে রইলো। সাদা চকচকে টাইলসটা নীলচে আলোয় দীপ্যমান। ফ্লোরের উপর গোল-গোল ফোঁটা টপটপ করে পরছে। নীল আলোটা ফোঁটা-ফোঁটা বিন্দুর উপর প্রতিচ্ছবি ফেলেছে। মেহনূর ধ্যানের মতো দৃষ্টিতে ফ্লোরের দিকে স্থির ছিলো, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ফোঁটার মতোই ফ্লোরটার জমিনে অশ্রুফোঁটা ঝরলো। নাক টেনে ঢোক গিললো মেহনূর। দু’হাতের তেলোয় সিক্ত চোখদুটো কঠিনভাবে ডলে মুছলো। বিছানা থেকে উঠে ওয়াশরুমে নিজেকে আবদ্ধ করলো সে, বেসিনের সামনে ট্যাপ ছেড়ে মুখে পানি ছিঁটা দিলো। হাতের কবজিদুটো ট্যাপের নিচে ধুতে থাকলে কানে দরজা খোলার শব্দ পেলো। একটুও বিচলিত না হয়ে ওয়াশরুম থেকে স্বাভাবিক ভাবে বেরুলো সে। আড়চোখে দেখতে পেলো, মাহতিম ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দু’হাতে কালো টিশার্টটা খুলে ফেলছে। সঙ্গে-সঙ্গে চোখ সরালো মেহনূর। তোয়ালেতে ভেজা মুখ মুছতে-মুছতে আলমারির কাছে গেলো। সোনালী রঙের হাতলটায় হাত রাখতেই পেছন থেকে কাঠ-কাঠ বলে উঠলো মাহতিম,
– কোথাও গুরুত্বপূর্ণ কথা চললে সবসময় নক করে ঢুকতে হয়। কথাটা মাথায় রাখবে, দ্বিতীয় বার রিপিট করবো না।
সোনালী হাতলটা পাঁচ আঙ্গুলে খাবলে ধরলো মেহনূর। হাতলটা যদি নাজুক কোনো বস্তু হতো, তাহলে এখুনি সেটা গোড়া থেকে আলগা হয়ে যেতো। মেহনূর চোখ বন্ধ করে ভারী নিশ্বাস ছেড়ে একটানে দ্বার খুললো। শাড়ির ভাঁজ থেকে খয়েরি মোলাটের ডায়েরী টেনে বের করলো, পাশ থেকে নীল কালির কলমটা বের করতেই আবারও পেছন থেকে বলে উঠলো মাহতিম। এবার অনেকটা আদেশের সুরে সুক্ষ্ম দাপটে বললো,
– হোয়াইট স্ট্রিপের টিশার্টটা দাও।
একবার ভাবলো কথাটা আমলে নিবে না। পরক্ষণে চুপচাপ বাঁ-দিকের দ্বারটা খুলে টিশার্ট বের করলো মেহনূর। মাহতিম তখন শেভিং টুলস বের করতে ব্যস্ত। শেভিং ফোম, ইলেক্ট্রনিক রেজার, হেয়ার ট্রিমার নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে ছুটলো। মেহনূর টিশার্টটা হাতে না দিয়ে বিছানায় রেখে চলে যাচ্ছিলো। দরজার কাছাকাছি যেতে-না-যেতেই ওয়াশরুম থেকে প্রচণ্ড জোরে ঝংকার উঠলো,
– মেহনূর!
শব্দের তীব্রতায় টালমাটাল হলো সে। চোখ তুলে ওয়াশরুমের দিকে তাকাতেই আরেকবার চেঁচিয়ে উঠলো মাহতিম,
– কানে শুনতে পাও না?
ওয়াশরুমের খোলা দরজার দিকে তীব্র দৃষ্টি ফেলে এগিয়ে চললো মেহনূর। দুই মেরুর মধ্যে উত্তপ্ত হাওয়া ছুটাছুটি করছে। মধ্যবর্তী স্থূলতা কবে মিটে যাবে, কেউ জানে না এখন। একজনের মধ্যে অসম রাগের নিরবতা চলছে, অন্যজনের মধ্যে প্রকাশ্য ক্রোধের ছোবল ঝরছে। মাহতিমের মুখে অপ্রাসঙ্গিক কথা, ইঙ্গিতপূর্ণ খোঁচা, নিজেদের মধ্যকার সম্পর্কের প্রতি তিক্ত বিষ সবকিছু দেখে নতুনভাবে ভাবনায় ডুবেছে মেহনূর। হয়তো মাহতিম মুখে কিছু না বললেও আকারে-ইঙ্গিতে মাহদির জন্য তাকেই দায়ী করছে। অব্যক্ত কথার আভাসে আজ পুরোপুরি সে এই বিষয়ে নিশ্চিত। তাই নিজের দিকটা নিয়ে সাফাই গাওয়ার জন্য সবকিছুই বৃথা লাগছে। অন্যদিকে মাহতিমের ভেতর শুধু এটুকু বিষয়েই রাগ, মেহনূর কেনো অভদ্র ভাবে কথাগুলো শুনলো। মাহতিম একান্তই নিজের মায়ের কাছে মনের ঝাঁজালো কথাগুলো ব্যক্ত করেছে। যে কথাগুলো শুধু মা-কেই অনায়াসে-নির্বিচারে বলতে পারে। সেখানে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে কেনো চুপ থেকে কথাগুলো শুনলো? এ কি সভ্য মস্তিষ্কের কাজ? কোনো বিবেক-বুদ্ধির মানুষ এসব করে? কথাগুলো হয়তো ওরকম মিনে বলেনি মাহতিম, কিন্তু কথার বিশ্রী ফলাটা বিশ্রীভাবে আঁচড় কেটেছে।
মেহনূর ওয়াশরুমের কাছে যেতেই মাহতিম তিক্ত গলায় বললো,
– টিশার্টটা আমার হাতে দেওয়ার কথা ছিলো। বিছানা থেকে তুলে ওটা এখানে নিয়ে এসো।
গালদুটোয় শেভিং ফোম লাগিয়ে মাহতিম ইলেকট্রিক সেকশন দেখছে। প্লাগটা সকেটের হোলে ঢুকাতেই মেহনূর টিশার্ট এনে দাঁড়ালো। হাত বাড়িয়ে টিশার্ট এগিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো। আয়নায় গম্ভীর দৃষ্টি ফেলে বাঁহাতে রেজার চালাচ্ছে মাহতিম। মেহনূরের দিকে একবিন্দু লক্ষ্য না করে ওর দিকে ডানহাত এগিয়ে দিলো। মেহনূর বাড়িয়ে দেওয়া হাতে টিশার্ট দিতেই হঠাৎ কবজি বিষিয়ে উঠলো। আকস্মিক ব্যথায় কপাল কুঁচকালো মেহনূর, কবজি ছাড়াতে ব্যস্ত হলে মাহতিমের চেহারায় তাকালো সে। হিংস্র জানোয়ার যখন খাদ্য পেয়ে নিষ্প্রভ অবস্থায় থাকে, মাহতিমের শান্ত মুখটা ঠিক তেমনই নিষ্ঠুর দেখালো! মেহনূর অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর ছোট্ট সুরে বললো,
– হাত না ছাড়লে আমি টিশার্ট ফেলে দেবো!
সরল হুমকি শুনে হঠাৎ হাসি পেলো মাহতিমের। এখুনি হাসির ছায়াটা মুখে পরলে বিপদ! চট করে নিজের ভঙ্গিমায় শক্ত আদল টেনে ফেললো। নরম কবজিটা টান দেওয়ার মতলব আঁটলো সে, এদিকে মেহনূর হাত ছাড়ানোর জন্য চরম পর্যায়ে ছুটাছুটি করছে। টিশার্টটা একপর্যায়ে হাতের মুঠো থেকে ছেড়ে দিলো মেহনূর। কবজি ছাড়াতে না পেরে আচানক এক ঝটকা মারলো। ঘটনার ক্ষিপ্ততায় ব্যালেন্স বিগড়ে কবজি ছাড়লো মাহতিম, সাথে-সাথে অস্ফুট আর্তস্বরে চোখ খিঁচে ফেললো! মেহনূর নিজেকে ছাড়িয়ে নিলেও মাহতিমের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ডানহাতের কবজিটা বাঁহাতে বুলাতে গিয়ে আচানক স্থির হলো সে। আশ্চর্য! শেভিং ফোমটা লাল হয়ে যাচ্ছে না? তখনই চোখ খুলে নিচে তাকালো মাহতিম, ফ্লোরে দুই ফোঁটা লাল বিন্দু পরে আছে। তার বাঁহাতের রেজারটায় সেই ছোপ-ছোপ নমুনা লেগে আছে। রেজারটার দিকে দৃষ্টি রেখে ডানহাতের তর্জনী ও মধ্যমা দিয়ে দু’বার ইশারা করলো। সোজা অর্থ হলো, ‘ বেরিয়ে যাও ‘, ‘ আমার চোখের সামনে থেকে এক্ষুনি দূর হও । ‘
.
ফুটন্ত পানিতে চায়ের লিকার ছাড়লো মেহনূর। চুলার আঁচটা কমিয়ে দিয়ে রুটির কাজটা দেখতে লাগলো। রান্নাঘরের একপাশে পেঁয়াজে ছুড়ি চালাচ্ছে সুরাইয়া। পেঁয়াজের ঝাঁঝে চোখ দিয়ে পানি পরছে, একটু পরপর সর্দি লাগার মতো নাক টানছে। অন্যপাশে সবজি কুটতে সাহায্য করছে সাবা। শানাজের হাতেও আজ রুটি বেলার চাকরি জুটেছে। চার বোন সবাইকে ছুটি দিয়ে নিজেরাই সবার জন্য নাস্তার আয়োজন করছে। পেঁয়াজ কাটার অবস্থা দেখে খিলখিল করে হাসলো মেহনূর। সুরাইয়ার দিকে হাপিত্যেশ করে বললো,
– বুবু ছুড়িটা আমার কাছে দাও। আমি কেটে দিচ্ছি। তুমি এসে চা-টা দেখো।
সুরাইয়া ক্ষীণ স্বরে বাধা দিলো,
– তুই আমার সামনে হাসবি না বলে দিচ্ছি। আমার অবস্থা দেখে হোহো মেরে হাসছিস লজ্জা করেনা? যা অন্য কাজ কর! তোর পেঁয়াজ আমি কাটতে পারবো।
সুরাইয়ার কথা শুনে পাশ থেকে বললো সাবা,
– বুঝলি সুরাইয়া, ভ্যাবলাটা পাক্কা সংসারী হয়ে গেছে। এজন্য আমাদের ভুলচুক দেখে ভ্যা-ভ্যা করে মজা নিচ্ছে। এগুলো খাঁটি হারা:মি বুঝলি। থাক, এদের কথায় কান দিস না। কাজ কর।
দু’বোনের ঠাট্টামস্করায় আরো হেসে উঠলো মেহনূর। এখানে আসার পর থেকে বোনে-বোনে মিল বেড়েছে। আগের মতো সেই চুলোচুলি স্বভাব নেই। ঝগড়া নিয়ে মাতামাতি নেই। সবার মধ্যে মিল-মহব্বতের আমোদটা জোরদার ভাবে এসেছে। একসময় সুরাইয়ার জ্বালাতনে মেহনূর প্রায় কেঁদেই দিতো, আজ সেই সুরাইয়া কতো সুন্দর করে প্রতিটি কাজে সাহায্য করছে। চোখ জ্বলছে, নাক ঝাঁজাচ্ছে, তবুও টু শব্দটি করেনি। ছুড়ি চালাতে পটু নয়, তবুও সুরাইয়া পটুতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। রান্নাঘরে এই তিনবোনের সখ্যতা দেখে মেহনূর স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। দাদাভাই নেই, তবুও কোনোকিছু বিগড়ে যায়নি। সম্পর্কগুলো যেনো আগের তুলনায় মজবুত হয়েছে, যেটুকু ফাটল ছিলো সবটুকু ঘুচে গেছে। মেহনূর চায়ের কাপ নামাতে থাকলে হঠাৎ শেফালি এসে হাজির হলো। চুলার দিকে তাকিয়ে বললো,
– আমারে এক কাপ চা দিবি? সক্কাল-সক্কাল চা খাইলে পরানডা কি যে শান্তি লাগে, কইবার পারুম না।
মেহনূর ফিচেল হেসে শেফালির কাপটা আগে রেডি করলো। দুধ-চিনি মিশাতেই বললো,
– নিমকি দেই? নাকি বিস্কুট খাবেন?
খুশীতে-আমোদে গদগদ হয়ে শেফালি বলে উঠলো,
– আমারে ভালা করিয়া চা-ই দে। নিমকি খাইবার পারি না। এহন হাবিজাবি খাইলে নাস্তা খাইতে কষ্ট হইবো।
মেহনূর তাতে সায় জানিয়ে চুপচাপ চা বানাতে লাগলো। মেজমা এখন আগের মতো তিরিক্ষি মেজাজে থাকে না। বিষবাক্য দিয়ে অন্যের মনে দগ্ধ তৈরি করে না। দাদাভাইয়ের সমস্ত কূটকর্ম সম্বন্ধে যেদিন জানতে পারলো, সেদিন থেকেই বড়মার ভয়ে-ভয়ে বদলে গেছে সে। বড়মার মধ্যে যেই আদর্শগত নীতিনিষ্ঠতা আছে, সেটা দেখে ধীরে-ধীরে সবাই কাবু হয়েছে। বর্তমানে গ্রামের মোল্লা বা মোড়ল অবশ্য বুজুর্গ ব্যক্তি হয়েছে, কিন্তু আজতিনি বড়মার কাছে শলা-পরামর্শ নিয়ে কাজ করে থাকেন। বড়মা সকলের কাছে মায়ের মতো, বোনের মতো ঘনিষ্ঠ হয়েছেন। সম্মানের জায়গাটাও উনার কম নয়। মেহনূর কাপের তলায় পিরিচ বসিয়ে চা এগিয়ে দিলো। শেফালী সেটা দুহাতে ধরে প্রফুল্ল কন্ঠে বললো,
– তোর চা-ডা খুব মজা হয়। মনে কিচ্ছু লইস না, পারলে বিকালে এই বুড়িরে এক কাপ চা দিস।
বলেই গরম চায়ে ঠোঁট ঠুকলো শেফালি। সুড়ুৎ করে এক চুমুক খেয়ে আবার বলে উঠলো,
– জামাই কই রে? সক্কালতে হেরে দেহি না। নাস্তা-পানি কিছু দিছিলি? নাকি পোলাডায় খালি পেডে বাইরে গেছে?
একটু বিব্রত মুখে হাসি দিলো মেহনূর। ভোরের ওই ঘটনার পর আর মুখদর্শন হয়নি। মাহতিম নিজ থেকেই দেখা দেয়নি। অন্যসময় হলে রান্নাঘর থেকে সবাইকে তাড়িয়ে নিজে আড়ি গেঁড়ে বসতো। শেফালির উত্তরে স্বাভাবিক মুখে বললো, মাহতিম বাইরে দৌঁড়াতে গিয়েছে। শেফালি রান্নাঘর থেকে চলে গেলে নাস্তার বন্দোবস্ত সারলো। সব আইটেম ডাইনিং টেবিলে সাজিয়ে এসে দুপুরের খাবারে ব্যস্ত হলো। সংসারী হলে বুঝি এই এক দুশ্চিন্তা! আজ কি রান্না করবো? কোন পদ করবো? খাবারটা সবার ভালো লাগবে? সবার খাওয়া শেষে খেতে যাবে মেহনূর। সিঙ্কের নিচে গ্লাস ধুচ্ছে সে, তখনই পেছন থেকে ব্যস্ত পায়ে শানাজ এসে ঢুকলো। খালি জগটা ভরার জন্য ফিল্টারের ট্যাপ ছাড়তেই বললো,
– মেহনূর, ভাইয়ার অবস্থা দেখেছিস? উহঃ! দৃশ্যটা মনে পরলেই গা ঝাঁড়া দেয়! রেজারটা কেমন ভাবে ডেবেছে একবার ভাব? পানি দিয়ে আসতে গেলাম। তখন দেখি ওই অবস্থা। তুই চটপট হাতের কাজটা সেরে খেতে আয়। তোর শ্বাশুড়ি কিন্তু চেঁচাবে।
জগটা পানিভর্তি করে চলে গেলো শানাজ। রান্নাঘরটার ভেতর শূন্যতা ছেড়ে গেলো সে। মেহনূর মুখ ফিরিয়ে খালি দরজাটার বাইরে তাকালো। মাহতিমকে এখান থেকে যাচ্ছে না। তার মানে মাহতিম খেতেও নামেনি। বেখাপ্পা ধাক্কাটার জন্য ধিক্কার দিতে মন চাইছে! ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ! মানুষ যে রাগের বশে পশুর মতো বিকৃত হয়ে যায়, এটাই তার নিকৃষ্ট উদাহরণ!
.
কোকের বোতল নিয়ে স্টাডি চেয়ারে বসলো মাহতিম। রুমটার মাহদির। দেয়ালে-দেয়ালে মাহদি নিশানা আজও লেগে আছে। টুকরো-টুকরো স্মৃতিগুলো রুমটার ভেতর আবদ্ধ। মাহতিম বহুদিন পর মাহদির বদ্ধ রাজ্যে ঢুকলো। এখনো রুমটার বাতাসে যেনো মাহদির গন্ধ রয়ে গেছে। মিঠে ঘ্রাণটা জোরে নিশ্বাস নিলে একটু-আধটু টের পাওয়া যায়। আবার এটা ভ্রমও হতে পারে। ডেষ্কটপ অন করে নিজের অফিশিয়াল পিসির সাথে কানেক্ট করে নিলো। ইন্টারনেট কানেকশানটা চেক দিয়ে কিছু মেইল দেখতে থাকলো। না, কিছু আসেনি। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতেই ডান পকেটে বিপ্ করে উঠলো। পকেট থেকে ভাইব্রেট ফোনটা বের করতেই স্ক্রিনে দেখলো ‘ সৌভিক ‘। কলটা রিসিভ করে সাদা এয়ারপডে কানেক্ট করলো মাহতিম। ওপাশ থেকে সৌভিকের হাসিমাখা গলা এলো,
– আছিস কোথায়? বাসায়, না বাইরে?
মাউস নাড়িয়ে কাজ করতেই জবাব দিলো মাহতিম,
– বাসায়, বাসায়। বাইরে কেন যাবো?
সৌভিক কথাটায় মজা পেয়ে বললো,
– এহহে রে! ভুলে গেছি দোস্তো, ভুলে গেছি। বাড়িতে মৌচাক থাকলে তুইতো অন্য জায়গায় ঢুঁ মারবি না।
হাসির আভাটা কপটভাবে মিলিয়ে গেলো মাহতিমের। গোমড়া মুখে বললো,
– কথার লিমিটটা পজিশন মতো রাখিস সৌভিক। ত্যাঁড়াব্যাকা বিশ্রী ইঙ্গিত আমার সহ্য না।
সৌভিক উলটাটা বুঝে বেঢপ হেসে উঠলো। তার যেনো হাসিই থামছে না। এয়ারপডের ওয়ারলেস কানেকশনে সব শুনছে মাহতিম। কপট রাগ দেখিয়ে বলে ফেললো,
– আল্লাহর ওয়াস্তে চুপ হ সৌভিক! আমার কিন্তু সত্যিই ভালো লাগছে না!
হাসিটা ঠেলেঠুলে সামলালো সৌভিক। গলাটা হালকা একটু খাঁকাড়ি দিয়ে বললো,
– চল বন্ধু, ম্যাচিং ম্যাচিং শেরওয়ানি পরি। পরবি?
মাহতিম তীর্যক ভাবে বললো,
– তোর মাথার তারগুলো এই লেভেলে নষ্ট হয়েছে জানতাম নাতো! আমাকে কোন্ এ্যাঙ্গেলে ব্যাচেলার পেলি? ঠিকঠাক মতো কাজটা সারলে বউ এতোদিনে প্রেগনেন্ট হয়ে যেতো। এদিকে তুই শেরওয়ানির জন্য ফোর্স করছিস? বা:টপার দেখেছি, তোর মতোন বা:টপার দেখিনি।
হো-হো করে দু’কানে হাসির আওয়াজ এলো। সৌভিকের হাসি শুনে একদিকে রাগও লাগছে, অন্যদিকে ভালোও লাগছে। একি যন্ত্রণা! মাথাটা ডানে-বামে নাড়িয়ে মৃদ্যু হাসলো মাহতিম। তখনই স্ক্রিনের উপর মেইলের নোটিফিকেশন এলো। ‘ আন-রিড ‘ মেইলটা দেখে সেখানে ক্লিক করলো মাহতিম। বাফারিং করতে-করতে ওপাশ থেকে বললো,
– তুই যাই বল, যেটাই বল, তুইযে আজীবন ব্যাচেলারের খেতাবে থাকবি, এটা তোকে গ্যারান্টি দিয়ে বলছি। তুইতো চান্দু পালটাবি না। যেই ফিগার করছিস, ওটার জন্য আরো দশ বছর ফুড়ুৎ! মাহতিম, কবে চাচ্চু ডাক শুনাবি? আরো টাইম নিবি?
– যখন শোনা শুরু করবি, তখন বছর-বছরই শুনতে থাকবি। অপেক্ষা কর।
বাফারিং শেষে মেইল ওপেন হলো। মেইলের প্রথম লাইন দেখে কপালে অসংখ্য ভাঁজ পরলো তার! কৌতুহল হয়ে নিচের ঠোঁটটা জোরালো ভাবে কামড়ালো। মাউসে হাত রেখে স্ক্রিনের লেখাটা মনোযোগ দিয়ে পড়তে লাগলো মাহতিম। শুধু পড়েই গেলো। মুখ দিয়ে কথা বেরুনোর অবস্থা নেই।
সৌভিক কিছুক্ষণ চুপ থেকেও কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছে না। কলটা কেটে গেলো নাকি? কান থেকে ফোন নামালো, স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো, এখনো ডিউরেশন চলছে। কানে ফোন লাগিয়ে ফের সাড়া চাইলো সৌভিক। বারবার বলতে লাগলো, ‘ হ্যালো? দোস্ত তুই শুনছিস? রাগ করলি দোস্ত? মাহতিম, তুই শুনছিস? হ্যালো? নেটওয়ার্ক কি সমস্যা দিচ্ছে? ‘ কথার মধ্যেই সাংঘাতিক ভাবে ভড়কে গেলো সৌভিক! পরপর সজোড়ে কয়েকটা ঘুষি মারার আওয়াজ হলো! এরপর সব সুনশান। সাড়া নেই, শব্দ নেই, ঝিঁঝি পোকার মতো শূন্য অবস্থা! কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইলো সৌভিক! কিছুক্ষণ পর কান থেকে আস্তে-আস্তে ফোন নামিয়ে ফেললো। সে কি অস্পষ্ট ভাবে ঠিক শুনলো? মাহতিম কি আসলেই ‘ আই এ্যাম সরি সৌভিক। কান্ট এ্যান্টেড দ্যা ওয়েডিং ‘ বলেছে?
চলমান .
#FABIYAH_MOMO .
#নোটবার্তা : ৩১০০+ শব্দ। ৭০০০+ শব্দ ফে:সবুক অথো:রিটি এলাউ করেন না। 💔