মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤ #পর্বসংখ্যা_৬৬. #ফাবিয়াহ্_মমো. #উপসংহার . অংশ-০১.

0
1738

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৬৬.
#ফাবিয়াহ্_মমো.
#উপসংহার .

অংশ-০১.

প্রচণ্ড ভয় নিয়ে আকাশে তাকালো সৌভিক। রাতের আকাশটা অসম্ভব রূপে শান্ত। আগামীদিনের দূর্ভোগ সংকেতটা রণাঙ্গনের মতো লাগছে। ঢাকজাতীয় রণবাদ্য যেনো বিপদের সংকেত দিচ্ছে। সামনে যেই অপ্রস্তুত অবস্থা আসছে, সেটার কবলে পরলে ভারী বিপদ। সৌভিক বুঝতে পারলো এই মূহুর্তে সে নিরুপায়। দুটো শান্ত মানুষ পরিস্থিতির খপ্পরে প্রচণ্ড জেদি হয়ে গেছে। তাদের ঠান্ডা স্বভাবের নিচে একরোখা তেজটা আগুনের মতো জ্বলছে। তাদের থামানো-দমানো অনেকটা দুষ্প্রাপ্য ব্যাপার। জানতে-অজান্তে বড় ভুলের দিকে পা বাড়িয়েছে তারা। সৌভিক কল্পনার চোখে সব যেনো ঠিকঠাক মতো দেখতে পেলো। মজবুত দড়িটা দুদিকের অসম্ভব টানে মাঝ বরাবার ছিঁড়ে গেলো। সৌভিক তৎক্ষণাৎ চোখ বুজে ফেললো। কল্পনার চিত্রটা সাথে-সাথে মুছে ফেলতে চাইলো, কিন্তু সে পারলো না। শত চেষ্টা করেও মন থেকে ঘুচলো না। এই নিঝুম রাতে সৌভিকের পাশাপাশি আরো দুটো মানুষ নির্ঘুম মূহুর্ত কাটাচ্ছে। একজন ছাদের ঘরে নিজেকে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে, অপরজন অন্ধকার রুমে নিজের ভাগ্যের খেলা চুপচাপ দেখে যাচ্ছে। পরদিন সকাল বেলাটা আশ্চর্যভাবে শুরু হলো। শুরু হলো সৌভিক ও শানাজের বিয়ের আমেজ দিয়ে। শুরু হলো নিজেদের নিরব সংঘর্ষ সকলের চোখে ধূলো দিয়ে। মেহনূর সেই রাতের কথাগুলো ভুলতে পারেনি। আর হয়তো সে ভুলবে না। মাহতিম কোন্ প্রেক্ষিতে কথাগুলো বুঝিয়েছে সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে না। যা বুঝার ছিলো, তা সম্পূর্ণ রূপে বুঝে ফেলেছে মেহনূর। হোক ভুল বুঝাবুঝি, এবার কি আদৌ মেহনূরের দোষ ছিলো? একদম না! মেহনূর তাই বলে বারবার নিজেকে ছোট করতে যাবে না। এমন মতের উপর অটল থেকে বিয়ের দায়-দায়িত্ব দেখছে সে। হঠাৎ মাহতিমের মুখোমুখি হয়ে গেলে মুখ ফিরিয়ে নেয় মেহনূর। যদি মাহতিম নিজ থেকে না আগায়, তাহলে মেহনূর নিজেও আশকারা দিবে না। যা যেমন আছে, তেমনি থাকুক। মানুষ ওকে পেয়েছে কি? চুপ করে থাকে বলে ইচ্ছামতো মর্জি খাটাবে? এবার এই মর্জিগুলো অমান্য করে দেখাবে। সেও দেখতে ইচ্ছুক জল কতদূর আগায়। কাউকে পরোয়া করবে না। কোনোকিচ্ছু আমলে নিবে না। দেখা যাক পরিস্থিতি তাকে কোথায় নিয়ে যায়।

ধুমধামের বিয়ে মানেই নানা কাজের ঝামেলা। এটা দেখো, ওটা দেখো এরকম করতে-করতে সময় যায়। ডেকোরেশনের ব্যাপারটা সিয়ামের হাতে সপে মাহতিম আপাতত ক্যাটেরিং দিকটা দেখছে। সবকিছু যেনো ফার্স্ট ক্লাস চাই, এরকম একটা জিদ কাজ করছে। কানে ফোন এঁটে খুবই শান্ত ভঙ্গিতে আপডেট শুনছে। বাঁ হাতের কবজিটা চোখের সামনে এনে সময়টা একবার দেখলো। দুপুর বারোটা বেজে পনের মিনিট চলছে। ঠিক সন্ধ্যার দিকে হলুদ ছোঁয়ার অনুষ্ঠান হবে। এখনো হাতে পাঁচ-ছয় ঘন্টার মতো সময় আছে। সময়ের হিসাবটা কাটায়-কাটায় ক্যালকুলেট করে বাড়তি কাজের চিন্তা করলো। মধ্য গগনের গোলাকার চাকাটা ভালোই গরম বাড়িয়েছে। অসহ্য তাপদাহে বাড়ির ভেতরটাও বেশ গরম। মাহতিম একটুখানি ঠান্ডা বাতাসের আশায় জানালার কাছে গেলো। ফোনে কথা বলতে থাকলে হঠাৎ পেছন থেকে ডাকলো,

– মাহতিম ভাইয়া,

নিজের নামটা শুনতে পেয়ে ওই অবস্থায় ঘুরলো মাহতিম। ঠিক পেছনে হাসিমুখে সুরাইয়া দাঁড়িয়ে আছে। চেহারায় সৌজন্যতা এবং সরল ভঙ্গিতে কিছু বলতে চাচ্ছে। ‘ দুই মিনিট পর কল দিচ্ছি। ‘ বলে কলটা কাটলো মাহতিম। সুরাইয়ার হঠাৎ আগমন দেখে একটু অদ্ভুত-অদ্ভুত লাগছিলো। পুরোনো ব্যাপার-স্যাপার ভুলে গিয়ে স্বাচ্ছন্দ্য গলায় বললো,

– কিছু বলতে চাচ্ছো?

মাথাটা ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে নাড়িয়ে স্বাভাবিক হলো সুরাইয়া। সহজ ভঙ্গিতে বললো,

– আমার পুরোনো ভুলগুলোর জন্য দুঃখিত ভাইয়া। একসময় আপনাকে প্রচুর বিরক্ত করেছি। আপনাকে, মেহনূরকে কম জ্বালাতন করিনি। এখানে আসার পর থেকে আপনার কাছে কথাগুলো বলতে চাইছিলাম, কিন্তু আপনি শানাজ বুবুর জন্য ব্যস্ত হয়ে আছেন। সবার সামনে এই কথাগুলো বলতে আমার অস্বস্তি লাখতো। এজন্য এই ফাঁকে আপনাকে বলতে এলাম।

কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর হাসলো মাহতিম। ফোনটা বাঁ পকেটে ফেলে নির্ভার কন্ঠে বললো,

– আগে কি করেছো, না-করেছো ওসব কথায় মাটি দাও। এখন যেমন আছো, সবসময় তেমনই থাকো। ক্ষমাটা ওর কাছে চাইলে আমি ব্যক্তিগত ভাবে খুশি হবো। ওকে বলা মানেই আমাকে বলা।

অনেকটা আক্ষেপমুক্ত হয়ে হাসি দিলো সুরাইয়া। এতোদিন ভয়ে ছিলো কথাগুলো কিভাবে পেশ করবে। কিন্তু এখন সবকিছু বলতে পেরে বুকের পাথর সরে গেছে। এক অদ্ভুত অপরাধে মন খচখচ করছিলো। যেটা এখন নেই। মাহতিমের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলবে, এটা চিন্তা করলেই ভয়ে বুক কাঁপতো! এখন কেনো জানি জড়তা কেটে গেছে। মাহতিম কিছু মনে পরার ভঙ্গিতে তৎক্ষণাৎ ট্রাউজারের রাইট পকেটে হাত ঢুকালো। কালো ওয়ালেটটা মুঠোয় নিয়ে বাহির করতেই ভেতর থেকে কার্ড টেনে নিলো। ওয়ালেটটা পুনরায় বন্ধ করে পকেটে রাখলে কার্ডটা সুরাইয়ার দিকে বাড়িয়ে দিলো। দু’আঙ্গুলের ফাঁকে ধরা রাখা কার্ডটায় উজবুক ভাবে তাকালো সুরাইয়া। প্রশ্ন গলায় বললো,

– এটা কি ভাইয়া?

মাহতিম ওর হাত টেনে কার্ড গুঁজে বললো,

– এটা রাখো। তোমার বোনকে সঙ্গে নিয়ে শপিংয়ে যাও। ও যা-যা কিনতে চায়, কিনে দিও। আর তুমিও নিজের জন্য কিছু কেনো। আমার তো সময় নেই, আমি শপিংয়ে যেতে পারবো না। তোমরা যাও কেমন?

মাহতিম অজুহাত দেখিয়ে খুব সুন্দর কেটে পরলো। সুরাইয়া পুরোপুরি অবাক! তার মানে সত্যি-সত্যিই দুজনের ভেতর দ্বন্দ্ব চলছে? মাহতিম তাহলে কৌশলের সাথে মেহনূরকে দূরে ঠেললো? সুরাইয়া চুপচাপ সিঁড়ি বেয়ে ছাদের রুমে ঢুকলো। মেহনূরের কাছে গিয়ে শান্ত ভাবে বললো,

– মেহনূর, ভাইয়া তোকে নিয়ে শপিংয়ে যেতে বলেছে। তুই একটু সময় বের করে আসতে পারবি? এই দ্যাখ কার্ড। কার্ডটাও ধরিয়ে দিলো।

মেহনূর একনজর কার্ডের উপর ফেললো। এরপর দৃষ্টি সরিয়ে শুকনো শাড়ি ভাঁজ করতে-করতে বললো,

– কার্ডটা যার থেকে নিয়েছো, তাকে ফেরত দিয়ে আসো। আমি কোনো শপিং-টপিংয়ে যাবো না বুবু।

ভাঁজকৃত শাড়িটা নিয়ে আলমারি খুললো মেহনূর। কোনো বিশেষ ভাবাবেগ না দেখিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হলো। পেছনে থাকা সুরাইয়া অবুঝের মতো একবার কার্ডের দিকে তাকালো, এরপর মেহনূরের দিকে দৃষ্টি রাখলো। মেহনূর ক্লথ-হ্যাঙ্কারে শাড়ি ঝুলাতেই বললো,

– দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট কোরো না বুবু। কার্ডটা ফেরত দিয়ে আসো। নিচে প্রচুর কাজ পরে আছে। আমি একা-একা পারবো না।

সুরাইয়া ছোট্ট স্বরে ‘ ঠিক আছে ‘ বলে বেরিয়ে গেলো। ও যেতেই শূন্য দরজার দিকে ফিরলো মেহনূর। হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য সবার শাড়ি কেনা শেষ। শুধু মেহনূর বাকি আছে। মারজা যখন মেহনূরের জন্য শাড়ি কিনে দিতে চাইলেন, মেহনূর তখন বাধা দিয়েছিলো। ওর গায়ের প্রতিটি শাড়ি মাহতিমের কিনে দেয়া। এ যাবৎ যতো পোশাক-আশাক দরকার পরতো, সবই মাহতিম বলার আগে নিজেই হাজির করতো। অথচ আজ সুরাইয়াকে দিয়ে কার্ড পাঠিয়ে দিয়েছে। কি নিষ্ঠুর আচরণ! ছিঃ! নূন্যতম বিবেকও কি কাজ করেনি? মাহতিম কি জানেনা, মেহনূর কিসে অভ্যস্ত? নিজে গিয়ে কি শাড়ি আনতে পারলো না? সে যদি সুরাইয়ার হাতে কার্ড না দিয়ে একটা শাড়ি ধরিয়ে দিতো, তাহলে মেহনূর সেটা ফিরিয়ে দিতো? কক্ষনো না! মেহনূর তখনই সমস্ত রাগ-জেদ-অভিমান পানি করে শাড়িটা বুকে জড়িয়ে নিতো। তার মাহতিমের দেওয়া শাড়িটা পরতে বিন্দুমাত্র সঙ্কোচ করতো না। পদে-পদে এমন নিষ্ঠুর ব্যবহার সহ্য করা সহজ? প্রচণ্ড জোরে আলমারির দ্বারটা বন্ধ করলো মেহনূর। শব্দের তীব্রতা রুমের বাইরে গিয়ে সুরাইয়ার কানেও পৌঁছলো। চমকে গিয়ে সিঁড়িতে ভয় পেলো সুরাইয়া। মুখ ফিরিয়ে ছাদের দরজার দিকে তাকালো।
.

জলন্ত অগ্নিপিণ্ডটা পশ্চিমাকাশে হেলে পরেছে। আকাশের বুকে কেউ যেনো কমলা রঙের তুলি টেনেছে। কি চমৎকার সে দৃশ্য! আকাশের পানে মুখ তুললে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে হয়। পড়ন্ত বিকেলের মিঠে আলোয় লন সাইডটা জমজমাট। আকাশে যখন সাঁঝের মায়ায় বেগুনি আঁচড় গাড়বে, তখনই চর্তুপাশ রাঙিয়ে মরিচবাতির আলো জ্বলবে। আস্তে-আস্তে বাড়ির লনে অতিথিবৃন্দের সমাগম হচ্ছে। লনটার একপাশে ছোট্ট একটা প্যান্ডেল করা। পুরো প্যান্ডেলটা হলুদ রঙে মুড়ে দেওয়া। দূর থেকে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার মতো আলোকসজ্জা। সবকিছু প্ল্যানমাফিক করতে পেরে স্বস্তি পেয়েছে মাহতিম। একটু পরেই শানাজকে প্যান্ডেল তোলা হবে। ফটোগ্রাফারের দলটা আসতে একটু দেরি আছে। শেষ বিকেলের আভাটা মুছে গিয়ে সাঁঝের মায়ায় ডুবলো। আকাশের রঙটা ফিকে হয়ে গাঢ় বেগুনি রঙে পরলো। নীতির রুমে সব মেয়েরা একত্র হয়ে সাজছে। তিনটা বিউটিশিয়ান মেয়ে জনে-জনে সবাইকে সাজিয়ে দিচ্ছে। শানাজের পড়নে হলুদ রঙের জামদানী কাপড়ের শাড়ি। লাল রঙের মোটা পাড়টা দারুণ চমৎকার! শাড়ির আঁচলটা টকটকে লাল। লালের উপর সোনালী বুননের কারুকাজটা ঝিকমিক করে জ্বলছে। সঙ্গে লাল রঙের ব্লাউজ। যার হাতাটা কনুই পযর্ন্ত এসেছে। মাথায় ঘোমটা রেখে বাঙালি স্টাইলে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে। শানাজকে হলুদ সন্ধ্যার হলুদ পরী লাগছিলো। গ্রামের ছাপ ধুয়ে শহুরের চাকচিক্যে মারাত্মক মানিয়ে গেছে। যেনো শানাজ শহরের মেয়ে, শহরের কাতারেই বেড়েছে। সবার আগে রেডি হলো ফারিন। সাজসজ্জা ও শাড়ির বেশ নিয়ে নিচে নামতে নিলো, দু’হাতে শাড়ি ধরে নিচে নামতে নিলে হঠাৎ মেহনূরের কথা মনে পরলো। ‘ কি সাংঘাতিক! ভাবী কোথায়? ভাবী না আমাদের সাথে ছিলো? ‘ কথাগুলো বলতে গিয়ে দ্রুত মেহনূরকে খুঁজতে লাগলো। সোজাসুজি ছাদের দিকে পা বাড়িয়ে কাঙ্ক্ষিত রুমের কাছে পৌঁছলো। রুমের স্লাইডিং ডোরটা বামে টেনে পা বাড়ালো ফারিন। আশ্চর্য হয়ে বিছানার দিকে চোখ বড় করে তাকালো। চরম বিষ্ময় নিয়ে বিছানার কাছে এগুতে-এগুতে বললো,

– ভাবী তুমি রেডি হওনি কেন? নীতি আপুরা সবাই রেডি হয়ে যাচ্ছে। তুমি কাউকে না বলে এখানে এসেছো কেন? কি হয়েছে তোমার?

ফারিন দু’হাতে শাড়ি ধরে বিছানায় এসে বসলো। মেহনূর বিছানার হেডসাইডের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বই পড়ছিলো। ফারিনকে পাশে বসতে দেখে বই বন্ধ করে বললো,

– কিছু হয়নি ছোটকু ননদিনী। তুমি নিচে যাও। সবাই তোমাকে খুঁজবে। আমি একটু পরেই তোমাদের সাথে দেখা করছি।

ফারিন ভ্রঁ কুঁচকে বিষ্ময় নিয়ে বললো,

– তুমি কি ভাইয়ার উপর কোনো কারণে রেগে আছো?

ঠোঁটের দু’কোণে হাসির ভাঁজ ফেলে ‘ না ‘ করলো মেহনূর। ফারিনের হাতদুটো আদর দিয়ে ধরলো। মুখে হাসি টেনে বললো,

– কোনো রাগ নেই গো। আমি যে তোমাদের মতো কোলাহল পছন্দ করি না, এজন্য একটু আলাদা হয়ে বসে আছি। তুমি যাও, আমি একটু পরেই নিচে আসবো।

ফারিন কোনো কথা বললো না। মেহনূরের হাবভাব দেখে যা বুঝার ছিলো, সব বুঝে গেছে। যেভাবে ব্যস্ত পায়ে ছাদে উঠেছিলো, তার বিপরীত ভাবে নিরস্ত পায়ে নেমে এলো। দোতলার কাছে দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকলো সে। কয়েক মিনিট চিন্তাভাবনা করে বামের সেই আধ ভেজানো রুমটার দিকে তাকালো। সেদিক বরাবর পা ফেলে সাদা দরজার কাছে পৌঁছলো ফারিন। চুড়ির ঝিনঝিন শব্দযোগে আস্তে করে দরজা ঠেলে দিলো। বিনম্র কন্ঠে বললো,

– ভাইয়া আছো?

ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মাহতিম। গায়ে জলপাই রঙের পান্ঞ্জাবী। হাতে পারফিউমের বোতলটা নিয়ে কড়া স্প্রে করছে সে। এটা তার শক্ত অভ্যাস। বদলানো মুশকিল। স্প্রের মুখটা বন্ধ করে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,

– বল,

ফারিন দরজা ছেড়ে ভেতরে ঢুকে পরলো। মাহতিমের কাছে এসে বিমর্ষ কন্ঠে বললো,

– তুমি ভাবীকে কিছু বলেছো?

স্লিভটা গুটাতে গিয়ে মাহতিম স্থির হয়ে গেলো। মুখটা ডানে ঘুরিয়ে ফারিনের দিকে তাকালো। প্রশ্ন করে বললো,

– কি বলতে যাবো?

ফারিন কোনোপ্রকার ভণিতা না করে বললো,

– এদিকে সবাই রেডি হয়ে যাচ্ছে। ভাবী এখনো শাড়িই পরেনি! এটা কি কোনো কথা?

মাহতিম কথাটা শুনে শক্ত হয়ে গেলো। সে কি আবারও কোনো ভুল করে ফেললো? সবাই রেডি হচ্ছে, ও কেনো ভঙ ধরে আছে? চিন্তার চাকাটা ঘুরাতে লাগলো সে। কোন্ ভুলটা করেছে সেটা নিয়ে ভাবতেই চোখ-মুখ কুঁচকে ফেললো মাহতিম। দাঁত শক্ত করে তৎক্ষণাৎ চেঁচিয়ে উঠলো,

– ওহহো শিট! আমিতো ভুলেই গেছি..

দ্রুত স্প্রের বোতলটা ফেলে গাড়ির চাবি খুঁজতে লাগলো। অস্থির হয়ে তন্নতন্ন করে চাবি খুঁজছিলো মাহতিম। ভাইয়ের অবস্থা দেখে কাহিনী বুঝলো না ফারিন। বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকলে মাহতিম ততক্ষণ চাবি পেয়ে গেছে। ঝড়ের বেগে রুম থেকে বেরুনোর সময় গলা উঁচিয়ে বললো সে,

– খবরদার! আমি না আসা পযর্ন্ত অনুষ্ঠান শুরু করবি না!

আর দাঁড়ালো না মাহতিম। দ্রুতবেগে দৌঁড় লাগিয়ে একছুটে গ্যারেজে আসলো। লন সাইড থেকে দৌঁড়ানোর দৃশ্যটা তৌফ দেখতে পেলো। ‘ মাহতিম কই যাস? ‘ বলার আগেই চোখের সামনে দিয়ে জিপ ছুটিয়ে বেরুলো। মাহতিমকে উন্মত্ত ভঙ্গিতে বেরুতে দেখে নানা প্রশ্নের উদ্রেক হলো। একটু পরে অনুষ্ঠান শুরু হবে, মাহতিম এখন কোথায় গেলো? ওমন তড়িঘড়ি ভঙ্গিতে কোথায় ছুটলো?

প্রচণ্ড অসহনীয় গরম। ভ্যাপসা গরমের জ্বালায় পুরো শহরটা ছটফট করছে। গ্রীষ্মের খরতপ্ত আবহাওয়াটা সন্ধ্যার দিকেও তাপ দিচ্ছে। আধাঘন্টার রাস্তাটা শর্টকাট মেরে দশ মিনিটে ফিরলো মাহতিম। গায়ের পাণ্ঞ্জাবীটা হুলস্থুল অবস্থার জন্য পুরোপুরি ভিজে গেছে। মাথার চুলগুলো ঘেমে নাস্তানাবুদ। কপালের কাছে চুলগুলো থেকে টুপ-টুপ পানি ঝরছে। গ্যারেজের কাছে জিপ ঢুকিয়ে দৌঁড় লাগালো মাহতিম। লনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে দেখলো, অনুষ্ঠান এখনো শুরু করেনি। এক দৌঁড় দিয়ে সিঁড়ির কাছে পৌঁছলো সে। তিনধাপ সিঁড়ি একসঙ্গে পেরিয়ে ছাদের রুমটায় পৌঁছে গেলো। স্লাইডিং ডোরটা খুলে ভেতরে তাকাতেই থমকে গেলো মাহতিম। দৌঁড়ের কারণে প্রচণ্ড হাপাচ্ছে সে। মুখ খুলে হাপাতে থাকলে তার দিকে দু’জোড়া দৃষ্টি পরলো। মাহতিমের অবস্থা ঘেমে-নেয়ে একদম জঘন্য! পুরো মুখ লাল হয়ে আছে, চুলগুলো ভিজে গেছে। মুখ দিয়ে অবিশ্রামভাবে নিশ্বাস নিচ্ছে। তার ডানহাতে একটা সাদা রঙের ব্যাগ। মাহতিমকে জোরে-জোরে হাপাতে দেখে কপাল কুঁচকালো শানাজ। অবাক কন্ঠে বললো,

– একি অবস্থা! আপনি কোথা থেকে এলেন? আপনি না রেডি হচ্ছিলেন?

অস্বাভাবিক নিশ্বাসের জন্য মাহতিম কথাই বলতে পারছে না। ঢোক গিলে ঠান্ডা হওয়ার জন্য মাথাটা নিচে ঝুঁকালো। মেহনূরকে রেডি করার জন্য একটু আগে এসেছে শানাজ। এসেই দেখে মেহনূর রেডি হয়নি। মেহনূরকে জোরপূর্বক নিজের কেনা শাড়ি ধরিয়ে রেডি হতে বললো। মেহনূর নিরুপায় হয়ে সেই শাড়িটাই হলুদের জন্য পরলো। এই অবস্থায় মাহতিমকে দেখে শানাজ কি করবে ভেবে পেলো না। মেহনূর একবারও পিছু ফিরে দরজার দিকে তাকালো না। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লম্বা চুল আঁচড়াচ্ছে। পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক করার জন্য মাহতিম ঢোক গিলে বললো,

– এই প্যাকেটটা বিছানায় রেখো শানাজ। নিচে কাজ আছে, আসছি।

চলে গেলো মাহতিম। হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে বিছানায় রাখলো শানাজ। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যবর্তী ফ্যাসাদে ঢুকা অনতিচর্চার বিষয়। তাই চুপচাপ মেহনূরকে নিচে আসতে বলে সেও রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। চুল আঁচড়ে ঘাড়ের কাছে খোঁপা করলো। সবুজ রঙের শাড়ির সাথে ঝুমকা জোড়া পরলো। সবুজ রেশমি চুড়িতে দু’হাত ভর্তি করলো। সম্পূর্ণ রেডি হয়ে রুম থেকে বেরুতে নিলো সে, যেতে ধরেই বিছানার দিকে সাদা ব্যাগটার উপর চোখ পরলো। স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকতেই ব্যাগটার দিকে এগিয়ে গেলো। কৌতুহলের বশেই সাদা ব্যাগটার ভেতর ডানহাত গলিয়ে দিলো সে। ভেতর থেকে খচখচ করা প্যাকেটটা টান দিতেই স্তম্ভ দৃষ্টিতে তাকালো। বুকটা আচানক ধড়ফড়-ধড়ফড় করতে লাগলো। গলা শুকালো, রক্তের স্রোত বাড়লো, মাথাটা ফাঁকা-ফাঁকা অনুভব হলো। স্বচ্ছ প্যাকেটটার ভেতর একটা চমৎকার হলুদ শাড়ি। রঙটা গাঢ় হলুদ, পাড়টা গাঢ় সবুজ। হলুদ-সবুজের মাঝে অদ্ভুত সুন্দর শাড়িটা দেখে অভিভূত হয়ে গেলো। এই শাড়িটা আনার জন্যই ওমন করে হাপাচ্ছিলো? ঘামে ভিজে জবজবা হয়ে ফিরলো? পুরো অনুষ্ঠানে নিজেকে মাটি করে মেহনূরের জন্য ছুটলো? উদাস চাহনিতে চোখ বুজলো মেহনূর। দু’হাতে শাড়িটা বুকে চেপে ধরলো। তখনই প্যাকেটের নিচ থেকে আঠা আলগা হয়ে গেলো, ছোট্ট হলুদ রঙের নোটচিটটা অজান্তেই ফ্লোরে পরে রইলো।

‘ I’m SORRY ‘

Yours Ansari.

চলমান .

#FABIYAH_MOMO .

#নোটবার্তা : খুবই দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, শেষ পর্বটা অতিমাত্রায় বড় হয়ে গেছে। এই বড় হবার ফলে ‘ তোকে ঘিরে ‘ উপন্যাসেও শেষ পর্বটা সমস্যা করতো। আমি বাধ্য হয়ে আমার বিশাল পর্বটার প্রথম অংশ তুলে দিচ্ছি। বাকিটুকু আগামীকাল পেয়ে যাবেন। ফেসবুকের এমন লিমিটেড শব্দের জন্য আমি বড় লিখেও শান্তি পাই না। দুঃখিত। 💔

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here