#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ .
#পর্বসংখ্যা_০৫.
#ফাবিয়াহ্_মমো .
অংশস্বরূপ ০১.
দৌঁড়াতে-দৌঁড়াতে রুমে এলো সুরাইয়া। বুকের হৃৎপিন্ড যেনো ধ্বক-ধ্বক করে কাঁপছে। মুখ হা করে নিশ্বাস নিচ্ছে। হাঁপাতে-হাঁপাতে দরজার কাছে থামতেই উৎকন্ঠার সাথে ডাকলো,
– সাবা বুবু? ও বুবু, জলদি উঠো! তাড়াতাড়ি উঠো!
কন্ঠের ব্যগ্রতা শুনে চোখ খুললো সাবা। মাত্র শুয়েছিলো সে, দরজার দিকে তাকাতেই ধড়ফড় করে উঠে বসলো। সুরাইয়া চটপট হাতে দরজা লাগিয়ে বিছানার দিকে ছুটে আসলো। নিশ্বাস নিতে-নিতে কপালের ঘাম মুছে চন্ঞ্চল গলায় বললো,
– জানো কি হয়েছে? বড়মাকে ফোন দিয়েছে। বড়মার সাথে কথা বলছে। আমি হারিকেন দিতে গিয়ে সব শুনে ফেলেছি।
সুরাইয়ার ফড়ফড়ানি অবস্থা দেখে প্রচুর কৌতুহল হচ্ছে সাবা। আসল কথাটা শোনার জন্য ব্যকুল হচ্ছে সে। সুরাইয়াকে তাগাদা দিয়ে বেচইন সুরে বলে,
– বল, তাড়াতাড়ি বল। কি শুনলি? আরে গাধী! তোর হাঁপানি থামা। তাড়াতাড়ি বল! এমনেই কথাটা শোনার জন্য তর সইছে না। জলদি বল।
বড় একটা ঢোক গিলে নিজেকে শান্ত করলো সুরাইয়া। শুষ্ক ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে নিচু স্বরে বললো,
– ভাইয়া আসছে বুবু, উনি নাকি শীঘ্রই আসছে। আমিযে কতো খুশি হয়েছি, কি পরিমাণ আনন্দ লাগছে! আমি শুধু এদিনটার অপেক্ষায় ছিলাম বুবু। মেহনূর যে কতো বাড় বেড়েছে, সেটা এখন ক্যাচ ক্যাচ করে ভাইয়া কেটে দিবে। নিচে হারিকেন দিতে গেছিলাম। বড়মা দেখি চোরের মতো কথা বলছে। খটকা লাগতেই পুরো ঘটনা শুনে ফেলেছি। ভাইয়া হয়তো ভরণপোষণের জন্য টাকা সেধেছিলো, বড়মা নেয়নি। আর জানো, ওই এমপির কলটা ভাইয়াই করিয়েছে। এবার বুঝো এই ভদ্রলোক কি ভয়ংকর! দূর থেকেই চেয়ারম্যানকে আচ্ছা মতো প্যাঁদিয়েছে। আমিতো শুনেই অবাক! ভিড়মি খেয়ে না-পারতে তোমার কাছে ছুটে আসলাম।
মুখে হাত চাপলো সাবা। হা হয়ে সুরাইয়ার দিকে তাকাতেই সুরাইয়া ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে মাথা নাড়াতে লাগলো। সাবার দিকে আরেকটু এগিয়ে নিচু স্বরে বললো,
– একদিকে যেমন আনন্দ হচ্ছে, অন্যদিকে তেমন চিন্তা হচ্ছে সাবা বুবু। ভাইয়া খুব ঠান্ডা মাথার মানুষ। উনি যেভাবে সবকিছু দেখাশোনা করছেন, সবার প্রতি খেয়াল রাখছেন, মেহনূর কি ওটা নিতে পারবে? তোমার কি মনেহয় মেহনূর জেদটা ছেড়ে দিবে?
কথাটা শুনে ঠোঁট ভিজালো সাবা। অন্যমনষ্ক দৃষ্টিতে ভাবনার রাজ্যে ডুবে গেলো। কথাটা ভুল বলেনি সুরাইয়া। একপার্শ্বিক দৃষ্টিতে চিন্তা করলে মেহনূরকে সঠিক মনে হবে। নিজের আত্মগরিমায় দাগ লাগলে কোনো মেয়ে চুপ রইবে না। হয় নিজের আত্মসম্মান ক্ষুণ্ণ করে দিনের-পর-দিন স্বামীর ঘর করবে, নয়তো সবকিছু ছেড়েছুড়ে নিজের জন্য আগাবে। মেহনূর সবসময় শান্তসুলভ থাকতো। মানুষও খোঁচাতে দেরি করতো না। কিন্তু ধৈর্য্যের শেষ সীমাটা যখন অতিমাত্রায় পেরিয়ে যায়, তখন মানুষের আত্মকেন্দ্রী চেতনা কখন তেজীভাবে রুখে, সে নিজেও জানে না। ভাইয়া সেদিন কি কারণে কথাগুলো বলেছেন, সেটার একমাত্র উত্তর উনিই দিতে পারবেন। কেনো এতোদিন যাবৎ গা ঢাকা দিয়ে থাকছেন, হালাল ভাবে স্বামী-স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও কেনো তিনি দূরত্ব রেখে চলছেন, কেনো আড়ালে থেকে সবকিছু দেখাশোনা করছেন, তাও আবার দুটো বছর ইচ্ছাপূর্বক যোগাযোগ চ্ছিন্ন রেখেছেন, সবকিছুর যুক্তিপূর্ণ উত্তর আছে। মাহতিম ভাইয়া অকারণে কোনো ভুলভাল কাজ করবে না, অন্তত এ ব্যাপারে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল। অন্য চেতনায় নিবিষ্ট ছিলো সাবা। হঠাৎ সুরাইয়ার উদ্দেশ্যে শক্তভাবে জবাব দিলো,
– ঠান্ডা মাথার মানুষ ঠান্ডা ভাবেই সামলাবে। মূর্খের মতো জবরদস্তি করবে না। মেহনূরকে উনি বুঝে বলেই চুপ মেরে আছেন। একবার আসুক। সবটা জানতে পারবি। আরেকটু ধৈর্য্য ধর্। পুরো ঘটনা না জেনে মতামত ছোঁড়াটা বোকামি হবে। শিক্ষিত হয়েও মূর্খের মতো লাফালাফি করাটা চলবে না।
কথাটার ভেতর কি ছিলো, সুরাইয়া জানে না। কিন্তু সাবার চোখদুটোতে অদ্ভুত তেজ ঝিকমিক করছিলো। যেনো সাবার ভেতরকার সত্ত্বা কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছে। আগ বাড়িয়ে মাহতিমের ব্যাপারে কথা বলতে নারাজ। শানাজের পর সবচেয়ে যুক্তিবাদী চেতনা রাখে সাবা। মাঝে-মাঝে উড়নচণ্ডী আচরণ দেখালেও কিছু ক্ষেত্রে প্রচণ্ড শক্ত ব্যবহার করে। শানাজের কাছে সকল সমস্যার সমাধান মেলতো। সব বোনের মধ্যে প্রীতিপূর্ণ আচরণটা শানাজের জন্য বজায় থাকতো। কিন্তু আজ সেই আচরণ সাবা পালন করে। সাবা আগের চেয়ে কিছুটা রোখা হয়েছে। নিস্তব্ধ রুমটার ভেতর জোরে নিশ্বাস ফেললো সাবা। শব্দটা রুমের দেয়ালে-দেয়ালে ছড়িয়ে গেলো। সাবাকে নিঃশ্চুপ দেখে কোমল হলো সুরাইয়া। কন্ঠস্বর নিচু করে প্রসন্ন গলা বললো,
– তুমি ওই ছেলেটাকে ফিরিয়ে দিয়েছো?
চট করে চোখে চোখ ফেললো সাবা। তীর্যক চাহনিতে কাঠ-কাঠ ভঙ্গিতে বললো,
– কেন? ওই ব্যাপারে প্রশ্ন করছিস কেন? জেনে কি করবি?
লাগাতার প্রশ্নের মুখোমুখি হতেই মিনমিন করলো সুরাইয়া। অপ্রস্তুত একটা হাসি দিয়ে আমতা-আমতা সুরে বললো,
– মানে বুবু, তুমি একটু শান্ত হও। আমার কথা না শুনে ক্ষেপতে যেও না। আসলে, ওই ছেলেটা আমার সাথে দেখা করেছে। ও তোমার কাছে মাফ চেয়েছে বুবু। বলেছে, চেয়ারম্যানের ব্যাপারটার জন্য সে খুব লজ্জিত। তুমি যদি তার সাথে কথা বলে মিটমাট করে নাও, তাহলে —
ভয়ে-ভয়ে থেমে গেলো সুরাইয়া। বাকি কথাটা কোনোভাবেই শেষ করতে পারলো না। সাবার রুক্ষমূর্তির চেহারা দেখে বহুকষ্টে ঢোক গিললো। ভীতবিহ্বল চোখদুটো বিছানায় এঁটে বললো,
– পরশু তো বিদায় অনুষ্ঠান। কলেজের কাজে ব্যস্ত থাকবে। এজন্য কাল তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছে। ঝাউতলার মোড়ে সকাল এগা —
পুরো রুমটার ভেতর ঠাস করে শব্দ হলো। কয়েক ন্যানো সেকেন্ডের জন্য হারিকেনটা কেঁপে উঠলো। এরপর সবকিছু থম লাগানো অবস্থা। ক্রোধের আক্রোশে চড় লাগিয়েছে সাবা। এরকম আগ বাড়ানো স্বভাব তার কষ্মিনকালেও সহ্য না। সুরাইয়া বাঁগাল ধরে চোখ নিচু করেছে, এখনই আকস্মিক বর্ষণের স্বীকার হবে সে। সুরাইয়ার নতমুখ দেখে শক্ত চোখে তাকালো, কর্কশ কন্ঠে চিবিয়ে-চিবিয়ে বললো সাবা,
– আমি ওর সাথে দেখা করবো না। তোকে শেষবারের মতো শা:ষিয়ে দিচ্ছি, ওই ছেলের সামনে তুই যাবি না। তোকে দ্বিতীয়বার বিরক্ত করলে মেহনূরের মতো স্যান্ডেল খুলে মা:রবি। কথাগুলো মনে রাখিস।
.
কলেজের মাটিতে আজ শেষ দিন। দুটো বছরের সময়সীমা আজ ইতি টানতে চলেছে। জীবনের দ্বিতীয় স্তরটা দেখতে-দেখতে শেষের দিকে। অবলীলায় কতোগুলো বছর হারিয়ে দিলো। শৈশবের দিনগুলো এখন সজীব পাতার মতো লাগে। ইচ্ছে হয়, সেই ছোট্টবেলায় ফিরে যাই। সেই অবুঝপনার দিনগুলোতে আবার ডুব দেই। সবাইকে নিয়ে আনন্দ কল্লোলে আবার মেতে উঠি। পরিবারের কাছে ছোট্ট বাচ্চাটি হয়ে যাই। আবারও সেই পুরোনো দিনের মতো আদরে-আদরে বেড়ে উঠি। মায়ের কাছে বকা, বাবার কাছে আদর, বোনের কাছে খুনশুটি, বড়দের কাছে ভালোবাসা নিয়ে আবার বড় হই। কিন্তু হায়! সে কি হয়? চলে যাওয়া সময়গুলো কখনো ফিরে আসে? কলেজের শেষ ক্লাসটি করে মাঠে বসেছে মেহনূর। মাঠের জমিনটা সবুজ ঘাসে ঘেরা। ডান হাতে ঘাসগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছে মেহনূর। খোঁচা-খোঁচা ঘাসগুলো হাতের তেলোয় সুড়সুড়ি অনুভূতি জাগিয়ে দিচ্ছে। নাকে আসছে বেলী ফুলের সুগন্ধ। গা শীতল করে ঠান্ডা হাওয়া ছুটছে, উড়িয়ে দিচ্ছে কানের এলোমেলো চুল। ঘাসের দিকে নরম দৃষ্টি ছুঁড়ে স্মৃতি বুনছে সে। ডানহাতের নিচে সুড়সুড়ি কাতর অনুভূতিটা মাহতিমের মতো লাগছে। পাগল লোকটা সবসময় শেভ্ করতো। দুগালে কখনো দাড়ি রাখেনি সে। ফিল্ডের নিয়ম মানতে গিয়ে গালদুটো ক্লিন শেভ রেখেছে। ঘুমন্ত মাহতিমের গালটা যখন কোমল হাতে ছুঁতো, তখন প্রাণচাঞ্চল্য অনুভূতিটা আষ্টেপৃষ্টে ছড়িয়ে যেতো। মুখে ফুটে উঠতো একচিলতে হাসি। মনের আনাচে-কানাচে লেগে যেতো এক টুকরো সুখ। প্রথম স্পর্শ, প্রথম অনুভূতি, প্রথম পুরুষ, প্রথম ভালো লাগা, প্রথম আনন্দ, প্রথম শান্তি সবকিছুই সেই লোকটা দখলিস্বত্ব করেছে। এতোদূরে এসে থাকছে, তবুও ক্ষণেক্ষণে মনের ভেতর উত্তাল চালিয়ে যাচ্ছে। আজ দূরত্বের পাল্লাটা ভারি, খুব ভারি। বিষাক্ত স্মৃতিগুলো বাটখারার কাজ করছে। ক্রমে-ক্রমে দূরত্বের পাল্লাটা আরো ভারি করছে। কিন্তু দিনশেষে মনের উপর বাটখারার দাগ লাগেনি, স্মৃতিগুলো পদদলিত হয়নি। আকাশটা কখন মেঘে ঢাকা পরেছে, খেয়াল করেনি মেহনূর। নিজের অতীত নিয়ে এতোটাই বিভোর ছিলো যে, প্রকৃতির চেহারা দেখতে পায়নি। টুপটুপ করে ফোঁটায়-ফোঁটায় বৃষ্টি পরছে। হাতের উপর গোলাকার বিন্দুটা পরতেই সংবিৎ ফিরে পেলো। বাতাসের শোঁ শোঁ ধ্বনি যেনো খিলখিল সুরে হাসছে। চন্ঞ্চল কিশোরীর ন্যায় বৃষ্টির উল্লাসে মেতে উঠেছে। ঝপ করে মেদিনী ভিজিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো। ঘাসের চেহারা বদলে গিয়ে দারুণ রূপ ধরলো। কিছুক্ষণের ভেতর পুরোপুরি ভিজে গেলো মেহনূর। বৃষ্টি দেখে একটুও উঠলো না সে। দুচোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ তুললো। বৃষ্টির অজস্র ফোঁটা সারা মুখ ছুঁয়ে ঝরছে। বুক ফুলিয়ে গভীর নিশ্বাস নিলো মেহনূর। মনের কোণে শীতল অনুভূতি আবদ্ধ করতেই আনমনে বলে উঠলো,
– যেই বৃষ্টি ছুঁয়ে একদিন আপনাকে চেয়েছিলাম, সেই বৃষ্টি আবারও আমাকে ভিখিরি বানিয়ে দিচ্ছে। আপনার জন্য প্রাণপণে আবদার করেছিলাম, আজ ফরিয়াদ করার জন্য মন ব্যকুল হচ্ছে। যদি এই বৃষ্টির মতো হুট করে চলে আসতেন, ঠিক এভাবেই না-জানিয়ে হাজির হতেন! জানি আর্জিগুলো কবুল হবে না।
বৃষ্টির মিঠাস্বাদের সাথে নোনা অশ্রুগুলো ঝরে গেলো। গাল বেয়ে, দুচোখের কোণা ছেড়ে ঘাসের উপর পরলো। আকাশ থেকে মুখ নামিয়ে ব্যাগটা কাধে তুললো মেহনূর। ভিজতে-ভিজতে মাঠ পেরিয়ে গেটের বাইরে চলে গেলো। আগামীকাল বিদায় অনুষ্ঠান। বোর্ড পরীক্ষার জন্য মাত্র দুই মাস বাকি। কলেজ কর্তৃপক্ষ ছোটখাট আয়োজনের জন্য অনুষ্ঠান রেখেছে। সেই উপলক্ষ্যে কলেজ জুড়ে উৎসবের ছোঁয়া লেগেছে। অনুষ্ঠান নিয়ে প্রচুর এক্সাইটেড সুরাইয়া। সকালের বৃষ্টি থামতেই শেফালির কাছে শাড়ির জন্য গেলো। শেফালি তখন মাহমুদার জন্য বনাজি ঔষুধ বানাচ্ছে। সুজলা পাশ থেকে ঔষুধের রস নিংড়ে চলছেন। সুরাইয়া কাছে আসতেই হাঁটু গোঁজ করে বসলো, মায়ের উদ্দেশ্যে মিনতি স্বরে বলল,
– আম্মা, কালকের জন্য একটা শাড়ি দিবা? সবাই সুন্দর শাড়ি পরে যাবে। আমার একটা সুন্দর শাড়ি দরকার। ও বড়মা? আপনি আমাদের শাড়ি পছন্দ করে দেন। কি রঙের শাড়ি পরবো বুঝতে পারছিনা।
সুজলা দুহাতে রস নিংড়ে বললেন,
– তাহলে তোর মায়ের কাছে প্যানাচ্ছিস কেন? আমার ঘর চিনিস না? চল, ঘরে চল। দাঁড়া, হাত ধুয়ে নেই।
পাশে থাকা বালতিতে হাত ধুলেন সুজলা। বসা থেকে উঠতে-উঠতে আঁচলে হাত মুছলেন। সুরাইয়াকে নিয়ে ঘরে চলে গেলে বাকি দুজনকে ডেকে পাঠালেন। সাবা ও মেহনূর বড়মার ঘরে আসতেই বিছানাভর্তি শাড়ির বাহার দেখলো। বেনারসি, জামদানি, তাঁত, সুতি, সিল্ক, কাতান সব ধরনের শাড়িতে বিছানা ভরা। সাবা শাড়ির অবস্থা দেখে কৌতুহলে বললো,
– আম্মা, শাড়ি ছড়িয়ে বসে আছো কেন? শাড়ি বিতরণ চলছে নাকি?
সাবার প্রশ্ন শুনে একগাল হাসলেন সুজলা। দুজনকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন। সাবা ও মেহনূর কাছে আসতেই বিগলিত সুরে বললেন,
– কাল যে অনুষ্ঠান, তোরা গা:ধার দল একটাবারও বলেছিস? সবাই সেজেগুজে যাবে। আর এই বাড়ির ফকিন্নিগুলো গিন্নি সেজে বেরুবে। সাবা? এদিকে আয়। এ্যাই মেহনূর? তোকে কি নেমতন্ন পাঠিয়ে আসতে বলবো? দুটোই সুরাইয়ার পাশে বস্।
বড়মার আদেশটা চুপচাপ পালন করলো। দুবোন একসাথে বিছানায় বসে পরলো। সুজলা হাতড়ে-হাতড়ে দুটো শাড়ি বের করলেন। সাবা ও সুরাইয়ার সামনে রেখে স্বচ্ছল গলায় বললেন,
– এই তাঁতের শাড়িটা সাবা পরবি। তোর গায়ের সাথে খয়েরী রঙটা মানাবে। সুরাইয়া? সুতির শাড়িটা তুই পরবি। শোন, মন খারাপ করবি না। তুই সাবার মতো গরম সহ্য করতে পারিস না। এজন্য তোকে হালকা গোলাপী রঙের কাপড় দিলাম। সকালে বাগান থেকে তিনটা গোলাপ ফুল ছিঁড়ে আনবি। আমি খোঁপায় বেঁধে দেবো। এটার সাথে সাদা ব্লাউজ পরবি না। গরমের জন্য সাদা রঙ বিশ্রী লাগবে। তোর গোলাপী ব্লাউজ আছে না? ওটাই পরিস।
খুব সুক্ষ্মভাবে দুজনকে বুঝিয়ে দিলেন সুজলা। ঠিক মায়ের মতো সবকিছু বাতলে দিলেন তিনি। শাড়ির এমন চমৎকার পছন্দ দেখে দুজনই প্রসন্ন হাসি দিলো। সুরাইয়া খুশিতে গদগদ বিহ্বল সুরে বললো,
– অনেক সুন্দর হয়েছে বড়মা। আমি মনে-মনে এমন রঙটাই চাচ্ছিলাম। আমি কাল সকাল-সকাল বড় দেখে ফুল তুলে আনবো। আমাকে সুন্দর করে বেঁধে দিবেন। ও বড়মা? আমি কিন্তু কাজল দিতে পারি না। আমাকে একটু গাঢ় করে কাজল লাগিয়ে দিবেন।
সাজগোজের আলাপ বাড়তেই সাবার খটকা লাগলো। আম্মা যে মেহনূরের জন্য শাড়ি দিলো না। সে কি ব্যাপারটা ভুলে গেলো নাকি? মনে পরতেই মায়ের উদ্দেশ্যে ফট করে বললো,
– মেহনূরের শাড়ি কই? ওর শাড়ি যে দিলে না। ও কাল কি পরবে?
প্রশ্নটা নেহাত সুজলার জন্য ছিলো। কিন্তু সেটা বিফল করে মেহনূর জবাব দিলো,
– আমি কোনো শাড়ি পরবো না বুবু। তোমাদের সাথে আমাকে জড়িও না।
এমন রসশূন্য কথা শুনে ভ্রু কুঁচকালেন সুজলা। চড়ের জন্য হাত উঠিয়ে কপট রাগে বললেন,
– একটা মা:রবো! তুই কি আলাদা নাকি? ওরা শাড়ি পরবে মানে তুইও পরবি, সোজা হিসাব। আয় আমার সঙ্গে। তোর শাড়ি আমি দেখাচ্ছি। উঠ্ এখন।
অগত্যা বসা থেকে উঠে গেলো মেহনূর। বড়মার পিছু-পিছু আলমারির কাছে গেলো। বাকি দুজন নিজেদের শাড়ি পেয়ে চুপচাপ সটকে পরলো। সুজলা আলমারির দ্বিতীয় দ্বার খুললেন, ভেতর থেকে একটান দিয়ে শপিংব্যাগ আনলেন। মেহনূরের সামনে ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করলেন। মেহনূর সেটা দেখে সমান্তরাল কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালো। সন্দিহান দৃষ্টিতে বড়মার দিকে তাকাতেই সুজলা একটি শাড়ি মেলে ধরলেন। জামদানি কাপড়ের গাঢ় নীল শাড়ি। নিচের একপ্রস্থ পাড়টা কুচকুচে কালো। পুরো শাড়িটার উপর কালো সুতার বুনন। মেহনূর হঠাৎ অস্থির অনুভব করলো। রঙটা খুব পরিচিত, খুব বেশি ঘনিষ্ঠ। ওই রঙটার কাছে মন বারবার হেরে যায়, খুব অদ্ভুত কারণে আসক্ত হয়। ঠোঁট নিঃসৃত হয়ে শুধু একটাই শব্দ বেরুয় ‘ নেভি ‘। শাড়িটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই সুজলা সেটা এগিয়ে দিলেন। মেহনূরের ডানহাত টেনে শাড়িটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
– এটাই পরিস। তোকে খুব সুন্দর লাগবে। ভেতরে ব্লাউজ-পেডিকোট সব মাপমতোন আছে। কাল সুন্দর করে পরিস।
কিচ্ছু বলতে পারলো না মেহনূর। কিচ্ছু বলতে পারলো না। শাড়িটা হাতে নিয়ে নির্বাক হয়ে গেছে। প্রত্যুত্তরে কি বলা দরকার, সেই হুঁশ নেই। কোনো কথা না বলে রোবটের মতো বেরিয়ে গেলো। খালি দরজার দিকে দৃষ্টি ফেলে মুচকি হাসলেন সুজলা। বহুদিন পর কারোর সুপ্ত ইচ্ছাটা পূরণ করলেন তিনি।
শাড়ি হাতে নিজের রুমে ফিরলো মেহনূর। দুহাত নামিয়ে শাড়িটা বিছানার উপর রাখলো। সকালের ঝিরঝিরে হাওয়াটা এখনো শীতল। সেই হাওয়াটা রুম ছাপিয়ে দাবড়াচ্ছে। জানালার পর্দা উড়াচ্ছে, মেহনূরের চুল উড়াচ্ছে, আরো উড়াচ্ছে টেবিলের কাগজ। পড়ন্ত বিকেলের শান্তমূর্তির চেহারা দিগ্বিদিক ছাপিয়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে কিছু হবে। উচাটন মন কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না, কেমন যেনো হচ্ছে। এ অনুভূতি কি ভয়ের না অভয়ের বুঝতে পারছেনা মেহনূর। দৃষ্টিটা উদভ্রান্তের মতো দিশেহারা হতেই অস্থির অনুভব করছে। কানে আসছে কাগজ উড়ার শব্দ। কোনো শব্দই আজ স্বাভাবিক লাগছে না। শব্দের খোঁজে ডানে তাকাতেই টেবিলের খাতাটা দেখতে পেলো। তখনই অন্যদিক থেকে ফোন বিপ্ করে উঠলো। ম্যাসেজের টিউনটা তোয়াক্কা করলো না মেহনূর। টেবিলের দিকে ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো। মুখের উপর একগুচ্ছ চুল ঝাপটা খেতেই উড়ন্ত পেজে চোখ পরলো। তৎক্ষণাৎ বুকটার মধ্যে ধ্বক করে লাগলো! কেউ যেনো সজোরে করাঘাত মারলো! অবিরাম নিশ্বাস নিতে-নিতে খাতার শেষভাগে তাকালো মেহনূর। সেই Ans থেকে Ansari লেখাটায় থমকে গেলো সে। বাতাসের উচ্ছ্বাসময় অবস্থা এখনো পেজটা উড়াচ্ছে। ফোনের দিকে একটুও ধ্যান গেলো না ওর। খাতাটা বন্ধের জন্য লেগে পরলে ফোনের ব্যাপারে ভুলেই গেলো। মেহনূর জানতেও পারলো না ফোনটার কাহিনি। ধরতেও পারলো না, কেনো ফোনটা বিপ্ হলো। নোটিফিকেশনের পর্দায় ছোট্ট ম্যাসেজটা দেখতে পেলো না সে। সাইড ব্যাগের ভেতরে এখনো স্ক্রিনটা জ্বলে আছে। স্ক্রিনের উপর ভেসে আছে গানের গোটা-গোটা শব্দ,
‘ আমি জানি কোনো একদিন,
কোনো এক নতুন ভোরে।
দেখা হবে আমাদের আবার,
এক স্বপ্নের শহরে। ‘
চলমান .
#FABIYAH_MOMO .