#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার
#রাহনুমা_রাহা
#অন্তিম_পর্ব
পায়েল যখন তপা কে নিয়ে নিজ আলোয়ে পৌঁছাল তখন ঘড়ির কাঁটা বারটা ছুঁই ছুঁই। সূর্যের তেজ ভূলোক কে ঝলসে দিতে ব্যস্ত। শরতের স্বচ্ছ নীল আকাশ কে ফুঁড়ো করে তেজস্বী সূর্য নিজের উত্তাপ ছড়িয়ে চলেছে সর্বত্র। তপা ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেছে। অস্থির অস্থির শরীরে টালমাটাল পায়ে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল।
পায়েল তপাকে দু’হাতে আগলে নমনীয় গলায় বললেন,
“খারাপ লাগছে মা?”
তপা মৃদু হেসে বলল,
“একটু অস্থির লাগছে আন্টি। অনেক দিন পর বাইরে বেরিয়েছি তো। এতক্ষণ একসঙ্গে হাঁটিনি অনেক দিন। সেজন্যই হয়তো। একটু বসতে হবে আন্টি।”
পায়েল বাকি পথটুকু ধরে ধরেই নিয়ে গেল। তপা সোফায় বসে চেয়ে রইল ঘরটার আনাচে কানাচে। এইতো তার সংসার। তার পরিবার। আনন্দে চোখ বন্ধ করে স্বস্তির স্বাস ছাড়ল সে।
কিয়ৎকাল পর ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন রায়হান তাজওয়ার। পায়েল ডেকে এনেছেন তাকে। তপা কে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন পায়েলের দিকে। পায়েল মৃদু স্বরে বলল,
“ঠিক আছো তুমি? বুকে ব্যথা আছে?”
রায়হান তাজওয়ার চোখ ছোট ছোট করে তাকালেন।৷ বললেন,
“ঠিক আছি। কি হয়েছে বলো তো?”
পায়েল আবারও বললেন,
“ধাক্কা সহ্য করার ক্ষমতা আছে তো?”
রায়হান তাজওয়ার মৃদু স্বরে বললেন,
“পলকের বউ?”
পায়েল দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তপা চমকে তাকাল। রায়হান তাজওয়ার মুচকি হেসে তপা কে কাছে ডাকলেন। তপা উঠে গিয়ে সামনে দাঁড়াল। পায়ে হাত দিয়ে সালাম করার জন্য সামান্য নিচু হতেই তপা কে থামিয়ে দিলেন তিনি। মৃদুস্বরে বললেন,
“এ অবস্থায় নিচু হতে নেই মা। আর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করাটা তো ইসলাম বিরোধী। তাই এগুলোর প্রয়োজন নেই। আমি এমনিতেই প্রাণ ভরে তোমাকে দোয়া করে দিচ্ছি।”
কিছুক্ষণ থেমে পুনরায় বললেন,
“বজ্জাতটা কোথায়? কোথা থেকে ধরে আনলে মেয়েটাকে?”
পায়েল সবটা বললেন। রায়হান তাজওয়ার ভাবুক হলেন। অতঃপর বললেন,
“ভুল যেহেতু করেই ফেলেছে কিছু তো আর করার নেই। ডাকো তাকে। তাড়াতাড়ি ফিরতে বলো অফিস থেকে।”
পায়েল তাজওয়ার কঠিন গলায় বললেন,
“এত সহজে? ওকে তো শাস্তি পেতেই হবে। আগে তিয়াশা কে খুঁজে খুঁজে অস্থির হোক। তবেই না বুঝবে স্ত্রী সন্তানের মূল্য। দিনকে দিন সন্তান ছাড়া থাকতে কেমন লাগে বুঝুক।তারপর সব কথা, আলোচনা।”
তপা অপরাধী চোখে তাকাল। দিনের পর দিন পলকের বাড়ি না ফেরার দায় নিজের ঘাড়ে টেনে নিল। মাথা নিচু করে ফেলল সে।
পায়েল তাজওয়ার তপার অপরাধী মুখটা পর্যবেক্ষণ করে বললেন,
“তুুমি কি কোনো ভাবে পলকের বাড়ি না ফেরার ব্যাপারটা নিয়ে নিজেকে দোষ দিচ্ছো? ভুলেও দিও না। তুমি ওর জীবনে আসার বহুকাল আগে থেকেই ও এমন।”
তপা মলিন কণ্ঠে বলল,
“আমার দোষ তবুও কিছু কম নয় আন্টি।”
পায়েল তাজওয়ার ফুঁসে ওঠে বললেন,
“আন্টি কিসের? আমার ছেলেকে বিয়ে করে এ বংশের দু’দুখানা বাতি আনতে চলেছো। এখনো আন্টি বললে আমি মানব কেন? মা বলো।”
রায়হান তাজওয়ার ফোঁড়ন কেটে বললেন,
“আমাকেও বাবা বলো। ছেলে তো আমারও।”
তপা অবাক হয়ে তাকাল। এই মানুষগুলো এত ভালো কেন? এদের অবদানেই পলক এত মার্জিত চরিত্রের অধিকারী। হঠাৎ পলকের কথা মনে হতেই মনটা আনচান করতে শুরু করল। পলক নিশ্চয়ই ফোন করে করে অস্থির হয়ে উঠছে। ভুলে ফোনটা টেবিলের উপর ফেলে এসেছে তপা।
“মা, আপনার ছেলেকে একবার ফোন করে দেখুন না সে কোথায়।”
পায়েল তাজওয়ার তপার মিনমিনে কণ্ঠ শুনে হেসে বললেন,
“এখন তো অফিসেই থাকবে। এ সময় ও অফিসে থাকে না?”
“অফিসেই থাকে। কিন্তু এতক্ষণে নিশ্চয়ই আমার খোঁজ নেওয়ার জন্য ফোন দিয়েছে। আমি তো ফোন ভুলে ফেলে এসেছি ফ্ল্যাটেই। ফোনে না পেলে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াবে। একটু কল দিন না মা।”
পায়েল মাথা দুলিয়ে চলে গেলেন ফোন আনতে।
পলক অফিসে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর থেকেই লাগাতার কল দিচ্ছে তপা কে। প্রথমে ভেবেছে হয়তো শুনতে পায় নি বা ওয়াশরুমে গেছে। কিন্তু আধঘন্টায়ও যখন পেল না তখন কপালে চিন্তার ভাজ পড়ল। হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো অফিস থেকে। ফ্ল্যাটে এসে বাইরে থেকে তালাবদ্ধ পেয়ে কপালের ভাজ আরও বেড়ে গেল। সেই সাথে যোগ হলো বুকের ভেতরের ধুকবুকানি। হারিয়ে ফেলার ভয়। দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে তপার ফোনের দেখা মিলল বিছানার উপর।
একে একে সিজান, প্রান্ত, পৃথা, আয়েশা, মোর্শেদুল হক সবাই কে কল দিল। কিন্তু আশানুরূপ কোনো তথ্যই পেল না। বেরিয়ে এলো ফ্ল্যাট ছেড়ে। এলোমেলো পায়ে, সতর্ক চোখে খুঁজতে লাগলো এদিক ওদিক। ভার্সিটিতে খোঁজ নিতেও ভুলল না। কিন্তু না, কোথাও নেই সে।
বেলা তখন দু’টোর ঘর পেরিয়ে গেছে। তপাকে খুঁজে না পেয়ে পাগল পাগল অবস্থা পলকের। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। ভাবল হয়তো তপার ফোন। কিন্তু মায়ের নাম্বার দেখে শেষ আশা টুকুনও মাঠে মারা গেল।
মায়ের ফোন পেয়ে ছোট বেলার মত আহ্লাদী হয়ে উঠল মন। ফোনটা ধরেই ডুকরে কেঁদে উঠল পলক।
ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,
“মা আমি হারিয়ে ফেলেছি ওকে। হারিয়ে ফেলেছি ওদের। সব হারিয়ে গেছে মা। আমার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে । আমি বোধহয় মরে যাচ্ছি মা। ওদের ফিরে আসতে বলো না মা।”
পায়েল তাজওয়ার থমকে গেলেন ছেলের এহেন কণ্ঠ শুনে। বললেন,
“পলক কোথায় তুমি? বাড়ি এসো এক্ষুনি।”
পলক কিছু বলল না। বলার মত কোনো কথাই খুঁজে পাচ্ছে না সে। তার কৃষ্ণময়ী হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তার সত্তাটাও হারিয়ে যাচ্ছে নিজের থেকে।
পায়েল পুনরায় বললেন,
“বাড়ি ফিরে আয় না বাবা। তোর হারিয়ে যাওয়া সম্পদ আমি ফিরিয়ে দেব। সযত্নে রেখেছি আমি। কোনো ক্ষতি হবে না। তুই একবার বাড়ি আয়।”
পলক কি বুঝল জানে না। হয়তো মায়ের কথা ধরতেই পারল না সে। মন, মস্তিষ্ক কিছুই তো কাজ করছে না তার।
অবাধ্য গলায় বলল,
“আমি যাব না। কোথাও যাব না। আমার কৃষ্ণময়ী না এলে আমি একচুলও নড়ব না। তুমি পারবে না আমার কৃষ্ণময়ীকে এনে দিতে। পারবে না। আমি যাব না। কিছুতেই না।”
পায়েল দিশেহারা বোধ করলেন। তার অত শক্ত পোক্ত মনের ছেলের এই পরিণতি দেখে চোখ উপচে জল গড়াচ্ছে তার।
কঠিন গলায় বললেন,
“পাঁচ মিনিটের মধ্যে বাড়ি আসবে তুমি। তবেই কৃষ্ণময়ীকে পাবে। নয়তো আমি ওকে ছুঁতেও দেব না। মনে থাকে যেন।পাঁচ মিনিট। সময় কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। দেবদাস সেজে রাস্তায় রাস্তায় না ঘুরে বেরিয়ে বাড়ি এসো।”
পলক বিশ্বাস করতে পারল না। তার মা তো কৃষ্ণময়ীকে চেনে না। তবে কি করে ফিরিয়ে দেবে? শান্তনা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারবে না জানে সে। তবুও অদৃশ্য টানে চলে এলো বাড়িতে। তবে পাঁচ মিনিট পেরিয়ে গেল বহু আগেই। আধঘন্টা লাগল তাজমহলে পৌঁছাতে।
তপা সোফায় বসে মূল ফটকের দিকে তাকিয়ে আছে ঠিক আধঘন্টা যাবত। যখন থেকে পায়েল তাজওয়ার বলেছেন পলক ফিরছে তখন থেকে। পায়েল, রায়হান দম্পতিও বসে আছেন পাশেই। অপেক্ষা করছেন তাদের আসামির। কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজা ঠেলে ভেতরে এলো পলক। এলোমেলো পোশাক, চুলগুলোও এলোমেলো অবস্থায় পড়ে আছে কপাল জুড়ে। শার্টের হাতায় মাটি লেগে আছে। প্যান্টেও আলগা মাটির স্তুপ লেগে আছে। তপা অবাক হয়ে চেয়ে দেখল তার আগাগোড়া গোছানো স্বভাবের পুরুষটিকে। এ কি অবস্থা তার! বিস্মিত নয়নে পরখ করতে করতেই পলক এলোমেলো পায়ে সামনে এসে দাঁড়াল তপার।
দরজা খুলেই সোফায় বসা তপার উপর নজর পড়ল পলকের। চিন্তিত মুখটি দরজার দিকেই তাকানো ছিল। পলক তখনও বিশ্বাস করতে পারছিল না তার কৃষ্ণময়ী এখানে সুস্থ শরীরে বসে আছে। টালমাটাল পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়াল তপার মুখোমুখি।
মিনিট খানেক দাঁড়িয়ে থেকে আচমকা পা ভেঙে বসে পড়ল তপার সামনে। মুখ গুঁজে দিল তপার কোলে। স্থান, কাল, পাত্র ভুলে ডুকরে কেঁদে উঠল। থেকে থেকে কেঁপে উঠল। তপা দিকবিদিকশুন্য হয়ে পড়ল মূহুর্তেই। কি করবে, কি করবে না বুঝতে পারল না সে। অসহায় চোখে এদিক ওদিক তাকাল। সামনে শ্বশুর শ্বাশুড়ি কে বসে থাকতে দেখে অস্বস্তি তাকে ঘিরে ধরল। হাতটা পলকের মাথায় নিতে চেয়েও নিতে পারছে না সে। তীব্র যন্ত্রণায় হাস ফাঁস করতে শুরু করল।
পায়েল তাজওয়ার তপার অবস্থা বুঝতে পেরে স্বামীর দিকে তাকিয়ে ইশারায় চলে যাওয়ার জন্য বললেন। এক মূহুর্ত ব্যয় না করে চলে গেলেন দু’জনেই।
তপা দু’হাতে ঠেলেও পলকের মুখ তুলতে পারল না। সে তখনও কেঁপে কেঁপে উঠছে। দিশেহারা তপা নিজেও ফুপিয়ে উঠল। মুখ নামিয়ে চেপে ধরল পলকের মাথায়। চুলের উপর দিয়েই এলোমেলো ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। আলতো হাতে বিলি কেটে দিতে লাগল।
কেটে গেল কিছু সময় এভাবেই। নিজেকে খানিকটা শান্ত করে পলক চোখ মেলে তাকাল। মাথা উঁচু করে তাকাল তপার মুখের দিকে। একহাতে মাথা টেনে মুখ বরাবর টেনে এনে গালে কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল এলোমেলো ভাবে। তপা চোখ বন্ধ করে স্বামীর করা পাগলামি উপভোগ করল।
পলক পুনরায় মুখ গুঁজে দিল। তবে এবার কোলে নয় পেটে। ঠোঁট ছুঁয়ে দিল বেশ কয়েক বার। তপা ঠেলে উঠিয়ে দিল। পাশে বসতে ইশারা করল। পলক বিনাবাক্যে বসল পাশের জায়গাটায়। আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ধরল তপা। বুকে মুখ গুঁজে বলল,
” আমি বুঝতে পারি নি। তুমি এতটা দিশেহারা হয়ে পড়বে আমি সত্যিই বুঝতে পারি নি। বুঝতে পারলে আমি আসতাম না এখানে। আমায় মাফ করো। আর এমন কিছু করব না যাতে তুমি এতটা ভেঙে পরো। এবারের মত মাফ করো।”
বলেই দু’হাতে পিঠের শার্ট আঁকড়ে ধরে ফুপিয়ে উঠল তপা।
পলক তপার মাথায় চুমু দিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
“ফোনটা নিয়ে আসতে পারতে।”
তপা কেঁপে উঠছে অনবরত। কাঁপা কাঁপা গলায়ই বলল,
“আমি সত্যিই অনুতপ্ত। বুঝতে পারি নি।”
পলক মৃদু হেসে বলল,
“তুমি এখনো আমার ভালবাসার পরিধি সম্পর্কে অবগত নও তিয়াশা। তুমি কখনোই বুঝতে পারবে না আমি তোমাকে ঠিক কতটা ভালবাসি। কোনো সীমানা নেই এই ভালবাসার। আমি নিজেও জানি না তোমাকে কেন এতটা ভালবাসি। তবুও ভালবাসি। এটা আর আমার কন্ট্রোলে নেই। বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেছে। তুমি ছাড়া আমি অচল। আর কখনো এমন বোকামি করো না কৃষ্ণময়ী। এবার হয়তো ফিরে এসেছি সুস্থ ভাবে। পরের বার হয় পাগল হয়ে ফিরব নয়তো এক্সিডেন্টে লাশ হয়ে।”
তপা পলকের মুখে হাত চেপে ধরে অসহায় গলায় বলল,
“মরে যাব আমি।”
পলক হাত সরিয়ে দিল। বলল,
“মরা এত সহজ? তোমাকে কোথাও না পেয়ে আমারও মনে হচ্ছিল আমি বোধহয় মরে যাচ্ছি। কিন্তু জানো মরণও ধরা দিচ্ছিল না। এত অসহায় আমি কখনো হই নি। বাবা হসপিটালে ছিল। তখনো না। কেন জানো?বাবা আমার কাছে ছিল। আমার বিশ্বাস ছিল বাবা সুস্থ হয়ে যাবে। আল্লাহ আমায় ফেরাবে না। কিন্তু তুমি তো আমার কাছ ছাড়াই হয়ে গেলে। তোমাকে না পেলে আমি কি করতাম কৃষ্ণময়ী? রাস্তায় রাস্তায় পাগল হয়ে ঘুরে বেড়াতাম? নিজের ভালবাসা হারানোর অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে জীবন্ত বেওয়ারিশ লাশ হয়ে ভেসে বেড়াতাম এখান থেকে ওখানে?”
তপা আর কিছু বলল না। কেবল চেয়ে চেয়ে দেখল একজন প্রেমিকের করা পাগলামি। শ্রবণ করল একজন স্বামীর বুকের গভীর হতে নিঃসৃত কিছু অতীব সত্য বুলি।
পায়েল তাজওয়ার পলকের মুখোমুখি বসে আছেন মিনিট পাঁচেক সময় নিয়ে। একটা টু শব্দও
এখন অবধি উচ্চারণ করেন নি তিনি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কেবল পরখ করছেন পলকের মুখাবয়ব। রায়হান তাজওয়ার পাশেই নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছেন। একমাত্র তপা ঘুরে ঘুরে তিনজনের মুখ পরিদর্শন করছে।
পলক মৃদু হেসে বলল,
“মা কি দেখছ এভাবে?”
পায়েল তাজওয়ার নড়েচড়ে বসলেন। বললেন,
“অন্যের সন্তান মানুষ করতে গিয়ে নিজের সন্তান মানুষ করতে পারি নি। কথাটা আজ সত্যি প্রমাণ করে দিলে তুমি।”
পলক চমকাল। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল। বলল,
“আমাকে তোমার অমানুষ মনে হচ্ছে?”
পায়েল তাজওয়ার বিনা দ্বিধায় বললেন,
“কোনো সন্দেহ নেই আমার মনে। তুমি দিনে দিনে অমানুষই তৈরী হয়েছো।”
পলক অবাক হয়ে কেবল একটা শব্দই উচ্চারণ করল,
“মা!”
পায়েল তাজওয়ার পুনরায় বললেন,
আমি ভাবতে পারছি না আমার ছেলে হয়ে তুমি এত হীন একটা কাজ করলে কি করে? আমাকে বিয়ের কথা জানালে কি আমি দ্বিমত করতাম? উল্টো খুশি হতাম। তিয়াশা কে আমারও পছন্দ ছিল। তিয়াশার বিয়ের কথা শুনে আমার আফসোস হচ্ছিল রীতিমতো। কেন এমন মিষ্টি একটা মেয়ে আমার ছেলের বউ হলো না।কিন্তু ততদিনে তুমি বলছিলে তুমি অন্য কাউকে ভালবাসো। তাই আর মাথা ঘামাই নি। কিন্তু তুমি কি করলে তাকেই বিয়ে করে লুকিয়ে রাখলে আমার থেকে?”
পলক মাথা নিচু করে ফেলল। তবে মনটা প্রসন্ন হলো এটা ভেবে যে, মা তার কৃষ্ণময়ীকে পছন্দ করে। কৃষ্ণময়ীর কোনো কষ্ট থাকবে না আর। সত্যি সত্যি একটা পরিবার হলো তার কৃষ্ণময়ীর।
তপা নিচু গলায় বলল,
“মা উনার দোষ নেই। আমিই বাড়িতে জানাতে বারণ করেছিলাম। তখন তো জানতাম না আপনার কাছে আসতে পারব। জানলে তো তখনই চলে আসতাম। উনাকে বকবেন না প্লিজ।”
পায়েল তাজওয়ার মৃদু ধমকের সুরে বললেন,
“তুমি চুপ করো। তুমি ভেবো না তোমাকে কিছু বলতে পারব না আমি। দোষ করলে দুটোরই কান মলে দেওয়ার ক্ষমতা আমার আছে। তাই চুপচাপ বসে থাকো।”
তপা মিয়িয়ে গেল। পলক চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করে বলল চুপ থাকতে।
পায়েল তাজওয়ার পুনরায় বললেন,
“এক মূহুর্ত বউকে খুঁজে না পেয়ে পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলি। কিন্তু ওই অবস্থায় মেয়েটাকে একা বাসায় রাখতে বুক কাঁপল না তোর? সিংগাপুর যাওয়ার পর তিন তিনটে মাস ও একা ছিল। ওর কি অবস্থায় কেটেছে তুই জানিস? শুধু ভালবাসলেই হয় না পলক। দায়িত্ব নিতে জানতে হয়। পালন করতে হয়। ওর খালি বাসায় একটা বিপদ হলে কি করতে পারতিস তুই? একবার আমাদের জানাতে পারতি না? আমাদের কি কোনো অধিকার নেই জানার?”
পলক এগিয়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল। মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“মা। এত রাগ করে না সোনা মা আমার। আমি জানাতে চেয়েছিলাম। যেদিন জানতে পারলাম সেদিন রাতেই বাবাকে হসপিটালে ভর্তি করতে হলো। তারপর কি করে জানাতাম ওই অবস্থায়? এবারের মত মাফ করো মা। আর হবে না।”
পায়েল তাজওয়ার চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বললেন,
“আর হবে না মানে? আবার বিয়ে করবি তুই? তিয়াশা তোমার বর কিন্তু তোমাকে ধোঁকা দিয়ে আবার বিয়ে করার পায়তারা করছে। এখনই শক্ত হাতে ধরো। একে বিশ্বাস নেই। এই ছেলেকে আমি হারে হারে চিনি।”
তপা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। পলক নির্নিমেষ চেয়ে রইল সেদিকে।
পায়েল গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
“ভুল যেহেতু করেই ফেলেছিস, শাস্তি তো পেতেই হবে। আজ থেকে বাবু আসার আগ পর্যন্ত তিয়াশা আমার সাথে থাকবে।”
পলক, তপা একসাথে চমকে উঠল। তপা কিছু না বললেও পলক ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ভুল আমি করেছি। শাস্তি দুজনকে দিচ্ছো কেন?”
পায়েল ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। পলক হেসে বলল,
“তোমার বৌমাকে জিজ্ঞেস করো তো, আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে কিনা।”
তপা মাথা নিচু করে ফেলল। পায়েল তা দেখে হেসে বলল,
“এত মিষ্টি মেয়েটা তোর মত অসভ্যর ফাঁদে পা দিল কি করে? জাদু টাদু করিস নি তো?”
পলক ঠোঁট কামড়ে হাসল।জাদুতো কৃষ্ণময়ী করেছে। নইলে তাকে ছাড়া এমন পাগল পাগল লাগে কেন?
রায়হান তাজওয়ার পায়েলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“কেমন মা হয়েছো তুমি হ্যা? ছেলে বিয়ে করে বাচ্চা হয়ে গেল তুমি টেরই পেলে না?”
পায়েল ফুঁসে উঠলেন। বললেন,
“ভুলে যেও না আমি তোমার সাথে সিংগাপুর গিয়ে পরে ছিলাম নইলে আগেই বুঝতে পারতাম।”
রায়হান তাজওয়ার বললেন,
” তুমি ভুলে যেও না আমি অসুস্থ হয়ে ছিলাম বলেই তুমি সিংগাপুর যেতে পেরেছো।”
পায়েল কটমট করে বললেন,
“তুমি ভুলে যেও না আমি সিংগাপুর এই প্রথম যাই নি। আগেও গিয়েছি।”
রায়হান হেসে বললেন,
“ভুলে যেও না আগের বারও আমার সাথেই গিয়েছো তুমি।”
বলেই পলকের দিকে তাকিয়ে ইশারায় তপা কে নিয়ে রুমে যেতে বললেন। পলক বাবার ইশারা বুঝতে পেরে হেসে ফেলল। কাল বিলম্ব না করে এক ঝটকায় তপা কে কোলে তুলে হাটা দিল রুমের পথে।
পায়েল কিছু বলার আগেই অতিদ্রুত ঘটা এই ঘটনা নজরে এলো তার। স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
“চালাকি করলে তুমি আমার সাথে?”
রায়হান তাজওয়ার অমায়িক হেসে বললেন,
“একটুখানি।”
পায়েল তাজওয়ারও হেসে ফেললেন। এইতো তার সুখী পরিবার।
পরের সময়গুলো কেটে গেল খুব দ্রুত। স্বামী শ্বশুর শাশুড়ীর যত্নের সাথে কাটিয়ে দিল বেশ কিছুদিন। তপা তাজমহলে ফেরার সপ্তাহ খানেকের মাথায় ছোটখাটো অনুষ্ঠান করে সকলকে জানিয়ে দিল তাদের বিয়ের কথা। সেই অনুষ্ঠানে সামিল হয়েছিল তপার নিকট আত্মীয়। প্রিয় থেকেও প্রিয় ভাইয়েরা।
শ্বাশুড়ি রূপী মায়ের ভালবাসায় তপার মনে হয় তপা বুঝি বাপের বাড়ি বেড়াতে এসেছে। ফ্ল্যাটটাকে ইদানীং শ্বশুর বাড়ি মনে হয়। এই সাজানো গোছানো তাজমহল কে মনে হয় বাপের বাড়ি। বিকেল টা কাটে বাগানের ফুলের সমারোহে। পলক তপার খোলাচুলের ভাজে ভাজে গুঁজে দেয় সাদা গোলাপ। সাদা কালোর মিশ্রণের মোহনীয় রূপে চোখ ধাঁধিয়ে যায় তার। পরক্ষণেই নিজেকে সামলাতে মুখ ডুবিয়ে দেয় সেই মাদকতা মেশানো কৃষ্ণ বরণ চুলের গভীরে।
নয়মাস পূর্ণ হয়ে দশমাসের চারদিন। ছিমছাম মেয়েটার গায়ের পরদে পরদে পানি। হাত পা ফুলে ঢোল। অল্প কিছু সময় বসে থাকলেই আর নড়াচড়া করতে পারে না। গাল ফুলে চোখ প্রায় দেখাই যায় না। পলক ইদানীং অফিসে যেতে চায় না। সারাক্ষণ ঘাপটি মেরে পরে থাকে তপার আশেপাশে। কিন্তু পায়েল আর তপার ঘ্যানঘ্যানানিতে বাধ্য হয় অফিসে ছুটতে।
পলকের মিটিং পরেছে আজ।যথারীতি অফিসে এসেছে দশটার আগে। মিটিংয়ের সময় এগারোটা। নির্দিষ্ট সময়ে মিটিং রুমে ঢুকে ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছে। মনোযোগ সহকারে শেষ করল পুরো কাজটা।প্রায় দু’ঘন্টা মিটিং শেষে ফোনের স্কিনে তাকাল পলক। বায়ান্নটা মিসড কল। সবগুলো মা বাবা আর প্রান্তর ফোন থেকে। পলক দিশেহারা বোধ করল আবারও। সেদিনের মত। যেদিন তপা কে হারিয়ে ফেলেছিল সে।
কাঁপা হাতে মায়ের নাম্বার ডায়াল করল। দুবার রিং হতেই পায়েল তাজওয়ার বললেন,
“হসপিটালে চলে এসো। তিয়াশার সিজারিয়ান অপারেশন চলছে।”
পলক নিজের সবটুকু জোর দিয়ে কেবল তিনটি শব্দ উচ্চারণ করল,
“তিয়াশা ঠিক আছে?”
পায়েল তাজওয়ার আশ্বাস দিয়ে বললেন,
“চিন্তার কিছু নেই। তুমি তারাতাড়ি এসো। কিছুক্ষণেই অপারেশন শেষ হবে।”
পলক খানিকটা স্বস্তি পেল। তবে শান্তি পেল না। হন্তদন্ত হয়ে ছুটল হসপিটালের দিকে।
পলক হসপিটালে পৌঁছেই মায়ের কাছে গিয়ে ধরা গলায় বলল,
“মা তিয়াশা?”
পায়েল তাজওয়ার কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,
“এমন ভং ধরে আছিস কেন? বাচ্চা কি তোর বউ একা জন্ম দিচ্ছে? আমরাও জন্ম দিয়েছি। এত কনসার্ন দেখানোর কিছু হয় নি ওকে? সব মায়েরাই সন্তান জন্ম দেয় এভাবেই। সবাই কিন্তু মরে যায় না। তিয়াশারও কিছু হবে না। চুপচাপ বাপ ডাক শোনার জন্য অপেক্ষা কর। ঘ্যানঘ্যান করলে কানের গোঁড়ায় দেব একটা।”
পলক হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। এত রিয়েক্ট করার কি হলো? আর এরাই বা এত রিলাক্স কি করে?
পায়েল তাজওয়ার ছেলের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। চিন্তা তারও হচ্ছে। কিন্তু পলক কে এই মূহুর্তে না থামালে তার ছেলে যে হসপিটালেই তুলকালাম বাঁধিয়ে ফেলবেন। তাই কোনো রকমে থামিয়েছেন।তবুও মিনিট খানেক পরপরই পলক কিছু বলার চেষ্টা করে। যতবার পলক কিছু বলতে চায় পায়েল ততবার চোখ রাঙানি দিয়ে থামিয়েছে।
অবশেষে অপারেশন থিয়েটারের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো দুজন নার্স। কোলে দু’টো ফুটফুটে শিশু। পলক সবার আগে এগিয়ে গেল।
নার্সের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার কৃষ্ণময়ী?”
নার্স বুঝতে না পেরে বলল,
“পেসেন্ট?”
পলক মাথা নাড়ালো।
নার্স হেসে বলল,
“পেসেন্ট সুস্থ আছে। কিছুক্ষণেই বেডে দেওয়া হবে।”
এবার সে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল তার ঔরসজাত সন্তানের মুখ। কি মায়া দিয়ে জড়ানো মুখ দু’টো। কৃষ্ণময়ীর গর্ভে জন্মেছে বলে এত মায়া? নাকি সব শিশুরাই এমন মায়া নিয়ে জন্মায়? বোধগম্য হলো না তার। কেবল যন্ত্রের মত হাত বাড়িয়ে দিল সামনে। দু কোলে তুলে নিল দু’জন কে। তাকিয়ে রইল বেশ খানিকটা সময়। দু’জনের কপালে চুমু এঁকে দিল।
ততক্ষণে বাকি সদস্যরা পলককে ঘিরে ধরেছে। পলকের মুখে তখন সদ্য বাবা হওয়ার আনন্দ ছলকে ছলকে পড়ছে।
পলক বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মা বাবা, কিছু মনে না করলে আমি ওদের আগে সিজান আর প্রান্তের কোলে দেই?”
সিজান, প্রান্ত অবাক হয়ে তাকাল। রায়হান, পায়েল দুজনে অমায়িক হাসলেন। এতদিনে তপার অতীত টা তাদের জানা হয়েছে। তপা নিজের বলে দিয়েছে। তাই তারা আর আপত্তি করলেন না।
সিজান, প্রান্তর চোখ চকচক করে উঠল আনন্দে। চোখের কোণে সামান্য জলকণা দেখা গেল কি?
একে একে সবার কোলেই পদার্পণ করল সদ্য জন্মানো অতিথি দুটো।
তপার জ্ঞান ফিরেছে কিয়ৎক্ষণ আগে। চারপাশে নিজের অতিব আপনজনদের দেখতে পেয়ে আনন্দে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। ভাগ্য তার এতই সহায় যে সিজান, প্রান্তও কর্মস্থল ছেড়ে বাড়িতে ছিল। তাইতো এত আনন্দের মূহুর্তের সাক্ষী হতে পেরেছে। আয়েশা তপার হাত মুঠোয় নিয়ে বলল,
“এই সুখ যেন কখনো শেষ না হয় মা। আল্লাহ তোর ঘর সুখে ভরিয়ে দিক।”
তপা তাকিয়ে দেখল তার একলা পৃথিবী আর একলা নেই। মা বাবা না থাকা সত্বেও কত আপনজন তার। এক মূহুর্তের জন্য তার বাবার মুখটা মনে পরলেও এই সুন্দর সময়টাতে নিজের খারাপ সময়ের স্মৃতি মনে করতে চাইল না।
কেবিনের কোথাও পলককে দেখতে না পেয়ে মন খারাপ হলো তপার। পায়েলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মা আপনার ছেলে?”
পায়েল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“এসেছিল। বাবুদের কোলেও নিল। তারপর আবার কোথায় যেন চলে গেল।”
তপা মৃদু অভিমানে চোখ বন্ধ করে ফেলল।
প্রায় আধঘন্টা পর তপার কেবিনে প্রবেশ করল একজন মধ্য বয়স্ক লোক। তপা চোখ খুলল। সামনে দাঁড়ানো মানুষটার মুখাবয়ব দেখে চমকে উঠল। সামনে আজমল হোসেন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তপা অন্য দিকে তাকাল।
আজমল হোসেন গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে তপার পাশে বসলেন। মাথা নিচু করেই বললেন,
“আমাকে ক্ষমা যায় না মা?”
তপা কিছু বলল না। আজমল হোসেন পুনরায় বললেন,
“একবার ক্ষমা করে দে না মা। আমি জানি আমি যা করেছি তা ক্ষমার অযোগ্য। তুই তো তোর মায়েরই সন্তান। আমার অস্তিত্বটুকু নাহয় নাই ধারণ করলি। তোর মায়ের অস্তিত্বে তো ক্ষমার ঝুলিটা অনেক বড়। সেই অস্তিত্ব ধারণ করেই আমাকে ক্ষমা করে দে না মা। শেষ বার।”
তপা চোখ মেলে তাকাল। চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে যাওয়া জলটুকু কাঁপা হাতে মুছে নিল। কঠিন গলায় বলল,
“করলাম ক্ষমা। আমার ছোট বেলা ফিরিয়ে দিতে পারবেন? পারবেন ভয়াবহ অতীতটা মুছে দিতে? বলুন পারবেন?”
আজমল হোসেন মাথা নিচু করে ফেলল।
এহেন সময় কেবিনে প্রবেশ করল পলক। তপার পাশে দাঁড়িয়ে গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠে বলল,
“তিয়াশা ভুল সবাই করে। কেউ বড়, কেউ চোট। ক্ষমা করা মহৎ। ক্ষমা করা দাও বাবাকে। আমরা ভুল করিনি? নিজেরা কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করাটা আমাদের ভুল নয়? এ নিয়ে কেউ প্রশ্ন করেছে? করেনি। হাসিমুখে মেনে নিয়েছে। তাই মনে হয় নি আমরা ভুল করেছি। কিন্তু আমরাও ভুল করেছি। তারা আমাদের হাসিমুখে ক্ষমা করেছে। তোমারও উচিৎ বাবাকে একবার ক্ষমা করে দেওয়া। তিনি অনুতপ্ত। তিনি প্রস্তুত নিজের ভুলের মাসুল গুনতে। তোমার উচিৎ ক্ষমা করে দেওয়া।”
আজমল হোসেন মাথা নিচু করেই উদ্যত হলেন কেবিন ছাড়তে। তপা নিজের সাথে যুদ্ধ করে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“বাবা!”
আজমল হোসেন থমকে দাঁড়ালেন।
তপা পুনরায় বলল,
“আমি পরিবার পাইনি। কিন্তু আমি চাই আমার সন্তানেরা সুস্থ জীবন পাক। তারা তাদের নানার আদর পাক। আমি নাইবা পেলাম।”
আজমল হোসেন পুলকিত হলেন। বরফ গলবে ভেবে।
পলক পাঁচ মিনিট যাবত এটা সেটা বলছে তপার সাথে। কিন্তু তপা নির্বিকার। কথা বলবে না সে পলকের সাথে। কড়া অভিমান হয়েছে তার। কেন সময়ে আসল না সে। কেন এসেও তার সাথে দেখা না করে চলে গেল।
পলক বুঝতে পারল তপার অভিমান। উঠে দাঁড়িয়ে দু’হাতে কান ধরে বলল,
“কতবার উঠবস করব? কতবার উঠবস করলে আমার কৃষ্ণময়ীর অভিমান কমবে? সে একটু ভালবাসবে আমাকে।”
তপা ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
“কান ধরলে হবে না। ওয়াদা করতে হবে।”
পলক বসল। তপার হাত ধরে বলল,
“বলো কি ওয়াদা করতে হবে? আজ তোমার জন্য জানটাও হাজির।”
“সারাজীবন আমাদের পাশে থাকার ওয়াদা। কঠিন বিপদেও পাশে থেকে সাহস দেওয়ার ওয়াদা। তীব্র ঝড়ের রাতে গভীর ভালবাসায় বুকে আগলে রাখার ওয়াদা। বুড়ো বয়সে আমার লাঠি হওয়ার ওয়াদা। সাদা চুলগুলো কাঁপা হাতে চিরুনী করে বিনুনী করে দেওয়ার ওয়াদা। তখন সাদা নয় কালো গোলাপ লাগিয়ে দেওয়ার ওয়াদা। সবচেয়ে বড় ওয়াদা আমাকে ছেড়ে কখনো কোথাও চলে না যাওয়ার ওয়াদা।”
পলক অপলক নয়নে তাকিয়ে রইল সদ্য তার সন্তানের মা হওয়া মেয়েটির মুখের দিকে।
“আমি ওয়াদা করছি সবগুলো কথার। তার সাথে আরও ওয়াদা করছি সারাজীবন আদরের চাদরে মুড়িয়ে রাখার ওয়াদা। ভালবেসে আগলে রাখার ওয়াদা। আমাদের সন্তানদের নিয়ে ভাল থাকার ওয়াদা।”
তপা মৃদু হাসল। সাথে হাসল চোখ দুটোও।
পলক উঠে গিয়ে একে একে দুই সন্তান কে কোলে তুলে দিল তপার। একজনের কপালে চুমু একে দিয়ে বলল,
“এটা আমার পালকি।”
অন্য জনের কপালে চুমু দিয়ে বলল,
“এটা আমার তিলক।”
তপা ঠোঁট প্রসারিত করে হাসল। পলক তপার কপালেও ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। বলল,
“এটা আমার কৃষ্ণময়ী। আমার অক্সিজেন। আমার নিশ্বাস, প্রশ্বাস। আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন।”
তপাও পিছিয়ে রইল না। পলকের এগিয়ে রাখা গালে ঠোঁট ছুঁয়ে বলল,
“আমাদের ভাল থাকার ঔষধ। আমরা তিনজনে তোমাকে খুব খুব খুব ভালবাসি পলক।”
পলক ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। তপার শুষ্ক ঠোঁটের ফাঁকে নিজের ওষ্ঠাধর ছুঁয়ে প্রেমের উষ্ণতা ছড়িয়ে দিল সারা অঙ্গে।
তপা মাথা কাত করে অন্য দিকে তাকাল। লজ্জায় গাল গরম হয়ে উঠল। ঠোঁটের কোণে শোভা পেল লাজুক হাসি।
পলক অপলক চেয়ে রইল তপার লাজে রাঙা মুখপানে।
নিম্ন অথচ হৃদয় কাঁপানো গলায় বলল,
“#কৃষ্ণময়ীর_অলংকার লাজুকলতা, অভিমান নয়।”
সমাপ্ত।
বি.দ্রঃ শেষের লাইনটা একটা আপুর উপন্যাসে পড়েছিলাম। এত ভাল লেগেছিল। ভাষায় প্রকাশ্য নয়। সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই এই লেখা। আপুর নাম ভুলে গেছি। তাই কার্টেসী দিতে পারলাম না।
সব লেখার পেছনেই একটা ছোট্ট ভূমিকা থাকে। আমি মাঝেমধ্যে টিভিতে কোনো দৃশ্য বা গান শোনার সময় হঠাৎ করেই মনে হয় এটুকু নিয়ে একটা উপন্যাস হয়ে গেলে মন্দ হয় না। তখন না লেখা অবধি পাগল পাগল লাগে। এই এখন একটা উড়াধুড়া প্রেমের গল্প মাথার পোকা খেয়ে নিচ্ছে। কিন্তু লিখতে পারছি না।
পরের গল্পের প্লট সাজানো হয়ে গেছে। কাল থেকেই হয়তো পোস্ট করব। একই সময়ে।
ভাল থাকুন, ভাল রাখুন এবং প্রিয় জনকে মাত্রাতিরিক্ত ভালবাসুন। সে ডিজার্ভ করে আপনার হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা।