অভিশপ্ত জীবন পার্টঃ- ২

0
611

অভিশপ্ত জীবন
পার্টঃ- ২
লেখিকাঃ- #Fabiha_Busra_Borno

এতো গুলো মানুষের সামনে ভাবি অকপটে বললেন,
আরে মুহিত তোমার ঠিক কয়টা লাগে বলো তো। নতুন বউয়ের মধু খেয়ে চলেছো দিন রাত সব সময় তাও তোমার তৃপ্তি মেটে না?? এখন শালিদের থেকে মজা নেওয়ার ফন্দি আঁটছো নাকি। তুমি পারোও বটে,,,,,,,,,

আরো কিছু বলার আগেই একজন মাঝবয়েসী ননদ ভাবিকে এক প্রকার ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন। রোকসানা এবং নাহার লজ্জায় নুইয়ে পড়েছে। মুহিত নিজেও ইতস্তত বোধ করছে। আর আমার পা দুটো মনে হচ্ছে অবশ হয়ে গেছে। ভেবে পাচ্ছি না ভাবির এমন আচরণের কারণ কি। বড় জা বললেন, কি হলো সুমি চলো দাদা দাদির সাথে কথা বলি। বড় জা-য়ের কথায় নিজের হুশ ফিরলো। কোন রকম লজ্জার লেষ কাটিয়ে পরিবেশ কে নর্মাল করতে সবাই কে নিয়ে দাদা দাদির ঘরে গেলাম। তাদের সাথে কথাবার্তা বলে দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ করি। তারপর ও বাড়িতে যাওয়ার জন্য রেডি হতে থাকি। খুব কষ্ট হচ্ছে যেতে। আজ গেলে আবারও ছয়দিন পরে আসতে পারবো। এই ছয়দিন ছোট ভাই বোন মা আব্বাকে ছেড়ে কিভাবে থাকবো আমি। এইসব ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসছে।

বিদায় লগ্নে এসে অঝোরে কান্না শুরু করে দিলাম। কিছুতেই ওই পরিবেশ আমার ভালো লাগছে না। চোখের পানি যেন বাঁধ ভেঙেছে আজ। অশান্ত মনে বারবার কু-ডাকছে। বড় ভাবি এবং প্রতিবেশী ননদেরা আমাকে ধরে গাড়িতে বসিয়ে দিলেন। বড় ভাবি বললেন আমার ছোট বোন আছে ঠিক তোমার মতো। আজ থেকে না হয় তুমি আমার আরেকটা বোন।

শশুর বাড়ি এসে পৌঁছেছি সন্ধ্যার আগে। কাছের আত্মীয় স্বজনরা চলে গেছেন। দুই চার জন যারা আছেন তাদের জন্য রান্না করতে হবে না। আমার মা খাবার বেঁধে দিয়েছেন। তাতেই আপাতত হয়ে যাবে।

আজ খুব তারাতাড়ি ঘুমুতে গেলাম। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এ বাড়িতে আসার পরে মেঝো ভাবি বা শিমলার সাথে একবারও দেখা হয় নি। কেন যেন এখনো আমার সামনে আসে নি। হয়তো নিজের বলা কথার জন্য লজ্জা পেয়েছে তাই আসেনি। মুহিত আর আমি ঘরে বসে আছি। মুহিত তার মেডিক্যালের কোন এক ভাইয়ের সাথে কথা বলছে ফোনে। তাকে বলছে আর দুই এক দিন ছুটির ব্যাবস্থা করতে। কিন্তু অপর পাশের ব্যাক্তিটি নারাজ। মন খারাপ করে মুহিত ফোন টেবিলে রেখে, দুই হাত মাথার উপরে দিয়ে সুয়ে পড়ে। আমি ও তার পাশে গিয়ে বসি আর বলি, তুমি কি কাল ই চলে যাবে??
মুহিত – হুম বিকালে যাবো।

কবে আসবে আবার??

যদি তারাতাড়ি কাজ শেষ হয় তাহলে প্রতিদিন রাত ১১ টার মধ্যে তোমার কাছে এসে বান্দা হাজির হবে।

না এভাবে রিক্স নিয়ে আসা যাওয়া করার দরকার নেই,,,

নতুন বউ বাসায় রেখে কাজে মন বসবে বলো। সব সময় তোমার ছোয়া পেতে ইচ্ছে করবে।

মুহিতের এইসব কথা শুনে আমি লজ্জায় শেষ। সারাদিন অনেক তোরজোরের পাশাপাশি প্রচুর কান্নার জন্য মাথা ব্যাথা হচ্ছে। তাই মুহিত আর আমি দুজনেই ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে উঠোন বাড়ি ঝাড়ু দিয়ে শাশুড়ীর সাথে রান্নাঘরে গেলাম। আপাতত আমার কোন কাজ নেই। এটা সেটা এগিয়ে দিচ্ছি আর মা যা বলছেন তার উত্তর দিচ্ছি। এর ফাঁকেই পাশের ঘর থেকে সোনিয়ার (মেঝো ভাবির ছোট মেয়ে) কান্না শোনা যাচ্ছে। মা আমাকে সোনিয়া কে নিয়ে আসতে বললেন। আমি সোনিয়া কে নিয়ে গিয়ে দেখি ভাবি বিছানার এক কোণে বসে আছে। অনেক রেগে আছে তা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। আর মুহিত ঘর বেড়িয়ে আসছে। হঠাৎ আমাকে দেখে মুহিত হকচকিয়ে গেল। সাথে সাথে নিজেকে সামলিয়ে বললো আমার কাছে সোনিয়া আসছে না। তোমার কাছে আসে নাকি দেখো।আমি কোন কিছু না ভেবেই সোনিয়া কে নিয়ে চলে আসলাম।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। মুহিত চলে যাবে। সামান্য কিছু কাপড় নিলো। আমার খুব খারাপ লাগছে। একে তো নতুন যায়গা। পরিচিত কেউ নাই। তারউপর মুহিত ও চলে যাচ্ছে। যায়হোক মুহিত কে বিদায় দিয়ে ঘরে বসে একা একা কান্না করছি। তখন আমার শাশুড়ী আসে আমার ঘরে। আমার কান্না দেখে তিনি বলেন, আজ আমার কোন মেয়ে নাই বলে ভেবো না তোমার কষ্ট আমি বুঝি না। তোমাকে বুঝতে হবে,, আমাদের জমিজমা তেমন কিছুই নাই। মুহিতের বড় দুই ভাই বউ বাচ্চা নিয়ে ভিন্ন খায়। এতো দিন মা ছেলে খেতাম এখন থেকে তুমি আসলে, কিছু দিন পরে আরো সদস্য বাড়বে। মুহিতের এই চাকরির উপরে আমাদের সংসার চলে। তাই চাকরিতে যাওয়া খুব দরকার।

একা একা ঘরে ভালো লাগছে না তাই আমি মেঝো ভাবির ঘরে গেলাম সোনিয়া আর শিমলার সাথে সময় কাটাতে। (বলে রাখি আমাদের বাড়িতে ৪ টা ঘর। আমরা একঘরে থাকি শাশুড়ী শিমলা কে সাথে নিয়ে থাকেন। শশুর অনেক আগেই মারা গেছেন। বড় ভাসুর আলাদা বাড়ি করে চলে গেছেন।তাদের রেখে যাওয়া ঘরটা আত্মীয় আসলে ব্যাবহার করা হয়।) ঘরে গিয়ে দেখি মুহিতের সাথে ভাবি ফোনে কথা বলছে। আমাকে দেখে ভাবি বললেন, এই মাত্র মুহিত কল দিলো, তোমার সাথে কথা বলতে চাইছে, আমিই তোমার কাছে যেতাম,, যায়হোক কথা বলো তোমরা। আমি মুহিত কখন পৌঁছেছে তা জিজ্ঞেস করার পাশাপাশি আরো কিছু কথা বললাম।

আমার মেঝো ভাসুর ট্রাফিক পুলিশ। তাই তিনি বেশির ভাগ সময় বাইরে থাকেন। সপ্তাহে দুই এক দিন বাসায় আসেন। আমাদের বিয়ের পরদিনই তিনি চলে গেছেন। যেহেতু তিনি দূরে থাকেন তাই ভাবিকে ফোন কিনে দিয়েছেন। দেখতে দেখতে চার দিন কেটে গেছে। এর মাঝে মুহিত এক দিন রাতে বাসায় এসে সকালে চলে গেছে। আজ রাতে আসবে। কাল বাবার বাড়িতে যাওয়ার কথা। যথারীতি রাত ১১ টার দিকে মুহিত বাসায় এসে আগে মায়ের সাথে কথা বলে তারপর ঘরে আসে। আমি খাবার দিলাম। খাওয়া শেষে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিলো বিছানায়। দরজায় খিল এটে লাইট নিভিয়ে আমিও মুহিতের খুব কাছ ঘেঁষে সুয়ে পড়লাম,,,,,,,,,,,,।

সকালে মুহিত বাজারে গেছে, আমাদের নিতে দাদা দাদি আসবেন,। শিমলা আমার শাশুড়ীকে জিজ্ঞেস করলো,, দাদি! কাকু আসেনি??

ওমনি ওর মা ছোট মেয়েটার গালে থাপ্পড় দিয়ে বললো, তুই কেন কাকু কাকু করিস,, কই তোর কাকু তো একবার ও তোদের সাথে দেখা করলো না,,,

শিমলার গায়ে হাত তোলার জন্য শাশুড়ী ইচ্ছে মতো বকাবকি করলেন। দুপুর গড়িয়ে বিকাল। আমার রেডি হওয়া শেষ কিন্তু মুহিত কে দেখতে পাচ্ছি না। কলপাড়ে গিয়ে দেখি,, পাটকাঠির চাটাই-এর ওইপাশে মুহিত আর ভাবির মাঝে কিছু একটা নিয়ে তর্কবিতর্ক হচ্ছে। দূর থেকে যদিও শোনা যাচ্ছে না কি নিয়ে কথা হচ্ছে। তবে আমার মনে খটকা লাগলো। কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে। মুহিত আসলো একটু পরেই। এসে রেডি হয়ে বেড়িয়ে পরলাম আমরা। আমি বাবার বাড়িতে থাকবো কয়দিন। মুহিতের ছুটি তিনদিন। পরশু দিন মুহিত চলে যাবে। এই দুইদিন আমি আর মুহিত অনেক যায়গা তে ঘুরতে গেলাম। আমার আব্বার একটা বাইক আছে। ৩/৪ মাস আগে কেনা। এখানে আসার পড়ে আমার ছোট চাচা মুহিত কে বাইক চালানো শিখাচ্ছেন। যদিও এখনো পুরোপুরি পারে না। এভাবেই দুইদিন কিভাবে পার হলো বুঝতে পারিনি। মুহিত চলে গেছে আজ সকালে। কিন্তু একবারও আব্বার কাছে কল দেয় নি। লজ্জায় আব্বাকে জিজ্ঞেসও করতে পারছি না, মুহিত কল করছিলো নাকি। সারাদিন রাত মুহিতের সাথে কথা হয় নি। পরের দিন দুপুরে মুহিত কল দিয়ে বললো সামনে বৃহস্পতিবার রাতে আসবে আর শনিবারে যাবে।

দেখতে দেখতে কেটে গেছে ৩ মাস। এভাবে আশা যাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে মুহিত বাইক চালানো পুরোপুরি শিখে গেছে। এখন মুহিত প্রায় সময় ই আব্বার বাইক নিয়ে আসে আর ১৫/২০ দিন পরে আব্বা কোন কারণে চাইলে দিয়ে আসে। যেদিন বাইক ফেরত দিয়ে আসে সেদিন মুহিত খুব রেগে থাকে আর সব সময় আমার সাথে খারাপ আচরণ করে।

গত এক সপ্তাহ আগে মেঝো ভাবি বাপের বাড়ি গেছে। এই এক সপ্তাহ মুহিত ও বাড়ি আসেনি। মেঝো ভাবি না থাকায় মুহিতের সাথে যোগাযোগ করা যায় নি। কারণ আশেপাশে কারো ফোন নাই তেমন। যাদের আছে তারাও বলে ফোনে টাকা নাই। এতোদিন কথা না বলার জন্য বিষন্নতায় ভুগছি। আমার শাশুড়ী ও কেন যেন বারবার মেঝো ভাবির বাপের বাড়ির খোঁজ নিচ্ছেন। প্রায় ১০ দিন পরে ভাবি আজ বাড়িতে আসছে। এসেই আমাকে বললেন, কাল মুহিত বাসায় আসবে।

এটা শুনেই কেমন যেন মনটা খুশিতে ভরে গেলো। মুহিতের সাথে কথা বলার জন্য ভাবির থেকে ফোন চাইলাম কিন্তু চার্জ নাই বলে ভাবি আমাকে ফোন দিলো না। যেহেতু কাল আসবে তাই হাতের কাজ গুলো শেষ করে ঘরে গেলাম। সারাদিন শাশুড়ীর অনেক ফরমায়েশ শুনতে হয়। ইদানিং শাশুড়ী আমার প্রায় সব কাজ গুলোর দোষ খুঁজতে শুরু করেছেন। আমি যা করি সেটা ভুল হয়। এতো সতর্ক হয়ে রান্না করি কিন্তু তাও উনার স্বাদ লাগে না। পাড়ার একে ওকে আমার নামে অনেক কটু কথা বলে। মাঝে মাঝে কিছু কথা আমার কানেও পৌঁছায়। হয়তো আমার নিজেরই ব্যার্থতা ভেবে সেই কথা গুলো মাথায় নিই না। কিন্তু মন খারাপ ঠিকই হয়।

আজ দুপুরে মুহিত এসেছে। কিন্তু আমার সাথে ভালো ভাবে কথা বলছে না। বুঝতে পারছি না কি নিয়ে তার এতো রাগ। দুপুরের খাওয়া শেষে বিশ্রাম নিতে ঘরে গেলাম। মুহিত আগে থেকেই ঘরে ছিলো। মুহিত কে জিজ্ঞেস করলাম,,

কি হয়েছে??

কিছু না।

তাহলে কথা বলছো না যে।

কি বলবো তোমার সাথে? কথা বলার কোন যায়গা রাখছো তোমরা? আমি আমার পরিচিত সবার কাছে বড় মুখ করে বলেছিলাম, বাইক টা আমার শশুর আমাকে দিয়েছে, কিন্তু আমি যখন রিকশায় উঠে কোথাও যায় আর পরিচিত কারো সাথে দেখা হয় তাহলে সবাই জিজ্ঞেস করে, আমার বাইক কই? তখন আমার জবাব দেওয়ার মতো কোনো কথা থাকে না। আজও আসার সময় একজন বললো বাইকের কথা,,,,,

তুমি কেন আগবাড়িয়ে বলতে গেছো তোমাকে বাইক দিয়েছে। বিয়েতে তো বাইক দেওয়ার কথা ছিলো না।

কথা ছিলো না বলে কি দেওয়া যাবে না। এতো দূরে যাওয়া আসা করতে আমার কত কষ্ট হয়,, সেগুলো কি তুমি বউ হয়ে বুঝো না??

সেই বিয়ের পরে থেকে অন্যের মোবাইল দিয়ে তোমার সাথে কথা বলতে হয়,, কতদিন বললাম পুরাতন হলেও একটা মোবাইল কিনে দাও,, কিন্তু তাও দিতে পারলে না,, যার সামান্য মোবাইল কিনে দেওয়ার মুরোদ নাই সে চাই বাইক!!!!

মোবাইল দিয়ে তুই কার সাথে কথা বলবি বুঝি না আমি,,,আমাকে দিয়ে বুঝি তোর হচ্ছে না। নতুন কাউকে চাই বুঝি। এতো দিন তো লোকের মুখে শুনছিলাম কথা বলার ফাঁকে হাসতে হাসতে নাকি এর ওর গায়ে ঢলে ঢলে পরিস,, সারাক্ষণ তাদের সাথে কথা বলার জন্য মন ছটফট করে বুঝি?

আমি ঘৃণায় লজ্জায় আর কোন কথা বলতে পারলাম না। বালিশে মুখ গুজে কান্না করলাম। কান্না করতে করতে কখন ঘুমিয়ে গেছি বুঝিনি। ঘুম ভাঙলো শাশুড়ীর বকবকানিতে,, সন্ধ্যা হয়ে গেছে এতোক্ষণ ঘুমিয়ে আছি আর রান্নাও হয় নি। আমি তারাহুরো করে উঠতে গিয়ে মাথা ঘুরে পরে যায়। সোনিয়া দেখে সবাই কে ডাকে,,পাশের গ্রামের ডাক্তার প্রেশার মেপে বলে, প্রেশার কম তাই মাথা ঘুরে পরে গেছে। কিছু দিন ভালো খাবার এবং রেস্ট নিতে হবে। তারপর ডাক্তার চলে গেলে মুহিত ও চলে যায় বাইরে। শাশুড়ী রাতের রান্না করলো। আমি এখনো সুয়ে আছি,, মাথা ঝিমঝিম করছে। এমন সময় মুহিত ঘরে এসে শার্ট খুলে লুঙ্গি আর গেঞ্জি গায়ে দিয়ে আবারও চলে যায়। কিছুক্ষণ পরে মুহিতের ফোন বেজে ওঠে। আমি খেয়াল করে দেখলাম ফোনটা মুহিতের শার্টের পকেটে। ধিরে ধিরে গিয়ে ফোন টা হাতে নিলাম। মেডিক্যাল থেকে কল এসেছে। প্রয়োজনীয় কল হবে ভেবে ফোন হাতে নিয়ে মুহিত এর কাছে যাচ্ছিলাম। মেঝো ভাবির ঘরের সামনে দিয়ে বাইরে যেতে হবে। ঘরের সামনে যেতেই মুহিত আর ভাবির কথা শুনতে পায়। ছিঃ কিভাবে এই কথা গুলো বললো?? এগুলো কি সত্যিই নাকি মিথ্যা,,, হায় আল্লাহ এগুলো যেন মিথ্যা হয়, এইসব ভাবতে ভাবতেই দরজা,,,,,,,,,,,,,

চলবে,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here