#বৃষ্টিময়_প্রেম
#পর্বঃ২
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
দাদিকে দেখে ভয়ে ভয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকলাম আমি। শুকনো ঢোক গিলে তার মুখ থেকে নিজের নামে বাজে কিছু শুনার প্রস্তুতি নিতেই তিনি বললেন,
— বাসায় কখন আসলি তুই? আর ঢুকার সময় কেউ তোরে দেখেনি তো?
দাদির কথা শুনে এতক্ষণ চেপে রাখা শ্বাস ছাড়লাম আমি! তার মানে তিনি কিছুই দেখেননি! যাক আল্লাহ বাচিয়েছেন আজকে। মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতেই আবার দাদির গলা শুনলাম,
—কি রে, কথা কস না ক্যান? সত্যিই কারও সাথে দেখা হয়নি তোর? কোন ব্যাটামানুষেক দেখছোস বাড়ি থেকে বাইর হতে?
দাদির কথা শুনে বুঝলাম তিনি উনার কথা বলছেন। তবুও মুখে বললাম,
— না তো দাদি, আমার তো কারও সাথে দেখা হয়নি আর আমিও কাউকে দেখিনি। কেন? কারও সাথে দেখা হওয়ার কথা ছিলো কি?
দাদি আমার কথা শুনে খুশি হলেন মনে হয়। তার মুখে স্বস্তির আভাস দেখা গেলো। তিনি বললেন,
— আর কইস না। ছেলেরা মেয়ে দেখে খাওয়াদাওয়া করেই চলে যাচ্ছিলো, ওদের নাকি এক জরুরি কাজে যাওয়া লাগবো। পাত্রের বড় ভাইও আসছিলো, সেই দেখতে পোলাডা। তবে সারাদিন ফোনে কথা কয় অফিসের মানুষের লগে। খাওয়া শেষে ওই ফোনই ছেড়ে গেছিলো টেবিলের উপর ওডা নেওয়ার জন্য আসছিলো আবার।
দাদির কথা শুনে বুঝলাম একটু আগে যার সাথে আমার দেখা হয়েছিলো উনি পাত্রের বড় ভাই! তার মানে উনি পাত্র না! হঠাৎ করেই যেন মনের মধ্যে অদ্ভুত স্বস্তি লাগলো উনি পাত্র না শুনে। কিন্তু কেন লাগলো তার কারণ বুঝতে পারলাম না আমি।
—আরেহ তুরফা, তুই এসে গেছিস? এত দেরি হলো কেন আজ? আমি এতক্ষণ ধরে ভাবছিলাম তুই কলেজ করে বাসায় আসছিস না কেন এখনো!
আন্টির কথা শুনে তার দিকে তাকালাম। তিনি খানিকটা চিন্তিত মুখে আমার দিকে চেয়ে আছেন। বুঝলাম দাদি আমাকে মানা করার কথা তাকে জানায়নি! দাদির দিকে তাকিয়ে দেখি তিনি চোখের ইশারায় আমাকে মানা করছেন আন্টিকে যেন না বলি তার বলা কথা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আন্টিকে হাসিমুখে জড়িয়ে ধরে বললাম,
— উফফো আন্টি, তুমিও না আমার বড্ডো চিন্তা করো! কলেজ শেষে একটু ঘুরতে গিয়েছিলাম ফ্রেন্ডদের সাথে। দুপুরে ওদের সাথে খেয়েই বাসায় এসেছি তাই লেইট হয়ে গেলো আজকে।
— চিন্তা কেন হবেনা মা? তুই আমাদের দায়িত্ব। তোর মাকে কথা দিয়েছি আমি তোকে দেখে রাখার জন্য। যতদিন তোকে যোগ্য ছেলের হাতে তুলে না দিয়েছি তোর খেয়াল তো আমাদেরই রাখতে হবে। এরপর কোথাও গেলে আমাকে বলে যাস।
আন্টির কথা শুনে মাথা নাড়লাম। বিয়ের কথা শুনে মনের মধ্যে শিহরণ খেলে গেলো। আমারও জীবনে কি কেউ আসবে যে আমাকে আগলে রাখবে এই কঠিন দুনিয়া থেকে? যার সবকিছুতে আমার অগ্রাধিকার থাকবে সবার উপরে? যে তার ভালোবাসার বৃষ্টিতে ভরিয়ে দিবে আমার হৃদয়ের মরুভূমি। যার আগমনে পরিপূর্ণ হবে আমার ছোট্ট জীবন?
— পাত্রপক্ষ রাজি হলেই হয় বিয়ের জন্য। এত ভালো ছেলে আর পরিবার হাতছাড়া করা যাবেনা। চৌধুরী বংশের লোকজন বলে কথা। ব্যবসা-সম্মান সবদিক দিয়েই তাদের বহু নাম-ডাক।
আমার ভাবনার মধ্যেই দাদির কথা শুনতে পেলাম। চৌধুরী বংশ? আন্টির কাছে শুনেছি আমার বাবাও চৌধুরী বংশের ছেলে ছিলেন। এইজন্যই আংকেলের ব্যবসা দাড় করাতে তিনি অনেক সাহায্য করেছেন ওই সময়। ইশ! আজ যদি আমার বাবা-মা বেচে থাকতো? তাহলে এই বাসায় থেকে দাদির খোটা শুনতে হতোনা প্রতিদিন। আমার জীবনটাও অন্যরকম হতো।
বাবা-মায়ের কথা মনে হতেই চোখে পানি চলে আসলো আমার। দ্রুত রুমে চলে আসলাম আমি। নামাজ পড়ে তাদের জন্য দোয়া করলাম আর আল্লাহর কাছে চাইলাম আমার জীবনকেও সুন্দর করে দেওয়ার জন্য। তারপর ফ্রেশ হয়ে একটা ঘুম দিলাম সন্ধ্যা পর্যন্ত।
সবার চিল্লাচিল্লিতে ঘুম ভেঙে গেলো আমার। সময় দেখলাম রাত ৮ টা বাজে। বেশ অনেকক্ষণই ঘুমিয়েছি আমি তাহলে। হাত-মুখ ধুয়ে বাইরে আসতেই দেখি আন্টি মিস্টি নিয়ে এগিয়ে আসলেন আমার দিকে। রাইসার দিকে তাকাতেই দেখি ও লাজুক হাসিতে আমার দিকে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো আমায়। কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছি কি হয়েছে তাই আন্টিকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম, উনিও হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন। বিস্তৃত হলো আমার মুখের হাসি। পাত্রপক্ষ রাজি হয়েছে!! দাদির খুশি দেখে কে! উনি নাকি পাড়ায় মিস্টি বিলি করতে গিয়েছেন এই খুশিতে! তার পাগলামির কথা শুনে হাসলাম আমি।
—
রাইসা একের পর এক রুপচর্চা করেই যাচ্ছে আর আমি বসে বসে ওর কাণ্ড দেখে যাচ্ছি। যার সাথে ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে অর্থাৎ প্রান্ত, তার সাথে নাকি কালকে ওর রেস্টুরেন্টে দেখা করার কথা। তার জন্যই এত প্রস্তুতি। কিন্তু আমি বুঝে পাচ্ছিনা আজকে তো প্রান্ত ওকে দেখেছেই তবে এত রুপচর্চার কি দরকার? যাই হোক, ওর ব্যাপার ও জানে। রাইসা ফেইসপ্যাক তুলতে বাথরুমে গেছে আর আমি চুপচাপ আমার ফোন টিপছিলাম। হঠাৎ ওর ফোন বেজে উঠতেই দেখি প্রান্ত কল দিয়েছে।
রাইসাকে বারকয়েক ডাকার পরেও ও শুনলোনা। এদিকে ফোন বেজেই যাচ্ছে। একপর্যায়ে রাইসা বললো আমি ধরে যেন প্রান্তকে বলি রাইসা একটু কাজে ব্যস্ত। ফ্রি হয়ে নিজে কলব্যাক করবে। ইতস্ততবোধ হলেও রাইসার কথা শুনে কাপা হাতে ফোনটা রিসিভ করলাম আমি,
— হ্যা-হ্যালো, প্রান্ত ভাইয়া। (আস্তে করে বললাম আমি)
ওপাশ থেকে কোন আওয়াজ পাওয়া গেলোনা। অদ্ভুত গাম্ভীর্য বিরাজ করছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বিরক্ত হলাম প্রান্তের উপর। কথা বলার জন্যই যদি ফোন দেয় তবে চুপ করে আছে কেন? তাই বিরক্তি নিয়েই এক নিশ্বাসে বলে উঠলাম,
— হ্যালো ভাইয়া, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন? যদি শুনতে পারেন তাহলে জেনে রাখুন আপনি যাকে ফোন দিয়েছেন আমি সে নই। আমি রাইসার বোন তুরফা। ও এখন একটু ব্যস্ত আছে, ফ্রি হয়ে পরে আপনাকে কলব্যাক করবে।
তার উত্তর শুনার জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও নিশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শুনতে পেলাম না। প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে ফোন কাটতেই ওপাশ থেকে শুনা গেলো গম্ভীর আওয়াজ,
— আমি প্রান্তের বড় ভাই, পূর্ণ বলছি। ওর কালকে জরুরি মিটিং আছে তাই কাল দেখা করতে পারবেনা। এই কথাটা ও নিজে রাইসাকে বলতে পাচ্ছিলো না সে কস্ট পাবে ভেবে। তাই আমি ফোন দিয়েছি ওর পক্ষ থেকে। আপনি রাইসাকে পরশুদিন আসতে বলবেন, এই মিটিং জরুরি না হলে আমি কখনোই প্ল্যান ক্যান্সেল করতে বলতাম না ওকে। আশা করি রাইসা বুঝবে।
একবারে এতকিছু বলে সাথে সাথেই ফোনটা কেটে দিলেন উনি। আমাকে কিছু বলার সুযোগই দিলেন না। অথচ এইদিকে তার কন্ঠ, তার নাম শুনে আমার হৃদপিন্ডের ধুকপুকানি বেড়ে গেছে। “পূর্ণ” নামটা শুনেই মনের মধ্যে শিহরণ জাগলো। উনার সাথেই দেখা কি তবে হয়েছিলো আজ বৃষ্টিতে আমার? আবার এখন ভাগ্যক্রমে তার সাথেই কথা হলো ফোনে??
এ কেমন অদ্ভুত ব্যপার।
একদিকে রাইসা বাথরুম থেকে ডেকে যাচ্ছে কি হয়েছে শুনার জন্য কিন্তু এইদিকে “পূর্ণ” নামক ব্যক্তির অদ্ভূত আচরণে ভাবনার জগতে ডুবে রয়েছি আমি! কোন এক অজানা কারণে তার কথা মনে হতেই কেন জানি চিন্তার ডালপালা ছড়িয়ে পড়ে আমার হৃদয়জুড়ে।
#চলবে
প্রথম পর্বে সাড়া দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। সবার গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় রইলাম।