রোদেলা,পর্ব: ৬৫

0
877

#রোদেলা,পর্ব: ৬৫
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু

সুফিয়ান সকাল থেকে অভুক্ত। তবুও কিছুই খেতে মন চাইলো না ওর। এখানে আসার অনেক পরে একগ্লাস জুস আর স্যালমন স্যালাড নেয় ও । খাবার খেতে খেতে হঠাৎ মনে পরে পরশের কাছে ওর ক্রেডিট কার্ডটা রাখা। গতরাতে ওর কার্ড ব্লক হওয়ায় আর ওর কাছে ক্যাশ না থাকায় এটা দিয়ে ঔষধের বিল দিয়েছে পরশ। পরে কার্ডটা আর নেয়া হয় নি। সুইচ অফ করা ফোনটাকে খুলে সুফিয়ান, পরশকে একটা কল করবে। কাছাকাছি থাকলে যেন দিয়ে যায় কার্ডটা। ফোনটা খুলতেই অনেক গুলো ম্যাসেজ আসে, সেগুলো চেক করতে না করতেই কল আসে ফোনে। ফোনে তেমন চার্জ না থাকায় সাথে সাথে ফোনটা সুইচ অফ হয়ে যায়। এক মুহূর্তের জন্য একটা নাম ভেসে উঠেছিলো স্ক্রিনে। তারপরই বন্ধ হয়ে যায় ফেনটা।

সুফিয়ানের মাথাটা কেমন চিড়িক দিয়ে উঠে। সেখানকার ওয়ার্কারদের সাহায্য নিয়ে ফোনটাকে চার্জ দেবার ব্যাবস্থা করে। ওর চার্জার লাগেজের মধ্যে যেটা অনেক আগেই চেক ইন এ দিয়ে এসেছে ও। ফোনে চার্জ হওয়া অবস্থায়ই ফোনটা চালু করে ও। মুহূর্তেই আবার ফোন আসে সেই একই নম্বর থেকে। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একটা কান্নার কন্ঠস্বর ভেসে আসে থেকে। চুপ করে হতবাক সুফিয়ান ওপাশের কথাগুলো শোনে ও। কোনকিছু না ভেবেই দৌড়ে বের হয় ইমিরিয়েট এয়ারলাইন্সের বিজনেস ক্লাস লাউন্জ থেকে। এখান থেকে বের হওয়া নিষেধ তবুও দেড় ঘন্টার মতো সময় হাতে থাকায় সিকিউরিটি পুলিশ বের হতে দেয় ওকে।

সেখান থেকে দৌড়ে বের হয় সুফিয়ান। এয়ারপোর্ট কি এতটুকু জায়গা…? এত বড় এয়ারপোর্ট দৌড়ে হাঁপিয়ে উঠছে ও তবুও প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে । এয়ারপোর্টের সবাই তাকিয়ে দেখছে ওকে। কেন এভাবে দৌড়ে যাচ্ছে ও সেটাই কৌতুহল সবার…

একটা সময় পৌঁছে যায় তিন নম্বর গেইটের কাছে। সেখানে ও সিকিউরিটি আটকায় ওকে। কোনমতে তাকে বুঝিয়ে বের হয় সুফিয়ান। লম্বা এই প্যাসেজটা মোটামুটি ফাঁকাই। অল্প কিছু লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাড়িয়ে আছে এদিক সেদিক। বের হয়ে দ্রুত দুই দিকেই তাকায় সুফিয়ান। দিশেহারার মতে খুঁজতে থাকে পুরো প্যাসেজটাতে। পেছনে ফিরে তাকিয়ে চেক করলো তিন নম্বর গেইটে দাঁড়িয়ে তো….?

নম্বর তো ঠিকই আছে,
আশেপাশে খোঁজ করতেই কেউ একজন ওর পিঠে হাত রাখে… তড়াক করে পেছন ফিরে সুফিয়ান। তাকিয়ে যা দেখলো তার জন্য প্রস্তুত ছিলো না ও। রোদেলা দাঁড়িয়ে ওর সামনে, লাল রঙের শাড়ি পরেছে ও, গায়ে ওভারকোটে জড়ানো। চোখজোড়া ফোলা, খানিকক্ষণ আগেই কেঁদেছে মেয়েটা তাই হয়তে। অপ্রস্তুত সুফিয়ান কি বলবে গুছানোর চেষ্টা করলো ভিতরে ভিতরে।

চোখমুখ মুছে ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রোদেলা বললো-
: কেমন মানুষ আপনি…? মেলিংটনে গেলাম আপনি নেই, প্রেমাকে বললাম আপনাকে কল দিতে অথবা আমাদের বাড়িতে যেতে, কল দিলেন না, বাড়ি যাওয়া তো দূরের কথা।
: মানে….!
প্রেমা তো কিছু বলে নি আমাকে,তাছাড়া আমি তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম, বাড়িতে কেও ছিলো না তখন।
: বলে নি মানে, আমি তো লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে পরশু গিয়েছিলাম আপনার কাছে। আপনি নাকি ওয়েলস এ গিয়েছেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলাম, আপনার খবর নেই তাই বাধ্য হয়ে চলে এলাম। আর আপনি আমাদের বাড়ি কখন গিয়েছিলেন?
: গতকাল সকালে।
: ওহ্ খোদা….! গতকাল সকালে আমি বাইরে বেরিয়েছিলাম একটা জরুরি কাজে।
আর আপনার ফোনে কি হয়েছে?
: ফোন বন্ধ করে রেখেছিলাম আমি নিজেই।
: কেন…?
: অভিমানে।
: আপনাকে আমি বুদ্ধিমান ভাবতাম, কিন্তু দেখলাম যতটুকু বুদ্ধিমান আমি আপনাকে ভেবেছিলাম ততটুকু আপনি নন…
: বলো তোমার যা মন চায়,
: পাঁচ পাঁচটা বছর একজনকে খুঁজলেন, তাকে পেলেনও অবশেষে, তার সাথে মিটমাট না করে পালিয়ে যাচ্ছেন…
: কই গেলাম পালিয়ে, সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়েই তো এলাম। তোমাকে বললাম, ওয়েলস এ গেলাম নানুদের কাছ থেকে বিদায় নিতে।
: আপনি আপনার নিজের কাছ থেকে পালাচ্ছেন সুফিয়ান, তা কি টের পাচ্ছেন ?
: আমি না হয় বুদ্ধিমান নই, তুমি তো বুদ্ধিমান, কয়েকদিন বাদে পিএইচডি করবে, অদূর ভবিষ্যতে সেখানকার প্রফেসর যে হবে না তা কে বলতে পারে।
সেই তুমি জানোই না আমি কেন খুঁজেছি তোমায়।
: আপনার কি মনে হয় আমি জানি না…?
: আমি কিন্তু সেদিনই বলেছিলাম “আমার তো মনে হয় তুমি জানো।
: আমি জানি, এবং এতকিছু জানি যে আপনার মাথা ঘুরে যাবে,
বাকা দৃষ্টিতে তাকায় সুফিয়ান।
: আমার প্রতি আপনার প্রথম ইমপ্রেসন তৈরী হয়েছিল সেই রাতেই, যে রাতে আমরা সবাই গিয়েছিলাম আপনার মিলে নোভেলকে ছাড়াতে। কি ঠিক বলেছি ?
অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় সুফিয়ান, কথাটা শুনে ও কেমন অস্বস্তি বোধ করে।
: কখন সেটাও বলি….?
যখন আমার পার্সটা এত লোক থাকতেও নিজে সিঁড়ি ভেঙে দিতে এসেছিলেন গাড়িতে তখন। উত্তরের অপেক্ষায় থেকে নিজেই বলে রোদেলা…
লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে ও,
: তারও অনেক পরে আমি বুঝেছি আমার পার্সে থাকা ছবিটা রেখে দিয়েছেন আপনি..
কিছুটা চমকিত হয়ে নিচে তাকায় সুফিয়ান, যেন অবিশ্বাস্য কিছু শুনছে ও, তারপর এমন একটা দৃষ্টিতে তাকায় ও যেন অনেক বড় অপরাধে ধরা পরেছে পুলিশের হাতে,
ক্ষীণ কন্ঠে বলে-
: সরি ফর দ্যাট,
: সরি বললে কাজ হবে…?
সরি-টরিতে কাজ হবে না…
: মানে…
: শাস্তি পেতে হবে আপনাকে…
: শাস্তি…!
: হুম… আমি দেশে আর ফিরবো না তা তো বলেই দিয়েছি, আপনার শাস্তি হচ্ছে আপনিও আমার সাথে এখানেই থাকবেন। এই নিন চুড়ি পরিয়ে দিন হাতে। বলেই বাক্সটা এগিয়ে দেয় রোদেলা…

সুফিয়ান এত কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিলো না… বাক্সটা হাতে নিয়ে ভ্যাবাচেকা ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ।
: কি ব্যাপার…? সময় হয়ে যাচ্ছে তো।

কোন উত্তর না দিয়ে পাশে থাকা বেঞ্চে মাথাটা নিচু করে বসে পরে সুফিয়ান। রোদেলা ধীর পায়ে ওর কাছে যায়, কাঁধে হাত রাখে সুফিয়ানের। ছেলেটা কাঁদছে হয়তো।

সব হারিয়ে মানুষ যখন নিঃস্ব মনে করে নিজেকে, আর খোদা তখন দু হাত ভরিয়ে দেয়, তখন বোধহয় এমনি হয়।

কিছু সময় পর রোদেলা মাটিতে হাটু গেঁড়ে বসে, বলে-
: আমি আপনাকে হারাতে চাই না সুফিয়ান,
মুখ তুলে তাকায় সে-
রোদেলা হাতদুটো বাড়িয়ে দেয় ওর দিকে, শার্টের হাতায় চোখ মুছে মুচকি হাসে সুফিয়ান। বাক্সটা খুলে চুড়ি দুটো পরিয়ে দেয় এক এক করে….
রোদেলা বলে-
: আমি আজ আপনার হলাম সুফিয়ান…
স্মিত হেসে সুফিয়ান বলে-
আমিও তোমার হলাম…
: আপনার ফ্লাইট কয়টায়
: সাড়ে দশ… কিন্তু আমার যেতে ইচ্ছে করছে না…
: আমারও আপনাকে ছাড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না…
নিচে বসা রোদেলার হাত ধরে চুপ করে অন্য দিকে
তাকিয়ে থাকে সুফিয়ান, অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে হচ্ছে ওর, কিন্তু ভিতরকার অনুভূতিগুলো গুছিয়ে বলা যায় কি…?

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here