#অভিশপ্ত_জীবন
সিজন 2
পর্ব ৫
আমি কোন রকম দরজার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখি রাসেল দাড়িয়ে আছে আর নিশি মাথা নিচু করে, খাটের ধারে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। রাসেল বললো,,
তুমি কি ভেবেছো এইসব করে তুমি সুখি হবে? এগুলো ভুল,, সবাই জানাজানি হলে তোমার সুন্দর জীবন টা নষ্ট হয়ে যাবে। প্লিজ বুঝার চেষ্টা করো।
আমি কি বুঝবো। আমি যা যা করি সবই তো সবার কাছে ভুল হয়। যখন আপনি আর আপা প্রেম করতেন কই তখন তো কেউ ভুল ধরেনি? তাহলে আমার বেলায় এমন কেন?
নিশি তুমি কি সত্যিই এখনো তোমার ভুল বুঝতে পারোনি। তোমার আপার আর আমার বিষয় টা ভিন্ন ছিলো। আর তোমার বিষয় টা ও ভিন্ন। আমি তোমার কোন ক্ষতি চাই না। যা হবার হয়ে গেছে। নতুন করে আর কিছু করো না প্লিজ।
আমি পারবো না ভুলে থাকতে বা ভুলে যেতে। কে মানবে কে মানবে না সেগুলো কে আমি তোয়াক্কা করি না। আমি কার সাথে সুখি হবো তা ঠিক করবো। অন্য কারো সুখের জন্য নিজের সুখ বিসর্জন দেওয়ার মতো মন মানসিকতা আমার নাই।
আর কিছু শোনার মতো অবস্থা আমার নাই। মনে হচ্ছে মাথায় চক্কর দিয়ে উঠলো। যদি আবারও পড়ে যায় তাহলে সাথে সাথে আমার বড় রকম ক্ষতি হবে। প্রাণপণ চেষ্টা করে আবারও বিছানায় আসি। চোখে নোনাপানি গুলো বাঁধ ভেঙেছে।
শুনেছিলাম, আমার মায়ের সন্তান না থাকার জন্য জীবনে অনেক কষ্ট করেছেন। কিন্তু আমার জীবন ভিন্ন গল্পে ধাঁথা হলো। মায়ের জীবন থেকে আমার জীবন সম্পুর্ন বিপরীত হলো।
রাসেল কিছুক্ষণ পরেই ঘরে চলে আসছে। এই মানুষটাকে দেখে কেন যেন গা গুলিয়ে আসছে। কত বিশ্বাস করতাম, কত ভালোবাসায় ডুবিয়ে রাখতাম। কিন্তু পুরুষ মানুষ মানেই বেঈমান,, মাত্র কয়েক মাস অপেক্ষা করতে পারলো না। আমার বোনের জীবন টা তছনছ করে দিলো। আর যে বোন কে আমি ছোট থেকে এতো আদর যত্নে বড় করলাম, মায়ের অভাব পুরোন করতাম সেই বোন কিভাবে পারলো আমার সংসার ভাঙতে।
হয়তো রাসেল ভেবেছে আমি ঘুমিয়ে গেছি তাই আমার গায়ে কম্বল তুলে দিয়ে কপালের পিছনে চুলের উপর চুমু দিয়ে সুয়ে পড়ে। রাসেল নিত্যদিনের এমন ছোট্ট ছোট্ট ভালবাসার কথা গুলো আমার খুব বেশি মনে পড়ছে আজ।
এমন একটা যন্ত্রণা যা না পারছি কাউকে বলতে আর না পারছি সহ্য করতে। তাই আজ মা কে খবর দিলাম, যেন আমাদের বাড়িতে আসে। খবর পাওয়ার সাথে সাথে মা আমাদের বাড়িতে আসে,, মা কিছু বললে টেনশন করবে, এই বয়সে এতো টেনশন সহ্য করতে পারবে না তাই, পরিক্ষার ক্ষতি হবে বলে নিশিকে নিয়ে যেতে বলি। কিন্তু নিশি এতো পরিমাণ রেগে গেলো যা আমি কল্পনাও করতে পারিনি।
মা কে সাফ বলে দিলো, সে এবাড়ি থেকে এখন আপাতত কোথাও যাবে না, দুটো কোচিং এর মাঝখানে আছে এখন। সামনে পরিক্ষা আর এই মুহূর্তে চলে গেলে নতুন কোচিং পাওয়া যাবে না। এমন আরো অনেক কিছু যুক্তি দেখায় নিশি। আমার শাশুড়ী ও নিশির পক্ষে বলে,, নিশিকে তো আমি আমার মেয়ে মনে করি, তার পড়াশোনার ক্ষতি হবে এমন কোন কঠিন কাজ ওকে দিয়ে করাই না।
নিশি ঘরের দরজা আটকে বসে আছে। সবাই চাইছে নিশি এখানে থাকুক তাই আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। বাবাকে বাসায় রেখে এসেছে মা, তাই বিকালে মা চলে গেছে। নিশির সাথে কথা বলা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছি। রাসেল সারাক্ষণ আমার ভিষণ যত্নার্তী করে কিন্তু কেন যেন মনে হয় সব কিছু ছলনা।
রাসেলের ল্যাপটপ নিয়ে বিভোর থাকা টা আমার বিরক্তি শীর্ষে চলে গেছে। তাই খুব কড়া ভাষায় বলি,,তোমার এইসব নোংরামি অন্য ঘরে গিয়ে করো, আমার চোখের সামনে না।
কি হয়েছে তোমার? বেশ কিছু দিন থেকে লক্ষ্য করছি তোমার মেজাজ অনেক খিটখিটে। কোন কিছু নিয়ে মন খারাপ? আমাকে বলো,কেউ কিছু বলেছে তোমাকে??
আমি আরো রেগে বলি,,প্লিজ আমার চোখের সামনে থেকে যাও,, তোমাকে দেখলে আমার ঘিন্না লাগে!!
বলেই হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম। জানি বাকি জীবন আমার এইভাবে কান্না করতে করতে যাবে।
রাতে নিশি আমার জন্য খাবার নিয়ে আসে, ওর হাতের খাবার কে বিষ মনে হচ্ছে আমার। মনে মনে সিদ্ধান্তঃ নিলাম বাচ্চা প্রসবের পরে আমি চিরতরে চলে যাবো।
আজ সারাদিন রাসেল বাসায় নাই। নিশিকেও দেখছি সব সময় ফোন হাতে এ কাজ সে কাজ করছে। আমার ঘর পরিষ্কার করার সময়ও দেখলাম দুই তিন বার ফোন হাতে নিচ্ছে তারপর রেখে দিচ্ছে। চোখের সামনে এইসব কেউ মেনে নিতে পারবে না। নিশিকে বললাম,,
ফোন টা এখন থেকে আমাকে দিয়ে দিস,, আমার ও ফোনের দরকার হয় মাঝে মাঝে। সব সময় তোর থেকে ফোন চেয়ে নিতে আমার খারাপ লাগে। নিশি জবাবে বললো,,
দুলাভাইকে বলে নতুন একটা ফোন কিনে নাও না আপা। আমারও ফোনটা ভিষণ দরকার। কিন্তু আমাকে কিনে দেওয়ার মতো কেউ নাই। তোর তো আছে, তাই তুই নতুন কিনে নে আর এই পুরাতন মাল আমাকে দিয়ে দিস। তোর মতো কপাল ভাগ্য গুনে হয়। আর আমি দেখ, সব সময় পুরোনো কিছুতেই সীমাবদ্ধ ছিলাম। তোর বাদ দেওয়া জামাকাপড় আমাকে পড়তে হতো আগে আর এখন তোর ব্যবহার করা ফোন টা নিচ্ছি।
মনে মনে ভাবছি, হুম আমার ব্যবহার করা সব কিছুতেই তোর ভাগ থাকতো আর এখনো আছে। বিকালের দিকে রাসেল বাড়িতে এসেই নিশিকে ডাকা শুরু করে। তারপর বলে তোমার সাথে কিছু কথা আছে।
কলিজায় কেউ হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করলে যেমন লাগে ঠিক তেমন লাগছে। নিশির ঘরে রাসেল গিয়েছে প্রায় ৩০ মিনিট আগে। এখনো কারো বের হওয়ার নামগন্ধ নাই। ওহ আল্লাহ তুমি আমার মৃত্যু দাও। আর সহ্য হচ্ছে না।
একটু পরে রাসেল আমার ঘরে এসেছে কয়েকটি ব্যাগ হাতে নিয়ে। আমার বউটা কি এখনো আমার উপর রাগ করে আছে? দেখি তো আমার অভিমানী বউয়ের অভিমান গুলো কোথায়? এই দেখো কি কি আনছি তোমার জন্য,, বলেই কয়েকটা ঢিলেঢালা ম্যাক্সি বের করে এবং ছোট মেয়ে বাচ্চাদের পোশাক। তারপর বলে,, আমি চাই আমার দুটো জান্নাতের ফুল হোক। আর ফুল দুটো আমার মিষ্টি বউয়ের মতো শান্ত এবং লক্ষি হবে।
একটা মানুষ কিভাবে এতো অভিনয় করতে পারে? কি মনে করে নিজেকে,, সে বড় অভিনেতা, তার অভিনয় আমি বুঝিনা। আমি রাসেল কে জিজ্ঞেস করলাম,, নিশির সাথে কি নিয়ে কথা বললে এতোক্ষণ?
আমার প্রশ্ন শুনেই রাসেল চমকে উঠেছে। নিজেকে সামলিয়ে বলে,, আরে তেমন কিছুই না, এমনই ওর পড়াশোনার খবর নিচ্ছিলাম।
পড়াশোনার খবর নিতে দরজা বন্ধ করে একা ঘরে, এতোক্ষণ কথা বলতে হয়??
তুমি তো দেখি রেগে লাল হয়ে যাচ্ছো? আমার মিষ্টি বউটা রাগলে টমেটোর মতো দেখায়।তোমার এই রাগি মুখ দেখার জন্য বারবার আমি নিশির সাথে কথা বলবো হাহাহায়া। বলেই আমার প্রশ্ন এড়িয়ে গেলো।
মানুষ কতটা নির্লজ্জ বেহায়া হলে এভাবে কথা বলে তা আমার জানা নেই। তবে এইসব চরিত্রহীনদের সাথে কথা বলে নিজের কষ্ট বাড়ানো ছাড়া অন্য কিছু না। ইদানিং শাশুড়ীও দেখছি নিশির প্রতি খুব যত্নশীল। ডিম সিদ্ধ করে দেয় প্রতিদিন সকালে, রাতে দুধ। সব সময় পড়াশোনার জন্য তাড়া দেয়। নিজের বোনের এমন যত্ন দেখে আমার হিংসা হচ্ছে।
আল্লাহর কাছে বারবার ফরিয়াদ করছি, যেন বাচ্চা প্রসবের সময় আমার মৃত্যু হয়। তাহলে সবার সুখ, আপদ বিদায় হবে দুনিয়া থেকে।
ভর দুপুর বেলা নিশিকে ডাকছি আমি। কিন্তু নিশির কোন পাত্তা নেই। মনে হচ্ছে বাসায় নাই নিশি। বাধ্য হয়ে শাশুড়ী কে বললাম। মা নিশি কোথায় গেছে?
নিশি পাশের পাড়ায় কে যেন ওর সাথে পড়ে তার কাছে গেছে একটু আগেই। এক্ষুনি এসে যাবে। কিছু লাগবে তোমার??
খুব পানির পিপাসা পেয়েছিল কিন্তু কেন যেন এখন আর সেই অনুভূতি নেই। তাই বললাম না মা এমনই ডাকছিলাম। ঠিক তখনই দেখি রাসেল ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে বাসায় আসছে। ঘরে এসে শার্ট খুলেই গোসল করতে চলে যায়। এমনিই সব সময় রাসেল কে সন্দেহ হয় তাই এখনো সন্দেহ হচ্ছে। রাসেলের গোসল শেষ হতে না হতেই নিশিও বাড়িতে এসে হাজির। নতুন করে কি কিছু বুঝার বাকি আছে? যা বুঝার বুঝে নিলাম।
গোসল শেষ করে রাসেল আমার পাশে বসে বলে,, আমার জান্নাতের ফুল গুলো কি করে?
রাসেল আমার পেটে হাত দিতে চাইলে আমি হাত সরিয়ে দিয়ে বললাম,, মনে হচ্ছে দীর্ঘক্ষণ ধরে পরিশ্রম করে আসলে। এতো ক্লান্ত হয়ে ঘেমে বাড়িতে আসলে, এখন একটা শান্তির ঘুম দাও। আপাতত আমার মেয়েদের আদর করতে হবে না। অনেক সময় পাবে তাদের আদর করার।
আর বলো না, বাইরে প্রচুর রোদ, ভেবেছিলাম কুমিল্লা যাবো কিন্তু বাস স্ট্যান্ড এ গিয়ে দেখি বাস নেই তাই চলে আসছি।
মিথ্যা গুলো মনে হয় আগে থেকে ঘুছিয়ে রাখে। কিভাবে পারে এমন অকপটে মিথ্যা বলতে। অথচ এই রাসেল একটা মিথ্যা বলার আগে দশ বার সত্যি টা বলার চেষ্টা করতো। আর মাত্র দুই মাস,, যদি আল্লাহ আমাকে নেই তো ভালো আর যদি কোনো ভাবে বেঁচে যায় তাহলে আমি নিজেই চলে যাবো আল্লাহর কাছে। প্রতিদিন ঘুম ভাঙে এবং ঘুমাতে যায় এই চিন্তা ভাবনা করতে করতে।
আমার অনেক গুলো নোংরা কাপড় জমা হয়ে আছে, পরিষ্কার করা হয় নি। নিশি প্রথমে ওর সব কিছু ধোয়ার পরে আমার ঘরে এসে বলে, আপা তোর কাপড় গুলো অনেক দিন থেকে ধোয়া হয় নি,, দেখি সব ধুয়ে দিই আজ। নিশি আমার নোংরা কাপড় গুছিয়ে নিচ্ছিলো তখন রাসেল এসে বলে,, শুধু বোনের গুলো পরিষ্কার করে দিলেই হবে,, দুলাভাই কে বুঝি চোখে পড়ে না? লোকে বলে, শালী নাকি আধা ঘরয়ালী হয় কিন্তু আমার শালী আমাকে পাত্তাই দেয় না।
আরে দুলাভাই আপনার মতো এমন চকলেট বয় দুলাভাইকে পাত্তা দিলাম না এটা বলতে পারলেন কিভাবে। আপার পরিবর্তে সব দ্বায়িত্ব তো আমিই পালন করে চলেছি তবুও মন ভরে না?
হুম হুম বুঝি বুঝি,, এ-তোই যদি দ্বায়িত্ব পালন করতে তাহলে এই শার্ট নামের মাটির বস্তা নিয়ে ঘুরতাম না। এই নেন,, এখন দয়া করে এগুলো নিয়ে পরিষ্কার করে আমাকে উদ্ধার করুন ছোট গিন্নি!!
আমার সামনে ওদের এমন খুনসুটি কথা গুলো শুনে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। সাধারণ শালী দুলাভাই এইসব কথা বলে ফাজলামো করতেই পারে কিন্তু এদের কথা গুলোর অন্য অর্থ আমার মনে আসছে। সব দ্বায়িত্ব পালন, চকলেট বয়, পাত্তা দেওয়া, ছোট গিন্নি এই কথা গুলো মেনে নিতে পারছি না। দুনিয়ার কোন নারীর যেন এমন যন্ত্রণা আল্লাহ না দেন। জাহান্নামের যন্ত্রণা কতটা ভয়ানক জানিনা কিন্তু আমার কাছে বর্তমানে যে যন্ত্রণার অনুভূতি হচ্ছে তা জাহান্নামের মতো মনে হচ্ছে।
রাসেল তার ময়লা শার্ট প্যান্ট গুলো দিয়ে বাইরে চলে গেছে। নিশি সেগুলো নিয়ে কলপাড়ে পরিষ্কার করছে তার শব্দ পাচ্ছি। জামাকাপড় গুলো নিয়ে যাওয়ার সময় ভুল করে নিশির ফোন আমার বিছানার উপরে রেখে গেছে। যেহেতু ফোনের লক আমি জানি না তাই ফোন টা আর হাতে নিলাম না। কিছুক্ষণ পরেই একটা কল আসে। ভাইব্রেশন হচ্ছে অনেকক্ষন। একটু আগের ঘটে যাওয়া কথোপকথনে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে গেছিলো আমার তাই মনে ছিলো না কার নাম্বার থেকে কল বাজলো তা দেখার কথা। মনে মনে চাইছি অনন্ত আর একবার কল আসুক। ভাগ্য হয়তো আমার পক্ষে আছে আজ, তাই কলটা আবারও আসছে। “”Jan”” লিখে সেভ করা নাম্বার। নাম্বার টা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলাম। এটা তো রাসেলের নাম্বার না?তাহলে কে এই জান? অন্য কেউ? নাকি রাসেল নতুন নাম্বার নিয়েছে আবারও?
এইসব ভাবতে ভাবতে কল কেটে গেলো।
চলবে,,