—“বুবু জানিস কি হয়েছে? পাশের বাসার ভাইয়াটা এলাকার ছেলেপেলেদের নিয়ে একটা ছেলেকে খুব মারছে। আধমরা করে ফেলেছে একদম।”
কথাটা শুনে আঁতকে উঠলো বেলা। এক ছুটে বারান্দার কাছে যেতেই আয়াজ নামক ছেলেটিকে পাশের এলাকার একটা ছেলেকে খুব বাজে ভাবে মারতে দেখলো। সঙ্গে ১৮, ২০ বছরের কিছু ছেলেও দাঁড়িয়ে আছে। আয়াজকে ভাই ডাকে সম্মোধন করছে বারংবার। বেলা অবাক হয়ে বিষয়টা দেখলো। তারা এ এলাকায় নতুন। বাবার ঢাকা থেকে ট্রান্সফার হওয়ায় কুমিল্লায় নিজস্ব বাড়িতে এসেছে কিছুদিন হলো। আয়াজ তাদের পাশের বাড়িতেই থাকে। বেলা কয়েকদিন আগে গিয়েছিল সেখানে। আয়াজের সাথেও ক্ষীণ সময়ের জন্য দেখা হয়েছিল তার। তখন এ ছেলেটির আচরণ কতইনা ভদ্র-সভ্য ছিল। অথচ এখন! কিভাবে রাস্তায় মারপিট করে গুন্ডামি করছে! বিশ্বাসই হচ্ছে না, এই ভদ্র, শান্ত ব্যক্তিটি ভেতরে ভেতরে কি দারুণ উগ্র মেজাজি।
বিহানের কথায় সম্বিৎ ফিরলো বেলার, “আয়াজ ভাইয়াকে কত ভদ্র ভেবেছিলাম, তাই না বুবু? কিন্তু উনি যে এমন, আমি কল্পনাও করিনি।”
বেলা একবার বিহানের দিকে তাকালো। তারপর আবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে আয়াজের মুখপানে স্থির চাহনি নিক্ষেপ করলো। আয়াজ তখন ঘাড় এদিক ওদিক নাড়িয়ে নিজেকে শান্ত করছিল। রাস্তায় জ্ঞানহারা ছেলেটার উদ্দেশ্যে কিছু একটা বলে পাশের ছেলেটির দিকে হাত বাড়ালো সে। সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে আয়াজের হাতে তা ধরিয়ে দিলো ছেলেটি। সিগারেট জ্বালিয়ে আয়াজ আশেপাশে তাকাতে লাগলো। সুদূরে দাঁড়ানোরত বেলা দৃষ্টিগোচর হতেই ভ্রু কুঁচকালো সে। তীক্ষ্ণ, ভয়ংকর লাল চোখ জোড়ার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ভড়লে গেল বেলা। হকচকালো, থমকালো। ভীতু কণ্ঠে বিহানকে তাড়া দিয়ে বললো,
—“ভেতরে চল বিহান। এখানে থাকা নিরাপদ হবে না।”
অতঃপর বেলা বিহানকে নিয়ে ব্যস্ত পায়ে চলে গেল রুমের ভেতর। অথচ আয়াজ তার দৃষ্টি সরালো না। তার ঈগল চোখের সূক্ষ্মতা ওই খালি বারান্দাটাতেই এঁটে রইলো।
_____
বেলার মা প্রভা বেগম বেশ শান্তশিষ্ট মহিলা। কারো সঙ্গে ঝামেলা বিশেষ পছন্দ না উনার। প্রয়োজন হলে তিনি নিজে অপর জনের দোষ মাথা পেতে নিবেন, কিন্তু সে বিষয় নিয়ে বাড়তি দু’কথা বাড়ানো তার স্বভাবে নেই। আবার প্রচন্ড মিশুকও তিনি। কুমিল্লা আসার কয়েকদিনের মাথায়ই পাশের বাড়ির সদস্যদের সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে উনার। আয়াজের মা রেখাও বড্ড মিশুক স্বভাবের। বিহান আর বেলাকে নিজের মেয়েছেলের মতোই আপ্যায়ন করেন তিনি।
দুপুরের খাবার শেষে প্রভা বেগম টেবিল গোছাচ্ছিলেন। বেলা আর বিহান তার ঠিক উল্টো দিকেই সোফায় বসে টেলিভিশন দেখছে। কাজ করতে করতে প্রভা বেগম ডাকলেন,
—“বেলা, শুন। একটা কথা আছে।”
বেলা টিভির পর্দায় চোখ রেখেই উত্তর দিলো,
—“বলো মা।”
—“ওই যে পাশের বাড়ির ভাবী আছে না? পরশু যার বাসায় গেলি?”
—“হ্যাঁ, কি হয়েছে সেখানে?”
মেয়ের জিজ্ঞাসাবাদে প্রবল আগ্রহী হয়ে উঠলেন প্রভা বেগম। কাজ ছেড়ে বেলার দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন। বললেন,
—“উনার মেয়েকে নাকি ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে আজ বিকালে। তোকে যেতে বললো। বিহানকে নিয়ে যাবি?”
বেলার বিরক্ত কণ্ঠ,
—“ওখানে যেয়ে আমি কি করব?”
—“কি করবি মানে? ভাবী কত অনুরোধ করলো। তোকে উনি মেয়ের মতোই দেখে। আমি উনার অনুরোধ কিভাবে ফেলি?”
টিভি দেখে চোখ সরালো বেলা। কণ্ঠে বিরক্তির রেশ আরও বাড়িয়ে বললো,
—“উনার মেয়েকে দেখতে আসছে মা। উনার মেয়ে থাকলেই তো হলো। আমার দরকার কি সেখানে? তাছাড়া যদি উনার মেয়ের জায়গায় ছেলে আমাকে পছন্দ করে ফেলে, তখন কি করবে?”
প্রভা বেগম খুশি হয়ে বললেন,
—“তাহলে তো আলহামদুলিল্লাহ। এ ফাঁকে তোর বিয়েটাও হয়ে যাবে।”
বেলার বিরক্তি আরও এক কদম চড়ে গেল। মাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে বললো,
—“তুমি তোমার আজগুবি কথা বন্ধ করবে? পাত্রপক্ষ যাওয়ার পর আমি যাবো, যাও।”
প্রভা বেগম তবুও দিরুক্তি করলেন। কিন্তু বেলা শুনলো না। ঠিকই বিকালের পর অর্থাৎ সন্ধ্যা হওয়ার একটু আগে গেল ও বাড়ি। বাড়িটিকে অল্পস্বল্প বিয়ে বাড়িই মনে হচ্ছিল। বেলা দুরুদুরু বুকে বিহানকে নিয়ে ড্রইংরুমে প্রবেশ করলো। এখানে আসার তার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে ছিল না। বিশেষ করে ওই আয়াজ নামক ছেলেটির জন্য। মনে মনে প্রার্থনা করলো, আয়াজের সাথে যেন তার দেখা না হয়।
রেখা বেলাকে দেখে এগিয়ে এলেন। বিহানের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
—“তোমরা এখন এলে যে? বিকালে এলে না কেন? আমি তো ভাবলাম আর আসবেই না।”
বেলা মিথ্যে বললো,
—“আসলে একটু কাজ ছিল তো আন্টি।”
রেখা অতটা গুরুত্ব দিলেন না সেকথায়। বেলাকে সোফায় বসিয়ে উৎফুল্ল মনে বললেন,
—“আমার আরুকে ছেলেপক্ষ পছন্দ করেছে বুঝলে? কয়েকদিন পর আকদ ওর। এরপর আরুর পরীক্ষা শেষে অনুষ্ঠান করে উঠিয়ে নিবেন। তুমি তো ছেলেকে দেখো নি, তাই না? দাঁড়াও আমি ছবি দেখাচ্ছি।”
বলে তিনি ফোন থেকে ছবি বের করতে ব্যস্ত হয়ে পরলেন। বেলা মৃদু হাসার চেষ্টা করলো। মনে মনে ভাবলো, রেখা আন্টি অনেকটা তার মায়ের মতোই। অত্যাধিক মিশুক। বেলা এবার আরুর দিকে তাকালো। রেখার ছোট মেয়ে। চাচাতো, মামাতো ভাই-বোনেরা ঘিরে ধরেছে তাকে। আরুও বেশ হেসে হেসে কথা বলছে তাদের সঙ্গে। আরু হতে নজর ফিরিয়ে বেলা বিহানকে খুঁজতে লাগলো। এখানে আসার পরপরই ছেলেটা তার বয়সী ছোট্ট সৈন্যদের পেয়ে কোথায় যে চলে গেছে! বেলা দেখতেও পায় নি। বাম দিকের জায়গাটাতে একটু খোঁজাখুঁজির অভিযান চালাতেই হঠাৎ আয়াজকে দেখতে পেল বেলা। হৃদযন্ত্র যেন সেখানেই ক্ষণিকের জন্য থমকালো। আঁখিজোড়া বিরক্ত হলো ভীষণ। আয়াজ এদিকেই আসছে। বেলার কাছাকাছি আসতেই মুচকি হেসে বেলাকে জিজ্ঞেস করলো,
—“কেমন আছো বেলা? তোমার পিচ্চি ভাইটা কোথায়?”
বেলা আয়াজের এত সুন্দর ব্যবহার দেখে আবারও অবাক হলো। এ ছেলে আসলে কি? বাড়ির সামনে মারপিট করে এখন আবার সাধুসন্ন্যাসী সেজে ঘোরাফেরা করছে। রাগ হলেও বেলা আয়াজের মতো হেসেই অকপটে বললো,
—“ভালো আছি ভাইয়া। বিহান বোধহয় ওদিকটায় খেলছে।”
জবান শুনে হালকা মাথা দোলালো আয়াজ। ফের রেখাকে বললো,
—“ভাইকে দেখেছ মা? বাগানে তো দেখছি না।”
রেখা ফোন ঘাটতে ঘাটতে জবাব দিলেন,
—“এই তোর কাছে আরুর হবু বরের ছবি আছে না? ওকে একটু দেখা তো। আমি খুঁজে পাচ্ছি না। আর আদ্র তো দোকানে গেছে মনে হয়।”
বলে একটু থামলেন তিনি। সামনের দিকে তাকাতেই আবার বলে উঠলেন,
—“ওই তো, আদ্র এসে গেছে।”
রেখার ইশারাকৃত জায়গায় আয়াজের পাশাপাশি বেলাও তাকালো। এবার যেন আগের চেয়েও বেশি চমকালো সে। বিস্ফোরিত নয়নে চেয়েই রইলো। হৃদযন্ত্রের আওয়াজ বাড়ছে, ধুকধুক শব্দের গতি নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে গেছে। আয়াজের মতো দেখতে আরও একটি মানুষ দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে। মুখে বিরক্তিভাব। দৃষ্টি বেলার আতঙ্কিত মুখশ্রীর পানে।
বেলার শরীর ঘামছে। নিশ্বাস ভারী হচ্ছে। আটকে আসা কণ্ঠে বহুকষ্টে রেখাকে সে জিজ্ঞেস করলো,
—“আমি এসব কি দেখছি আন্টি? আয়াজ ভাইয়া তো আমার পাশে। উনি ওখানে গেলেন কিভাবে?”
রেখা একটু থতমত খেয়ে বললেন,
—“ওটা আয়াজ না বেলা। ও তো আমার আরেক ছেলে আদ্র।”
বেলার অস্থিরতা কমলো না। আস্তে আস্তে চোখ বুজে এলো।
________________
চলবে~
প্রিয় বেলা
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
সূচনা পর্ব