হৈমন্তীকা
১৬.
নাওয়াজ সুঠাম দেহের অধিকারী। খানিক সুদর্শনও বটে। শ্যামবর্ণ গায়ের রঙ। তীক্ষ্ণ চোখে সামনে তাকানোর পাশাপাশি হৈমন্তীকে বার দুয়েক আড়চোখে দেখেছে সে। সেদিকে একদম খেয়াল নেই হৈমন্তীর। সে রিকশার কোণ ঘেঁষে বসে আছে। দমকা হাওয়ায় বারবার পরে যাওয়া ঘোমটাটি কপাল অব্দি ঢেকে নিলো সে। তীব্র অস্বস্তিতে আরেকটু চেপে বসল। তা দেখে নাওয়াজ নরম গলায় বললো,
— “আরেকটু হলেই তো পরে যাবে হৈমন্তী। এদিকে চেপে বসো। আমরা তো যথেষ্ট দূরত্বেই বসে আছি।”
সরাসরি বলায় হালকা লজ্জা পেল হৈমন্তী। জোড়ালো হেসে বললো,
— “সমস্যা নেই। আমি ঠিক আছি ভাইয়া।”
— “কই ঠিক আছো? আমি তো দেখছি রিকশা একটু টোকা খেলেই রাস্তায় পরে যাবে।”
কথাটা মন্দ বলে নি নাওয়াজ। সত্যিই আরেকটু হলে নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে পরে যেতে পারে সে। তাই আর কথা বাড়ালো না হৈমন্তী। অল্প দূরত্ব ঘুচিয়ে বসল। তবে প্রতিউত্তরে কিছু বললো না। নাওয়াজ ক্ষীণ সময়ের জন্য চুপ থেকে আবার বললো,
— “তোমার কি ধরণে বাসা পছন্দ হৈমন্তী? আমি সে হিসেবে তোমাদের জন্য বাসা খুঁজবো।”
— “আমি কি বলবো? আপনিই ভালো জানবেন।”
— “তবুও… বলো।”
হৈমন্তী আনমনে খোলা আকাশের দিকে চাইলো। মুক্ত বাতাসে প্রাণভরে নিশ্বাস নিয়ে বললো,
— “বাসাটা যেন খোলামেলা জায়গায় হোক। আমার রুমে যেন একটা বিশাল বড় বারান্দা থাকুক। যেখানে দাঁড়িয়ে আমি প্রকৃতি বিলাশ করতে পারবো। রাতে জ্যোৎস্নায় স্নান করতে পারবো। এই যে, এভাবে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেব।”
কথাগুলো বলার সময় বিস্তর হাসি ফুটে উঠে তার অধরযুগলে। সেদিকে স্থির দৃষ্টি মেলে নাওয়াজ প্রশ্ন ছুড়লো,
— “তুমি প্রকৃতি প্রিয় মানুষ, তাই না?”
— “হ্যাঁ।”
বলে নাওয়াজের পানে মুচকি হেসে তাকালো হৈমন্তী। পরক্ষণেই নাওয়াজের হঠাৎ বলা প্রশ্নে হকচকালো সে। বিরক্ত হলো ভীষণ।
— “আমি শুনেছি তোমাকে নাকি তোমার চেয়ে বয়সে ছোট একটা ছেলে বিরক্ত করে? এজন্যই বাসা ছাড়ছ তোমরা?”
হৈমন্তী প্রথমে ভাবলো, জবাব দেবে না। তারপর আবার ভাবলো, জবাব না দেওয়ায় যদি অভদ্র ভাবে? ছোট্ট করে সে উত্তর দিলো, “না।”
— “তাহলে আঙ্কেল যে বললেন?”
প্রশ্নাত্মক চাহনি নাওয়াজের। হৈমন্তীর বিরক্তির মাত্রা বাড়লো। বাবা উনাকে এসব কথাও বলে দিয়েছেন? কি দরকার ঘরের কথা বাহিরের মানুষকে বলার? অসন্তুষ্টিতে চোখ, মুখ কুঁচকালো সে। ক্ষীণ আওয়াজে বললো,
— “জানি না আমি।”
_____
আজ সারাদিন তুষারের দেখা মেললো না। ভার্সিটিতেও কোথাও দেখতে পায় নি হৈমন্তী। আজ কি তবে তুষার আসে নি? মনে মনে নিজেকে জিজ্ঞেস করতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। ছেলেটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিনের জ্বালাতন করাটা এক অদৃশ্য মায়ায় ফেলছে তাকে। হৈমন্তীর দীর্ঘশ্বাসগুলো জড়ো হতে লাগলো। অতি সন্তপর্ণে সেগুলো বেরিয়ে আসতে দিলো সে। কঠিন ভাষায় নিজেকে শাসাল, “পাগল হলি তুই হৈমন্তী? যার জন্য তোর বাবাকে অপমান হতে হয়েছে, তাকে নিয়ে ভাবছিস? লোকে কি বলবে? তোর বাবার মনটা ভেঙ্গে যাবে না?”
মুহুর্তেই নিজের অনুভূতিকে সুদূর ছুড়ে মারলো সে। প্রশ্রয় দিলো না। রিকশা খুঁজতে গিয়ে দেখল, রাস্তায় আজও রিকশা চালকের হর্তাল। তাদের ঘোর আন্দোলন চলছে ব্যস্ত থাকার, অন্যদেরকে তাদের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার। শুধু হৈমন্তীর বেলায়ই তারা ব্যতিক্রম। নিরুপায় হয়ে বাসে উঠল সে। জানালার পাশের সীটে আগে থেকেই একটা ছেলে বসে ছিল। এই ক্লান্ত শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকাও সম্ভব না। অগত্যা, ছেলেটির পাশেই বসল সে। কোলাহলপূর্ণ যান্ত্রিক যানবাহনটি পর পর দুটো স্টপে এসে থামলো। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর যখন তৃতীয় তম স্টপে বাসটি থামলো, বাসের দরজা দিয়ে তুষারকে ঢুকতে দেখলো হৈমন্তী। ভড়কে গেল। চোখ বড় বড় করে তাকালো।
তুষারের মুখে রাজ্যের বিরক্তি। আজও পাঞ্চাবী পরেছে সে। ছাই রঙা পাঞ্চাবীটি ফর্সা শরীরে কি দারুণ মানিয়েছে! তুষার হৈমন্তীর দিকে এগিয়ে এলো। এসেই পাশের সীটের ছেলেটিকে সরাসরি বললো,
— “ভাইয়া, সামনে একটা সীট খালি আছে। আপনি ওখানে গিয়ে বসুন।”
ছেলেটা হেডফোন কানে গান শুনছিল। তবুও কিভাবে যেন গানের একেকটা সুর, কথা স্পষ্ট শোনাচ্ছিল কর্ণকুহুরে।
‘তোমার হৃদ মাঝারে রাখিব।
ছেড়ে দেব না।
ওরে ছেড়ে দিলে সোনার গৌড়
আর তো পাবো না।
তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিব।
ছেড়ে দেব না..’
ছেলেটা হেডফোন কান থেকে খুললো। আঞ্চলিক ভাষার টানের সহিত প্রশ্ন করলো,
— “জি? কিছু বলছেন?”
— “আপনি সামনের সীটে গিয়ে বসুন।”
— “আশ্চর্য! কেন?”
খানিক উঁচু গলা ছেলেটির। তুষার চোখে মুখে বিরক্তির রেশ ছিটিয়ে গম্ভীর স্বরে আওড়ালো,
— “আপনার পাশের মেয়েটি আমার বউ। তাই অন্য সীটে বসুন। আমি ওর সাথে বসব।”
ছেলেটি ভ্রু কুঁচকে তাকালো। হৈমন্তীর দিকে একবার তাকালো। হৈমন্তীরও একই অবস্থা। কপাল অতিরিক্ত কুঁচকানো। চেহারায় বিস্ময় ভাব। লোকটি আবার তুষারের দিকে তাকালো। ক্ষীপ্ত স্বরে বললো,
— “আপনার বউ হইলে নিয়া যান। আমি আমার সীট ছাড়ব কেন?”
তুষারের আঁখিজোড়া তীক্ষ্ণ হলো। সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ করে নিলো ছেলেটিকে। হৈমন্তীর দিকে না তাকিয়ে কঠিন আদেশের সঙ্গে বললো,
— “উঠুন হৈমন্তীকা।”
কণ্ঠে ধমকের রেশ। হৈমন্তী দাঁড়িয়ে গেল। তুষার এবার সত্যি সত্যি ছেলেটিকে ধমক দিয়ে উঠলো, “জায়গা দিন।”
হ্যাংলা, পাতলা ছেলেটি মুখ বাঁকালো। কি যেন বিড়বিড় করে জায়গা দিলো হৈমন্তীকে। হৈমন্তী পা বাড়ানোর আগেই তার হাত ধরে বাস থেকে নেমে গেল তুষার। ফুটপাত ধরে দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে তীব্র ঝংকার তুলে বললো,
— “বেয়াদব ছেলেটার সঙ্গে বসেছিলেন কেন? আর সীট ছিল না? বাসেই উঠতে হবে কেন?”
হৈমন্তী হাত ছাড়াতে চাইলো। কাঠকাঠ গলায় জবাব দিলো,
— “রিকশা পাই নি।”
তুষার হাতে বাঁধন শক্ত করে বললো,
— “তবে সিএনজি নিতেন। কিংবা আমাকে বলতেন। ওই ছেলের সাথেই কেন বসবেন? হারামিটা কিভাবে আপনার দিকে তাকাচ্ছিল খেয়াল করেছেন?”
__________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা