হৈমন্তীকা
২৫.
দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে হৈমন্তী। কান্নার ক্ষীণ শব্দ কাঁপিয়ে তুলছে পুরো করিডোর। কেঁপে কেঁপে উঠছে শরীর। তুষার পাশেই নীরব হয়ে বসে আছে। গম্ভীর নজরে চেয়ে চেয়ে দেখছে তার হৈমন্তীকাকে। সময় একটু পার হতেই কান্নার দমক অল্প কমলো। তবে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে হৈমন্তীর। ঘনঘন নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে সে। চোখ দু’টো কেমন ফুলে গেছে। নাকে রক্তিম আভা। তুষার দূরত্ব কমালো। স্বস্নেহে গাল দুটো মুছে দিতেই তা আবারও পানিতে ভিঁজে গেল। সে আবারও মুছে দিলো গাল। মুখ এগিয়ে কপালে অধরযুগল ছোঁয়াতেই ছিটকে সরে গেল হৈমন্তী। থেমে থেমে বললো, “ছুঁবেন— ছুঁবেন না আমাকে!”
তুষার ভ্রু কুঞ্চিত করলো। তবে কোনোরুপ প্রশ্ন ছুড়লো না। নিশ্চুপ হয়ে হৈমন্তীর অদ্ভুদ আচরণের মানে খুঁজতে লাগল। হৈমন্তীর ফুঁফানোর শব্দ বাড়লো। একহাতে পরনের জামা খামছে ধরে হাহাকার করে উঠলো,
— “আপনি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল তুষার! আমার ভুল, আপনার সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা বলা। আমার ভুল, আপনাকে ছোট ভাবা। শুধুমাত্র আপনার জন্য আমার আগের হাসি-খুশি জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে। আমার বাবা আমাকে দেখতে পারেন না। মা কথায় কথায় এখন আর বকেন না। বাবা মা থাকতেও আপনি আমাকে এতিম করে দিলেন তুষার। যন্ত্রণায় ভেতরটা ধ্বংস করে দিলেন। আমি প্রতিনিয়ত আপনার জন্যে কাঁদছি। এত— এত কষ্ট কেন দিচ্ছেন আমাকে তুষার? চলে যান না আমার জীবন থেকে। প্লিজ!”
তুষারের মুখশ্রী শক্ত হয়ে এলো। বক্ষস্থলের ভারি ভাবটা উপচে আসতে চাইলো যেন! অনড় দৃষ্টিতে হৈমন্তীর মুখপানে তাকিয়ে রইল সে। চোখের কোণাংশ ক্ষীণ কেঁপে উঠতেই উঠে দাঁড়ালো তুষার। একপলক হৈমন্তীকে দেখে গটগট পায়ে চলে গেল করিডোর থেকে। সঙ্গে সঙ্গে হৈমন্তীর ভরসার স্থানটা ফাঁকা হয়ে গেল। শূণ্যতায় ভরে উঠল মন, মেজাজ, মস্তিষ্ক। সে কাঁদল। খুব করে কাঁদল। কেউ এলো না বলতে, “হৈমন্তীকা, আর কাঁদবেন না। আমার ভালো লাগে না।”
নিজেকে একটু সামলাতেই হৈমন্তীর কান্না পুরোপুরি থেমে গেল। মেঝের দিকে দৃষ্টি ফেলে কি যেন ভাবতে লাগলো সে। ততক্ষণে আসরাফ সাহেবের সঙ্গে কথা মিটিয়ে কেবিন থেকে মাত্র বেড়িয়েছে নাওয়াজ। হৈমন্তীকে একা বসে থাকতে দেখে তার পাশে গিয়ে বসল। হৈমন্তীর ফোলা চোখ,মুখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে একটু সময় নিয়ে বললো,
— “কেঁদেছ হৈমন্তী? আঙ্কেল রাগের মাথায় বকেছেন তোমাকে। তাই বলে কান্না করবে?”
হৈমন্তী উত্তর দেয় না। নাওয়াজকে তার পছন্দ নয়। একদম শুরু থেকে। এই পরিস্থিতে তো আরও অসহ্য লাগছে। নাওয়াজ আবার বললো,
— “আঙ্কেল যখন বলেছে তৈমুরের সাথে যোগাযোগ না রাখতে, তাহলে কেন রেখেছ? তাছাড়া শুনেছি তোমাদের বাসায়ও এসেছিল নাকি! তাও আবার আঙ্কেলের সামনে। মানতে হবে, ছেলেটার সাহস আছে কিন্তু!”
বলে হু,হা করে হাসতে লাগল নাওয়াজ। হাসতে হাসতে একসময় একদম চুপ হয়ে গেল। ম্লান স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
— “ছেলেটার সঙ্গে যোগাযোগ কেন রাখছো হৈমন্তী?”
হৈমন্তী শক্ত গলায় জবাব দেয়,
— “আপনাকে ভাবতে হবে না আমাকে নিয়ে।”
— “আমাকে ভাবতে হবে হৈমন্তী। তোমাকে পাওয়ার একটুখানি সুযোগ এখনো আছে আমার।”
বিরক্তিতে কপাল কুঁচকালো হৈমন্তী। রোষপূর্ণ গলায় বললো, “আপনি যান তো এখান থেকে। আপনাকে বিরক্ত লাগছে আমার।”
নাওয়াজ যেন একটু অবাকই হলো। থম মেরে বসে রইলো আরও কিছু সময়। পরপরই ধীরস্থির পায়ে চলে যেতে লাগল। যাওয়ার আগে মৃদু স্বরে বলে গেল,
— “নিজের খেয়াল রাখবে। আসছি।”
হৈমন্তী বোধহয় শুনলো না। কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া দেখালো না।
_____
চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকতে থাকতে কখন ওভাবেই ঘুমিয়ে পরেছে, খেয়াল নেই হৈমন্তীর। যখন ঘুম ভাঙলো, তখন প্রায় বিকালের শেষভাগ। গোধুলি লগ্ন। চোখ মেলতেই নিজেকে কারো প্রশস্ত বুকে আবিষ্কার করলো হৈমন্তী। তৎক্ষণাৎ খেয়ালে এলো, কানের কাছে হৃদপিন্ডের ঢিপঢিপ শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে। হৈমন্তী মাথা উঁচিয়ে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে তুষারের ক্লান্ত মুখখানা ভেসে উঠল সামনে। একহাতে চা খেতে খেতে, অন্যহাতে হৈমন্তীকে আগলে রেখেছে। হৈমন্তী একটু নড়াচড়া করতেই তাকে ছেড়ে দিলো সে। চায়ে এক চুমুক দিয়ে তা একপাশে রেখে দিলো। তবে হৈমন্তীর দিকে তাকালো না। অন্যদিকে চেয়ে গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন ছুড়লো,
— “দুপুরে খাবার পাঠিয়ে ছিলাম। খান নি কেন?”
হৈমন্তীর মনে পরলো, দুপুরের দিকে হেমন্ত তাকে একটা খাবারের প্যাকেট দিয়ে গিয়েছিল। সে খায় নি। ওই যে, তিনহাত দূরের চেয়ারে এখনো রাখা আছে প্যাকেটটি। হৈমন্তী সেদিকে একবার তাকালো। ঢিমে যাওয়া স্বরে বললো, “ইচ্ছে করে নি।”
সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালো তুষার। চেয়ার থেকে খাবারের প্যাকটটা উঠিয়ে প্রবল শক্তিতে ছুঁড়ে মারলো ডাস্টবিনে। মৃদু মৃদু শরীর কাঁপছে তার। রাগে কিছু ভাঙ্গতে ইচ্ছে করছে। বড় বড় শ্বাস নিয়ে মুহুর্তেই নিজেকে আবারও আগের মতো শান্ত করতে চাইলো সে। কিন্তু হচ্ছে না। সশব্দে আগের জায়গায় বসলো তুষার। উঁচু গলায় আওড়ালো,
— “আমার রাগ কমছে না হৈমন্তীকা। আমার রাগ কমিয়ে দিন।”
হৈমন্তী নির্বিকার রইলো। চুপচাপ দেখতে লাগল তুষারের কান্ড। তার বুক ভীষণ ভাবে উঠা-নামা করছে। এক একেকটা নিশ্বাসের শব্দ খুব করে শুনতে পাচ্ছে হৈমন্তী। তুষার আবার বললো, “কিছু করছেন না কেন? আমার রাগ বাড়ছে।”
সে আগের মতোই চুপ। আস্তে ধীরে অনেক্ষণ লাগিয়ে তুষারের হাতটা নিজের হাতে মুঠোয় নিলো। জলে উজ্জ্বল চোখ জোড়া থেকে এক ফোটা পানি তুষারের হাতের পিঠে পরতেই আটকে আসা কণ্ঠে বললো,
— “আমি অনেক, অনেক ভেবেছি! আমার মনে হয় আমি বোধহয় আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি তুষার। তাই সুযোগ দিচ্ছি। সবাইকে মানানোর দায়িত্ব দিচ্ছি। কিন্তু যদি ব্যর্থ হন, তবে হৈমন্তীকাকে ভুলে যেতে হবে আপনার।”
হৈমন্তী থামলো। তুষার অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে। এখনো বুঝে উঠতে পারে নি কথাগুলো। শুধু হাতের বাঁধনটুকু ভীষণ শক্ত করে ধরে রেখেছে। এ ভেবে, এই হৈমন্তীকা যদি স্বপ্ন হয়? কথাগুলো যদি মিথ্যা হয়?
_________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা