তুমি বললে আজ – পর্ব ১

0
2004

.
“এতই যখন ছেলেদের পে/ট দেখিয়ে বেড়ানোর ইচ্ছা জাগে তাহলে শাড়িটা এভাবে না পেচিয়ে আঁচলটা ফেলে রাখলেই হয়।”

কানের একদম নিকটে এসে কথাটা শুনেই আমার অন্তরাত্মাটা হু হু করে কেঁপে উঠলো। গলা শুকিয়ে গেল হঠাৎ করেই। পিছনে তাকিয়ে সেই কণ্ঠের মানুষটাকে দেখার সাহসটা আর হলো না। কারণ আমি তো জানি, কে এই মানুষটা? কিন্তু কেনই বা কথাটা বললো? সবার ভাষ্যমতে আমার ছোট মস্তিষ্কে মেলাতে পারলাম না কথার মানেটা। ভারী কণ্ঠে দাঁতে দাত চে*পে আবারও বলে উঠলো,

“হ*ট সে*ক্সি শোনার তো খুব ইচ্ছা জাগছে মনে? তাহলে বু/কে/র আঁচলটা জ/ড়ি/য়ে কি লাভ? আঁচলটা ফেলে দিয়ে শুধু ব্লাউজটা রাখলেই হতো। বেয়াদব!”

এবার রীতিমতো খুব করে কান্না পাচ্ছে আমার। এখন কিছুটা আন্দাজ করতে লাগলাম কথাগুলো কেন বললেন? আপুর গায়ে হলুদের হাসি ঠাট্টার মুহূর্তে যে এভাবে ফট করে নিভে যেতে হবে আমাকে ভাবতেও পারি নি।

আজ আমার বড় চাচার বড় মেয়ে রিমি আপুর গায়ে হলুদ। সেখানেই হৈ-হুল্লোড়েরে মেতে ছিলাম। হলুদে মেয়েরা সবাই কমলা ও সবুজ রঙের মিশ্রণে শাড়ি পরেছে আর ছেলেরা গাড়ো সবুজ পাঞ্জাবি। মুখের সাজ বলতে কিছুই নেই আমার তবুও কেন জানি দেরি হয়ে গেল। বাসার সাইডে ফাঁকা জায়গা আছে, সেখানেই আপুর হলুদের প্রোগ্রাম করা হচ্ছে। এসে দেখি সবাই লাইন করে দাড়িয়েছে। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম ফটোসেশান করার জন্যই এমন করে দাঁড়াতে হয়েছে সবার। আমি ও বড় চাচার ছোট মেয়ে রিফাপু আসতেই একটা লাল ওড়না ধরিয়ে দিলো আমাদের হাতে। ওড়নাটার মাঝে রিমি আপুকে নিয়ে আমি ও রিফাপু সামনে আর আমার আরও দুটো চাচাতো ফুপাতো বোন পিছনে দাড়ালো। অনেক হাসি মজা করেই ফটোসেশান করতে করতে আপুকে টেজে আনা হলো। তারপর তত্ত নিয়ে একে একে যেতে হবে সামনে। আমার বাকী চাচাতো ফুপাতো বোনেরা ও আপুর বান্ধবীরা সবাই সামনেই দাড়ানো ছিলো। এদিকে দেরিতে আসায় আমি আর রিফাপু রয়ে গেলাম পিছনে। তত্ত্বের ডালাটা হাতে দিয়ে রিফাপু আমাকে নিজের সামনে দাঁড়িয়ে দিয়ে পিছনে দাড়ালো সে। দূর থেকে কিছু ছেলে বাজে ভাবে তাকাচ্ছিলো আমাদের দিকে। বুঝতে না পারলোও তাদের বাজে বাজে কথাগুলো ঠিকই শুনতে পারছিলাম। তবুও চুপচাপ দাঁড়িয়েই ছিলাম। তারপর ঠিক কিছু সময় পরেই গম্ভীর গলার সেই কথাটা শুনেই চমকে গেছি।

এই ব্যাক্তিটির তো এখানে আসার কথা ছিলো না। তাহলে কোথায় থেকে এভাবে ওনার আবির্ভাব ঘটলো? এই লোকগুলোকে কিছু না বলে আমাকে কেন এত বা/জে কথা বলছেন উনি? ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে সেই আমাকে অপমান করার জন্যই পরে থাকেন বজ্জাত লোকটা। আজকেও এতগুলো মানুষের মধ্যে ছাড়লো না আমাকে। ভেবেই চোখগুলো ভিজে ভিজে উঠছে। আমার ভাবনা গুলোকে দূরে টেলে ফেলার জন্য রিফাপুর আগমন ঘটলো। আস্তে করে বলে উঠলো,

“বনু, তোর কোমর বিছাটা কোমরে নেই, পড়ে গেছে হয়তো।”

আরেক দফা চমকে উঠলাম আমি। এতক্ষণে এই অদ্ভুত বজ্জাত লোকটার কথার মানে গুলো বুঝতে পারলাম খুব ভালো ভাবেই। বাঙালি স্টাইলে শাড়িটা পড়েছিলাম, তাতে পে*টের শতভাগ অংশই দেখা যাচ্ছিলো। তাই পেট বের হওয়া থেকে বাঁচার জন্য কোমর বিছা দিয়ে ভালোভাবে আঁটকে দিয়েছিলো আপু। কিন্তু এত হাসি মজার মাঝে কখন যে কোমর থেকে বিছাটা পড়ে গেছে বুঝতেই পারি নি। ছলছল চোখে রিফাপুর দিকে তাকালাম। চোখ দিয়েই বোঝালাম ‘এই তোমার এই বজ্জাত ভাইয়ের থেকে আমাকে আজকের মতো বাঁচিয়ে নেও’। আপুও চোখের ইশারায় বোঝালো ‘বাঁচতে চাইলে যত তারাতাড়ি সম্ভব এখান থেকে কে*টে পর’। সহসায় রিফাপুর হাতে ডালাটা দিয়ে দু’হাতে শাড়িটা নিয়ে আঁকড়ে ধরলাম পেটে। পিছনের মানবের মনোভাব বোঝার জন্য একটু ফিরতেই আমার ডান কাঁধটা ওনার বুকে গিয়ে ঠেকলো। তড়িৎ গতিতে কেঁপে উঠলাম আমি। যতটুকু সাহস সঞ্চয় করেছিলাম সেটাও কর্পূরের ন্যায় ফুস করে উঁড়ে গেল যেন। শাড়িটা দিয়ে কোনভাবে পেটটা দু’হাতে আঁকড়ে ধরে এক প্রকার দৌড়েই চলে আসলাম সেখান থেকে।

.
রুমে এসে বিছানায় বসে বসে চিন্তা করতে লাগলাম, এই অদ্ভুত বজ্জাত লোকটার তো আসার কথা তো ছিলো না। পড়াশোনার চাপে নাকি আজকে আসা সম্ভব না, তাহলে হঠাৎ করে আসলেই বা কেন? ওনার না আসার কথাটা শুনে মুখে না বললেও মনে মনে কতটা যে খুশি হয়েছিলাম, তা কাউকে বলে বোঝাতে পারবো না। কিন্তু আমার সেই খুশিতে তিনি স্বযত্নে এক বালতি পানি ঢেলে দিলেন। আমার তো আগেই বোঝা উচিত ছিলো ওনাকে ছাড়া আমাদের পরিবারের প্রতিটা ফাংশন অসম্পূর্ণ। বড় বাবা , বড়মা, আব্বু আম্মু সহ পরিবারের প্রতিটা মানুষ ওনাকে ছাড়া কিছুই বোঝেন না।

তাশরিফ রওনাফ তাসফি। বড় চাচা ও আব্বুর একমাত্র আদরের ছোট বোনের একমাত্র ছেলে। আর আমার একমাত্র যমদূত।
আমার এই ১৮ বছর বয়সেও তিন ভাইবোনের মাঝে বা মা, বড়মাও ফুপির মাঝে কোন মনোমালিন্য হতে দেখি নি। দাদু মা*রা যাবার পর বড় চাচাই আব্বু ও ফুপিকে সামলিয়েছে। বড়মাও যোদ্ধার মতো টিকে রেখেছে সংসারটা। ফুপি ছোট হলেও আগে ফুপির সংসারটা গুছিয়ে দিয়ে তারপর পর আব্বু বিয়ে করেন। আম্মুও নিজের করে নেন এই সংসারটা। রিমি আপুর কয়েক মাসের বড় তাসফি ভাইয়া। তাদের পরেই নাকি আমার এক ভাই পৃথিবীতে এসেছিলো, কিন্তু কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে আবারো চলে যেতে হয়েছিলো তাকে। তারপর বড়মার কোলে আসে রিফাপু। তার বছর তিনেক পর অনেক জল্পনা কল্পনার পরেই নাকি আমি পৃথিবীতে আসি।

এসব কিছুই দাদী, বড়মা, আম্মু, ফুপি রিমি আপুর মুখে শোনা। বিশাল এক জনগোষ্ঠীর পরিবার হলেও পরিবারের ছোট মেয়ে বলা চলে আমাকে। বিশাল জনগোষ্ঠীর পরিবার বলছি তার কারণ হলো দাদুরা সবগুলো ভাই ছিলেন বড় চাচা ও আব্বুর মতো জয়েন ফ্যামেলির। তিন ভাই ছিলেন তারা, তাদের মধ্যে দাদুই ছিলেন সবার ছোট। ছোট দাদীকে বিয়ে করে পরিবারে আনার পর থেকেই নাকি ছোটোখাটো ঝামেলা চলতো নাকি পরিবারে। তারপর থেকেই খন্ডে খন্ডে আলাদা হয়ে যায় সবাই। দাদু মা*রা যাবার পর বড় চাচা ও আব্বু আমাদের আলাদা হওয়া ছোট পরিবার নিয়ে চলে আসেন শহরে। মাঝে মাঝে গ্রামে গেলেও শহরেই সবার বেড়ে ওঠা।
পরিবারের ছোট মেয়ে হওয়ার দরুন সবকিছু বলার সাথেই পেলেও আমার কিছু চাওয়ার উপর সব ধুলিসাত করেন তাসফি ভাইয়া। সবার চেয়ে বেশি আদরে রাখলেও, শাসনটাও সবচেয়ে আমিই বেশি পাই। আমাকে নিয়ে ওনার কিছু করা বা বলার উপর কেউ কথাই বলে না। কেন কেউ কিছু বলে না, সেটার উত্তর আমার অজানা। পরিবারের একমাত্র ছেলে হওয়ায় যেন তাসফি ভাইয়া সবার চোখের মনি, তার উপর পড়াশোনায় সবসময় টপ। তিনি যেটা বলবেন সেটাই যেন শেষ সিদ্ধান্ত। মাঝে মাঝে ওনাকে খুব করে গলা টি/পে ধরতে মন চায়, কিন্তু সেই দুঃসাহস আমার নেই।

.
খট করে দরজা খোলার শব্দে সমস্ত চিন্তা ভাবনাকে দূরে ঠেলে সেদিকে তাকালাম। রিফাপুকে দেখে আবারো চোখের কোণায় পানিগুলো এসে ভীর জমালো। রুমে ঢুকে মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে হাতে থাকা একটা শপিং ব্যাগ এগিয়ে দিলো আমার দিকে। তারপর বললো,

“তোর এই আধ খোলা শাড়িটা পুরোপুরি খুলে পটাপট এটা পরে, ঝটপট নিচে চল।”

এবার আরও অভিমান এসে যেন ভীর জমালো আমার মনে। কত ইচ্ছে ছিলো রিমি আপুর বিয়েতে শাড়ি পরে অনেক মজা করবো। অনেক কষ্টে শাড়িটা পরে ছিলামও, কিন্তু আপু এসে সযত্নে সেটা খুলে ফেলতে বলছে। একেই বলে ভাগ্য।
মনে মনে ভেবে নিলাম, যাবো না আমি হলুদে। যতক্ষণ পর্যন্ত ওই বজ্জাত বদ*মাইশ লোকটা থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত কিছুতেই যাবো না। এক আকাশ অভিমান নিয়ে রিফাপুকে বললাম,

“যাবো না আমি কোথাও। চলে যাও তুমি, আর তোমাদের ওই আদরের বজ্জাত ভাইকে নিয়ে মজা করো, আনন্দ করো। আমাকে দরকার নেই তোমাদের।”

এবার টুপটুপ করে একফোঁটা পানি পড়লো চোখ থেকে। বুঝতে পারলাম বড্ড বেশিই রাগ হচ্ছে এবার আমার। অতিরিক্ত রাগের বসে কান্না পেয়ে যায় কেন জানি। রিফাপুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম মিটিমিটি হাসছে সে।

“বনু তো দেখি অনেক রেগে আছে। কিন্তু সে কি জানে তার জন্য পুরো হলুদের অনুষ্ঠানটাই স্টপ করে রাখা হয়েছে। আর সেই মহান কাজটা কে করেছে তা নিশ্চয়ই বলতে হবে না।”

“বললাম তো যাবো না আমি।”

বলতেই শপিং ব্যাগটা ঢেলে ফেললো রিফাপু। বেড়িয়ে আসলো কলাপাতা রঙের একটা জামা। জামাটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,

“আর একটুকুও সময় নষ্ট করিস না, দেখবি তাসফি ভাই চলে এসেছে। তোর জন্য সবাই অপেক্ষা করছে, তাড়াতাড়ি জামাটা পড়ে নে বনু, প্লিজ! আর রাগ করে থাকিস না।”

অবাক হয়ে জামাটার দিকে তাকিয়ে থাকলেও রিফাপুর কথাটা শুনতে পেয়েছি। জামাটা দেখার পর এক নিমেষেই মন খারাপ দূর হয়ে গেছে। অসম্ভব রকমের সুন্দর জামাটা দেখতে। শাড়ির থেকে এই জামাটাতেই আমাকে ভীষণ ভালো লাগবে। কিন্তু এটা আপুকে কিছুতেই বুঝতে দেওয়া যাবে না। তাই একটু গম্ভীর হয়ে বললাম,

“আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি যাও আমি রেডি হয়ে আসছি।”

আমার কথাটা শুনে রিফাপু মনে হয় অনেক স্বস্তি পেল। আমার গালটা টেনে দিয়ে হাসতে হাসতে বললো,

“আহ্ কত নাটক তার, জামাটা দেখে যে মনে মনে লাড্ডু ফুটছে সেটা তো আর মুখে বলবি না। তাড়াতাড়ি কর এখন, তা না হলে তাসফি ভাই এখনি চলে আসবে।”

তাসফি ভাইয়ার কথা শুনে শুকনো একটা ঢোক গিললাম। যতই মনে মনে ওনার গোষ্ঠীর ষষ্ঠী উদ্ধার করি না কেন, ওনার কথা শুনলে এমনিতেই কেন যানি একদল ভয় এসে আমার এই ছোট মনে ভীর জমায়।

“থাক, আমাকে আর এভাবে ভয় না দেখিয়ে তাড়াতাড়ি শাড়িটা খুলতে সাহায্য করো।”

মুচকি হেঁসে শাড়ির পিন গুলো খুলতে লাগলো রিফাপু। শাড়িটা খুলে ভাজ করে বিছানায় রেখে বললো,

“নিচে গিয়ে দেখি কি অবস্থা। তুই জলদি করে জামাটা পরে সোজা নিচে চলে আসবি। তা না হলে কিন্তু সত্যি সত্যি তোর কপালে দুঃখ আছে।”

শেষের কথাটা বলে একটা হাসি দিলো রিফাপু। আর একটু দেরি করলে সত্যিই আমার কপালে বিরাট দুঃখ আছে। তাই জামাটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে উঠলাম,

“যাচ্ছি যাচ্ছি, আমাকে আর ভয় দেখাতে হবে না। তোমাদের আদরের বজ্জাত মার্কা ভাইয়াকে বলে দিও যাচ্ছি আমি।”

হো হো করে হেঁসে উঠে চলে গেল রিফাপু। আমিও পাহাড় সমান রাগ, দুঃখ, ভয় নিয়ে রেডি হতে লাগলাম।

.
নতুন জামা পেলেই যেন ছোট বেলায় ফিরে যায়। তার মধ্যে এতত… সুন্দর একটা জামা। কিছুক্ষণ আগের ঘটনাটা যেন একদমই ভুলে গেছি যেন। ওড়নাটা সামনে দিয়ে একপার্ট করে দু’পাশে ঝুলিয়ে বারবার আয়নায় নিজেকে দেখছি। সত্যিই তখনকার চেয়ে শতগুণে এখন ভালো লাগছে নিজেকে। লোকটা যেমনই হোক না কেন, ওনার পছন্দটা বরাবরই অনেক ভালো। আগেও যতবার আমাকে কিছু কিনে দিয়েছেন সবগুলোই ছিলো অসাধারণ। কথাগুলো বজ্জাত মার্কা হলেও তাসফি ভাইয়ের চয়েসটা অলওয়েজ বেস্ট। তাসফি ভাইয়ার কথা মনে হতেই হলুদের কথা মাথায় আসলো আমার। এতক্ষণে তো ভুলেই বসেছিলাম রিমি আপুর হলুদের কথা। উফ্, আর একটুকুও সময় নষ্ট করা যাবেনা। না হলে বজ্জাত লোকটা আমাকে একদম আস্ত রাখবে না। আয়নায় আরও একবার নিজেকে দেখে নিলাম। তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলে নিচে যাবার জন্য পা বাড়াতেই কেউ একজন আমার হাতটা টেনে ধরলো। তাসফি ভাইয়ার কথা ভেবে চমকে উঠলাম।

.
.
#তুমি_বললে_আজ
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
#সূচনা_পর্ব

শুরু করলাম নতুন গল্প। আশা করি সবাই অনেক ভালোবাসা দিবেন। প্রথম পর্ব কেমন হয়েছে জানাতে ভুলবেন না।🖤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here