সুখ সন্ধানী – পর্ব ৫

0
371

#সুখ_সন্ধানী
পর্ব ৫
লেখিকা #Fabiha_Busra_Borno

হিমেল কে বিছানায় সুইয়ে দিয়ে আমি নিজেকে পবিত্র করার জন্য পুকুরঘাটে যায়। পুকুরের পানিতে নিজেকে ডুবিয়ে জীবনের ঘটে যাওয়া অতীত গুলো ভাবতে থাকি। নিজের ইজ্জত রক্ষা করার জন্য কত মিথ্যা অপবাদ মাথায় নিলাম,, ভরা মজলিসে জোড়া বেতের আঘাত মাথা মুন্ডানো শতশত মানুষের নানান বাজে কথা নিরবে সহ্য করলাম। অথচ ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এতো কিছুর পরেও এই নিষ্ঠুর দুনিয়ার মানুষ রুপি জানোয়ারদের কবল থেকে রক্ষা পেলাম না। গরীব মানুষের বুঝি আমার মতো এমন পদে পদে বিপদ লুকিয়ে থাকে যা সুযোগ পাওয়া মাত্র হামলা করে। খুব ইচ্ছে করছে এই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করতে কিন্তু আমি না থাকলে আমার প্রতিবন্ধী অবুঝ সন্তানের কি হবে। অন্তত তার জন্য আমার বেঁচে থাকতে হবে। উনার স্পর্শ করা স্থান গুলো বারবার পানি দিয়ে ধুয়ে দিচ্ছি।

জানিনা কতক্ষণ পানিতে ছিলাম,, হিমেলের কান্নার আওয়াজে ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসি। হাত পা পানিতে ভিজে থেকে থেকে সাদা শ্যাওলার মতো হয়ে গেছে। নাহ্ অতীত নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না। জীবন যুদ্ধে সুখের সন্ধান করে বাঁচতে হবে। পুকুর থেকে উঠে শুকনো কাপড় পড়ে হিমেল কে কোলে নিলাম। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম, হিমেলের মাথার পিছনে কিছুটা অংশ ফুলে গেছে। হয়তো তখন পড়ে গিয়ে মাথায় ব্যাথা পেয়েছিলো। ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে নিরবে চোখের পানি বিসর্জন দিলাম। দুপুর হয়ে গেছে মুকুল রাতুল বাড়ি ফিরেছে। তারা দুজন হিমেল কে খুব ভালোবাসে। হিমেল কে কোলে নিতেই মাথার ফোলা দেখে জিজ্ঞেস করে কিভাবে ব্যাথা পেলো। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ছোট করে বললাম কোল থেকে পরে গেছিলো।

এই ঘটনার পরে আর কখনো আমি একা কারো বাড়িতে যায় না। হিমেলের বয়স প্রায় একবছর হবে। কিন্তু এখনো বসতে পারে না। সব সময় সুইয়ে রাখতে হয়। কোথাও কাজে গেলেও গাছের ছায়ায় বা ছাতার নিচে সুইয়ে রেখে কাজ করি। অবশ্য পাড়া প্রতিবেশী সবাই বলে এটা নাকি আমার পাপের ফল।আমি নাকি জীবনে অনেক পাপ করেছি তাই আল্লাহ দুনিয়াতেই আমার শাস্তি দিচ্ছেন। হ্যাঁ হয়তো উনাদের কথা সঠিক, পাপ তো করেছি-ই। সব চেয়ে বড় পাপ গরীবের ঘরে জন্ম নেওয়া।

বেশ কিছু দিন থেকে বাবার সর্দি জ্বর। আশেপাশের ডাক্তারের কাছে থেকে ঔষধ খাওয়ানো হচ্ছে কিন্তু কোন রকম সুস্থতার অবকাশ নেই। জীবনে প্রচুর পরিশ্রম করেছেন উনি,, হয়তো মাটির তৈরি দেহ এখন ক্লান্ত,, তাই অবসরে যেতে চাইছে। বাবাকে নিয়ে পাশের সদর হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিলাম। টাকা পয়সার অভাবে ঔষধপত্র কিনতে পারছি না। বাড়ির হাঁস মুরগী বিক্রি করে আর হিমেলে প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়া কিছু টাকা জোগাড় করে এক মাসের ঔষধ কিনলাম। হ্যাঁ হিমেলের আবেদন কার্যকর হয়েছে। মেম্বার বিভিন্ন অজুহাতে কয়েকবার আমাকে ডেকেছিল কিন্তু আমি যায় নি। জানতাম তার উদ্দেশ্য কি তাই প্রয়োজন মনে করিনি।

বাবা অসুস্থ মানুষ বিছানা থেকে উঠতে পারে না, ছেলে প্রতিবন্ধী, মায়ের ও বয়স হয়েছে, ভাই দুটো ছোট এমন পরিবারের জীবনযাপন কতটা ভয়ানক তা শুধু ভুক্তভোগীরা ই জানে।একদিন দীঘির মাছ তোলার জন্য জেলেরা আসে সাথে দীঘির মালিক আজিজ চাচাও আসেন। এর আগে কখনো চাচা আমাদের বাড়ির ভিতর আসেন নি কিন্তু বাবার অসুস্থতার কথা শুনে তিনি আমাদের বাড়িতে আসেন। এতো বড়লোক মানুষ কে বসতে দেওয়ার মতো কোন চেয়ার নেই আমাদের। মা তারাহুরো করে খেঁজুরপাতার পাটি(মাদুর)বিছিয়ে দিলেন। চাচা বাবার সাথে কথা বলার ফাঁকে মাকে জিজ্ঞেস করেন আমার বিষয়ে। মা সামান্য কিছু কথা বিস্তারিত বলেন।

আমি চাচাকে সালাম দিলাম। হাজার হলেও উনার দয়াতে মাথা গজাড় যায়গা আছে। বাবাকে দেখে যাওয়ার সময় আজিজ চাচা তিনশো টাকা দিয়ে যান কিছু ফলমূল এবং ঔষধ কেনার জন্য। দিন দিন আমাদের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সুখ যেন ধরা দিতেই চাইনা। বাবা সুস্থ না হলে দীঘি দেখাশোনার জন্য যে টাকা পেতো তা আর পাবে না। কিন্তু বাবার যা অবস্থা মনে হয় না উনি সুস্থ হবেন। এমন নানান রকম চিন্তা ভাবনা করে করে রাতের অর্ধেক পার করি।

আজ সকালে সুজনের এলাকার একজন লোকের মুখে শুনলাম সুজন কে নাকি পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে। নেশার টাকা জোগাড় করার জন্য সে প্রতিদিন এর ওর বাড়িতে চুরি করতো। সেইদিন নাকি হাতেনাতে ধরে পুলিশে দিয়েছে। খবর টা শুনে খুব ভালো লাগলো। আল্লাহ দেরিতে হলেও বিচার করেন। কিন্তু খুশিটা বেশিক্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হলো না। কয়েকজন লোক এসে বললেন আমাদের এই ভাঙা বাড়ি নামক দোকান ঘর টা নাকি আজিজ চাচা ভেঙে নতুন করে গোডাউন ঘর দিবেন। পাকা রাস্তার ধারে গোডাউন ঘর দিলে উনার লাভ হবে। এই অবস্থায় এতো গুলো সদস্য নিয়ে কিভাবে বাড়ি ছেড়ে দিই।

দুপুর পরে মাকে সাথে নিয়ে আজিজ চাচার বাড়িতে যায়,, উনার বাড়ির বাগানের ভিতর লোকজনের বসার ব্যাবস্থা করে রেখেছেন। বাইরের কোন মানুষ বাড়ির ভিতর যেতে পারে না। কিছুক্ষণ বসে থাকার পরে চাচা আমাদের সাথে দেখা করতে আসেন। তিনি বলেন,,

দোকান ঘরে তোমাদের থাকতে দিয়েছিলাম কিন্তু লিখে দিইনি। ওইখানে একটা গোডাউন থাকলে আমি প্রতি বছর প্রায় বিশ হাজার করে টাকা আয় করতে পারবো কিন্তু তোমাদের দশ বছর ধরে থাকতে দিয়ে দশ পঁয়সা ও পাইনা।

উনার হাতে পায়ে ধরলাম কিন্তু উনি এক কথার মানুষ,, কোন ভাবেই রাজি হচ্ছেন না। বারবার আমাদের পরিস্থিতি গুলো বুঝিয়ে বললাম। আমাদের এতো আকুতিমিনতী দেখে অবশেষে উনি বললেন, আচ্ছা একটু ভেবে দেখি।

বাড়িতে কোন রান্নাবান্না নাই। যে যার মতো চিন্তায় মশগুল,, কি হবে, কোথায় যাবো। ইচ্ছে করছে সবাই এক সাথে বিষ খেয়ে সব কিছুর সমাধান করে দিই। হঠাৎ দুইদিন পরে এক সন্ধ্যা বেলা আজিজ চাচা একা একা আমাদের বাড়িতে আসেন। আমরা তো সবাই অবাক। উনি বললেন,, আমাদের এই ঘর ভেঙে নতুন করে বাড়ি বানিয়ে দিবেন। তাও পাকা বাড়ি বানিয়ে দিবেন। সব কিছু কেমন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছেন। যে মানুষ দুইদিন আগে বাড়িতে থাকতে দিতে চাই নি আর আজ সেই মানুষ নতুন পাকা বাড়ি বানিয়ে দিবেন, তাও এমনি এমনি।

আজিজ চাচার বউ মারা গেছেন মাস ছয়েক আগে। কি যেন ক্যান্সার নাকি হয়েছিল। উনার একটা ছেলে আর একটা মেয়ে আছেন। ছেলেকে বিয়ে দিয়েছেন অনেক দিন আগেই। একদিন গভীর রাতে চাচা আমাদের বাড়িতে আসেন এবং আমার বাবা মা কে বলেন, আমাকে উনার সাথে কিছু সময় পার করতে হবে। যদি আমি উনার কথা মতো চলি তাহলে আমাদের সকল দুঃখ কষ্টের অবসান হবে এক নিমিষেই।

হয়তো এখনো কোন বাবা মায়ের কাছে এমন প্রস্তাব দেওয়ার সাহস কারো হয় নি। কিন্তু আমার বাবা মা গরীব অসহায় তাই উনাদের কাছে এমন প্রস্তাব দেওয়াটা কোন আহামরি বিষয় না। তাই তো এমন সহজ ভাবে কথা গুলো বলে ফেললেন। আব্বা মা হয়তো এই প্রস্তাবের কি জবাব দিবে বা কিভাবে জবাব দিবে তার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। উনার বলা কথা গুলো শোনার সাথে সাথে গা গুলিয়ে রিরি করে উঠে। কিভাবে মেয়ের বয়সী একটা মেয়েকে এমন প্রস্তাব দিতে পারলেন। তাও আবার সোজা বাবা মায়ের কাছে। মানুষ কতটা নির্লজ্জ হলে এমন করতে পারে।

আমি ঘরে থেকে একটা বটি বের করে এনে বললাম,,
কুত্তারবাচ্চা তুই এখান থেকে যাবি নাকি এক কোপে ঘাড় নামিয়ে দিবো!!

উনি চলে যাওয়ার সময় বলে গেলেন,, আচ্ছা দেখা যাবে কোথায় থাকে তোর এতো দেমাগ,, দুইদিন পরে যখন রাস্তায় সুবি তখন হাজার হাজার পুরুষের ছোঁয়া পাবি। দেখবো তখন কয়জনের ঘাড় নামাস!!

উনি যাওয়ার পরে আর কারো ঘুম হলো না। অনেক চিন্তা করলাম, এখন আমার কি করা উচিত। উনার কথা শুনলে পাঁচটা জীবন সুন্দর ভাবে বাঁচবে, আর না শুনলে পদে পদে নানা রকম বিপদের সম্মুখীন হতে হবে। আর বর্তমানে আমাদেরকে কেউ সামান্য সাহায্যও করবে না। অসুস্থ বাবা, অর্ধবয়স্ক মা, পুঙ্গু সন্তান, ছোট ছোট ভাইদের নিয়ে কোথায় যাবো কি করবো। সারারাত চিন্তা করে বুঝলাম, আমি চাইলেই সবাইকে সুখে রাখতে পারবো।

আমি আজিজ চাচার বাড়িতে আবারও গেলাম। এইবার একা একা এসেছি। আমার আসার কথা শোনা মাত্র চাচা আমার সাথে দেখা করতে চলে আসেন। আমি উনার কাছে প্রথমে ক্ষমা চেয়ে নিই গতরাতের বলা কথা গুলোর জন্য। তারপর উনাকে বলি আমি উনার কথায় রাজি আছি কিন্তু আমারও কিছু শর্ত আছে। যদি সেগুলো মেনে নেন তাহলে আপনার চাওয়া পুর্ন হবে।

উনি বেশ চাঙা স্বরে বললেন,, বল কি কি শর্ত তোমার? কি কি চাই তোমার??

আমি শান্ত কণ্ঠে বললামঃ-

শর্ত ১,,,,,,

চলবে,,,

এতো কষ্ট করে সময় বের করে গল্প লিখি কিন্তু মনের মতো লাইক কমেন্ট শেয়ার হচ্ছে না 😪💔

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here