বীরাঙ্গনা হইতে বারাঙ্গনা – 03

0
329

#বীরঙ্গানা_হইতে_বারাঙ্গনা
#মম_সাহা
পর্বঃ তিন
হালকা জলপাই রঙের কামিজটা শরীরে জড়িয়েই ব্যস্ত পায়ে অভ্রদা এর বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুট লাগালো পত্র। ছানার তরকারি হলে অভ্রদা বেশ খুশি হন। চা বাগানের চারপাশেই হিজিবিজি ঝোপঝাড়ে ভরা। তার মাঝখানে কেবল সরু একটা রাস্তা। খুব কমই খোলামেলা জায়গা আছে, আর যতটুকু খোলামেলা জায়গা আছে তার বেশিরভাগই মাঠ। যেখানে বর্তমানে বড় বড় দালান উঠানোর কথা চলছে।
মোটা বেণীটা দুলাতে দুলাতে বাগানের মাঝের সরু পথটা দিয়েই ছুটে চলছে পত্র। তরকারির বাটিটা দু’হাতে সাবধানের সাথে আঁকড়ে ধরে রাখা। নিজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রায় তিন চার মিনিট পথ পেরুতেই সরু রাস্তায় তুমুল শব্দ করে একটি জিপ গাড়ি এসে তার সামনে থামলো। পরিচিত সেই কালো রঙের জিপ গাড়িটা দেখে পত্রের পা আপনা-আপনি থেমে গেলো। তার কেন জানি ভীষণ লজ্জা লজ্জা লাগে এই শহুরে ছেলেদের সামনে। বিশেষ করে আতস ছেলের অমন চাহনি তাকে কেমন অস্বস্তি দেয়! অস্বস্তিতে শিরশির করে উঠে তার শিরা উপশিরা। আর কিশোরী পত্র এমন অনুভূতির সাথে কখনোই পরিচিত ছিলো না। কেমন নিজেকে অসার অসার লাগা অনুভূতি এটা!
পত্র যখন অস্বস্তিতে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তখনই জিপ গাড়ি থেকে সুঠামদেহী সুদর্শন যুবকটি নেমে এলো। মুখে প্রাণোচ্ছল হাসি নিয়ে বেশ কৌতুক করে বললো,
“তা পত্রলেখা যে! কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি!”
পত্রের লজ্জা তখন আকাশ ছুঁইছুঁই। অভ্রদা’র পরে এই আরেকজন মানুষ যার মুখ থেকে নিজের নামটা শুনতে বেশ ভালো লাগছে পত্রের। কেমন রোমাঞ্চ জাগছে মনে! অদ্ভুত অনুভূতিদের কেমন ভরাডুবি আ° আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে অন্তরে। হৃৎপিণ্ডের গতিও স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনটা কেন হয়! এ প্রশ্নের উত্তর একমাত্র বান্ধবী বিন্নী দিতে পারবে।
পত্রের আকাশ-পাতাল ভাবনার মাঝেই সুদর্শন যুবকটি বেশ উৎফুল্ল কণ্ঠে বললো,
“খুকির বুঝি কথা বলা বারণ!”
পুরুষালী কণ্ঠে পত্রের আকাশ-পাতাল ভাবনার সমাপ্ত ঘটলো। কেঁপে উঠলো কিঞ্চিৎ। আমতা-আমতা করে সে বললো,
“আমি অপরিচিত মানুষের সাথে কথা বলি না।”
পত্রের কথায় ভ্রু কুঁচকালো আতস। বুকের মাঝে দু’হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাজ করে বললো,
“তা পরিচিত কীভাবে হতে পারি বলো? নাম-ধাম তো বলেছি তখন। এবার আর কী করতে হবে? জন্মতারিখ, ঠিকানা, কুষ্টি মেলাতে হবে? তারপর পঞ্জিকা দেখে দিনক্ষণ বের করে আবার পরিচিত হতে হবে নাকি!”
আতসের গা-ছাড়া ঠাট্টায় পত্রের লজ্জা আরেকটু বাড়লো। সে মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে বললো,
“একদম ঠাট্টা করবেন না।”
“আচ্ছা! ঠাট্টা করলে কী হবে শুনি! পত্রলেখা কী কেঁদে দিবে?”
পত্র হয়তো বুঝলো লোকটা বেশ ভাব জমানোর চেষ্টা করছে। তার উপরে কথার ধরণ ও দেখতেও সুন্দর। নিখুঁত তার দেহ অবয়ব। যেন বড়দি এবং পুষ্পের মতন বড়ো যত্ন করে সৃষ্টিকর্তা তাকেও সৃষ্টি করেছে।
“তা, বললে না তো কোথায় যাচ্ছো?”
“ঠাকুর জেঠুদের বাড়ি। চিনেছেন? নিশ্চয় চেনেন নি। শুধু শুধু জিজ্ঞেস করে লাভটা হলো কী?”
পত্রের মিনমিনে কথার ধরণে বেশ একটা তীক্ষ্ণ ধাঁচ আছে। আতস আরও ক্ষাণিকটা মুগ্ধ হলো। প্রশংসা করে বললো,
“তোমার কিন্তু অনেক রূপ আছে। একেক সময় একেকটার বহিঃপ্রকাশ বেশ আকর্ষণ জাগানোর মতন। তা চলো আমার সাথে, আমি তোমাকে তোমার জেঠুর বাড়ি পৌঁছে দেই।”
পত্র এবার চোখ তুলে তাকালো। একবার জিপ গাড়ি আরেকবার আতসের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। একদম ফর্সা গায়ের রঙ লোকটার, ভালোই লাগে। সচারাচর পত্রের ফর্সা ছেলেদের কেমন কেমন যেন লাগে কিন্তু এই যুবকটিকে অকারণেই ভালো লাগে তার। তাই তো কঠিন কথা বলতে গিয়েও কণ্ঠনালীতে আটকে যায়। অতঃপর কঠিনের জায়গায় কণ্ঠ হয় কোমল এবং সেই কোমল কণ্ঠে মিনমিন করে বলে,
“সবসময়ই এক শ্বাসে ছুট লাগিয়ে জেঠুর বাড়ি গিয়েছি, অভ্যেস আছে আমাদের। আপনাদের মতন জিপ গাড়িতে চড়ার অভ্যাস করলে পরে তো মুশকিল হয়ে যাবে চলাফেরা করতে। আমরা পা এর উপরই ভরসা করি ভীষণ। অভ্রদা বলে, ‘যতক্ষণ রথ আছে ততক্ষণ খেঁটে খাও। অন্যের উপর নির্ভরশীল হলে দিনশেষে খোঁটা খেতেই হবে। আর বোধ হয়, খোঁটা খাওয়ার চেয়ে খেঁটে খাওয়াই ভালো। পেট না ভরলেও আত্মা ভরবে।’ আর আমি অভ্রদা’র কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করি।”
আতস আবারও প্রশংসা করে বললো,
“বুদ্ধিমান তো তোমার অভ্রদা। একদিন দেখা করতে হবে।”
পত্র ঘাড় কাঁত করে সম্মতি জানালো আতসের কথায়। অতঃপর আতসের পাশ কেটে চলে যাওয়ার সময় মৃদু টান পড়লো তার দীর্ঘ আকৃতির বেণীতে। চঞ্চল পা আবারও থেমে গেলো। ধুকপুক করে উঠলো বুক। আতস মিহি স্বরে পত্রের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,
“তোমার অভ্রদা এতকিছু বলেছে মানলাম, কখনো কী এটা বলেছে যে তুমি ভীষণ সুন্দর?”
এমন ফিসফিস এবং মোহনীয় স্বরে কেঁপে উঠলো পত্র। অপরিচিত পুরুষের সান্নিধ্যে এর আগে সে কখনো আসে নি, তাই অস্বাভাবিক কম্পন দেখা দিয়েছে তার শরীরে। কণ্ঠ শুকিয়ে কাঠ প্রায়। ঝিমিয়ে আসা শরীরটা নিয়ে সে ভীতু ভীতু কণ্ঠে বললো,
“নাহ্ তো। কালোকে কেউ সুন্দর বলতে যাবে কেন?”
“আমি তো রঙের কথা বলি নি, আমি সৌন্দর্যের কথা বলেছি। আর তুমি কী জানো পত্রলেখা? তুমি ঐ দূরের আকাশের মতন সুন্দর! যার মন সুন্দর, তার মতন সুন্দর পৃথিবীতে আর কেউ হতে পারে না। আর তোমার মনের চেয়ে সুন্দর কিছু নেই।”
অতি প্রশংসায় মিইয়ে গেলো পত্র। কাঁপা হাতে তরকারির বাটিটা শক্ত করে ধরে ছুট লাগালো সে। পেছন থেকে সুদর্শন যুবকটির সুদর্শন হাসি ঝংকার তুলে উঠলো। হাসতে হাসতে প্রায় খানিকটা উঁচু কণ্ঠে বললো,
“কতটুকু আর ছুটবে কন্যা? গন্তব্য তো আমিই।”
কথা গুলো হয়তো প্রতিধ্বনি তুললো চা বাগানের সরু বৃক্ষগুলোর মাঝে। সাথে লজ্জারা হামাগুড়ি দিয়ে পড়লো পত্রের অনুভূতিতে। এই অনুভূতির সাথে সে পরিচিত নয় কিন্তু সে জানে, এটা বিশেষ কিছু।
_
“তোর কী ঐ শহরের ছেলেটাকে দেখলে বুক ধুকপুক করে, পত্র?”
বেশ ভাবুক স্বরে বিন্নী পত্রকে প্রশ্নটা করলো। পত্রও বেশ কতক্ষণ ভাবুক হয়ে উত্তর দিলো,
“যতবার দেখা হয়েছিল, ততবারই তো ধুকপুক ধুকপুক করেছিল রে বিন্নী। আমার তো মনে হচ্ছিলো এ বুঝি হৃৎপিণ্ডটা ছিঁড়ে হাতে চলে আসবে।”
বিন্নী আবার ভাবুক হয়ে কী যেন ভাবতে লাগলো, পত্রও গভীর ধ্যান দিয়ে তাকিয়ে রইলো বিন্নীর উত্তরের জন্য। বিন্নী পত্রের সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী এবং অভ্রদা’র বোনও। ছোটোবেলা থেকেই বড়দির পর এই মেয়েটাকে পত্র চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারে। এবং পত্রের ধারণা বিন্নী চট করে সকল সমস্যার সমাধান করতে পারে। আর এসব বিষয়ে তো সে পটু। তাই তো অভ্রদাদের বাড়িতে এসে ছানার তরকারিটা রেখেই সে বিন্নীর কাছে ছুটে এলো।
বেশ অনেকটা সময় ভাবাভাবির পর বিন্নী পত্রের দিকে তাকালো। চোখ-মুখে কিসের যেন একটা উৎফুল্লতা। পত্র অবাক হলো, অবাক কণ্ঠে বললো,
“কিরে, খই, চোখ-মুখ এমন চাঁদের মতন জ্বলজ্বল করছে কেন তোর? কিছু বুঝলি আমার ধুকপুক রোগের কারণ?”
বিন্নী কি যেন একটা বলতে গিয়েও মুখ ফুলালো, বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
“আবার খই ডেকেছিস আমায়! যা বলবো না কিছু।”
“আহা বিন্নী, তোকে তো আমি ভালোবেসে খই ডাকি। আমার বিন্নী ধানের খই তুই। বল না আমার এমন রোগের কারণ কী?”
“তোর বোধহয় প্রেম প্রেম পাচ্ছে তাকে দেখলেই, তাই তো বুক ধুকপুক করে।”
“কী! প্রেম প্রেম পাচ্ছে আমার!”
পত্রের কণ্ঠে বেজায় বিস্ময়। বিস্ময়ের চোটে চোখ দু’খানা বড়ো বড়ো হয়ে গেছে। অবিশ্বাস্যকর এক চাহনি। বিন্নী জ্ঞানী মানুষের মতন কতক্ষণ মৌন থেকে গম্ভীর গম্ভীর মুখ করে বললো,
“হ্যাঁ আমি ঠিকই বলেছি। জানিস, আগে আমাদের পূর্ব দিকের চা বাগানের দাসেদের বাড়ির সুন্দর ছেলে প্রহরকেও দেখলে এমন বুক ধুকপুক করতো। কথা বলতে ইচ্ছে হতো। এটাকে বলে প্রেম প্রেম পাওয়া।”
পত্র যেন আহাম্মক বনে গেলো। অদ্ভুত কণ্ঠে বললো,
“যা তুই ভুল বলছিস, এমন কিছুই না।”
“এমন কিছু না হলে তোর বুক ধুকপুক করতো না। শহরের ঐ ছেলেরা তো আরও কয়েকটা দিন আছে। দেখ তোর রোগ কতটুকু বাড়ে। আমাদের ক্লাসের সবারই তো কেউ না কেউ আছে, তোর হলে মন্দ হবে না। সিনেমা দেখবি ক্লাস ফাঁকি দিয়ে, তারপর আমাদের ঐ নৌপ্রভা বিলের ধারে গিয়ে দু একটা মনের কথা আদান-প্রদান করবি। মেলা ঘুরবি। অনেক মজা হবে রে।”
পত্র লজ্জা লজ্জা মনে উচ্ছ্বাসিত হতে গিয়েও হলো না। কেমন একটা মন খারাপ করে বললো,
“অভ্রদা বলেছে, ‘কালোদের উপর সমাজ বড়জোর করুণা করে এর বেশি কিছুই না। অথচ চিরপরিচিত প্রথা অনুসারে মানুষ বোকা, তাই তারা করুণাকে ভালোবাসা ভেবে আনন্দে আহ্লাদ করে। অথচ দিনশেষে তাদের জন্য কেবল মায়া থাকে, ভালোবাসা না।’ আর আমি জানি, অভ্রদা সবসময় ঠিক বলে।”
পত্রের কথাখানা যেন বিন্নীর তেমন পছন্দ হলো না, সে বেশ বিরক্ত হয়ে বললো,
“বড়দা’র কথাকে এমন বেদবাক্য মনে করার কিছু নেই। ও এমনেতেও বেশি বেশি বলে।”
পত্র বিন্নীর কথা মানলো না। কারণ সবাই বলে, অভ্রদা চা বাগানের সবচেয়ে ঠান্ডা এবং শিক্ষিত ভদ্র ছেলে। সবাই তাকে বেশ সম্মান করে কেবল তার গুণী কথাবার্তার জন্য। বিন্নীর তো ভাই, সবসময় একসাথে থাকে বলে হয়তো তেমন ধরে না তার কথা কিন্তু এমনেতে প্রচুর ভয় পায়। আর একটা কথা আছে না, “দাঁতের মর্ম দাঁত থাকতে বোঝা যায় না”, বিন্নীর অবস্থাও তেমন।
বিন্নী হয়তো আরও কিছু বলতো কিন্তু অভ্র চলে আসার কারণে কথা থামাতে হয় সেখানেই। গুরুগম্ভীর চেহারার শ্যামলা পুরুষটির বেশ নজরকাড়া সৌন্দর্য। বিন্নী তো ভাইকে দেখেই সাথে সাথে চুপ করে গেলো। পত্রও গুটিয়ে নিলো নিজেকে। অভ্র এখানে আসার কারণ হলো এটা লাইব্রেরী, আর এখানে অভ্রের একরকমের ধ্যান জ্ঞান সবই হয়।
তার মাঝেই নীচ থেকে বিন্নীর বাবার কণ্ঠ শোনা গেলো, বাজার থেকে এসেছেন বোধহয়। বিন্নী আর অপেক্ষা না করে ছুটে গেলো নীচে। লাইব্রেরীটা তাদের উপরতলা। পত্রও বিন্নীর পেছন পেছন যেতে নিলে তাকে থামিয়ে দেয় অভ্রদা। গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“পড়াশোনা করছিস তো?”
“হ্যাঁ।”
পত্র কোনোরকমে ঘাড় নাড়িয়ে উত্তর দেয়। অভ্রদা লাইব্রেরীর ডান দিকের তিন নাম্বার সারি থেকে একটি ইংরেজি নোভেল বের করে লাইব্রেরীর ভেতর অবস্থানরত চেয়ারে বসে ধীর কণ্ঠে বললো,
“কী নিয়ে আলোচনা করছিলিস?”
“কই, তেমন কিছু না তো।”
অভ্রদা বইয়ের দিকেই মুখ ডুবিয়ে রাখলেন, পত্রও দাঁড়িয়ে রইলো ঠাঁই। পত্র জানে, অভ্রদা’র এখনো কথা শেষ হয় নি। চুপচাপ, শুনশান মিনিট দুই পেরুতেই অভ্র মুখ খুললো অথচ বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে চোখ তুললো না। আগের ন্যায় রাশভারী কণ্ঠে বললো,
“এই যে তোর নারী জীবন, মূল্য কোথায় তার জানিস? তোর বয়স পনেরো। আর এই যে তোর দিদির বিয়ে হচ্ছে, তার বয়স কত? আঠারো বছর দুই মাস। আর দুই তিনদিন পর সে একটা সংসারের দায়িত্ব হাতে নিবে। সে যে মেট্রিক পাশ, তার সার্টিফিকেট কোনো একদিন মাটির চুলার আগুনের আঁচ বাড়ানোর জন্য জ্বলবে নিজে। তার এই যে সুন্দর গায়ের রঙ! তা একদিন মিশে যাবে রোদ্রের তাপে, দায়িত্বের ভাঁজে। দিনশেষে তোর মা এবং আমাদের মায়েদের মতন তাকেও শুনতে হবে কী করেছো জীবনে! যারা পুরো জীবনটা সংসারের নামে উৎসর্গ করে দিনশেষে তাচ্ছিল্য মাখা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়, সে-ই হলো নারী। তোর বোন পুষ্প, যে স্কুল ফাঁকি দিয়ে রঙচঙে সিনেমা দেখতে যায়, চোখে কাঁজল দিয়ে পাড়া ঘুড়ে বেড়ায় তারও ঐ যে গতি ওটাই হবে। এ ক্ষেত্রে তুই ভাগ্যবতী, সুন্দর মেয়েরা খুব দ্রুত মানুষের নজরে পড়ে আর একটু চাপা রঙের মেয়েরা বড় হলেও সমাজের তেমন মাথা ব্যাথা থাকে না। তো, নিজের রঙ নিয়ে হতাশ হবি না। যেখানে মনে করবি তুই ব্যর্থ, সেখান থেকেই সৃষ্টিকর্তা তোর সফলার দার খুলে রেখেছে। তোর কেবল এগিয়ে যেতে হবে। কেমন?”
পত্র নিরব থেকে বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনলো অভ্রদা’র কথা। সত্যিই অভ্রদা বেশ জ্ঞানী, নাহয় এত সুন্দর সুন্দর কথা বলতে পারতো!
“কোন সাবজেক্ট নিয়ে যেন ভর্তি হয়েছিস?”
“সাইন্স।”
“স্কুলের নাজমুল স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়বি, আমি বলে এসেছি। মনে থাকবে? আর কালকের উপন্যাস বইটা পড়েছিস?”
“না। বিয়ের অনেক কাজ গো অভ্রদা, তাই সময় করে উঠতে পারছি না।”
অভ্র আর কোনো কথা না বলে ধ্যান দিলো বইয়ের পাতায়। আর আশ্চর্যজনক ভাবে পত্রও এবার বুঝতে পারলো অভ্রদা’র কথা শেষ। অভ্রদাকে সে বেশ ভালো বুঝে। পত্র ধীর গতিতে বের হয়ে যেতেই অভ্র বই থেকে মুখ তুললো, বেশ ধীরে, গোপনে বললো,
“তুই আমার বড্ড যত্নের তিল তিল করে গড়া সুখ মহল।”
_
সন্ধ্যা নামতে নামতেই চারদিক আঁধার করে বিদ্যুৎ চলে গেলো। চা বাগানে এখনো বিদ্যুৎ ব্যবস্থা তত উন্নত করা হয় নি। অন্যান্য জেলা থেকে এই জেলাটা বেশ পিছিয়েই আছে।
পত্র হারিকেন জ্বালিয়ে উঠানের মাঝ খানে পাটি বিছিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করছে। দিদির বিয়ের আর তো দিন দুই আছে। দেখতে দেখতে চলে এলো বিয়েটা। কিন্তু পড়াশোনার জন্য পত্র সময়ই পাচ্ছে না। যখনই পড়তে বসবে ভাবে, তখনই কোনো না কোনো কাজের জন্য ঠিক ডাক পরে। পত্রদের বাড়িতে এমনেতে তারা তিন বোনে এবং মা-বাবা সহ আরও একজন বিধবা পিসি থাকে পত্রের। আর বিয়ে ঘনিয়ে এসেছে বলে কিছু আত্মীয় স্বজনেরও ভীড় পড়েছে বাড়িতে। আজও সন্ধ্যায় খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তে বসেছে পত্র। তার সাথে দিয়ে ছুটে যাচ্ছে চঞ্চল বাচ্চাদের দল। কেউ খেলছে, কেউ হাঁটছে, কেউ আড্ডা দিচ্ছে। পত্র ধ্যান দিতে গিয়েও পারছে না। আকাশেও একটা গুমোট গুমোট ভাব। তার মাঝেই রান্নাঘর থেকে হাঁক তুললেন ছায়া, চওড়া কণ্ঠে ডাকছে পত্রকে। পত্র বই গুটিয়ে উঠার আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো পত্রের বিধবা পিসি। উঠান পেরিয়ে দক্ষিণ দিকে রান্নাঘরের সামনে গিয়ে বিরক্ত কণ্ঠে বললেন,
“কী যে সমস্যা তোর বউ! মাইয়াটা একটু পড়তাছে, পড়ুক। তুই ডাকোছ ক্যান?”
ছায়া মাছের বড়ো বড়ো টুকরো গুলোতে হলুদ-লবন মাখাতে মাখাতে বললো,
“এত মানুষের কাজ আমি একা হাতে সামলাতে পারি? একেকজন তো রাজরানী হয়ে বসে আছে। একরাত পড়ে কী বিদ্যেধরী হবে শুনি?”
“তোর চেয়ে বেশিই বিদ্যেধরী হবে দেখিস। তোর ছোটো মেয়েকে ডেকে করাতে পারিস না? তার তো বিদ্যেধরী হওয়ার নামগন্ধ নাই, তো কামই করুক।”
ননসের কথায় বিরক্ত হলো ছায়া, বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
“ও মেয়ে পারে কিছু? পরে দেখা যাবে রান্না করতে এসে হাত পুড়িয়ে বসে থাকবে। নাহয় তো ওকেই ডাকতাম।”
“ছোটো মেয়ে হাত পুড়াবে বলে চিন্তা করছিস আর মেঝোটা কী দেবীর শরীর? পুড়বে না সেসব?”
“পু° ড়লেও তো দাগ পড়বে না পিসি। পুষ্পর চামড়া সুন্দর, পু°ড়ে গেলে দাগটা জ্বলজ্বল করে ফুটে থাকবে যা মায়ের অনুশোচনা সৃষ্টি করাবে। আমরা তো আগে থেকেই পু°ড়ে যাওয়া ভাগ্য আর চামড়া নিয়ে আসছি, আমাদের পু° ড়ালে অনুশোচনা দূরে থাক, কারো মায়াও হয় না।”
হাসি হাসি মুখে খুব গহীনের অভিযোগ তুলে ধরলো পত্র মায়ের দারে। ছায়া বুঝলো না সে অভিমান, বরং রেগে গিয়ে একট ছোটো কাঠের টুকরো ছুঁড়ে মারলো পত্রের দিকে। আক্রোশে ফেটে পড়ে বললো,
“বড়ো কথা শিখেছিস। কার জন্য এতকিছু করছি? দিনশেষে এমন কথা শোনার জন্য! আমাকে তুলে নেয় না কেন ভগবান!”
“তোমায় কেন তুলে নিবে মা? দোষ তো আমার, ভগবান তুলে নিলে আমাকে নিবে। কালো হওয়ার চেয়ে বড় দোষ বোধহয় পৃথিবীতে আর একটাও নেই।”
মেয়ের হাসি হাসি মুখের ধারালো কথায় চুপ মেরে গেলো ছায়া। এর মাঝেই বেশ হন্তদন্ত হয়ে পত্রের বাবা সমিরবাবু সাইকেল নিয়ে এসে উঠোনে থামলেন। ঘামে চুপচুপে হয়ে গেছে তার শরীর। হৈচৈ-এ পরিপূর্ণ বাড়ি নিমিষেই ঠান্ডা হয়ে গেলো। ছায়াও স্বামীর এমন হন্তদন্ত অবস্থা দেখে রান্নাঘর থেকে ছুটে এলো। ঘরে সবার সাথে হাসাহাসি করা পদ্মলতা ও পুষ্পলোপাও ছুটে এলো। পত্র বাবার কাছে গিয়ে জলের গ্লাস এগিয়ে দিলো। সমিরবাবু কোনোরকমে জলটা খেয়ে অসহায় চোখে একবার বড়ো মেয়ের দিকে তাকালেন, অতঃপর দু’ফোঁটা অশ্রু ঝরিয়ে বললেন,
“পদ্ম মা, তোমার হবু স্বামী পালিয়েছে। বিয়েটা আর হচ্ছে না।”
এই একটা বাক্যেই উৎসবমুখর পরিবেশটা থিতিয়ে এলো। পদ্ম কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো বাবার দিকে। চোখের সামনে ভেসে উঠলো কত রঙ বেরঙের ঝাপসা স্মৃতি।
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here