#আজও_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ০২
_________________
আচমকাই হাতে কারো শীতল স্পর্শ পেতেই চমকে উঠলো অপূর্ব। পাশ ফিরে তাকালো তক্ষৎনাত। মাত্রই চোখ দুটোকে বুঁজিয়ে ঘুম নামক সন্ধিপথে মগ্ন হতে নিয়েছিল সে। এরই মাঝে বাস থামা সাথে পাশের মেয়েটির এমন অদ্ভুত আচরণ সব কিছুই তাঁর ঘুম নামক আরামদায়ক মুহূর্তটাতে প্রচুর ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। অপূর্ব দৃষ্টি রাখলো বোরকা পরিধিত মেয়েটির দিকে। যদিও কালো বোরকার আড়ালে চোখ ব্যতীত আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটার চোখ দুটো অসম্ভব ভাবে কাঁপছে হাত পাও স্বাভাবিক রাখতে পারছে না। অপূর্ব মেয়েটার চোখের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ফেললো কেন যেন মেয়েটার ওই কাঁপা কাঁপা চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারছে না সে। নিজের হাতে এখন খানিকটা ব্যাথা অনুভব করছে অপূর্ব মেয়েটা খুব শক্ত পোক্তভাবেই চেপে ধরেছে হাত। অপূর্ব বুঝতে পেরেছে মেয়েটা ভয় পাচ্ছে, ভীষণ ভাবে ভয় পাচ্ছে। অপূর্ব বেশি ভাবলো না খানিকটা ভরাট কন্ঠেই বলে উঠল,
‘ কি হয়েছে আপনার? এত ভয় পাচ্ছেন কেন?’
প্রিয়তা অপূর্বের দিকে তাকালো না। খানিকটা হতভম্ব কন্ঠ নিয়েই অপূর্বকে বলতে লাগলো,
‘ প্লিজ আমায় একটু হেল্প করুন না ওই লোকগুলো আমায় নিতেই এসেছে?’
এবার অপূর্ব চমকালো, ভীষণভাবে চমকালো তাঁর মানে এই মেয়েই বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে এসেছে। কি সাংঘাতিক! অপূর্ব চমকানো গলাতেই বলে উঠল আবার,
‘ তাঁর মানে আপনি বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে এসেছেন?’
প্রিয়তা এবারও অপূর্বের দিকে না তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল,
‘ আমায় জোর জবরদস্তি করে একজন ৬০ বছরের বুড়োর সাথে বিয়ে দিতে চাচ্ছে পালিয়ে আসবো না তো করবো বলুন।’
এবার যেন আরও চরম অবাক হলো অপূর্ব। কি বলছে এই মেয়ে?’ অপূর্ব সন্দিহান দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ এসব কি বলছেন আপনি?’
‘ আমার কথা বিশ্বাস করুন প্লিজ। ওদের সাথে আমাকে যেতে দিয়েন না। প্লিজ যেকোনো ভাবে ওদের আমার মুখ দেখা থেকে আটকান। আমি আপনার কাছে হাত জোর করছি প্লিজ আমায় একটু হেল্প করুন আমি বড্ড বিপদে পড়েই এইভাবে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এসেছি।’
প্রতি উওরে অপূর্ব কিছু বললো না। মেয়েটা কাঁপছে ভয়ংকরভাবে কাঁপছে। চোখ দুটোতে বিষন্নতায় ঘিরে ধরেছে খুব। অপূর্বের কেন যেন বিশ্বাস করতে মন চাইলো মেয়েটার কথা। তাঁর মনে হচ্ছে ‘এই মেয়ে মিথ্যে বলছে না।’
এদিকে শিহাব নামের ছেলেটি একে একে সব যাত্রীদের দেখতে দেখতে এগিয়ে যেতে লাগলো অপূর্বদের দিকে। ছেলেটা যতই অপূর্বদের দিকে এগোচ্ছে প্রিয়তা ততই শক্ত করে চেপে ধরছে অপূর্বের হাত। শিহাব বোরকা পরিধিত মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
‘ আপনার মুখ দেহান?’
সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে উঠলো প্রিয়তা। এখন কি করবে সে। তাঁকে দেখলেই তো চিনে যাবে এঁরা। শিহাব নামের এই ছেলেটিকে চেনে প্রিয়তা। তাঁর চাঁচির সাথে প্রায় সই কথা বলতে দেখেছে সে। প্রিয়তার ভাবনার মাঝেই আবারো বলে উঠল শিহাব,
‘ কি হলো কথা হুনেন না কেন মুখ দেহান আপনার?’
শিহাবের কথা শুনেই পিছনের লোকটিও বলে উঠল,
‘ কি হলো শিহাব তুই এহনো ওখানে দাড়িয়ে আছিস কেন?’
উওরে শিহাব বললো,
‘ বস এই মাইয়াডা মুখ দেহাইতে চায় না।’
‘ মুখ দেখাতে চায় না মানে,
‘ বস বোরকা পড়ে আছে মুখ ঢাকা তো।’
‘ কথা না শুনলে টান মেরে বোরকা খুলে ফেল তারপরও মুখ না দেখে ছাড়বি না শিহাব।’
শিহাব শুনলো বসের কথা। আবারও বললো মেয়েটিকে,
‘ হুনছেন বস কি কইলো ভালোভাবে মুখ দেখান নয়তো,,
প্রিয়তা এবারও শুনলো না। একদম ঝেকে বসে আছে সে কিছুতেই তাঁর মুখ দেখাবে না। প্রিয়তার কান্ডে শিহাব এবার বিরক্ত হয়ে বললো তাঁর বসকে,
‘ বস মেয়েটা মুখ দেখতে দেয় না,
‘ না দিলে জোর কর বলদটা এতক্ষণ সময় লাগে একটা মেয়ের মুখ দেখতে।’
শিহাব বেশি না ভেবে খানিকটা রাগ নিয়ে বললো,
‘ আমনের জন্য বস আমায় বলদ কইলো, আপনার মুখ দেখান মাইয়া? বুঝচ্ছি আপনে ভালো কথায় হুনবেন না, আমনেরে জোরই করা লাগবে বুঝচ্ছি আমি।’
বলেই নিজের হাতটা এগিয়ে দিতে লাগলো শিহাব প্রিয়তার মুখের দিকে। উদ্দেশ্য টান মেরে মুখের নিকাব খুলে ফেলা। প্রিয়তা থমকে গেছে এখন পুরোপুরি। হাত পা কাঁপা কাঁপা আরো বেড়ে গেছে তার বার বার মিনতির স্বরে পাশের ছেলেটির কাছে হেল্প চাইছে সে। সাথে মনে মনে আল্লাহকে ডাকছে খুব করে কোনোভাবেই যেন এঁরা তাঁর নিকাব না খুলতে পারে। প্রিয়তা খিঁচে চোখ বন্ধ করে নিলো তাঁর, আর হয়তো শেষ রক্ষা হলো না। এতদূর এসেও যেন চাঁচির হাত থেকে রক্ষা পেল না সে। বেশ কিছুক্ষন যাওয়ার পরও মুখে কারো হাতের স্পর্শ অনুভব না পেতে আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালো প্রিয়তা। সামনেই শিহাবের হাত শক্ত করে চেপে ধরেছে অপূর্ব। অপূর্বকে দেখে বোঝা যাচ্ছে খুব স্বাভাবিকভাবেই শিহাবের হাতটা ধরেছে সে। কিন্তু শিহাব বুঝতে পারছে তাঁর হাতের হাড্ডি গাড্ডি ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হচ্ছে ভিতর থেকে। এবার অপূর্ব মুখ খুললো ভয়ংকর ভাবে রাগ হচ্ছে তাঁর এইভাবে বাস ভর্তি লোকের সামনে একটা মেয়ের নিকাব খুলে নেওয়া কতটা অরুচিকর ভেবেই রাগ হচ্ছে তাঁর। অপূর্ব গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
‘ সাহস কি করে হয় অপূর্বের বউয়ের নিকাবের দিকে হাত দেওয়ার।’
সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুখ কুঁচকে এলো প্রিয়তার। কি বলছে কি ছেলেটা অপূর্বের বউ মানে। শিহাব তাঁর হাতের ব্যাথায় মুখ থেকে কোনো কথা বের করতে পারছে না। তারপরও বহুত কষ্টে বললো পিছন ঘুরে বললো,
‘ বস মোর হাত শেষ, হয়ালে এদিকে আহেন।’
সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে লোকটা এগিয়ে আসলো প্রিয়তাদের দিকে। হতভম্ব গলায় বললো,
‘ কি হইছে হারামজাদা?’ একটা মেয়ের মুখ দেখতে এতক্ষণ সময় লাগে।’
শিহাবের হাত ছেড়ে দিলো অপূর্ব। নিজের হাতটা ছাড়া পেতেই হাতটা শক্ত করে ধরে বললো শিহাব,
‘ বস পোলাডা মোর হাতটা ভাইঙা দিছে।’
‘ কি পোলাডার এত বড় সাহস মতলবের পোলাগো দিকে হাত বাড়ায় কই দেখি সর দেখি ছ্যারাডারে দেখতে দে।’
শিহাবের চেয়ে মতলব অনেকটা খাটো যার দরুন অপূর্বের ফেসটা ঠিকভাবে দেখতে পারছে না সে। শিহাবকে ছাড়িয়ে যেই না অপূর্বের ফেসটা দেখলো মতলব সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে কুঁকড়ে উঠে বললো,
‘ ভাই আপনে এখানে?’
অপূর্ব এবার তাকালো সামনের লোকটির দিকে। একে চেনে বলে মনে পড়ছে না তাঁর। অপূর্বের ভাবনার মাঝেই হতভম্ব হয়ে বলে উঠল মতলব,
‘ ভাই আপনে এইভাবে বাসে করে,
অপূর্ব খানিকটা অবাকের স্বরে তাঁর ভ্রু-জোড়া কুঁচকে কপাল চুলকে বললো,
‘ আমায় চিনেন আপনি?’
উওরে প্রফুল্লতার স্বরে বললো মতলব,
‘ আপনায় চিনবো না ভাই আপনার মতো এত বড় রা…
বলতে গিয়েও অপূর্বের চোখের দিকে তাকিয়ে থেমে গেল মতলব। আশেপাশের সবার দিকেও তাকালো সে। সবাই তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। পরক্ষনেই প্রসঙ্গ পাল্টে বললো মতলব,
‘ এই মেয়ে আপনার সাথে ভাই?’
উওরে অপূর্ব বেশি না ভেবে বললো,
‘ হুম।’
‘ তাহলে তো আমরা যাকে খুঁজছি সে হওয়ার কোনোই চান্সই নেই। আপনে বহেন ভাই। আমরা যাচ্ছি।’
বলেই সকল যাত্রীদের উদ্দেশ্য করে ক্ষমা চেয়ে তৎক্ষনাৎ বাস থেকে নেমে পড়লো মতলব ওঁরা। ওরা নামার কিছুক্ষনের মাঝেই বাস চলতে শুরু করলো আবার। এদিকে বাস যেতেই শিহাব হা হয়ে বলে উঠল,
‘ বস আমনে কিছু বললেন না কেন?’
‘ কি কমু?’
‘ পোলাডায় আমায় হাত ভেঙে দিলো।’
শিহাবের কথা শুনে ওর গালে হাল্কা চাপড়ে বললো মতলব,
‘ তোর ভাগ্য ভালো উনি শুধু তোর হাতটা ধরেছে না হলে তুই তো গেছিলি আজ। কিন্তু মেয়েটা ছিল কে?’
এবার করিম বললো,
‘ বললো তো বউ!’
প্রতি উওরে করিমের দিকে চোখ বড় বড় করে বললো,
‘ বউ বললো না বোন বললো গাঁদা উনি তো বিয়ে করেনি।’
‘ কিন্তু উনি তো বউই কইলো বস (শিহাব)
‘ তোগো কান দুটো বাসায় গিয়ে পরিষ্কার করোন লাগবে বুঝচ্ছি আমি চল এহন ওই মাইয়াডারে খোঁজা লাগবে। নয়তো মাইয়ার চাঁচি রেগে বোম ফাটাইবে।’
বলেই সামনে এগিয়ে চললো মতলব। আর শিহাব করিমও হাবলাকান্তের মতো চললো মতলবের পিছু পিছু। মাঝে মাঝে এঁরা সত্যি বুঝে না তাদের বস এই শুদ্ধ তো এই অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলেন কেন? আর কে ছিল ওই ছেলেটা যে তাদের বস এইভাবে ভাই বলে সম্মেলন করছিল ছেলেটাকে।’
____
চলন্ত বাসের ভিড়ে ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে আছে প্রিয়তা তাঁর পাশের অপূর্ব নামের ছেলেটির দিকে। এর দুটো কারন এক তাঁকে বউ বলে আখ্যায়িত করা আর দুই কে এই ছেলে যার কারনে চাঁচির পাঠানো ছেলেগুলো ওনাকে এত সম্মান জানিয়ে বেরিয়ে গেল বাস থেকে। প্রিয়তা যখন এসব ভাবনায় মগ্ন ছিল তখনই হুট করে অপূর্ব প্রিয়তার চোখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
‘ আমার দিকে কেউ ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকুক এটা আমার পছন্দ নয় মিস। আর হ্যাঁ কিছুক্ষন আগে যা বলেছি তা আপনাকে ওদের থেকে রক্ষা করার জন্য তাই সিরিয়াস ভেবে নিয়ে নিশ্চয়ই বোকার মতো তাকিয়ে থাকবেন না।’
প্রিয়তা থমকালো, অপূর্বের থেকে চোখ সরিয়ে ফেললো তক্ষৎনাত। সে কি বলেছে তাঁকে বউ বলার বিষয়টা সে সিরিয়াসভাবে নিয়েছে মটেও নেয় নি। হা একটু চমকেছিল কিন্তু পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়েছে তো। ভেবেছিল একটা ধন্যবাদ জানাবে ছেলেটিকে কিন্তু ছেলেটির গম্ভীর ভাবের কারনে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না প্রিয়তা।’
প্রিয়তা কিছু বললো না নিশ্চুপে বসে রইলো সে। তবে তাঁর পাশের ছেলেটি আসলে কে? জানার জন্য খুব কৌতুহল জেগেছে মনে। কিন্তু সাহস করে বলতে পারছে না কিছুই। প্রিয়তা আর একবার তাকালো ছেলেটির মুখের দিকে। ছেলেটা আবারও বাসের সিটের সাথে তাঁর সমস্ত শরীর এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। আচ্ছা ছেলেটির কি মাথা যন্ত্রণা করছে? নাকি খুব ঘুম পেয়েছে? নাকি ক্লান্ত।’
প্রিয়তা কথাগুলো মনে মনে আওড়ে অপূর্বের মুখের দিকে দৃষ্টি রাখলো। গোল ফেস, ফর্সা মুখ, চোখের ডান পাশে ছোট্ট একটা দাগ আছে, যেটা খুব গভীরভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে ছেলেটাকে,হাল্কা লাল ঠোঁট, শীতল ভেজা চোখ, মাথা ভর্তি ঘন কালো চুল। যা মাথার সাথে সাথে লেপ্টে আছে কপাল জুড়ে। রাতের শীতল ভেজা বাতাসের ছোঁয়ায় খানিকটা নড়ছে সেগুলো। পরনে নেভি ব্লু কালার শার্ট, সাথে কালো টিশার্ট, কালো জিন্স শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত বোল্ড করা, শার্টের বোতাম খোলা সব।’
ছেলেটার মুখে এক অন্যরকম মায়া ফিল করছে প্রিয়তা। ছেলেটাকে ভয়ংকর সুন্দর বলে আখ্যায়িত করতে মন চাইছে তাঁর। সাথে নিসন্দেহে বলা যায় ছেলেটা প্রবল ভালো মনের মানুষ। নয়তো অচেনা এই মেয়েকে সাহায্য করতো না এইভাবে?’
প্রিয়তা যখন অপূর্বকে দেখতে ব্যস্ত তখন চোখ বন্ধ করেই ভরাট কন্ঠে বলে অপূর্ব,
‘ আমি কিন্তু একবার বলেছি আমার দিকে কেউ ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকুক এটা আমার পছন্দ নয় মিস!’
সঙ্গে সঙ্গে ঘাবড়ে গেল প্রিয়তা, চমকে উঠলো ভীষণ ভাবে। ছেলেটা তো চোখ বন্ধ করে ছিল তাহলে বুঝলো কি করে সে তাঁকে দেখছে? ছিঃ ছিঃ কি লজ্জা? কি লজ্জা? ছেলেটা নিশ্চয়ই তাঁকে খুব বাজে ভাবলো!’
#চলবে….