#স্মৃতিতে_তোমার_বন্দনা
#পর্ব_২৯
#Saji_Afroz
.
.
পরশের কাছে সত্যটি গোপণ করতে পারলোনা নয়নতারা । ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো সে।
পরশ বললো-
রুমালটা দিয়ে চোখটা মুছে নিন । শান্ত হোন ।
-রুমালটা রাফসানের।
-তো? এই রুমালে চোখ মোছারও অধিকার আপনার নেই?
-নাহ।
-কেনো?
.
উড়না দিয়ে চোখ মুছে নয়নতারা বললো-
আমি আশা করবো ছোঁয়া যেন এসব না জানে।
-কিন্তু আপনি ভালোবাসেন রাফসানকে।
-রাফসান ভালোবাসে ছোঁয়াকে। আর ছোঁয়াও এই বিয়েতে রাজি।
-কার খুশির জন্য করছেন এসব আপনি? ছোঁয়া নাকি রাফসান?
-দুজনেরই। রাফসানের মতো ভালো ছেলে ছোঁয়ার কাম্য।
-তবে শুধু রাফসানই কেনো?
-দেখুন এসব আমাদের পারসোনাল বিষয়। আপনি যদি ছোঁয়াকে বলেনও এসব, কোনো প্রমাণ নেই! সো বলে লাভ নেই।
.
পরশ মুচকি হেসে বললো-
আমি বলবনা। চিন্তার কিছু নেই।
.
নয়নতারা হনহনিয়ে চলে গেল।
পরশ নিজেরমনে বলল-
আমি চাইলেই এই সুযোগটা কাজে লাগাতে পারতাম। কিন্তু আমি এভাবে ছোঁয়াকে পেতে চাইনা। ওর মন জয় করে ওকে পেতে চাই। আর একদিন আমি সফল হবোই। আমার ভালোবাসা যে মিথ্যে নয়।
.
.
-এবার বেশিদিনের জন্য যাচ্ছিনা। রাদিব ভাইয়া খুব তাড়াতাড়ি দেশে আসতে চলেছে। উনি আসলেই বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হবে। শুধু উনার না, আমারও মানে আমাদেরও।
.
রাফসানের কথা শুনে মুখে হাসি আনার চেষ্টা করলো ছোঁয়া। রাফসান সেটা বুঝতে পেরে বললো-
একটা সময় আসবে, যেদিন তোমাকে অভিনয়ের হাসি দিতে হবেনা।
-সেদিনটা তখনি আসবে, যখন আমার স্বপ্ন পূরণ হবে৷ এর আগে সম্ভব নয়।
.
ছোঁয়ার কথা শুনে রাফসানের মুখটা মলীন হয়ে হয়ে গেলো। কি করেনি সে ছোঁয়ার জন্য? তবুও একটুখানি জায়গা সে ছোঁয়ার মনে তৈরী করতে পারলোনা।
হতাশমনে রাফসান বললো-
আন্টির সাথে দেখা করে নিই। বের হতে হবে আমায়।
.
.
নিজের রুমে অনেকক্ষণ ধরেই পায়চারি করছে নয়নতারা।
ছোঁয়া তার রুমে এসে বললো-
দূর হলো আজ আপদটা।
.
নয়নতারা থেমে বলল-
কার কথা বলছিস?
-কার আবার? রাফসান।
-এভাবে কেন বলিস তুই! মানুষটা তোকে ভালোবাসে ছোঁয়া। এভাবে যদি সে আমাকে ভালোবাসতো, আমি কখনোই তোর মত করতাম না।
-তোমাকে ভালোবাসলে তো আমি বেঁচেই যেতাম।
.
দুই বোনই দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ছোঁয়া খেয়াল করলো, নয়নতারা ঘামছে। সে বলল-
ফুল স্পীডে ফ্যান চলার পরেও ঘামছো কেন তুমি? শরীর খারাপ করছে তোমার?
-ও কিছু না। ঘুমোতে হবে।
-সব ঠিক আছে আপু?
-হ্যাঁ।
-সিউর?
-হু। তুই যা এখন। আমার ঘুম পাচ্ছে।
.
ছোঁয়া বেরিয়ে
যেতেই বিছানার উপরে বসে পড়লো নয়নতারা। তার সত্যিটা যে পরশ জেনেছে। সে কি গোপন রাখতে পারবে কথাটি! না রাখলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। নাহ! আজ আর ঘুম হবেনা এই চিন্তায়।
.
.
সারারাত নয়নতারা ও রাফসানের বিষয়টা ভাবলো পরশ।
সে নয়নতারার কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারছে। তার ভালোবাসার মানুষটার সাথে তারই ছোট বোনের বিয়ে হবে। চোখের সামনে দুজনে দম্পতি হয়ে ঘুরে বেড়াবে। এই যেনো এক হৃদয় বিদারক যন্ত্রণা। যা কোনো মেডিসিনেও ঠিক হবার নয়। নয়নতারার জায়গায় সে নিজে থাকলে এতোক্ষণে হয়তো পাগলই হয়ে যেতো। কারণ কাউকে পাগলের মতো ভালোবাসা যায়, কথাটি মিথ্যে নয়। এতোবড় ত্যাগ স্বীকার নয়নতারা করছে কিভাবে? নিজের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য অন্তত একটা চেষ্টা তো করতে পারতো! ছোঁয়া যেখানে রাফসানকে পছন্দই করেনা, সে সত্যিটা জানলে কষ্ট পাওয়ার কথায় নেই। কেনো নয়নতারা ছোঁয়াকে জানালোনা সবটা? কেনো?
নানারকমের প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে পরশের মাথায়।
উঠে বসে পানি খেয়ে নিলো সে। আর বিড়বিড়িয়ে বললো-
নয়নতারা হার মানতে পারে, আমি পারিনা। আমি চেষ্টা করে যাবো, শেষ পর্যন্ত করে যাবো!
.
.
কয়েকটা দিন কেটে গেল। পরশের কথামত ছোঁয়া নিয়মিত ক্লাসে যায়। বাসায় যতটুকু সময় থাকে, সাফিনা আহম্মেদের সাথেই সময় কাটায় সে। তবে আজকাল পরশের সাথে তার দেখাও কম হয়। সকালে ছোঁয়ার ক্লাস , ফিরতে দুপুর হয়ে যায়, এদিকে বিকেলের পরেই পরশকে বেরুতে হয় হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। রাতে ফিরে কখনো ছোঁয়ার দেখা পায় আবার কখনো পায়না। এভাবেই দিন কাটছে। তবে যে সময়টুকু ছোঁয়াকে কাছে পায় সে, তার দিকে তাকিয়ে থেকে মনের তেষ্টা মেটায়। শফিউল আহম্মেদ তো একদিন বলেই ফেললেন-
এভাবে তাকিয়ে থাকলে হবে! কখন পটাবি, কখন বিয়ে করবি? আর কখন আমি নাতি-নাতনীদের সাথে খেলা করব!
.
বাসার সকলেও ছোঁয়াকে ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু এসব সম্পর্কে ছোঁয়া কিছুই জানেনা। পরশের হুট করে কিছু করার ইচ্ছে নেই। ভালোবেসে অপেক্ষা করতেও যে শান্তি…
.
বিকেলে বাগানে বসে চা খাচ্ছিল পরশ। এমন সময় আগমন ঘটলো ছোঁয়ার। পরশ তাকে বলল-
বসো, চা খাও।
-আমার জন্য তো আনেন নি।
-নিয়ে আসব?
-না থাক।
-কেন?
-আমার চা খেতে ওতটাও ভাল লাগেনা।
-গায়ের রঙ কালো হয়ে যাবে বলে?
-নাহ।
-তবে?
-আপনি ফুচকা খেতে পছন্দ করেন?
-না।
-ব্যাপারটা সেই রকম।
-তার মানে তুমি ফুচকা খেতে পছন্দ করো?
-কিভাবে বুঝলেন?
-ফুচকার উদাহরণ দিলে তাই।
-আর ফুচকার কথা বলবেন না প্লিজ! আমার তো নাম শুনলেই জিভে পানি চলে আসে।
.
পরশ হেসে বলল-
এতটা ভালো লাগে?
-আবার জিজ্ঞেস করে! আমাকে যদি বলা হয়, ভাত না খেয়ে ফুচকা খেতে হবে সারাজীবন। রাজি হয়ে যাব আমি।
-তবে চলো এখন।
-কোথায়?
-তোমাকে ফুচকা খাইয়ে আনি।
.
কিছুক্ষণ ভেবে ছোঁয়া বলল-
অন্যদিন যাব।
.
পরশ জানে তার এই প্রস্তাবে রাজি হবেনা ছোঁয়া। তবুও এমন একটা কথা বলে ফেললো সে। জানা থাকলেও হতাশ হলো পরশ। এই মেয়েটি তার সাথে ফুচকা খেতে যেতেই রাজি হলোনা, সারাজীবন থাকার জন্য হবে তো?
.
.
সন্ধ্যায় হাসপাতালে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছিল পরশ। এমন সময় ড্রয়িংরুম থেকে তোহার কথা বলার শব্দ তার কানে ভেসে এল । পরশ এসে দেখা পেল তার। হাসিমুখে বললো-
তুই এখানে?
-হ্যাঁ। বাবা আসছে কালই। পরশু আমার এনগেজমেন্ট। দাওয়াত দিতে এলাম।
-এত দ্রুত সব ঠিকঠাক?
-তোর মত নাকি? এখনো তো…
.
ছোঁয়াকে দেখে কথা ঘুরিয়ে তোহা বললো-
এখনো সিঙ্গেল তুই।
-তুই যে অন্য বিয়ে করতে চলেছিস।
-ছেড়ে দেই তাকে?
.
হেসে ফেললো পরশ।
তোহা সবাইকে তার এনগেজমেন্ট এর দাওয়াত দিলো। ছোঁয়াকেও যেতে বললো তার পরিবার নিয়ে। সালেহা চৌধুরী তাকে বসতে বললে সে বলল-
আজ আন্টি বসবো না। পরশ তো বেরুচ্ছে। ওর সাথে যাই। ও আমায় ড্রপ করে দিবে।
-সে কি করে হয়!
-হয় হয়। আজ আসি।
.
পরশ ও তোহা বেরিয়ে পড়লে, সালেহা চৌধুরী ছোঁয়ার উদ্দেশ্যে বললেন-
আমার ছেলে টা যে কবে বিয়ে করবে!
-এভাবে কেন বলছেন আন্টি?
-কি করব! তার যে কোনো মেয়েকেই পছন্দ হয়না।
-কেন?
-সেটাও জানিনা। আচ্ছা মা তুমি বলো, আমাদের কি ইচ্ছে হয়না ছেলের বউ ঘরে আনতে? নাতী নাতনীদের মুখ দেখতে?
-এটা সব মা বাবারই ইচ্ছে।
-কিন্তু পরশ এটা বুঝেনা। ওর কি বয়স কম হয়েছে!
-মোটেও না। বিয়ের বয়স পার হতে চললো।
-সেটাই।
-জোর করে দিয়ে দিন।
-এতবড় ছেলেকে জোর বা কিভাবে করি!
-উনি বিয়ে কেন করতে চায়না এটা বের করতে হবে আন্টি। তবেই এর একটা সমাধান করা যাবে।
.
সাফিনা আহম্মেদ মনে মনে যেন এটাই চাচ্ছিলেন! ছোঁয়া নিজেই বের করুক না, কেন পরশ অন্য কাউকে বিয়ে করছে না…
সাফিনা আহম্মেদ বললেন-
তুমি আমাকে এই ব্যাপারে সাহায্য করো। ও কেনো বিয়ে করতে চায়না এটা তুমি বের করবা।
-আমি!
-হ্যাঁ তুমি। আমার জন্য এতটুকু করতে পারবে না?
.
মুচকি হেসে ছোঁয়া বললো-
পারব আন্টি।
.
.
গাড়িতে পাশাপাশি বসে রয়েছে তোহা ও পরশ।
তোহা বলল-
পরশ? এত সময় নেওয়া ঠিক হচ্ছে তোর?
-কি বিষয়ে বলছিস?
-অবশ্যই ছোঁয়ার।
-কি করব? আমার প্রতি তার কোনো ইন্টারেস্টই দেখছি না।
-প্রপোজ করার পরে হয়তো দেখবি।
-এমনও হয়?
-হয়। সে জানেনা তুই তাকে ভালোবাসিস। এমন কিছু কর যাতে সে বুঝতে পারে এটা।
-তারপর?
-তারপর আর কি! প্রপোজ করে ফেলবি।
-বলছিস?
-হু। রাফসানের ভাই বিদেশ থেকে আসার আগেই তোকে সব সেরে ফেলতে হবে পরশ। ভালোবাসার মানুষকে নিজের ভালোবাসা উপলব্ধি করাতে এত বেশি সময় নেওয়া উচিত নয়।
.
গাড়ি থামিয়ে পরশ বলল-
বাসায় চলে এসেছি তোর।
.
তোহা নামতে নামতে বলল-
আমার কথা গুলো ভেবে দেখিস।
.
তোহা চলে যাওয়ার পরেও গাড়ি ছাড়লোনা পরশ। তোহা যা বলে গেল তা ভুল নয়। সে আসলেই সময় নষ্ট করছে। রাদিব চলে আসবে কিছুদিন পরেই। যা করার সে আসার আগেই করতে হবে। নাহলে আর কিছুই করার থাকবেনা। কিন্তু করবে তো করবে টা কি সে!
.
চলবে