রোদেলা-৭৪

0
642

#রোদেলা-৭৪
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু

ওরা সেদিন বাড়ি ফিরেছিলো ভারাক্রান্ত মন নিয়ে৷ কারন আসার আগে নাসিমার সাথে রোদেলার একপ্রস্ত কথা কাটাকাটি হয়েছে। এসব আর নিতে পারে না রোদেলা। সন্তানেরা কাতর হয়ে থাকে মায়ের সান্যিধ্য পেতে। আর ওরা তার থেকে পালাতে পারলেই যেন বাঁচে। প্রিসিলা তো সেই ছোটবেলায়ই বলেছিলো ও যখন বিয়ে করে শ্বশুর চলে বাড়ি যাবে আর আসবেনা এখানে। সত্যি ও এখন যেতেই চায় না। নাইওরের যে একটা ব্যাপার আছে তা ও সম্পন্ন করে নি ঠিকঠাক।

এসব নিয়েও কথা শোনাতে ছড়ে নি নাসিমা। তার বোনদের কাছে বলতে শুনেছে- আজকালকার পোলাপান বিয়ে হয়ে গেলেই স্বামী চিনে ফেলে। বাবা-মাকে তখন আর দেখতেও ইচ্ছে করে না। এত পাকনামি আমরা করি নাই, বাবা…..!

একথা শুনে হাসি পেয়েছিলো রোদেলার, কষ্টের হাসি।
এ কথা যে ওদের দু বোনকে উদ্দেশ্য করে তা বুঝতে বাকী থাকে না ওর। পোলাপান কেন আসতে চায় না তার কারন কি কখনো খুঁজেছেন তিনি…? সে সময় তার কই…?
তিনি তো কত ব্যস্ত পর কে নিয়ে।

সেদিন কথা-কাটাকাটির কারণ সন্ধ্যায় নাশতা খাওয়ার সময় নাসিমা সবার উদ্দেশ্যে বলে নোভেল দেশে এসে পরেছে আর যেতে চায় না, সেখানে নাকি ওর মন বসে না ইত্যাদি ইত্যাদি।
এসব বাইরে থাকতে-ই শুনেছে ও। ইংল্যান্ড অনেকের স্বপ্নের দেশ। কত কত মানুষ সেখানে যাওয়ার জন্য মরিয়া।
আর ওর নাকি ভালো লাগে না সেখানে। সুখে থাকলে ভুতে কিলায় অবস্থা। ভালো না লাগলে নাসিমার কি করার আছে।
তাই ও এসব কথায় পাত্তা দিলো না। কিন্তু হঠাৎ যখন সবার সামনে বললেন-
: ওকে এখানেই রেখে দিই কি বলিস….
তোরা দুবোন চলে যাবি, একা আমি এত বড় বাড়িতে থাকবো। ও সাথে থাকলে…..

রোদেলা অনিমেষ চোখে তাকায় নাসিমার দিকে। শেষ পর্যন্ত নোভেলও যে তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল তা তিনি বেমালুম ভুলে গেছেন। কত সহজ সবকিছু ভুলে যাওয়া। আচ্ছা রোদেলা ও যদি তাকে কষ্ট দেয় তা কি তিনি ভুলে যাবেন…?
না হয়তো, ওদের করা সব ভুলের নির্ভুল তালিকা আছে নাসিমার কাছে।

এ বাড়িটা রোদেলার নামে হলেও মূলত কেনা হয়েছে নাসিমার জন্য। তিনি যদিও তা গ্রহণ করে নি এমন একটা মনোভাব পোষণ করেছিলেন রেজিষ্ট্রি করার সময়, অথচ এখন তিনি কর্তৃত্ব ফলাচ্ছেন বাড়ির মালিক হিসেবে । তিনি যদি সত্যিই তা মনে করতেন এ বাড়ির মালিক রোদেলা তাহলে তিনি অবশ্যই একান্তে এ ব্যাপারে ওর মতামত নিতেন। কিন্তু তিনি কি করলেন সবার সম্মুখে এসব আলোচনা তুললেন। আলোচনার কিছুই নেই যেন পরোক্ষ্য ভাবে তিনি তার সিদ্ধান্ত জানাচ্ছেন রোদেলাকে, এমন ভাব তার চোখেমুখে।

ঘর ভর্তি মানুষের সামনে কি বলবে ও, আড় চোখে তাকায় নাসিমার দিকে, দ্রুত সবার দিকেও একবার চোখ ফেরায় তাদের ভাব বুঝতে। তারা কিছুই শুনে নি এমন ভঙ্গিতে নাশতা খাচ্ছেন।
এর মধ্যেই নাসিমা আবার বলেন-
: দেশে কিছু একটার ব্যাবস্থা করতে পারলে….
তুই একটা কাজ কর সুফিয়ানকে বলে ওর একটা ব্যাবস্থা করে দিয়ে যা যাওয়ার আগে।

রোদেলা পর্যন্ত ঠিক ছিলো, কিন্তু সুফিয়ানকে এর মধ্যে আনায় মেজাজ বিগরে যায় ওর। এসব কথা তো তিনি ওকে একা নিয়ে বলতে পারতেন… তা না, এখন মেজাজ গরম হয়ে কোন উত্তর দিলে সবার কাছে খারাপ হয়ে যাবে ও। যদিও এসব পাত্তা দেয় না ও। তাদের কাছে খারাপ, ভালো কোন ম্যাটারই না রোদেলার কাছে। কিন্তু সুফিয়ানকে কেন এর মধ্যে টেনে আনলেন তাতেই রাগ এসে গেলো ওর। চা খেতে খেতে না শোনার ভঙ্গিতে ভাবতে লাগলো কথাগুলো। মুহূর্তেই মাথা ঠান্ডা করে ও, এটা যে তার চালাকি, বুঝতে বাকী থাকে না ওর। এটা বুঝেই সংযত হয় মুহূর্তে । কি বলবে কি করবে বুঝতে পারে না ও। কিছু সময় ভাবার পর রোদেলা চিন্তা করে বলবে যে – এ বাড়ি কিনবার পর যা কিছু ছিলো তা প্রিসিলার বিয়েতে খরচ হয়েছে। হাত একেবারে খালি, তাছাড়া সুফিয়ানের হাতেও তেমন কিছু নেই। আমরা ওখানে যে বাড়িটাতে থাকি তার লোন এখনো শোধ হয় নি। তাছাড়া ও ঐখানকার ব্যাবসা এখনো পুরোপুরি দাঁড় করাতে পারে নি উনি । তার উপর প্রিসিলাকে ইংল্যান্ড নিতে ও অনেক খরচ।

পরমুহূর্তেই ভাবে এসব বলা মনে নোভেলের স্যাটেল হওয়ার দায়িত্ব যে একমাত্র নাসিমারই তা মেনে নেয়া। নোভেল সবারই ভাতিজা। তবে নাসিমার একা কেন ওর ভবিষ্যৎ তৈরীর দায়…?

চা শেষ করে রোদেলা বলে-
সুফিয়ান নিজের ব্যাবসা গুটিয়ে ফেলেছে সেই কবে। ও কি ব্যাবস্থা করবে। তারচে ভালো মোঝো আঙ্কেলকে বলো।
মেঝো আঙ্কেল তো বিরাট ব্যাবসা, তাকে বললে তিনি নিশ্চয়ই কিছু একটা ঠিক ব্যাবস্থা করে দিবেন।

এতক্ষণে টনক নড়লো মেঝো খালামনি । তিনি একমুহূর্ত সময় না নিয়ে বললেন-
: তোর আঙ্কেলের ব্যাবসার অবস্থা আজকাল তো ভালো যাচ্ছে না। ঐ ঘরের ছেলেমেয়েরা সব ভাগবাটোয়ারা করে নিয়ে নিয়েছে। ব্যাবসা ছোট হয়ে গেছে তাই। তিনি এখন দিশেহারা। ব্যাংক লোন-টোন নিয়ে নাজেহাল অবস্থা।

ছোট খালামনিকে কিছুই জিজ্ঞেস করা হয় নি, তবুও তিনি তার পরপরই শুরু করলেন, ওর গাড়ির ব্যাবসাও ভালো যাচ্ছে না। কয়দিন পরপরই ড্রাইভার এ*ক্সি*ডে*ন্ট করো জেল জরিমানা নিয়ে হাজির হয়। দিনশেষে আয়-ব্যায়ের হিসাবই মেলে না। ইদানীং ভাবছি ওদের বাড়ি চলে যাবো। এত পেরেশানি নিয়ে বেঁচে থাকা মুশকিল।

কথাগুলো বলে গেলেন একনাগাড়ে। যেন পরের বার যে তার টার্ন আসবে তা বুঝেই আগেভাগে আত্নসমার্পণ করলেন তিনি।

কথাগুলো শুনে রোদেলা হেসে নাসিমার উদ্দেশ্যে
বললো-
: তুমি কিছু বলো…? তোমার স্বামীর তো কোন রোজগারই নেই, তাহলে তুমি কেন এত মাথা ঘামাচ্ছো নোভেলকে নিয়ে..? তাছাড়া ওর বাবা-মা তো মরে যায় নি, তারা আছেন ওর মাথার উপর। তুমি শুধু শুধুই…..

কথাটা শেষও করতে পারে নি রোদেলা। এরপর শুরু হলো নাসিমার কথার বান। কত করেছে আমার ভাইবোন তোদের জন্য। আর এখন সব ভুলে কথার জাহাজ হয়ে গিয়েছে, অকৃতজ্ঞ, বেইমান আরো কত কি।

আচ্ছা একটা জীবণে তারা ওদেরকে দেখেছে। তা ওরা কক্ষণো অস্বীকার করে না, কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটা সুযেগও বাদ দেয় না ওরা। তাছাড়া নাসিমাও কম করে নি তাদের জন্য। তারপর ও তাদের সবার দান নোভেলের ভবিষ্যৎ গড়ে দিলেই কি শোধ হয়ে যাবে। এ কথা কেন ভাবেন তিনি। তিনি নিজের মেয়েদের ব্যাপারটা না বুঝে নোভেলের কথা কেন ভাববেন। আমাদের উপর দিয়ে কি যাচ্ছে তা উনাকে কখনোই বলি না। ভাবি কি দরকার অযথা চিন্তা দেওয়ার। তাই তিনি ভাবেন কত ভালে আছি আমরা। টাকার পাহাড়ে বসে আছি আমরা, যেন এসব করে দিতে আমাদের ইচ্ছেটাই যথেষ্ট। যা আমরা করছি না। ইচ্ছে তো নেই-ই এটা মিথ্যা না, কিন্তু বর্তমানে অর্থ ও নেই ওদের হাতে।

এসব ব্যাপারে বিশ্রী রকমের ঝগড়া বাঁধে দুই জনে। খালামনি দুজনে তাদের বোনকে বোঝানোর তো প্রয়োজনই করে নি, মধ্যেখানে টুস করে বলে দিলো- আমরা মূর্খ মানুষ,
তোরা শিক্ষিত, তোদের কাছে এমন ব্যাবহার আশা করি নি…..

একথা শুনে, কষ্টের পাহাড় যেন আরেকটু উচ্চতা বাড়ালো বুকের মাঝখানে। কাঁদতে কাঁদতে ফিরেছিলো সেদিন ওরা দুবোনে….

ছোট্ট এই পৃথিবীটাকে ভালোবাসাহীন মনে হয়েছিল সেদিন। এমন সব কথা নাসিমা বলেছিলো ওর সম্পর্কে সে রাতে যা ও নিজেও জানতো না। অশ্লীল ভাষার ব্যাবহার ও নিজেও যে করে নি তা সত্যি না। আজন্ম একটা সংযত বাঁধ যে ছিলো তা ভেঙে গিয়েছিলো সেদিন। মনে যা এসেছে তাই বলেছে রোদেলা। কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরে একটা স্যাটাস লিখেছিলো ও সময়টাকে সাক্ষী রাখতে।
“বাদ এশা মাকে দাফন করে এলাম”।
কারন আজকের কষ্টটা ও ভুলতে চায় না।

কেউ জানলো না ভিতরকার রক্তক্ষরণের খবর।

মায়ের সব নম্বর, ব্লক করে দিলো, আলমারি খুলে রিটার্ন টিকিটের ডেট দেখলো। কতদিন বাকী তার হিসেবও করলো সাথে সাথে। কিছু কাজ আছে বাকী। সেগুলো করেই চলে যাবে এ নরক থেকে।

এরপর দুদিন কেটে যায়, একটা মানুষ ও ফোন করে না ওকে। এমন একটা পরিস্থিতি প্রথম বারের মতো ঘটলো। ও ভেবেছিলো কেউ হয়তো ওকে সান্ত্বনা দিবে, কিন্তু এক এক করে সাতটা দিন কেটে গেলো। রোদেলার আশাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিলো তারা। না কেউ এলো ওদের বাসায়, না কোন ফোন। দোষ না করেও দোষী ওরা। কেউ ওদের মনের কষ্টের খবর রাখে না। উল্টো সমাজ বলবে- মেয়েরা ভালো থেকে মায়ের খোঁজ নেয় না, বড় হয়ে বদলে গেছে আজকাল……

কত নির্মম করুণ দৃশ্য এটি….
কত নিষ্ঠুর প্রিয়জন নামের আত্নীয় গুলো। নিজেদের কাঁধে হাল পরায় কত দ্রুত বদলে যায় তাদের মুখ।

কাওকে দোষ দেয় না ও। দোষ ওদের ভাগ্যের। তা না হলে ওদের মা কেন ওদেরকে বুঝবে না…..

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here