#এ_তুমি_কেমন_তুমি
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্ব-১১
কাঁচের দরজায় হাত রেখে ফারহানকে একটু ছুঁয়ে দিতে চাইছে অনু। মাথায় ব্যান্ডেজ, হাত-পা শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যান্ডেজ করা। মুখের অক্সিজেন মাস্ক একটু পরপর ঝাপসা হয়ে আবার স্বচ্ছ হচ্ছে। দুই পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষ চিন্তিত মুখে বসে আছে। সেলিনা চৌধুরীর অবস্থা সবচেয়ে খারাপ, থেকে থেকে জ্ঞান হারাচ্ছে সে। তাকে সামলাতে ব্যস্ত তামান্না। রাতেই এক্সিডেন্ট করেছে ফারহান, মাথায় গভীর আঘাত পেয়েছে, বাম পা ভেঙে গেছে, শরীরের অনেক জায়গা কেটে গভীর ক্ষত হয়েছে, অবস্থা আশংকাজনক। মাথায় আঘাতটা একটু বেশি গভীর। অনু অনেকটা সময় ফারহানের দিকে তাকিয়ে থেকে একপাশে চলে গেলো। ইরফান এগিয়ে গেলো অনুর কাছে।
ইরফান অনুর পাশে বসতেই অনু বললো, “এসব কীভাবে হলো ভাইয়া?”
“তোর আর তামান্নার সামনেই নাকি বাসা থেকে বের হয়ে গিয়েছিলো। সারারাত ফোনে পাচ্ছিলাম না, শেষরাতে বারবার কল করছিলাম কিন্তু অফ বলছিল। সকালে একটা লোক কল দিয়ে বললো ফারহান হসপিটালে আছে। গাড়ির বামপাশ থেকে একটা ট্রাক ধাক্কা মেরেছে ফারহানের গাড়িতে। বামপাশটা একদম থেতলে গেছে। অনেকটা সময় ওভাবেই গাড়িতে ছিল ফারহান তাই অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে।”
অনু দু’হাতে মুখ চেপে কান্না করতে লাগলো নিঃশব্দে। ইরফান অনুর কাঁধে হাত রাখলো।
“একটা সত্যি কথা বলবি অনু?”
অনু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালে ইরফান বললো, “গতকাল ফারহান তোকে কিছু বলেছিল?”
অনু কী বলবে বুঝতে পারছে না।
“আমি জানি অনু গতকাল তোর সাথে ফারহানের কিছু তো কথা হয়েছে যার জন্য ফারহান এতটা ডেস্পারেট হয়ে গিয়েছিলো।”
অনু ভেজা গলায় বললো, “মানে? আমার কথায় ভাইয়া কেনো ডেস্পারেট হবে?”
হতাশ হলো ইরফান, “অনু তুই কী সত্যি বুঝতে পারিস না ফারহান তোকে কতটা ভালোবাসে?”
অনু বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকালো ইরফানের দিকে,”এসব আপনি কী বলছেন ভাইয়া?”
“আচ্ছা ফারহানের কথা বাদ দিলাম। তোর মনে কী ফারহানের জন্য কোনো অনুভূতি নেই?”
“এখন এসব বলার সময় নয়।”
“এটাই সঠিক সময়। আমার কথার উত্তর দে, ফারহানের সাথে তোর কী কথা হয়েছে?”
অনু উপায় না পেয়ে সব খোলে বললো ইরফানের কাছে। ইরফান এতক্ষণে আসল কাহিনি বুঝতে পারলো। ইরফান কিছু বলবে তার আগেই ফারহানের কেবিন থেকে নার্স হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে এলো। কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত চলো গেলো। অনু দৌড়ে কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে দেখলো ফারহান জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। ভয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠলো অনু। ইরফান অনুর পেছনে দাঁড়িয়ে সবটা দেখলো।
অনুর কাঁধে হাত রেখে বললো, “চিন্তা করিস না ফারহানের কিছু হবে না।”
একটু পর ডক্টর দ্রুত ফারহানের কেবিনে ঢুকলো, সাথে নার্স। সবাই চিন্তিত মুখে কেবল দেখে গেলো। অনু কেবিনের সামনে থেকে সরলো না। সেলিনা এখন শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনুর দিকে। অনুর অস্থিরতা নজর এড়ালো না সেলিনার। অনুর দিকে তাকিয়ে থেকেই আবার জ্ঞান হারালো সেলিনা। ফারহানকে ডক্টর ইলেক্ট্রিক শক দিচ্ছে। বেশ অনেকটা সময় পর ফারহান স্বাভাবিক হয়ে এলো।
ডক্টর বের হতেই ইরফান বললো, “ডক্টর আমার ভাইয়ের কী অবস্থা?”
ডক্টর ব্যর্থ গলায় বললো, “সরি।”
জুনায়েদ এগিয়ে এসে বললো, “সরি মানে কী?”
“রোগী কোমায় চলে গেছে। এখন আর আমাদের হাতে কিছু নেই। মাথায় আঘাত আর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্য এমনটা হয়েছে।”
ডক্টর নিজের কথা শেষ করে চলে গেলো কিন্তু রেখে গেলো দু’টো বিধস্ত পরিবার। ইরফান এতক্ষণ নিজেকে শক্ত রাখলেও এবার ভেঙে পড়লো।
জুনায়েদ বললো, “তোমরা চিন্তা করো না আমি দেখছি বিষয়টা।”
১৭.
ফারহানের ডানহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বসে আছে অনু। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মুখের দিকে। ফারহানকে এভাবে দেখে বুকের ভেতরটা যন্ত্রণায় জ্বলে যাচ্ছে অনুর।
“আর কত ঘুমাবেন এভাবে? এবার উঠুন না প্লিজ, আপনাকে এভাবে সহ্য হচ্ছে না আমার। কতদিন হয়ে গেলো আপনার গম্ভীর আওয়াজটা শুনতে পাই না।”
ছ’মাস হতে চললো ফারহান কোমায় আছে। সবাই সবকিছু জেনে গেছে এক্সিডেন্টের কিছুদিন পর। সব জেনে সবাই অনেক অবাক হয়েছিল, ফারহানের মতো বুদ্ধিমান ছেলে এমন একটা বোকামি করেছে কেউ বিশ্বাস করতে পারেনি। কিন্তু কারো কিছুই বলার ছিল না, কারণ বলবে কাকে? সে তো নিজেই থেকেও নেই। লিজা প্রথমদিকে কষ্ট পেলেও অনেকটা সামলে উঠেছে। ফারহানের এক্সিডেন্টের জন্য কষ্ট ঠিকই পেয়েছে কিন্তু কোথাও একটু অভিমান থেকেই গেছে। সবসময় দোয়া করে ফারহান তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাক কিন্তু দেখতে যায় না খুব একটা। মন দিয়ে নিজের পড়াশোনা করছে। তানিশাও নিজের পড়াশোনা আর ঘুরাঘুরি নিয়ে বেশ আছে। ফারহান বর্তমানে নিজের রুমেই আছে। রুম আর রুমের মতো নেই, একটা হসপিটালের কেবিন হয়ে গেছে। সেলিনার জন্য ফারহানকে বাড়িতে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সকাল বিকাল জুনায়েদ এসে দেখে যায়। অনুর দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে ফারহানের পাশে বসে বকবক করে। অহংকারী সেলিনা চৌধুরী বিলুপ্ত হয়ে গেছে ছেলের এক্সিডেন্টের সাথে। তামান্না আর ইরফানের সম্পর্ক একদম স্বাভাবিক হয়ে গেছে। সবাই ভালো আছে শুধু অনু আর সেলিনা ছাড়া। ফারহানের এই অবস্থা সবাই মেনে নিলেও অনু আর সেলিনা আজও মানতে পারেনি। অনুর এক ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে ফারহানের হাতে পড়লো। খানিকটা কেঁপে উঠলো ফারহানের হাত, অনু খেয়াল করলো না সেটা। আরো কিছুটা সময় সেখানে থেকে বের হয়ে গেলো রুম থেকে। বাসায় যেতে হবে তার, অফিস শেষে একটা ক্লাস ছিল সেটা করেই এখানে চলে এসেছে।
অনুকে দেখে তামান্না বললো, “তোমার জন্য চিংড়ি রান্না করলাম। না খেয়েই চলে যাচ্ছো কেনো?”
অনু তাড়া দিয়ে বললো, “এবার তো বাড়ি ফিরতে হবে ভাবি আর দেরি করা যাবে না।”
“আচ্ছা ঠিক আছে তুমি একটু দাঁড়াও আমি বক্সে করে দিয়ে দিচ্ছি।”
“কিন্তু ভাবি?”
“কোনো কিন্তু না অনু। তোমার জন্য রান্না করেছি তাই তোমাকেই খেতে হবে।”
তামান্না বক্স আনার জন্য কিচেনের দিকে পা বাড়াতেই কাঁচের গ্লাস পরার শব্দে থমকে দাঁড়ালো। তামান্না ঘুরে তাকালো অনুর দিকে। একে অপরের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে দৌড় লাগালো ফারহানের রুমের দিকে। সেই রুমে আপাতত ফারহান ছাড়া কেউ নেই।
কাঁচের গ্লাসটা ফ্লোরে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। ফারহানের ডান হাতটা সাইড টেবিলে রাখা। ফারহান দরজার দিকে কাত হয়ে নিভু নিভু চোখে তাকাচ্ছে। অনুর কোনো দিকে হুঁশ নেই। দ্রুত পায়ে ফারহানের দিকে আগাতে লাগলো।
তামান্না ব্যস্ত গলায় বললো, “অনু সাবধানে কাঁচ আছে।”
তামান্নার বলতে বলতেই এক টুকরো কাঁচ অনুর পায়ে বিঁধে গেলো। অনু একটু আহ শব্দ করে ব্যাথা উপেক্ষা করেই ফারহানের কাছে চলে গেলো।
কাঁপা হাতটা ফারহানের গালে রাখলো, “আপনার জ্ঞান ফিরেছে?”
ফারহান ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে রইলো অনুর দিকে। অনু ফারহানের দৃষ্টির মানে বুঝতে পারছে না। ফারহানের মস্তিষ্ক এখনো পুরোপুরি সচল হয়নি তাই হয়তো চিনতে কষ্ট হচ্ছে অনুকে।
অনু কাঁপা গলায় বললো, “এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো? কিছু তো বলুন। আজ কতগুলো দিন ধরে আপনার আওয়াজ শোনার জন্য ছটফট করে যাচ্ছি আমি। আপনি কী সেই খবর রেখেছেন?”
ফারহান অল্প আওয়াজে ভেঙে ভেঙে বললো, “অনামিকা।”
এটুকু বলেই আবার জ্ঞান হারালো। অনু কাঁদতে কাঁদতে ফারহানকে ডেকে যাচ্ছে। তামান্না দ্রুত জুনায়েদকে কল করতে লাগলো। তামান্নার চিৎকারে ততক্ষণে সেলিনা চলে এসেছে।
অস্থির গলায় বললো, “কী হয়েছে বউমা? তুমি এমন করছো কেনো? আমার ফারহান ঠিক আছে তো?”
তামান্না ভেজা গলায় হাসি মুখে বললো, “মা ফারহানের জ্ঞান ফিরেছে।”
সেলিনা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে তামান্নার দিকে। তাকে দেখে মন হচ্ছে সে তামান্নার কথার মানেই বুঝতে পারেনি। এদিকে অনু একাধারে ফারহানকে ডেকে যাচ্ছে।
সেলিনা কাঁপা গলায় বললো, “মানে, কী বলছো?”
“হ্যাঁ মা আমাদের ফারহান ঠিক হয়ে গেছে। একটু আগেই কথা বলেছে ফারহান।”
রুমের আনাচে কানাচে পরিপূর্ণ দুই পরিবারের মানুষ দিয়ে। জুনায়েদ চেকআপ করছে ফারহানকে। সবার চোখের কোণে আনন্দ অশ্রু।
জুনায়েদ সব চেক করে বললো, “ফারহানকে একটু হসপিটালে নিতে হবে।”
সবার হাসিখুশি মুখ অন্ধকার হয়ে গেলো, চিন্তার রেখা দেখা দিলো।
সেলিনা বললো, “ও না ঠিক হয়ে গেছে তাহলে হসপিটালে নিতে হবে কেনো ভাই?”
“আপা কিছু টেস্ট করাতে হবে। সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখতে হবে। ফারহান কোমা থেকে বের হয়েছে কিন্তু মস্তিষ্কে আঘাতের জন্য অন্য কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা দেখতে হবে।”
চলবে