যেদিন তুমি এসেছিলে – পর্ব 8

0
605

#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_৮
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_______________
শুভ্র আলোক ছটায় আহনাফের ফরসা পিঠটিতে আলতো কাঁপা হাতে রক্ত তুলা দিয়ে মুছে দিচ্ছে অর্ষা। পাশেই তুলোর প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে রেণু। আহনাফের লজ্জা কিন্তু ভাঙেনি। সে তোয়ালে খোলেনি শরীর থেকে। শুধুমাত্র ক্ষতস্থান থেকে কিঞ্চিৎ সরিয়েছে।
অর্ষার কাঁপাকাঁপা হাতের স্পর্শ বুঝতে বেগ পেতে হয় না আহনাফকে। সে অনেকক্ষণ যাবৎ চুপ থাকলেও এবার বলেই ফেলল,’তোমার কি আবার জ্বর এসেছে?’
অর্ষা চমকে উঠে বলল,’না তো!’
‘তাহলে এত কাঁপছ কেন?’
রেণু মুখ টিপে হাসছে। অর্ষার কাঁপাকাঁপা হাতটি সেও লক্ষ্য করেছে তবে এতক্ষণ কিছু বলার সাহস হয়নি। এখন আহনাফ বলায় সে আর না হেসে পারল না। অর্ষা আরো বিব্রতবোধ করতে থাকে।
‘আফায়ও মনে হয় শরমাইতাছে।’ মুখ টিপে হেসেই বলল রেণু।
আহনাফ অর্ষার দিকে ঘুরে বসল। অবাক হওয়ার ভান ধরে বলল,’তাই নাকি? তাহলে তো শরমে শরমে কাটাকাটি হওয়ার কথা। কারণ আমিও শরম পাই।’
রেণু এবার শব্দ করে হেসে ফেলে। আহনাফ ধমক দিয়ে বলে,’হাসছিস কেন? লজ্জা পাওয়া কি খারাপ কিছু?’
রেণুর হাসি বন্ধ হয়ে যায়। সে স্ট্যাচুর মতো সোজা হয়ে দাঁড়ায়। অর্ষা ঠিক বুঝতে পারল না আহনাফ তার পক্ষ নিল নাকি তাকে নিয়ে মজা উড়াল। সে আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। আহিলের কাছে শুনেছে লোকটা নাকি ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের। কিন্তু কই? এখন তো তার এমনটা মনে হচ্ছে না। সে তো দিব্যি অর্ষার সঙ্গে মজা লুটছে। এর মানে কী তবে? কিন্তু আহিলও তো আর তাকে মিথ্যে বলবে না!
সে ভাবনা-চিন্তা বাদ দিয়ে যারপরনাই নিজেকে শান্ত করল। নিচুস্বরে বলল,’আমি যাই। আপনি রেস্ট নিন।’
উত্তরের অপেক্ষা না করেই অর্ষা বড়ো বড়ো পা ফেলে আহনাফের ঘর থেকে প্রস্থান করে।
.
আমেনা বেগমদের বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ১২টা পার হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরে ছেলের এই অবস্থা দেখে তিনি কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছেন। জহির চৌধুরী অস্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন। আহনাফ মূলত তার মতোই হয়েছে। সহজে নিজের সুখ, দুঃখগুলো প্রকাশ করতে পারেন না; যেমনটা আমেনা বেগম অনায়াসেই পারছেন।
আমেনা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলছেন,’তুই আমায় আগে কেন জানাসনি বল তো? আমার ছেলের এই অবস্থা, আর আমরা আনন্দ করে এলাম!’
আহনাফ তার মাকে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল,’তেমন ক্ষতি তো হয়নি মা। তোমাদের চিন্তায় ফেলতে চাইনি। তাই জানাইনি।’
তিনি কাঁদতে কাঁদতেই রাগের সহিত বললেন,’এখন কি আগে থেকে জানার জন্য তোর ক্ষতি হওয়া লাগবে?’
‘শান্ত হও মা।’
‘কী শান্ত হব? তুই কি বুঝবি সন্তানের জন্য মায়ের কত চিন্তা হয়।’
‘সেটাই তো! আমাদের পেটে তো কখনো বাবু হবে না।’ চিন্তিত হওয়ার ভান ধরে বলল আহিল।
আহনাফ মুচকি হাসে। আমেনা বেগম আগুন দৃষ্টিতে ছোটো ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন,’খবরদার! আমার সাথে একদম মজা নিবি না।’
আহনাফ ইশারায় আহিলকে বলল মাকে আর না রাগাতে। সে নানানভাবে মাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। তবে কোনোভাবেই শান্ত করতে পারছেন না। না পেরে আহনাফ শুয়ে পড়ে বলল,’অনেক রাত হয়েছে মা। শরীরটা খুব খারাপ লাগছে।’
তিনি চোখের পানি মুছে বললেন,’তুই ঘুমা বাবু। আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।’
‘তোমাকে রাত জেগে বসে থাকতে হবে না। তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো।’
‘চুপ করে থাক। কোনো কথা বলবি না। তুই অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকবি আর আমি কাছে থেকেও ঘুমাব? বিদেশ-বিভূয়ে তো অসুস্থ হলেও জানাস না কখনো।’
‘জানিয়ে কী হবে? তুমি তো যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি জুড়ে দেবে। এখনো একই কাজ করছ। যাও তো ঘুমাও।’
‘আমি কী বললাম তুই শুনিসনি? তুই আগে বিয়েটা কর। বউয়ের হাতে তোর সব দায়িত্ব দিয়ে তারপর আমি শান্তিতে ঘুমাব।’
‘তুমি তাও ঘুমাবে না মা। আমি জানি ভালো করে।’
তিনি ফ্যাকাসে মুখে বললেন,’না ঘুমালে নাই। প্রয়োজনে বউ-শাশুড়ি মিলে ছেলের সেবা করব।’
জহির চৌধুরী বললেন,’ছেলেটাকে এবার একটু ঘুমাতে দাও।’
‘ওষুধ খেয়েছ ভাইয়া?’ জিজ্ঞেস করল আহিল।
‘হ্যাঁ। আমি খেয়েছি। অর্ষা ঠিকমতো খাচ্ছে নাকি, ওষুধ খেয়েছে নাকি ওর খবর নে আগে। যেহেতু তোর কারণেই এই বাড়িতে আসছে, সূতরাং অর্ষা এখন তোর রেসপন্সিবিলিটি।’
‘ও ঘুমাচ্ছে ভাইয়া। রেণু আপার থেকে জেনে নিয়েছি।’
আমেনা বেগম বললেন,’ঠিক আছে। তোরাও গিয়ে এখন ঘুমিয়ে পড়।’
আমেনা বেগম রয়ে গেলেন। তিনি ছেলের মাথায় চুলে বিলি কেটে দিচ্ছেন। এতক্ষণ ক্ষতস্থানে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছিল আহনাফের। তবে এখন মায়ের মমতাময়ী হাতের স্পর্শে দু’চোখের পাতায় শান্তির ঘুম ভর করেছে।
______
সকালে কলেজে যাওয়ার সময় কেয়া এসে উপস্থিত হলো এই বাড়ি। সকলের নাস্তা প্রায় শেষ। আহিল আর অর্ষা বের হচ্ছিল তখন মেইন গেইটে কেয়ার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। অর্ষা দৌঁড়ে গিয়ে কেয়াকে জড়িয়ে ধরে।
কেয়াও অর্ষাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,’কেমন আছিস?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌, আপু। তুমি কেমন আছো?’
‘আমিও ভালো আছি। গতকাল তো তোর সাথে দেখা হলো না। তাই ভাবলাম আজ দেখা করে যাই। তোর শরীর কেমন এখন?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌। এখন অনেকটাই সুস্থ। তুমি আজ শো-রুমে যাওনি?’
‘গিয়েছি। ভার্সিটিতে যাব আজ। পরীক্ষা আছে।’
‘পরীক্ষা কয়টায়?’
‘সাড়ে দশটায়। তোরা মনে হয় কলেজে যাচ্ছিলি। তাহলে আর দেরি করিস না। সাবধানে যা।’
আহিল বলল,’আমরা যাচ্ছি। তুমি ভেতরে যাও।’
‘না, না। এসেছিলাম অর্ষাকে দেখতেই।’
অর্ষা অসহায়ভাবে বলল,’ওর ভাই এক্সিডেন্ট করেছ জানো? করুণ অবস্থা!’
‘বলিস কী? কোথায় এখন?’
‘বাসায়ই আছে। দেখে আসো।’ বলল আহিল।
কেয়া হাতঘড়িতে সময় দেখে বলল,’ঠিক আছে। তোরা সাবধানে যাস। আল্লাহ্ হাফেজ।’
‘আল্লাহ্ হাফেজ।’
অর্ষা এবং আহিল যাওয়ার পর কেয়া বাড়িতে ঢোকে।
আমেনা বেগম ড্রয়িংরুম থেকে বেডরুমের দিকে যাচ্ছিলেন। রেণু দরজা খুলে দেওয়ার পর কেয়াকে দেখে দাঁড়িয়ে যান। হেসে বলেন,’আরে কেয়া তুমি! এসো ভেতরে এসো।’
কেয়াকে নিয়ে তিনি সোফায় বসলেন। কেয়া জিজ্ঞেস করল,’ভালো আছেন আন্টি?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌ মা, ভালো। তোমার কী খবর বলো? কাল আসলে দেখা করোনি কেন?’
‘জি আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো। সময় ছিল না আন্টি। আজ পরীক্ষা আছে তো তাই ছুটি নিয়েছি। ভাবলাম যাওয়ার আগে অর্ষাকে দেখে যাই।’
‘ওরা তো কিছুক্ষণ আগেই বের হলো।’
‘দেখা হয়েছে। আহনাফ ভাইয়া নাকি এক্সিডেন্ট করেছে?’
আমেনা বেগমের হাসি হাসি মুখটিতে আঁধার নেমে আসে। মুখটা প্রায় কাঁদো কাঁদো। ধরে আসা গলায় বললেন,’হ্যাঁ। কী যে হয়ে গেল!’
‘খুব বেশি অসুস্থ?’
‘হ্যাঁ। একটু আগে খাইয়ে ওষুধ খাওয়াই দিলাম। এখন ঘুমাচ্ছে।’
ঘুমাচ্ছে যখন তখন তো আর দেখতে যাওয়ার কিছু নেই। তাই কেয়া ছোটো করে বলল,’ওহ!’
‘তুমি খেয়ে এসেছ?’
‘জি আন্টি।’ একটু থেমে কেয়া হাত ঘড়িতে সময় দেখে বলল,’এখন তাহলে উঠি আমি। ভার্সিটিতে যেতে হবে।’
‘আচ্ছা। ভালোমতো পরীক্ষা দিও। আর সময় করে একদিন এসো।’
‘ইন-শা-আল্লাহ্ আসব।’ বলে কেয়া চলে যায়। আমেনা বেগম একবার আহনাফের রুমে উঁকি দিয়ে দেখেন জেগেছে কিনা। না, জাগেনি।
.
.
কলেজে আসার পর থেকে ফোনে ঘুটুর-মুটুর প্রেমালাপে ব্যস্ত লামিয়া। ওর ফিসফিসানি প্রেমালাপে বিরক্ত গ্যাঞ্জাম পার্টির বাকি সদস্য। এমনকি সে ক্লাসে বসেও পর্যন্ত বেঞ্চের নিচে মাথা লুকিয়ে ফিসফিস করে কথা বলছে।
রেশমি প্রায় অতিরিক্ত বিরক্ত হয়েই লামিয়ার কোমরে খোঁচা দিয়ে বলল,’দুনিয়াতে একলাই কি তুই পিরিত করস? ফোন রাখ কইতাছি। এক্ষুণী ফোন রাখবি।’
লামিয়া বিরক্ত চোখে তাকায়। ফোন কেটে ফিসফিস করে বলে,’এখন প্রেম করব না তো কখন করব? বিয়ের পর?’
‘বিয়ের পরেই করবি। বিরক্ত লাগতাছে তোর লুলামিগিরি!’
‘রেশমি বাজে কথা বলবি না।’
অর্ষা যথাসম্ভব চেষ্টা করছিল ওদের কথোপকথনে কান না দিয়ে স্যারের লেকচারে মনোযোগ দেওয়ার জন্য। ওর বামপাশে বসেছে জুঁই। সে কারো সাথে ম্যাসেজিং করছে আর মিটমিট করে হাসছে। ডানপাশে রেশমি আর লামিয়া ফিসফিস করেই তুমুল ঝগড়া বাঁধিয়ে দিয়েছে। একেই না বলে গ্যাঞ্জাম পার্টি?
স্যারের অনেকক্ষণ যাবৎ ওদের লক্ষ্য করছিলেন। এবার তিনি কড়াকণ্ঠে লামিয়া ও রেশমির উদ্দশ্যে বলল,’কী হচ্ছে?’
জুঁই ভয়ে আঁৎকে ওঠে। যদিও স্যার ধমক দিয়েছিলেন ওদের দুজনকে, তবে জুঁই ভেবে নিয়েছে স্যার ও’কে ফোন চালাতে দেখে ফেলেছে। যার দরুণ ভয়ের চোটে ফোন হাত থেকে ছিটকে অর্ষার পায়ের কাছে পড়েছে। ক্লাসের সকলের দৃষ্টি এখন ওদের বেঞ্চে বসা ওদের চারজনের ওপর স্থির। অর্ষা ফোন তুলে বেঞ্চের নিচ থেকে মাথা উঠাবে তখনই ফোন ভাইব্রেট হওয়া শুরু হয়। স্যারও তখন ওদের বেঞ্চের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
স্যার ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে আছেন অর্ষার দিকে। গম্ভীরকণ্ঠে বললেন,’কী? প্রেম করছ?’
বিস্ময়ে হা হয়ে যায় অর্ষার মুখ। প্রেম আর সে? সে তো এসবের আগেও নেই, পিছেও না। সে তড়িঘড়ি করে বলল,’না, না স্যার।’
‘কী না, না? দেখি ফোনটা দাও।’
জুঁই চোখ বন্ধ করে মনে মনে আল্লাহকে ডাকছে। স্যার ফোন হাতে নিয়ে দেখেন স্ক্রিনে লেখা ‘সন্টুমন্টু জান’। তিনি নামটা দেখে দু’ভ্রুঁ উঁচু করে জোরে বললেন,’সন্টুমন্টু জান?’
এই নাম শুনে ক্লাসের সবাই সমস্বরে হেসে ওঠে। স্যারও কেন জানি হেসে ফেলল। কিয়ৎক্ষণ বাদে সকলকে ধমক দিয়ে বলল,’সাইলেন্ট!’
দ্বিতীয় দফায় ফোন ভাইব্রেট হচ্ছে। এবার স্যার নিজেই ফোন রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দেন। তিনি কিছু বলার পূর্বেই ফোনের অপর প্রান্ত থেকে রাশভারী কণ্ঠে ভেসে আসে,’এই বেয়া’দব, ফা’জিল মেয়ে এখন কেন উত্তর দিচ্ছেন না? আপনার জান জান বলা বের করব আমি। আপনি চেনেন আমায়? খবরদার বলে দিচ্ছি আমায় ডিস্টার্ব করবেন না।’ বলে ফোন লাইন কেটে দেয় ছেলেটি।
এবার সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। এমনকি স্যারও। স্যার বিস্ময় নিয়ে বললেন,’তোমায় আমি অনেক সহজ-সরল ভাবতাম অর্ষা। সন্টুমন্টু জান লেখা দেখে ভাবলাম, থাক দু’দিন পর ভার্সিটিতে যাবে; এখন তো প্রেম করতেই পারে। কিন্তু এখন তো দেখছি ঘটনা ভিন্ন! তুমি একটা ছেলেকে ডিস্টার্ব করছ?’
স্যারের কথা কর্ণকুহরে আঘাত করার পূর্বেই অর্ষার হাত-পা কাঁপছে। এমনকি জুঁই বাদে গ্যাঞ্জাম পার্টির সকলেও অবাক। কারণ ওপাশে কথা বলা ছেলেটি ছিল আহনাফ!
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here