#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_২৩
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
উত্তেজনায় ঘরের মাঝে বারবার পায়চারি করছেন আমেনা বেগম। সাথে বারবার আহনাফকে কল করছেন। রিং হওয়া সত্ত্বেও আহনাফ ফোন রিসিভ করছে না। সে তার বাড়ির আর কারও সাথে যোগাযোগ না রাখলেও মাঝেমধ্যেই মায়ের সাথে কথা বলত। খোঁজ-খবরও নিত। তাহলে আজ আবার হঠাৎ কী হলো? অস্থিরচিত্তে মাথায় হাত রেখে সোফায় বসে আছেন জহির চৌধুরী। দুশ্চিন্তায় অন্তর্আত্মা কাঁপছে তার। এতক্ষণে অর্ষার সুইজারল্যান্ড পৌঁছে যাওয়ার কথা। অথচ আহনাফের সাথে তারা এখনো কোনো যোগাযোগ করতে পারছে না।
অর্ষাকে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দিয়ে আসার পর থেকেই আমেনা বেগম এবং তিনি আহনাফের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন। অনেকগুলো ম্যাসেজও পাঠিয়েছেন তারা। ডেলিভারি হলেও আহনাফ সীন করেনি। চিন্তায় তাদের গলা শুকিয়ে আসছে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে অসাড় হয়ে আসছে।
জহির চৌধুরী দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন। রাত ৪:০৫ বাজে। তাহলে সুইজারল্যান্ডে এখন রাত ১২:০৫ বাজে। এত রাতে মেয়েটা কোথায় আছে এখন! আহনাফের বাড়ির ঠিকানাও তো অর্ষাকে দেওয়া হয়নি।
তার বুকের ব্যথাটা বাড়ছে। তিনি সোফায় হেলান দিয়ে বসে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন,’ফোন ধরেনি?’
আমেনা বেগম মুখটা কাঁদোকাঁদো করে বললেন,’না! ম্যাসেজও সীন করছে না।’
‘আমরা মনে হয় আবার ভুল করে ফেললাম আমেনা! মেয়েটাকে এভাবে একা পাঠানো উচিত হয়নি আমাদের। অনেক বড়ো ভুল করে ফেললাম।’
আমেনা বেগম কী বলবে বুঝতে পারছেন না। হঠাৎ করে যে আহনাফ ফোন ধরবে না, ম্যাসেজ সীন করবে না এটা তো তারা কেউই ভাবতে পারেনি। এর আগে আমেনা বেগম যতবার ফোন করেছে, ম্যাসেজ করেছে আহনাফ রেসপন্স করেছে। আজ তাহলে হঠাৎ কী হলো ওর? কোনো দূর্ঘটনা! নাহ্! এসব ভাবতেই দুশ্চিন্তার পারদ আরো বেড়ে যাচ্ছে।
অর্ষার সুইজারল্যান্ড যাওয়ার বিষয়টি আহনাফকে আগেই জানানো হয়নি। তাহলে আহনাফ যে কোনোমতেই রাজি হতো না এটা তারা সকলেই জানে। এজন্য তারা প্ল্যান করেছিল অর্ষারকে ফ্লাইটে তুলে দিয়ে আহনাফকে খবরটি জানাবে। তখন অর্ষাকে বাড়িতে না নিয়ে ওর কোনো উপায় থাকত না। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে ঘটনা হিতে বিপরীত হয়ে গেল।
ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য ঘুম থেকে উঠেছিল আহিল। বাইরে লাইটের আলো জ্বলতে দেখে বের হয়। লিভিংরুমে বাবা-মা’কে দেখে একটু অবাকই হয়।
ঘুম ঘুম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,’তোমরা এখনো না ঘুমিয়ে এখানে কী করছ?’
আহিলকে দেখে জহির চৌধুরী এবং আমেনা বেগম দুজনেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। অর্ষার সুইজারল্যান্ড যাওয়ার বিষয়টি আহিলের থেকে লুকিয়েছে সবাই। কেননা এভাবে অর্ষার সুইজারল্যান্ড যাওয়ার বিষয়টি সে কোনোমতেই সমর্থন করত না। রাতে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পর আহিল যখন অর্ষার কথা জানতে চেয়েছিল, তখন তারা মিথ্যে বলেছিল অর্ষা ওর বাবার বাড়ি।
‘কোনো সমস্যা?’ বাবা-মাকে নিশ্চুপ ও নির্বাক থাকতে দেখে নিজেই আবার প্রশ্ন করল আহিল।
জহির চৌধুরী আমতা আমতা করে বললেন,’না। সব ঠিক আছে।’
আহিল তীক্ষ্ণ চোখে বাবা-মায়ের দিকে তাকায়। শাণিতকণ্ঠে বলে,’তোমাদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে না সব ঠিক আছে। কিছু লুকাচ্ছ তোমরা আমার থেকে?’
আমেনা বেগম হাসার চেষ্টা করে বললেন,’না, বাবা। কী লুকাব?’
‘কী লুকাচ্ছ সেটাই তো আমি জানতে চাচ্ছি।’
‘কিছুই না। তুমি অযথাই জেরা করছ।’ বললেন জহির চৌধুরী।
‘জেরা করছি না আব্বু। আমি শুধু জিজ্ঞেস করেছি।’
‘বললাম তো কিছু হয়নি।’
আহিলের সর্বপ্রথম এখন যেই নামটা প্রথম মাথায় এলো তা হলো ‘অর্ষা’। অর্ষার বিষয় ঘটিত কিছু বাবা-মা লুকাচ্ছে না তো?
সে কাঠ কাঠ গলায় শুধাল,’রাতে অর্ষা কখন বাড়ি ফিরেছিল?’
ভয়ে আমেনা বেগম ঘেমে গেছেন। একই তো অর্ষার চিন্তায় কলিজায় একটুখানিও পানি নেই। এখন আবার ছেলের জেরার সম্মুখে পড়তে হয়েছে। তারা দুজনেই উপলব্ধি করতে পারে আহিলের থেকে কিছু লুকিয়ে আর লাভ নেই। তারা ভেবেছিল অর্ষা আহনাফের কাছে পৌঁছানোর পর তারা আহিলকে সবটা জানাবে। এখন ঘটনা যখন ভিন্ন কিছু, তখন অপেক্ষা করার আর জো নেই।
লম্বা দম নিয়ে আমেনা বেগম সবকিছু আহিলকে বলতে শুরু করে। সব শুনে বিস্ফোরিত হয় আহিল।
বাবা-মায়ের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে বলে,’তোমরা আমায় না জানিয়ে কাজটা কেন করলে? ভাইয়ার সাথে জোর করে বিয়ে দিয়ে এক ভুল তো করেছই; এখন আবার আরেক ভুল। এটা তো ভুল নয় রিস্ক। কীভাবে ও’কে তোমরা একা পাঠালে বলো তো?’
রাগে চেঁচিয়ে কথাগুলো বলে ফুলদানিটা ফ্লোরে ছুঁড়ে মারে। তাদের কিছু বলতে না দিয়ে নিজেই বলে,’আমার বন্ধুরা আমার জান। সব বন্ধুগুলোর চেয়ে অর্ষা যে ব্যতিক্রম জানো না? ও বোকা স্বভাবের মা! তোমরা কাজটা একদম ঠিক করোনি। ওর যদি কিছু হয় সত্যি বলছি, খুব খারাপ হবে এবার।’
সে আর কিছু না বলে, না শুনে নিজের ঘরে গিয়ে শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দেয়। অপেক্ষা করে সকাল হওয়ার। গ্যাঞ্জাম পার্টির বাকিরা কি জানত অর্ষার সুইজারল্যান্ড যাওয়ার কথা?
__________
হেলেন তার বান্ধবী রিশিতাকে রিসিভ করে নিয়ে যাওয়ার সময় দেখল এয়ারপোর্টের বাইরে এক কোণায় দাঁড়িয়ে রয়েছে অর্ষা। চোখে-মুখে চিন্তার ছাঁপ।
গাড়িতে ওঠার পূর্বে দুজনের একবার চোখাচোখিও হয়ে গেল। হেলেনকে দেখেই অর্ষা জড়সড় হয়ে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দাঁড়াল। হেলেন ওর কাণ্ডে বাঁকা হাসে।
রিশিতা জিজ্ঞেস করে,’হাসছিস কেন?’
হেলেন হেসে দু’দিকে মাথা নাড়ায়। যার অর্থ বিশেষ কোনো কারণ নেই। গাড়িটি চোখের আড়াল হতেই অর্ষা হাফ ছেড়ে বাঁচে। কিন্তু তার দুশ্চিন্তা তো কমেনি। আহনাফ এখনো কেন আসছে না? আচ্ছা সে আসবে তো? যদি না আসে? তাহলে কোথায় যাবে, এখানকার কিছুই তো সে চেনে না।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেও পা ব্যথা করছিল। তাই লাগেজ মাটিতে রেখে, লাগেজের ওপর বসে। রাস্তার ধারে থাকা দূরের আলপাইন গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে মনে আল্লাহ্-কে ডাকছে।
২ঘণ্টা সে এভাবেই বাইরে বসে থাকে। এছাড়া সে করবে-ই বা কি? এতক্ষণেও আহনাফ আসেনি। এবার তার কান্না পাচ্ছে। সবাই বলেছিল আহনাফ নাকি ও’কে নিতে আসবে। কিন্তু আসেনি। ও অবশ্য এমন কিছুই ভেবেছিল। কারণ আহনাফ যে ও’কে পছন্দ করে না সেটা তো ও ভালো করেই জানে। তবুও সে অপেক্ষা করতে থাকে। তার কাছে কোনো সিমও নেই যে,যোগাযোগ করবে। কোথাও পরিচিত নেই কেউ। কার কাছে সাহায্য চাইবে? এই ভিনদেশে এখন সে কোথায়ই বা যাবে? কোথায় খুঁজবে আহনাফকে?
‘এক্সকিউজ মি?’
কারো কণ্ঠ শুনে চকিতে মাথা তুলে তাকায় অর্ষা। শর্ট স্কার্ট পরা একটি মেয়ে ঝুঁকে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ঝুঁকে দাঁড়ানোর ফলে সিল্কি চুলগুলোও ঝুঁকে রয়েছে। মেয়েটি কি বাঙালি? মুখের আদল তো অনেকটা ওরকম-ই। তবে দেখতে বেশ ফরসা।
সে সুললিত কণ্ঠে ইংরেজিতে বলল,’তোমাকে অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছি এখানে বসে আছো। কী হয়েছে?’
দুশ্চিন্তায় বোধবুদ্ধি হারানোর উপক্রম অর্ষার। সে কথাই বলতে পারছে না। এবার মেয়েটিও হাঁটু মুড়ে সামনে বসে। অর্ষার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখটা দেখে জিজ্ঞেস করে,’তুমি কি বাঙালি?’
অর্ষা উপর-নিচ মাথা ঝাঁকায়। এবার মেয়েটি স্পষ্ট বাংলা ভাষায় বলে,’আমিও বাঙালি। তবে ইন্ডিয়ান। তুমি?’
‘বাংলাদেশি।’
‘ওহ আই সী! তুমি বাংলাদেশ থেকে এসেছ?’
‘জি।’
‘কোথায় যাবে?’
‘জুরিখ শহরে।’
‘তুমি কি নতুন সুইজারল্যান্ডে? তোমায় কেউ নিতে আসেনি।’
এতক্ষণ যাবৎ আটকে রাখা কান্নাগুলো যেন এবার ঝর্ণার গতিতে আসতে চাইছে। সে দৃষ্টি নামিয়ে দু’দিকে মাথা নাড়ে। ফোঁপাচ্ছে সে।
মেয়েটি অস্থির হয়ে বলে,’একি! কাঁদছ কেন তুমি? আমায় বলো কী হয়েছে?’
এবার অর্ষা সত্যি সত্যিই কেঁদে ফেলে। মেয়েটি আবারও জানতে চায় কী হয়েছে। অর্ষা ক্রন্দনরতস্বরে সব বলে।
মেয়েটি অর্ষাকে আশ্বস্ত করে বলে,’কেঁদো না। আমার বাড়িও জুরিখ শহরে। তোমার হাজবেন্ড তো এখনো আসলো না। তুমি আপাতত আজ আমার বাসায় চলো। কাল সকালে না হয় দুজনে মিলে তোমার হাজবেন্ডকে খুঁজব। ছবি আছে তো?’
‘আছে।’
‘গুড। এবার বলো যাবে আমার সাথে?’
অর্ষা বুঝতে পারছিল না মেয়েটিকে বিশ্বাস করবে নাকি করবে না। পরক্ষণে ভাবল,এই ভিনদেশে বাঙালি যদি কেউ সাহায্যও করে সেটাই তো অনেক। রাস্তায় রাস্তায় ঘোরার চেয়ে এই রিস্কটুকু নেওয়াই যায়। তাই সে রাজি হয়ে গেল সাথে যাওয়ার জন্য।
.
.
কিছু ভাঙার শব্দে ঘুমের ঘোর কাটে আহনাফের। কিন্তু নেশা এখনো কাটেনি। আজ এক বন্ধুর পার্টি উপলক্ষে সারাদিন বারে ছিল। নেশার পরিমাণটা আজ বেশি হয়ে গেছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারছে না। হেলেন বাড়িতে দিয়ে না গেলে তো সে বোধ হয় আজ বাসায়ও আসতে পারত না। কী ভেঙেছে দেখার জন্য বহুকষ্টে সে উঠে দাঁড়ায়। হেলতে-দুলতে এগিয়ে গিয়ে সুইচ টিপে আলো জ্বালায়।
ফ্লোরে কাচের গ্লাস ভেঙে পড়ে আছে। পাশের টি-টেবিলে লেজ গুটিয়ে বসে আছে ক্যাথিওন। কাজটা কে করেছে বুঝতে বেগ পেতে হয় না ওর। সে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসে। এরপর কিচেনে গিয়ে ফ্রিজ থেকে লেবু এবং ঠাণ্ডা পানি বের করে শরবত বানায়। তিন গ্লাস শরবত পেটে চালান দেওয়ার পর নেশার ঘোর কাটে তার। মাথায় পানি দিয়ে চুলগুলো ভিজিয়ে নেয়।
বেডরুমে গিয়ে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ক্যাথিওনকে বলে,’অসময়ে ঘুম ভাঙালি, আবার গ্লাসও ভাঙলি। বড্ড জ্বালাচ্ছিস তো তুই।’
ক্যাথিওন উত্তরে বলে,’ম্যাউ, ম্যাউ।’
ও যে কী বলে ও-ই ভালো জানে। ওর ম্যাউ ম্যাউ ভাষা বোধগম্য হয় না আহনাফের। সে বালিশের পাশ থেকে ফোনটা হাতে নেয়। হোয়াটসএপে মায়ের অনেকগুলো ফোন আর ম্যাসেজ দেখতে পায়। অর্ষা সুইজারল্যান্ড! বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় সে। তাদের ম্যাসেজ অনুযায়ী প্রায় তিন ঘণ্টা আগেই অর্ষার ফ্লাইট ল্যান্ড করেছে। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। ততক্ষণে মায়ের নাম্বার থেকে আবারও কল আসে।
সে ফোন রিসিভ করে। ওপাশ থেকে আমেনা বেগম অস্থির হয়ে বলা শুরু করেন,’কোথায় ছিলি তুই? ফোন কেন রিসিভ করছিলি না? ম্যাসেজও দেখছিস না।’
আহনাফের ক্ষিপ্ত হয়ে বলে,’কাজটা তোমরা একদম ভালো করোনি মা। আমি যাচ্ছি এয়ারপোর্ট।’
সে ফোন কেটে দিয়ে গায়ে একটা শার্ট জড়িয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে এয়ারপোর্ট যাওয়ার উদ্দেশ্যে। এয়ারপোর্ট পৌঁছিয়ে পুরো এয়ারপোর্ট তন্ন তন্ন করে খোঁজে। বাইরেও খোঁজে। কোত্থাও নেই অর্ষা। সে এখন কোথায় খুঁজবে মেয়েটিকে? এই অচেনা শহরে যদি কোনো ক্ষতি হয়? সে কী করবে না করবে বুঝতে না পেরে এয়ারপোর্টের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবার চেষ্টা করে কোন স্টেপ তার নেওয়া উচিত। সে গাড়ি নিয়ে জুরিখ শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে অর্ষা খোঁজার বৃথা চেষ্টা করে। এভাবে একটা মানুষকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে অসম্ভব মনে হয়নি আহনাফের। এমনও হতে পারে আহনাফকে না পেয়ে অর্ষা হয়তো নিজেই রাস্তায় হেঁটে খোঁজার চেষ্টা করছে। এরকম আরো অনেক কিছু ভেবেই সে অর্ষাকে খোঁজার চেষ্টা করে। একসময় সে হাঁপিয়ে পড়ে। বুঝতে পারে এভাবে অর্ষাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। পুলিশের সাহায্য লাগবে।
পুলিশ স্টেশনে যাওয়ার আগে মনে পড়ল অর্ষার ছবিও তো তার কাছে নেই। সে গাড়ি এক সাইডে পার্ক করে আমেনা বেগমকে ম্যাসেজ করে অর্ষার কিছু ছবি পাঠিয়ে দিতে বলে।
.
.
অর্ষা মেয়েটির সাথে তার বাড়িতে এসেছে। সে চোখ ঘুরিয়ে চারপাশটা দেখছে। দু’রুমের একটা ফ্ল্যাট তবে বেশ নামি-দামি বেশভূষা বাড়িটির। আর সবকিছু পরিপাটি করে গোছানো।
অর্ষাকে রুম দেখিয়ে মেয়েটি বলল,’আগে ফ্রেশ হয়ে এসো।’
অর্ষা মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়। সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীর ম্যাজম্যাজ করছিল। ফ্রেশ হওয়াটা অতীব জরুরী ছিল বটে। সে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে মেয়েটি টেবিলে হরেক রকমের খাবার সাজিয়েছে।
অর্ষাকে দেখে হেসে বলল,’বসো।’
অর্ষা বসল। আশেপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,’বাড়িতে আর কেউ থাকে না?’
‘না, আমি একাই।’
‘ওহ। আচ্ছা আপনার নাম কী?’
‘সুজিকা। আমি কিন্তু খ্রিস্টান। আর আমাকে আপনি করে বলতে হবে না। তুমি করেই বলো।’
উত্তরে অর্ষা একটু হাসল। মেয়েটি খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল,’বাই দ্য ওয়ে, তোমার নাম কী?’
‘অর্ষা। আমি মুসলিম।’
অর্ষার সরলতায় সুজিকা মুচকি হাসে। খাবার সামনে পেয়ে চুপচাপ গলাধঃকরণ করছিল অর্ষা। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভীষণ ক্ষুধার্ত সে। তাই সুজিকা খাওয়ার সময় আর কোনো কথা বলল না। দুজনে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ করে ঘুমাতে যায়। শুয়ে শুয়ে দুজনে দেশের গল্প করছিল।
অর্ষা এক পর্যায়ে বলে,’আপনি অনেক ভালো আপু। ভাগ্যিস আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। নয়তো, আল্লাহ্ ভালো জানে এখন আমার কী হতো!’
সুজিকা হেসে বলে,’ডোন্ট ওয়্যারি বেবি। গড যা করে, ভালোর জন্যই করে। আচ্ছা তোমার হাজবেন্ড কেন তোমায় নিতে এলো না?’
অর্ষা প্রত্যুত্তরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’তার সাথে আমার সম্পর্ক স্বাভাবিক নয়। সে আমাকে পছন্দ করে না।’
এরপর বিস্তারিত সবই বলল। সব শুনে সুজিকা জিজ্ঞেস করে,’তোমাদের মাঝে ফিজিক্যাল কোনো সম্পর্ক হয়নি?’
অর্ষা একটু অস্বস্তিতে পড়ে যায়। জড়তা নিয়ে বলে,’না।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। অনেক জার্নি করে এসেছ। এখন তুমি ঘুমাও। কাল সকালে গল্প করা যাবে।’
কথা সত্য। অর্ষার সত্যিই ভীষণ ঘুম পেয়েছে। সে ‘গুড নাইট’ বলে অল্প কিছু সময়ের মাঝেই ঘুমিয়ে পড়ে। আচানক ঘুমের মাঝে সে অনুভব করে কেউ তার শরীরে হাত বুলাচ্ছে। দুঃস্বপ্ন ভেবে কাটাতে চাইলেও হচ্ছে না। স্পর্শগুলো বাস্তব মনে হচ্ছিল। চকিতে চোখ মেলে তাকায় অর্ষা। সবুজ ডিম লাইটের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পায় সুজিকা অর্ধন’গ্ন হয়ে অর্ষার ওপর ঝুঁকে রয়েছে এবং শরীরে হাত বুলাচ্ছে।
অর্ষা ধাক্কা দিয়ে সরাতে সরাতে জিজ্ঞেস করে,’এসব আপনি কী করছেন আপু? সরেন প্লিজ! আপু, আপনি এমন করছেন কেন?’
সুজিকা ঘোরলাগা কণ্ঠে বলে,’স্টপ ইউর মাউথ বেবি।’
এরপর সে অর্ষার ঘাড়ের কাছে মুখ নিয়ে চুমু খায়। ভয়ে, আতঙ্কে চেহারার বর্ণ পাল্টে গেছে অর্ষার। সে ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছে সুজির থেকে নিজেকে ছাড়ানোর। সে তো এটাই বুঝতে পারছে না, একটা মেয়ে হয়ে সে কেন এমন করছে? পরমুহূর্তে তার মাথায় এলো, সুজি কি তবে লেসবি’য়ান! অর্ষার মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। মাথা কাজ করছে না। মনে মনে সে আয়তুল কুরসী পড়তে লাগল। সেই মুহূর্তে সে খেয়াল করল বেড সাইড টেবিলে কাচের গ্লাসটি। গ্লাসটা হাতের মুঠো শক্ত করে ধরে জোরে আঘাত করে সুজির মাথায়। হঠাৎ আক্রমণে সুজিকা দুর্বল হয়ে পড়ে। সেই সুযোগে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে অর্ষা দৌঁড়ে ঘরের বাইরে বের হয়। পেছন পেছন সুজিকাও আসতে থাকে। অর্ষা দৌঁড়ে মেইন দরজার কাছে চলে আসে। ভাগ্যিস তালা দেওয়া ছিল না। সে দরজা খুলে দৌঁড়াতে থাকে রাস্তায়। পেছন পেছন সুজিকাও আসছে।
সে বারবার বলছে,’অর্ষা দাঁড়াও বলছি। আমি বলছি দাঁড়াও।’
অর্ষা প্রাণপণে দৌঁড়াতে থাকে। সে সময়ে সুজিকা এবং অর্ষাকে এভাবে দৌঁড়াতে দেখতে পায় আগত গাড়িতে থাকা পুলিশ। এভাবে দুজনকে দৌঁড়াতে দেখে তাদের সন্দেহ হয়। তাই তারা-ও ওদের ফলো করা শুরু করে।
গাড়ি নিয়ে দাঁড় করায় অর্ষার সামনে। অর্ষা থমকে দাঁড়ায়। গাড়ি থেকে পুলিশ বের হয়ে দুজনকেই ধরে ফেলে।
একজন অর্ষাকে জিজ্ঞেস করে,’কী হয়েছে?’
অর্ষা হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। কান্নার জন্য ঠিকমতো কথাও বলতে পারছে না। তাই পুলিশ দুজনকে থানায় নিয়ে আসে। থানায় গিয়ে অর্ষা কিছুটা শান্ত হয়। এমন কিছু কখনো তার সাথে হতে পারে বা হবে সে কল্পনাতেও ভাবেনি। মনে পড়লেই বুক ফেটে কান্না আসছিল।
‘শান্ত হোন। কী হয়েছে আমাদের বলুন।’ বলল সামনে বসে থাকা পুলিশ।
অর্ষা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বিস্তারিত সব বলে। সমস্ত ঘটনা জানার পর সুজিকাকে লকাপে আর অর্ষাকে সামনেই বসিয়ে রাখে। সে তখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। দুজন পুলিশকে সুজিকার বাসায় পাঠানো হয়েছে অর্ষার জিনিসপত্রগুলো নিয়ে আসার জন্য।
অর্ষাকে শান্ত করতে সামনে বসে থাকা পুলিশটি পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বলল,’পানি পান করুন।’
কাঁপা কাঁপা হাতে গ্লাসটি হাতে নিয়ে এক চুমুকে সম্পূর্ণ পানি শেষ করে অর্ষা। কান্নার পরিমাণ কিছুটা কমে এসেছে এখন। সে শান্ত হয়ে চেয়ারে বসে আছে। হাত-পা কাঁপছে এখনো। মনে হচ্ছে কোনো ঘোরের মাঝে আটকা পড়ে আছে। ঘটনাটি কিছুতেই ভুলতে পারছে না।
‘অর্ষা!’
কিছুক্ষণ বাদে পরিচিত কণ্ঠে নিজের নামটি শুনে চমকে পেছনে তাকায় অর্ষা। আহনাফ দাঁড়িয়ে রয়েছে। নিজের চোখকেই সে বিশ্বাস করতে পারছে না। এক পলক নিশ্চুপ তাকিয়ে থেকে উল্কার বেগে দৌঁড়ে গিয়ে আহনাফকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। সমস্ত শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে সে। শার্ট খাঁমচে ধরে হাউমাউ করে কান্না করতে শুরু করে। আহনাফ কিছু বলছে না। শুধু আলতোভাবে অর্ষার মাথায় হাত রাখে।
চলবে…