#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_৪৪
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
________________
গ্রীষ্মের দাবদাহ কড়া রোদের মধ্যে, চারদিকে যখন একটুও বাতাসের সন্ধান নেই; ঠিক সেই মুহূর্ত ভারী বর্ষণ যেমন অপ্রত্যাশিত হয় পথিকের নিকট তেমনটাই অপ্রত্যাশিত ছিল আহনাফের নিজে থেকে বলা ‘মিস ইউ’ কথাটি। এর পূর্বেও অর্ষা আহনাফের থেকে অপ্রত্যাশিত অনেক কিছু পেয়েছে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। হুটহাট লোকটা চমকে দিতে ওস্তাদ।
অর্ষার নিরবতার রেশ কাটার পূর্বে আহনাফ নিজেই কল কেটে দেয়। কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকে অর্ষা। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে হোয়াটসএপে বন্ধুদের গ্রুপে যায়। এরমধ্যে অনেকে মেনশন করেছে কলে জয়েন হওয়ার জন্য। অর্ষা গ্রুপকলে জয়েন হওয়ার পর রেশমি ধমক দিয়ে বলে,
‘এতক্ষণ লাগে আসতে?’
রেশমির কণ্ঠস্বরে চাপা উত্তেজনা স্পষ্ট টের পাচ্ছিল সকলে। আহিল বলল,
‘রাগারাগি বাদ দিয়ে এখন আসল কথা বল। কী হয়েছে? কোনো সমস্যা?’
‘সমস্যা না রে ভাই! ঘটনা দারুণ ঘটে গেছে। লামিয়া, রেস্টুরেন্টে ঐ ছেলেটার কথা মনে আছে তোর? ঐযে সিঁড়িতে হাতের সাথে যে হাত লেগেছিল?’ জানতে চাইল রেশমি।
লামিয়া বলল,’হুম মনে আছে। পরে কী হয়েছে বল।’
‘বিয়ের জন্য আজকে মা অনেকগুলো সিভি নিয়ে এসেছে বুঝেছিস? বলল চয়েজ করতে। প্রচন্ড অনিহা নিয়ে শুধুমাত্র মায়ের ভয়ে সিভিগুলো দেখছিলাম। তখন দেখি ঐ ছেলেরও সিভি সেখানে!’
ছেলেরা বাদে মেয়েরা সকলেই বেশ অবাক হয়ে যায়। রেস্টুরেন্টে ঐ ঘটনার সময় আশিক আর দিদার আগেই ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। আর আহিল তো বাইরেই ছিল। তাই ওরা কিছুই বুঝতে পারল না।
আশিক বলল,’তোরা কবের আর কোন ছেলের কথা বলছিস?’
রেশমি তখন বিস্তারিত ঘটনাটি তিন বন্ধুকে বলল। দিদার বলল,’তাহলে তো বেশ ভালোই হলো। আরেকটা দাওয়াত খাওয়ার সুযোগ হয়ে যাবে আবার।’
‘ছেলের নাম কী রে? আর কী করে?’ জানতে চাইল জুঁই।
‘নাম মাহিত। ইঞ্জিনিয়ার।’
অর্ষা বলল,’বাড়িতে বলেছিস ছেলে পছন্দ হয়েছে?’
‘ডিরেক্ট বলিনি। সিভিটা দেখিয়ে বলেছি, এটা ভালোই। দেখতে পারো। মা তো বলল জানাবে। দু’তিন দিনের মধ্যে দেখতে আসতে পারে।’
‘যাক! খুশির খবরই পেলাম। তোর ম্যাসেজ দেখে তো প্রথমে ভয়ই পেয়ে গেছিলাম।’ বলল অর্ষা।
রেশমি তখন খিলখিল করে হেসে ওঠে। আহিল অর্ষার উদ্দেশ্যে বলে,’আমি আটটার দিকে তোকে নিতে আসব।’
‘ঠিক আছে।’
.
.
দু’দিন পরই ছেলেপক্ষরা রেশমিকে দেখতে গিয়েছিল। আর খুশির খবর হচ্ছে সকলে রেশমিকে পছন্দও করেছে। আজ ছেলের বাড়ির সকলে আসবে বিয়ের কথা পাকাপাকি করতে। খুশিতেই রেশমির চোখের ঘুম উবে গেছে। সকাল সকাল সে তার চার বান্ধবীকে কল করে ইমার্জেন্সী বাড়িতে যেতে বলেছে। লামিয়া আর জুঁইয়ের জন্য হুট করে যাওয়াটা কষ্টকর হলেও, নিহাল ও সুবাসের সাপোর্টের জন্য শ্বশুর-শাশুড়ি কেউই কোনো আপত্তি করেনি। অন্যদিকে অর্ষার আবাসন শ্বশুরবাড়ি কম, বাপের বাড়ি বেশি বলা যায়। তারা এক কথাতেই রাজি হয়ে গেছিলেন।
রেশমির বাসায় গিয়েও অর্ষা ফোন নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত ছিল। ভাবির থেকে কেয়ার ফোন নাম্বার নেওয়ার পর সেদিনই কল করেছিল। দূর্ভাগ্যবশত নাম্বার সেদিন অফ ছিল। এরপরে যতদিন, যতবার ট্রাই করেছিল নাম্বার বন্ধই ছিল। আজ সকালে কেয়া নিজেই ফোন করেছিল। বলেছে বিকেলের দিকে ফোন দিয়ে কথা বলবে। এজন্যই অর্ষা এত অস্থির হয়ে রয়েছে।
রেশমি সাজগোছ নিয়ে ব্যস্ত। কোন শাড়ি পরবে, কীভাবে সাজবে নানান রকম প্রশ্ন। রীতিমতো জুঁই আর লামিয়া বিরক্ত হয়ে গেছে রেশমির এমন পাগলামিতে।
বিরক্ত হয়ে লামিয়া চিৎকার করে অর্ষাকে ডাকে। ডাক শুনে অর্ষা তড়িঘড়ি করে বারান্দা থেকে বেরিয়ে এসে বলে,’কী হয়েছে?’
‘রেশমিকে কিছু বলবি? দুই ঘণ্টা ধরে কোন শাড়ি পরবে সেটাই নাকি বুঝতেছে না। কতক্ষণ ধরে ইউটিউবে একটার পর একটা মেকাপ টিউটোরিয়াল ভিডিয়ো দেখতেছে, একটা সাজও নাকি ওর পছন্দ হচ্ছে না। মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে পুরা।’
রেশমি মুখ গোমড়া করে বসে আছে ড্রেসিংটেবিলের সামনে। অর্ষা পেছন থেকে ওর গলা জড়িয়ে ধরে বলল,’আজ তোর বিয়ের ডেট ফিক্সড হবে। বিয়ে তো আর হবে না। তাহলে এত সাজবি কেন তুই?’
রেশমি মুখটা ইনোসেন্টের মতো করে বলল,’আরে মাহিত আজই প্রথম আসবে। এই ক’দিন বাড়ি থেকে অনেবার কেউ না কেউ এসেছে। কিন্তু মাহিত আসেনি। সেই যে রেস্টুরেন্টে একবার দেখেছিল। ওর তো মনে হয় মনেও নেই। তাহলে সাজব না একটু সুন্দর করে?’
‘তোরা ফোনে কথা বলিসনি একবারও?’
‘বলেছি। সে তো আমার ছবিও দেখেছে। তাও বলে সে নাকি খেয়াল করেনি সেদিন কোন মেয়ের সাথে ধাক্কা খেয়েছিল!’
অর্ষা হেসে ফেলে। খাটের ওপর বিছিয়ে রাখা বিভিন্ন রকম শাড়ি থেকে মেরুন রঙের একটা শাড়ি তুলে নেয়। পেছন থেকে শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে ধরে বলে,’এই শাড়িটায় তোকে সুন্দর লাগবে।’
রেশমি হেসে বলে,’ওকে ডান। এটাই পরব।’
রেশমির রেডি হতে হতে ছেলেপক্ষের সবাই চলে আসে। কিছুক্ষণ বাদে যখন রেশমিকে সবার সামনে নিয়ে যায় সকাল তখন চমকে ওঠে। রেশমি তখনও অব্দি সকালকে দেখেইনি। অর্ষা সাথে থাকায় সকাল একটু কনফিউজড ছিল পাত্রী কে তা নিয়ে!
রেশমির নত করে রাখা মুখ দেখে সকাল আন্দাজ করে নেয় তার হবু ভাবি রেশমিই। তাহলে আহিলের সাথে যে সম্পর্ক ছিল! ব্রেকাপ হয়ে গেছে? অসংখ্য প্রশ্ন তার মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল। এ ক’দিন সে নানুর বাসায় ছিল বলে রেশমির ছবি দেখেনি। আর দেখতেও আসতে পারেনি। আজ সরাসরি যে তার জন্য এমন চমক অপেক্ষা করছিল তা সে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। ডেট ফিক্সড করার কথা তোলার পর সকাল বলল,
‘আমি ভাবির সাথে একটু কথা বলি?’
সেলিনা বেগম হেসে বললেন,’আচ্ছা যা।’
এরপর রেশমির দিকে তাকিয়ে বললেন,’তোমার ননোদিনীকে নিয়ে যাও।’
রেশমিও এবার সকালের দিকে তাকিয়ে চমকে যায়। সবকিছু কেমন ঘেটে যাচ্ছে। মাহিত সকালের ভাই! হায় আল্লাহ্! সে নিজেও তো এবার সারপ্রাইজড! আচ্ছা সকাল যদি এখন আহিলের বিষয়টা বাসায় বলে দেয় তাহলে? শেষ! স’র্ব’না’শ এবার হবে রে ভাই! ভয়ে ভয়ে সে সকালকে নিয়ে বাড়ির ছাদে গেল।
আড়ালে গিয়ে সকাল জিজ্ঞেস করে,’আপনার না আহিলের সাথে রিলেশন ছিল? ভাইয়াকে কেন বিয়ে করছেন তাহলে?’
রেশমি ভয়ে অস্থিরচিত্তে বলে,’আস্তে বলো।’
‘আমি আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি। আহিলের সাথে কি আপনার ব্রেকাপ হয়ে গেছে?’
রেশমি এবার বুঝিয়ে বলে,’আরে কীসের ব্রেকাপ! আহিল আমার খুব ভালো বন্ধু। আমাদের একটা গ্যাং আছে। নাম গ্যাঞ্জাম পার্টি। নামটা আমাদের দেওয়া নয়। অন্যদের দেওয়া। আসলে আমরা সবসময় একটা না একটা গ্যাঞ্জাম করতামই তাই এরকম নাম দেওয়া।’
এইটুকু বলে রেশমি হেসে ফেলে। কলেজে কাটানো মুহূর্তগুলোর কথা মনে পড়ে যায় তার। সকাল সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।
রেশমি আবার বলা শুরু করে,’আমাদের গ্যাং-এর সদস্যরা হচ্ছে আমি, অর্ষা, লামিয়া, জুঁই, আহিল, আশিক আর দিদার। আমরা খুব ভালো বন্ধু মানে খুবই ভালো বন্ধু! একজন আরেকজনের প্রাণ বলতে পারো। আমাদের কখনোই কারো প্রতি বন্ধুত্বের ভালোবাসা ব্যতীত অন্য কোনো আকর্ষণ বা ভালোলাগা কাজ করেনি। স্রেফ বন্ধুত্বের বন্ডিং ছিল, আছে আর সারাজীবন থাকবে। তুমি আহিলের পিছে বেশ ভালোভাবেই লেগেছিলে। আর আহিল চাচ্ছিল না কোনো রকম সম্পর্কে জড়াতে। অন্যদিকে তুমিও ওর পিছু ছাড়ছিলে না। তাই বাধ্য হয়ে আমাকে ওর গার্লফ্রেন্ড সাজিয়ে কথা বলিয়েছে তোমার সাথে।’
‘এসব সত্যি তো ভাবি?’
‘আলবৎ সত্যি। একটা কথাও মিথ্যে নয়। আমার সাথে যে একটা মেয়ে এলো না তখন? ওর নাম অর্ষা। সম্পর্কে আহিলের ভাবিও হয়। মানে ওর আপন বড়ো ভাইয়ের সাথে বিয়ে হয়েছে বুঝেছ? আমার রুমে আরো দু’জন আছে। লামিয়া আর জুঁই। আশিক, দিদার আর আহিল একটুপরই চলে আসবে। তখনই বুঝতে পারবে আমি সত্যি বলছি নাকি মিথ্যা।’
সব শুনে সকাল ক্রুর হাসি দিয়ে মনে মনে বলে,’এবার কোথায় পালাবে আহিইল্লা!’
এরপর সে খুশিতে, আনন্দে আপ্লুত হয়ে রেশমির গালে চুমু খেয়ে বলে,’থ্যাঙ্কস আমার ভাইয়াকে বিয়ে করার জন্য। না হলে তো সত্যিটা জানতেই পারতাম না।’
রেশমি হেসে ফেলে। বুকের ওপর থেকে ভয় নামক ভারী পাথরটা নেমে গেছে। সে সকালের হাত ধরে বলল,’তোমার ভাইয়াকে এসব বলিও না প্লিজ!’
সকাল ও’কে আশ্বস্ত করে বলল,’চিন্তা নেই ভাবি। আমি কিছুই বলব না। ভাইয়া অনেক ফ্রি মাইন্ডের আছে। আপনি নিজে থেকেই চাইলে সব শেয়ার করতে পারবেন। তবে না বলাই ভালো আপাতত। নয়তো ভাইয়া যদি আমার এসব কাণ্ডকারখানা জানে, তাহলে আমি শেষ!’
‘আরে জানবে না। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।’
সকাল আর রেশমি আরো কিছুক্ষণ থাকে ছাদে। দুজনে গল্পগুজব করে। আহিলের সম্পর্কে নানান রকম গল্প উন্মুখ হয়ে শুনছে সকাল। তার যে কী রকম খুশি লাগছে তা বোধ করি ভাষায়ও প্রকাশ করা যাবে না।
দুজনে নিচে নেমে আসে। ততক্ষণে আহিল, আশিক আর দিদারও চলে এসেছিল। সকালকে দেখে আহিলের চোখ ছানাবড়া। অন্যদিকে আহিলের এমন রিয়াকশন দেখে সকাল মুখ টিপে হাসে। বিয়ের ডেট ফিক্সড হয়েছে। চার দিন পর রোজা শুরু হবে। তাই ঈদের পরেরদিনই বিয়ে। সকলে খাওয়া-দাওয়া করে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। সুযোগ বুঝে সকাল গিয়ে আহিলের পাশে দাঁড়ায়। সবার দৃষ্টির আড়ালে ফিসফিস করে বলে,
‘তৈরি থাকিয়েন আপনি। নাটক যে কত প্রকার ও কী কী সেসব এবার আমি আপনাকে বোঝাব!’
আহিল চোখ বড়ো করে তাকিয়ে থাকে। কী রকম সাংঘাতিক মেয়ে! সকাল বাঁকা হাসি দিয়ে সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়।
আহিল বিরক্ত হয়ে মনে মনে বলে,’রেশমির জন্য কি দুনিয়াতে ছেলের অভাব পড়েছিল? এই মেয়েটার ভাইয়ের সাথেই বিয়ে ঠিক হওয়া লাগল? ধ্যাত! জীবনটা তেজপাতা বানিয়ে দেবে এবার।’
সাতটার দিকে অর্ষাকে সাথে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আহিল। অর্ষার মন মেজাজ খুবই খারাপ। কেয়া ফোন করবে বলেও করল না। সে ফোন দিয়েও নাম্বার বন্ধ পাচ্ছে। এরকম করার মানে কী!
বাড়িতে গিয়ে রেস্ট নেওয়ার জন্য আগে নিজের রুমে চলে যায়। ফ্রেশ হয়ে শুয়ে থাকে কিছুক্ষণ। ঘুমে চোখ লেগে আসছিল সেই মুহূর্তে আননোন একটা নাম্বার থেকে কল আসে।
ঘুম জড়ানো কণ্ঠে ফোন রিসিভ করে সালাম দেয় অর্ষা।
ওপাশ থেকে সালামের উত্তর আসে কেয়ার কণ্ঠ থেকে। তড়াক করে শোয়া থেকে উঠে বসে অর্ষা।
‘কী করছিস?’ জিজ্ঞেস করল কেয়া।
‘এতক্ষণে ফোন দেওয়ার সময় হলো? কখন ফোন করার কথা ছিল?’
‘রাগ করিস না। আমার ফোনে কিছুদিন ধরেই সমস্যা। আজ সকালে ঠিক করে এনে তোকে কল করেছিলাম। দুপুরের দিকে আবারও একই সমস্যা। তাই বিকেলে ফোন দিতে পারিনি। এখন তোর ভাইয়ার ফোন থেকে ফোন দিলাম।’
অর্ষা কথা খুঁজে পাচ্ছে না। কতকিছুই তো বলার ছিল তার। তাহলে এখন কেন বলতে পারছে না?
কেয়া নিজে থেকেই বলল,’আমার ওপর তোর খুব রাগ তাই না?’
অর্ষা মলিনকণ্ঠে বলে,’কেন করলে এমন আপু?’
কেয়া অপরাধী কণ্ঠে বলল,’এছাড়া আমার কোনো উপায় ছিল না। তখন সিচুয়েশনটাই এমন ছিল যে অন্যকিছু ভাবার সুযোগ আমার ছিল না। তোর ভাইয়াকে ঠকানোও আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।’
‘তুমি তো কখনোই তার কথা আমায় বলোনি।’
‘ভেবেছিলাম সময় হলে বলব। কিন্তু তার আগে যে সবকিছু এমন এলোমেলো হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি।’
‘এভাবে পালানো উচিত হয়নি তোমার। তুমি আহিলের ভাইয়াকে সবটা বলতে তো পারতে। বিয়ের শপিং করলে যখন, তখনও কি বলতে পারোনি?’
‘সাহস হয়নি তখন।’
‘একটু সাহসের অভাবের জন্য মানুষটাকে হার্ট হতে হয়েছে। দুই পরিবারকে অপমানিত হতে হয়েছে।’
কেয়া চুপ করে থাকে। বলার মতো উত্তর নেই তার কাছে। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে অর্ষা বলল,’বাদ দাও। যা হওয়ার হয়েছিল। কিন্তু তুমি আমার সাথে কেন কোনো যোগাযোগ করোনি? রেজাল্টের দিন কেন ওভাবে কল রেখে দিয়েছিল?’
‘আমার জন্য তোকে সাফার করতে হয়েছে। কোন মুখে তোর সাথে কথা বলতাম? এখনো তোর মুখোমুখি হওয়ার সাহস আমার নেই।’
‘এজন্য কী তুমি আমার সামনে আসবে না কখনোই? যা হয়ে গেছে তা কি এখন আর আমরা বদলাতে পারব?’
কেয়া নিরুত্তর। অর্ষা বলল,’কবে দেখা করবে আমার সাথে?’
‘জানিনা।’
‘জানিনা মানে? এটা আবার কেমন কথা? বিয়ের পর দেখি খুব স্বার্থপর হয়ে গেছ। ভাইয়া কোথায়? দাও দেখি তার সাথে কথা বলি।’
‘বাজারে গেছে। আসলে কথা বলিয়ে দেবো।’
‘উনি জানে আমার কথা?’
‘সব জানে।’
‘বাহ্! শুধু আমিই কিছু জানিনি। সবকিছু হলো তোমাদের জন্য। মাঝখান থেকে শাস্তিও আমায়ই পেতে হলো। এমনকি তুমিও কোনো যোগাযোগ করোনি। মনে তো হয়েছিল সবকিছুর জন্য বোধ হয় আমিই দায়ী ছিলাম।’
‘এভাবে বলিস না সোনা! তোর কোনো ফল্ট ছিল না। একটা কথা বলবি?’
‘কী?’
‘তুই কি তার সাথে সুখী নোস?’
অর্ষা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,’আল্লাহ্ ভালোই রেখেছে আপু।’
‘একটা সত্যি কথা কি জানিস, আমার মন কেন জানি তোদের একসাথে দেখতে চাইত। আমি মাঝে মাঝেই ভাবতাম তোদের বিয়ের কথা।’
‘কে জানত তোমার ভাবনা যে একদিন সত্যি হয়ে যাবে!’
‘আচ্ছা শোন, তোকে একটা গুড নিউজ দেই।’
‘দাও দাও।’
‘তুই খালামনি হবি।’
‘কী! মজা করছ?’
‘উঁহু! সত্যি।’
অর্ষা খুশিতে আপ্লুত হয়ে বলে,’আল্লাহ্! আজকে কতগুলা খুশির খবর পেলাম। আপু! বিশ্বাস করো, আমার ইচ্ছে করছে তোমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। আমার সব রাগ, অভিমান পানি হয়ে গেছে এই খবর জানার পর। কয় মাস চলছে?’
‘তিন মাস। শোন, আপু কিন্তু জানে না। তুই আগেই বলিস না কিছু।’
‘আচ্ছা বলব না। তুমি প্লিজ আমার সাথে দেখা করো। আমি তোমায় না দেখে আর থাকতে পারব না।’
‘আচ্ছা আচ্ছা। তুই এত অস্থির হোস না। তোর ভাইয়া আসলে তোর সাথে কথা বলিয়ে দেবো। তখন তোরা দেখা করার বিষয়ে কথা বলে নিস।আরে লক্ষী বোন আমার, তোর শ্বশুরবাড়িতে আমার কথা কিছু জানাইস না প্লিজ!’
‘ঠিক আছে।’
কথা শেষ করে অর্ষার ইচ্ছে করছিল খুশিতে নাচতে। সবকিছু যেন ভালোই হচ্ছে। ভয় হয়! কোনো খারাপ সংবাদ যেন আর না আসে। এখন থেকে যেন সবটা শুধু ভালোই হয়।
সব ভালো গেলেও ভালো যাচ্ছিল না আহনাফের সাথে অর্ষার সময়গুলো। ইদানীং আহনাফের ভীষণ ব্যস্ততা। আগে তো আগ বাড়িয়ে ফোন দিত। ম্যাসেজ করত। এখন কিছুই হয় না। অর্ষা ফোন দিলে কথা হয়। নয়তো না। প্রথম প্রথম ভালোবাসা দেখিয়ে এখন সব ভালোবাসা ডুবে ম’রে’ছে! রাগও হয়, খারাপও লাগে। সবচেয়ে বেশি হয় কষ্ট। মানুষ তাই বলে এমনভাবে বদলে যায়? তাহলে অল্প সময়ের জন্য ভালোবাসা না দেখালেই পারত।
.
কাল থেকে প্রথম রোজা শুরু। সন্ধ্যা থেকেই সেহরির জন্য নানান পদের রান্না করছে আমেনা বেগম আর অর্ষা। ঈদ ঈদ আমেজ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। আমেনা বেগম রান্না করতে করতে অর্ষাকে বলছেন,
‘আহনাফটা থাকলে কত ভালো হতো এখন! ছেলের কাজই শেষ হয় না। কবে আসবে কে জানে।’
অর্ষার মনটাও খারাপ হয়ে যায়। সে তো নিজেও আহনাফের প্রতিক্ষায় দিন গুনছে। রান্নাবান্না শেষ করে রাতে খেয়ে-দেয়ে সবাই আজ আগেই ঘুমিয়ে পড়ে। সেহরির আগে উঠে তাহাজ্জুদ পড়বে বলে আজ আর কেউ রাত জাগেনি।
রাত তখন ১টা বাজে। চোখের ওপর আলো পড়ায় ঘুম পাতলা হয়ে যায় অর্ষার। পাশ থেকে তখন মৃদু ধাক্কা আসে।
‘আরে সরো না একটু! আমাকেও শুতে দাও।’
নিভু নিভু চোখে অর্ষা তাকায়। রুমের লাইট জ্বালানো। সে তো লাইট বন্ধ করে রেখেছিল। পাশে তাকিয়ে এবার সে চমকে যায়। আহনাফ! স্বপ্ন নাকি সত্যি? সে লাফিয়ে উঠে বসে। কাঁথা-বালিশ টেনে বুকের ওপর নিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকে। ভয় পেয়েছে খুব বোঝা যাচ্ছে। আহনাফ ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,
‘ওমন করছ কেন? ভয় পেয়েছ?’
অর্ষা তুতলিয়ে বলল,’আপনি কবে এসেছেন? কখন এসেছেন?’
অর্ষার ভয় পাওয়া দেখে আহনাফ দীর্ঘশ্বাস নেয়। উঠে বসে বলে,’দিতে চাইলাম সারপ্রাইজ। আর তুমি পেলে ভয়!’
চলবে…