#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_৪৮
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
চারিদিক শুনশান। দেয়ালজুরে ঝলমলে আলোর রোশনাই। ইফতারের কিছু পর দিয়ে মাহিত রেশমির সব বন্ধুদের ট্রিট দেবে বলে রেস্টুরেন্টে নিয়ে এসেছে। সাড়াশব্দ এতক্ষণ ছিল-ই না বলতে গেলে। সবার ধারণা ছিল, রোজার মাস বলে হয়তো রেস্টুরেন্টে লোকজন তেমন আসে না। তবে ধীরে ধীরে লোকজনের সমাগম টের পাওয়া যাচ্ছে।
সকলের সাথে উপস্থিত আছে আহনাফ, নিহাল আর সুবাসও। মাহিত-ই বলে দিয়েছিল ওদেরকে সাথে করে নিয়ে আসতে। আগে থেকে পরিচিতি থাকা ভালো। সম্পর্ক মজবুত হয় এতে। এছাড়া সে রেশমির মুখে বন্ধুদের এতশত গল্প শোনে যে, সবার সাথে তার সম্পর্কের ভিতও মজবুত করতে ইচ্ছে হয়।
পুরো টেবিল দখল করে আছে এতগুলো মানুষ; তবুও কারও মুখে যেন কোনো রকম ‘রা’ নেই। কেমন যেন নিরব, নিস্তব্ধ। সমস্যাটা হয়েছে অন্য জায়গায়। এখানে আহনাফ, নিহাল, সুবাস আর মাহিত উপস্থিত বাকিদের থেকে সিনিয়র। বাকিরা চাইলেও ওদের সামনে উড়তে পারছে না। মুখের কাছে এসে কথা আটকে থাকলেও বকবকানি শুরু করতে পারছে না। সকাল বসেছে মাহিতের পাশে। ভয়ে ভয়ে আড়চোখে সে বার দু’য়েক আহিলের দিকে তাকিয়েছিল বৈকি। আহিলের কোনো ধ্যানজ্ঞান বিশেষ লক্ষ্য হচ্ছে না। সে হাতের আঙুল দ্বারা টেবিলের ওপর আঁকিবুকি করছে।
নিরব পরিস্থিতি সরব করে তুলতে মাহিত-ই প্রথম কথা তুলল। রেশমির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তোমার বন্ধুরা নাকি খুব কথা বলে? কই এখন তো দেখছি সবাই কেমন চুপচাপ।’
মাহিতের কথায় বন্ধুরা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। রেশমি বলে,’ওরা হয়তো লজ্জা পাচ্ছে।’
‘আরে লজ্জা পাওয়ার কী আছে? এখানে তো সব আমরা-আমরাই। সবাই সবার সাথে পরিচিত হব, আড্ডা দেবো এজন্যই তো একসাথে হয়েছি।’ বলল মাহিত।
এরপর মাহিত নিজে থেকে আহনাফ, নিহাল আর সুবাসের সাথে গল্প জুড়ে দিল। স্বভাবে সে দিলখোলা। মন খুলে কথা বলতে পছন্দ করে। অল্প সময়েই চারজনের কথাবার্তার পর্ব জমে উঠেছে। ওয়েটার এসে আগে কোল্ড কফি দিয়ে যায় সবাইকে।
দিদার কফিতে চুমুক দিয়ে আশিকের কানে ফিসফিস করে বলে,’একটা জিনিস কি লক্ষ্য করেছিস?’
আশিক ঘাড় বাঁকিয়ে জানতে চাইল,’কী?’
‘এখানে আমি আর তুই বাদে সবাই ডাবল।’
‘বলিস কী!’
আশিক খেয়াল করে দেখল কথা সত্য। আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সেও ফিসফিস করে বলে,’কপালে বুঝি প্রেম নেই রে!’
আহিল ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে বলে,’বিড়বিড় করে কী বলিস?’
দিদার দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,’বলি নিজেদের দুঃখের কথা।’
‘তোদের আবার কীসের দুঃখ?’
‘এইযে আমি আর আশিক বাদে সবাই মিঙ্গেল।’
‘ঐ হ্যালো, আমি নিজেও আছি তোদের দলে।’
‘ছাই আছিস! তোমার নায়িকাও তো এখানে আছে। সকালের কথা বলছি।’
‘ব্যাটা আস্তে বল! ওর ভাই আছে এখানে।’
আশিক বলল,’আর থাকা! সে এখন তিন দুলাভাইয়ের সাথে গল্পে ব্যস্ত দেখছিস না? ভালো কথা, তোর আর সকালের হিল্লেটিল্লে কি হয়ে গেছে?’
‘আহিল চোয়াল শক্ত করে বলে,বাজে বকিস না।’
‘বাজে কথা হবে কেন? যদি হয়ে যায়, তাহলে সকালকে আমাদের হয়ে একটা কথা বলে দিস।’
আহিল সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আশিক নিজে থেকেই বলে,’বলবি যে ওর দুই বান্ধবী আছে না? কী যেন নাম? মনে পড়ছে না। আচ্ছা যাই হোক, ওদের সাথে আমার আর দিদারের একটা ভাবসাব করিয়ে দিতে বলিস।’
আহিল বিরক্তিসূচক শব্দ করে কফিতে চুমুক দেয়। এর মাঝে খাবার এসে পড়ে। দিদারের সব আফসোস গায়েব হয়ে গেছে খাবার দেখে। খেতে খেতে আশিক সকালের উদ্দেশ্যে বলল,
‘আচ্ছা তোমার নাম সকাল কেন? মানে বিকাল, সন্ধ্যা, রাত নয় কেন?’
প্রশ্ন শুনে সকাল হকচকিয়ে যায়। অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে বসে থাকে। এটাও কি করার মতো কোনো প্রশ্ন হলো? উত্তরে মাহিত বলে,
‘আসলে ও সকালে হয়েছিল তো তাই আব্বু ওর নাম সকাল-ই রেখে দিয়েছে। আবার আম্মুর নামের প্রথম অক্ষরের সাথেও ওর নামের প্রথম অক্ষরের মিল আছে।’
আশিক উৎসাহিত হয়ে বলল,’কারেক্ট। আহিলের সাথেও মিল আছে। দুজনের নামের লাস্ট অক্ষরই ‘ল’। ওয়াও।’
আশিকের কথা শুনে আহিলের বিষম উঠে যায়। জুঁই আহিলের এক পাশে বসা ছিল। সে আহিলের পিঠে, মাথায় হাত দিয়ে মৃদু চাপড় দিতে দিতে আশিকের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।
বন্ধুরা মিলে হাসাহাসি করে কথাটা এড়িয়ে যায়। রেশমি চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,’শা’লা আহা’ম্মক!’
আহনাফ সরু চোখে একবার আহিলের দিকে তাকাল, আর একবার সকালের দিকে। সকাল দৃষ্টি নত করে কাচুমুচু হয়ে বসে আছে। ভীষণ ইনোসেন্ট দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। একটু বোধ হয় ঘাবড়েও গেছে। মাহিত অবশ্য মনে কিছু নেয়নি। সে হেসে হেসে সুবাসের সাথে অফিসের কাজকর্ম নিয়ে আলাপ করছিল।
ফিরে আসার পথে আহনাফ কোনো রকম ভূমিকা করা ছাড়াই আহিলকে জিজ্ঞেস করল,’সকালের সাথে তোর রিলেশন আছে?’
আহিল চমকে ওঠে। আড়চোখে একবার অর্ষার দিকে তাকিয়ে ফাঁকা ঢোক গিলে। এটাও আহনাফের চোখে পড়ে। সে গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে বলে,
‘পেছনে ফিরে ওর দিকে তাকাচ্ছিস কেন? চোখে চোখে তো কথা বলার কিছু দেখছি না। কিছু বলতে হলে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বল।’
আহিল আহনাফের সম্পর্কটা ঠিক যে কী রকম সেটি ভাষায় প্রকাশ করা যেমন সহজসাধ্য নয় তেমনই লেখাটাও ভীষণ কঠিন। নিজেদের মনের যেই টান, ভালোবাসা, সম্মান ও শ্রদ্ধা রয়েছে সেটা শুধু এই দুই ভাই-ই বুঝতে পারে। ভয় নেই তবে সম্মান রয়েছে মাঝখানে। আহিল তবুও সাহস নিয়ে বলল,
‘সকালের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’
‘তোরা পূর্বপরিচিত?’
‘হু। রেশমির বিয়ের ডেট যে ফিক্সড হলো তখন তো আমরা সবাই গেছিলাম।’
‘তখন থেকেই পরিচয়?’
আহিল মিথ্যে বলতে গিয়েও থেমে গেল। লম্বা দম নিয়ে বলল,
‘না। তারও আগে থেকে।’
এরপর সে সংক্ষিপ্তভাবে সকালের সাথে পরিচয়ের কথাটুকু আহনাফের কাছে তুলে ধরল।
আহনাফ কিছুটা অবাক হয়ে বলল,’তুই তাহলে জানতি না রেশমির যার সাথে বিয়ে হয়েছে সকাল তার বোন?’
‘উঁহু।’
‘সকালও জানত না তার ভাইয়ের হবু বউ রেশমি?’
‘না। রেশমিও জানত না মাহিতের বোন সকাল।’
আহনাফ শব্দ করে হাসে। গাম্ভীর্য ভাবটা এখন আর নেই। অর্ষাও কিছুটা নিশ্চিন্ত হয় হাসতে দেখে। যদিও সে আন্দাজ করে রেখেছে, সম্পর্ক থাকলেও আহনাফ কখনোই বাধা হয়ে দাঁড়াবে না; বরঞ্চ পারলে সাহায্যই করবে।
আহনাফের হাসিতে আহিলও কিছুটা যোগ দিল। সে হাসছে মৃদু। হাসি থামিয়ে আহনাফ বলল,
‘ঘটনাটা বেশ ইন্টারেস্টিং। আমার কি মনে হয় জানিস?’
‘কী?’ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল আহিল।
আহনাফ মুচকি হেসে বলল,’ওর সাথে কিছু হওয়ার সম্ভাবনা আছে। নয়তো এত মীরাকেল কেন হবে?’
‘কী জানি!’ ভাবলেশহীনভাবে বলল আহিল।
বাড়িতে পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে ফোন হাতে নেয় আহিল। আজ আর নামাজ পড়তে মসজিদে যায়নি। বাড়িতেই পড়ে নিয়েছে। ডাটা অন করতেই হোয়াটসএপের ম্যাসেজ টোন বেজে ওঠে। সকালের ম্যাসেজ,
‘আপনার ফ্রেন্ড এত ঠোঁটকাটা স্বভাবের কেন?’
ম্যাসেজের সময় চেক করে আহিল। ওরা রেস্টুরেন্টে থাকাকালীনই সকাল ম্যাসেজটা করেছিল। বালিশ ঠিক করে আরাম করে শুয়ে নিল আহিল। রিপ্লাইতে লিখল,
‘কোন ফ্রেন্ডের কথা বলছ?’
সকাল অনলাইনেই ছিল। তাই রিপ্লাই পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হলো না।
সকালের রিপ্লাই আসে,’আশিক ভাইয়ার কথা বলছি।’
‘আশিক আবার কী করল?’
‘কী করল মানে? ভাইয়ার সামনে মুখ ফসকে কথাটা বলার কী দরকার ছিল? আপনার নামের লাস্ট অক্ষর আর আমার নামের লাস্ট অক্ষর যে সেইম এটা সবার সামনেই বলতে হলো?’
ম্যাসেজের শেষে এংরি ইমুজি দেওয়া। ইমুজি দেখে আহিল হেসে ফেলে। লিখে,
‘ও এমনই। কিন্তু তুমি এত রেগে যাচ্ছ কেন?’
‘রাগ করব না? ভাইয়া যদি সন্দেহ করত একবার!’
‘তাহলে কী হতো?’
‘সোজা মে’রে ফেলবে আমাকে।’
‘তাই নাকি? তাহলে ভালোবাসো কোন সাহসে? খুব তো বলতে আগে ভালোবাসার কথা।’
ম্যাসেজটা সীন হলো ঠিকই। তবে সকালের কোনো রিপ্লাই এলো না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন কোনো উত্তর এলো না তখন আহিল নিজেই আবার ম্যাসেজ করে,
‘কী হলো? স্ট্যাচু হয়ে গেলে মনে হয়?’
‘কিছু হয়নি। তবে আপনি আর ভাবি মিলে যেই নাটক করেছেন; ভালোবাসার তো দফারফা অবস্থা।’
‘ভালোবাসার অবস্থা দফারফা হবে কেন? আমার অবস্থা হবে দফারফা। তুমি নিজেই তো বলেছ। ভয়ে আছি এখন।’
‘এত ঢং করতে হবে না।’
‘ঢং করলাম নাকি?’
‘ঢং-ই তো। ভয় তো পান না শুধু শুধু নাটক করেন। যাই হোক, আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন যে আমি আপনাকে আর জ্বা’লা’ব না।’
‘তাই? ভয় পেয়েছ?’
‘ভয় পাব কেন? আমার একটা আত্মসম্মান আছে না?’
‘আরে বাহ্! পিচ্চি দেখি কথাও শিখে গেছে। আত্মসম্মান থাকাটা খুবই ভালো। প্রতিটা মানুষেরই উচিত নিজের আত্মসম্মান বজায় রাখা। কিন্তু তোমার হঠাৎ এমন সুবুদ্ধি উদয় হলো যে?’
‘আপনি কি বলতে চাচ্ছেন আমার মাথায় শুধু কু’বু’দ্ধি?’
এবারও ম্যাসেজের শেষে এংরি ইমুজি। আহিল লিখল,’যেই মেয়ে ডেয়ার নিয়ে এতসব কাণ্ড করে তার মাথায় সুবুদ্ধি থাকার জায়গাটা কোথায় শুনি?’
‘আজেবাজে কথা বলবেন না তো। ডেয়ার নেওয়াটাই আমার ভুল ছিল। না আমি সেদিন ডেয়ার নিতাম, আর না এমন বাজেভাবে আপনার প্রেমে পড়তাম।’
আহিল হাসল কিন্তু কিছু লিখল না। সকাল নিজে থেকে দ্বিতীয় ম্যাসেজ লিখল,’আত্মসম্মানবোধ মনে হয়
অর্ষা ভাবির থেকে পেয়েছি।’
আহিল অবাক হওয়ার ইমুজি দিয়ে লিখল,’অর্ষা তোমার ভাবি হলো কীভাবে? কী আশ্চর্য! তোমার কি আরো ভাই আছে? অর্ষাকে তার বউ করার প্ল্যান এঁটেছ মনে হচ্ছে। এই খবরদার, এরকমটা করা যাবে না। আমার ভাই অর্ষাকে ভীষণ ভালোবাসে।’
‘ধুর! থামবেন আপনি? শুধু উলটা-পালটা কথাবার্তা বলেন। ভাবি ভুলে বলে ফেলেছি। আর আমারও আর কোনো ভাই নেই।’
‘ভুলে?’
‘হু ভুলেই।’
‘ওহ। আমি ভাবলাম অন্যকিছু।’
‘অন্যকিছু কী আবার?’
‘কিছু না।’
‘মজা নিচ্ছেন?’
‘মজা নেব কেন?’
‘কারণ সময় এখন আপনার। আপনি তো ভালো করেই জানেন, আমি আপনাকে আর জ্বা’লা’ব না। তাই এখন আপনি আমাকে জ্বা’লা’চ্ছে’ন।’
‘কে যেন একদিন প্রথম দেখায় আমায় বলেছিল আমি নাকি পুরাই আগুন। সো, আগুনের সাথে কথা বললে একটু জ্ব’ল’তে-পু’ড়’তে তো হবেই।’
সকাল দীর্ঘশ্বাস নিল। সে ছেলেটাকে যত শান্তশিষ্ট ভেবেছিল ততটাও তো নয়। হাড়গোড় জ্বা’লি’য়ে খাওয়ার লোক। বে’ত্ত’মি’জ একটা! সে লিখল,
‘একেই বলে কারও পৌষ মাস তো কারও সর্বনাশ।’
আহিল হাসির ইমুজি দিয়ে লিখল,’ঠিক আছে। এখন তাহলে ঘুমাও। পরে কথা হবে। আল্লাহ্ হাফেজ।’
.
.
কেয়া আসবে আজ সিলেট থেকে। গতকাল রাতেই কুসুম ফোন করে অর্ষাকে জানিয়েছে। এটাও বলেছে সকাল সকাল যেন ঐ বাড়িতে চলে যায়। কেয়া সংকোচের দরুণ ফোন করেনি। পাছে আহনাফ আবার অর্ষার পাশেই থাকে যদি?
সকালে আহনাফ এবং জহির চৌধুরী অফিসে যাওয়ার পর অর্ষা রেডি হয়ে নেয়। আহিল যায়নি এখনো। ঘুমাচ্ছে। যাবে কিনা তারও ঠিক নেই।
আফরিন ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে জুস খাচ্ছিল। অর্ষাকে বোরকা পরা দেখে জিজ্ঞেস করল,
‘কোথাও যাচ্ছ?’
‘হ্যাঁ। আমাদের বাসায়।’
‘হঠাৎ?’
অর্ষা ইতস্তত করতে থাকে। কেয়ার ঢাকায় আসার বিষয়টি শ্বশুর-শাশুড়িকে গতকাল রাতেই জানানো হয়েছে। আফরিন তখন সেখানে উপস্থিত ছিল না। খুব সম্ভবত ঘুমিয়ে ছিল। তাই নতুন করে প্রসঙ্গটি তুলতে আনইজি ফিল হচ্ছিল। আফরিন যদি কোনো রিয়াক্ট করে?
উত্তরের জন্য আফরিন তখনো তাকিয়েই ছিল। অর্ষা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,’কেয়া আপু আসবে আজ।’
‘কেয়া আপু আসবে! কোত্থেকে?’ অবাক হয়ে জানতে চাইল আফরিন।
‘সিলেট থেকে।’
আফরিন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভাবলেশহীনভাবে বলল,’ওহ। সাবধানে যেও।’
প্রত্যুত্তরে অর্ষা মৃদু হেসে আমেনা বেগমের থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়। আহনাফকে আগেই বলে রেখেছিল দু’দিন থাকবে সে ঐ বাড়িতে। আহনাফ কোনো আপত্তি করেনি। অর্ষার গাল টেনে বলেছিল,’ঠিক আছে।’
ঐ বাড়িতে পৌঁছিয়ে ভাবির সাথে কাজে লেগে পড়ে অর্ষা। এই প্রথম কেয়ার স্বামী আসবে এই বাসায়। আপ্যায়নের ত্রুটি তো রাখা যাবে না। রুহুলও বাজার করেছে মনমতো। টুকিটাকি আরো যা লাগবে তা কেনার জন্য কুসুমকে টাকাও দিয়েছে অর্ষা। দুপুর গড়িয়ে যখন বিকেল হবে হবে ভাব, সেই সময়ে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত অবস্থায় বাড়ি পৌঁছাল কেয়া আর ওর স্বামী।
অর্ষা একছুটে গিয়ে কেয়াকে জড়িয়ে ধরে। কেয়া হাসে। পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
‘এখনো বড়ো হোস নি। বাচ্চাই আছিস।’
অর্ষা এই কথার কোনো উত্তর না দিয়ে মৃদু হাসল। রুহুল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ওদের দিকে। কেয়া আগে গিয়ে রুহুল এবং কুসুমের কাছে কান্নাকাটি করে মাফ চায়। এই প্রথম কুসুমের চোখেও পানি দেখা গেল।
কেয়া তার স্বামীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল,’ওর নাম সিফাত।’
সিফাত রুহুল এবং কেয়াকে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করল। অর্ষার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
‘তোমার অনেক গল্প শুনেছি কেয়ার কাছে।’
অর্ষা কিছুটা লজ্জামিশ্রিত হাসল। কুসুম বলল,’আচ্ছা গল্প পরে হবে। ভেতরে আসো এখন।’
দুপুরের আয়োজন খাবারের অল্পকিছু শুধু কেয়াই খেয়েছে। বাকি সবাই রোজা। খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে কেয়া অর্ষাকে ডেকে এনে বারান্দায় বসল।
অর্ষা বলল,’গল্প কি পরে করা যেত না? খেয়েছ এখন একটু বিশ্রাম করো।’
কেয়া মুচকি হেসে নিজের হাত দুটো অর্ষার কোলের ওপর রাখল। মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,’আগে একটু কথা তো বলতে দে। তুই কিন্তু একটু মোটা হয়েছিস।’
অর্ষা বিস্মিতকণ্ঠে জানতে চাইল,’তাই?’
‘হু। কেন ওজন মাপিস না নাকি?’
‘অনেকদিন হয়েছে মাপা হয় না।’
‘মেপে দেখিস।’
অর্ষা দুঃখী দুঃখী গলায় জিজ্ঞেস করে,’খুব বেশি মোটা হয়ে গেছি নাকি আপু?’
কেয়া খিলখিল করে হেসে ওঠে। দু’হাতে অর্ষার দু’গাল চটকে দিয়ে বলে,’একদম না। পার্ফেক্ট হয়েছিস। আগের চেয়ে আরো বেশি সুন্দর লাগে এখন। রূপবতী কন্যা।’
‘হয়েছে। আর বাড়িয়ে বলতে হবে না। সুন্দর তো তুমি হয়েছ।’
‘আমি একটু মুটিয়ে যাচ্ছি না?’
‘তা একটু যাচ্ছ! তবে সুন্দর লাগছে কিন্তু।’
‘সব বাচ্চার ক্রেডিট বুঝলি।’
‘বাচ্চা পেটে আসলে বুঝি মেয়েরা সুন্দর হয়ে যায়?’
‘অবশ্যই। তখন মেয়েদের আলাদা একটা সৌন্দর্য দেখা যায়। তোর যখন বাবু পেটে আসবে তুই তো আরো বেশি সুন্দর হয়ে যাবি রে অর্ষা। কী মুশকিল! তোকে তো তখন চোখে চোখে রাখা লাগবে।’
‘কেন?’
‘যদি কেউ তোকে কি’ড’ন্যা’প করে নিয়ে যায়?’
‘বাবু পেটে আসার পর তোমার মাথা মনে হয় আউলিয়ে গেছে। শুধু উলটা-পালটা কথা বলতেছ।’
‘মোটেও না। বরং এখন যা যা বলতেছি সেগুলোই একদম পিওর সত্যি। কোনো খাদ নেই।’
রাতে কেয়া অর্ষার সাথেই ঘুমাল। অর্ষা কতবার করে বলল দরকার নেই, কেয়া তবুও শুনল না। যদিও সে নিজেও মনে মনে কেয়ার সাথে থাকতে চেয়েছিল। সিফাত একা বারান্দার রুমে ঘুমিয়েছে। রাতে কেয়া আর অর্ষা মিলে অনেক গল্প করে। সিফাতের সম্পর্কে অনেক কিছু শেয়ার করেছে। দুজনের নতুন সংসার কীভাবে শুরু হলো সবকিছু। এক সময় গল্প করতে করতে অর্ষা জিজ্ঞেস করে,
‘আমার শ্বশুরবাড়িতে যাবে না আপু?’
কেয়া কিয়ৎক্ষণ নিরব থেকে বলল,’না।’
‘না কেন?’
‘কোন মুখে যাব?’
‘অতীতের ঐসব ঘটনা কেউই মনে রাখেনি আপু। মা তোমাকে যেতে বলেছে ভাইয়াকে নিয়ে।’
‘সত্যি?’
‘৩ সত্যি।’
‘আন্টিকে আমার সালাম জানাস।’
‘তার মানে কী? তুমি যাবে না?’
কেয়া কাৎ হয়ে শুয়ে অর্ষার গায়ের ওপর হাত রাখল। আদুরেকণ্ঠে বলল,’না রে সোনা।’
‘আমি বাবাকে আসতে বলব। তারপর দেখব তুমি কীভাবে না গিয়ে পারো।’
‘জেদ করিস কেন? খুব জেদী হয়েছিস দেখছি।’
অর্ষা গোপনে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,’ঘুমাও। অনেক রাত জেগেছ আজ।’
কেয়া এক সময় ঘুমিয়ে পড়লেও অর্ষার ঘুম এলো না। দিনে দু’বার আহনাফের সাথে কথা হয়েছিল তাও অল্প সময়ের জন্য। আর রাতে একটু কথা হয়েছে। দূরে এসে যেন আরো বেশি মনে পড়ছে। কী যন্ত্রণা! কতক্ষণ এপাশ-ওপাশ করেছে তার কোনো হিসেব নেই। একবার ভাবল ফোন করবে। পরক্ষণে কী ভেবে যেন আর ফোন করা হলো না।
পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কোনো রকম সারা দিনটা পার করে অর্ষা। বুকের ভেতর কেমন যেন ধড়ফড় করছে। মনটা অস্থির হয়ে আছে আহনাফের জন্য। দু’দিন থাকার কথা থাকলেও আর থাকতে পারছিল না সে। চোখের আড়াল হয়ে থাকাটা এখন যেন অসম্ভবপর হয়ে পড়েছে। বড্ড দায়! বিকেলের দিকে কেয়াকে বুঝিয়ে বাড়িতে চলে আসে। অপেক্ষা করতে থাকে কখন পাঁচটা বাজবে আর কখন আহনাফ আসবে।
সময়ের আগে বাড়িতে ফিরে আসায় সবাই একটু অবাক হলেও কেউ কিছু জানতে চাইল না। আমেনা বেগম শুধু জিজ্ঞেস করেছিলেন,
‘সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো?’
‘জি, মা।’
‘কেয়ার কী অবস্থা? কেমন আছে এখন?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছে।’
‘তোমায় না বলেছিলাম ওদের নিয়ে আসতে?’
‘পরে আসবে মা। কয়েকদিন আগে ভাবির কাছে থাকুক।’
আমেনা বেগম হেসে বলেছেন,’ঠিক আছে।’
অর্ষা ঘরে শুয়ে ছিল। কখন যে চোখ লেগে এসেছে বুঝতেই পারেনি। তন্দ্রাভাব কাটে আহনাফের ডাকে,
‘অর্ষা?’
পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায় অর্ষা। দুই ভ্রুঁ কুঁচকানো। আহনাফ কিছুটা ঝুঁকে আছে মুখের ওপর। আহনাফকে দেখে কপালের ভাঁজ কাটে। ঠোঁটে ফুটে ওঠে হাসি। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে আহনাফকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আচমকা অর্ষা যে এমনকিছু করে বসবে আহনাফ বুঝতে পারেনি একদম। কোনো রকম টাল সামলিয়ে নেয়। তবে এ কথা সত্য যে, খুশিও হয়েছে। তার চোখেমুখেও ফুটে উঠে হাসির ঝিলিক। সেও বাহুবন্ধনে অর্ষাকে আবদ্ধ করে নেয়।
আহনাফের বুক থেকে মাথা সরিয়ে অর্ষা জিজ্ঞেস করে,’জানেন কত মিস করেছি? মনে হচ্ছিল এবার বুঝি আমিই ম’রে যাচ্ছিলাম।’
‘এজন্যই আজ চলে এলে?’
অর্ষা ফের বুকে মুখ গুঁজে বলল,’হুম।’
‘এখন শান্তি লাগছে?’
অর্ষা দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে বলল,’না।’
এরপর আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সে। আহনাফ অর্ষার মুখটা দু’হাতের আজলায় নিয়ে কপালে আর চোখে চুমু খেয়ে বলল,
‘জানো তোমার মধ্যে কত মায়া?’
অর্ষা ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,’না তো। আমি কি মায়াবতী?’
‘উঁহু! মায়াবিনী। তুমি আমার মায়াবিনী।’
চলবে…