#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_৪৯
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
নীলাভ আকাশে অন্ধকার মেঘের ছড়াছড়ি। ঝড়ো হাওয়ায় জানালার কপাট একটা আরেকটার সঙ্গে প্রচণ্ড শব্দ করে বাড়ি খাচ্ছে। বিকট শব্দে টিকে থাকা দায়। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে শব্দটা কেয়ার ভালো লাগছে। প্রকৃতির পরিবর্তনে যেন সেও বিলীন হতে ইচ্ছুক। শামিল হতে চাইছে সে বৃষ্টির সাথে সাথে। প্রেগন্যান্সির সময়টা বোধ হয় এমনই হয়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিসই মনে ধরে যায়। আবার ক্ষুদ্র বিষয়েই রাগ হয়। মন খারাপ হয়।
‘জানালা লাগাচ্ছিস না কেন?’
ঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে বলল কুসুম। অন্যমনস্ক কেয়ার হুঁশ আসে। ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে,
‘এইতো লাগাচ্ছি।’
কুসুম চলে গেল নিজের রুমে। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও জানালার কপাটগুলো লাগিয়ে দিল কেয়া। তখনই সে ঝুমঝুম বৃষ্টির শব্দ শুনতে পায়। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ এত ভালো লাগে! গানের টিউনের মতো যদি নিঁখুতভাবে ফোনে রেকর্ড করে রাখা যেত তাহলে বেশ হতো।
বালিশ ঠিক করে কাৎ হয়ে শুলো সে। অর্ষার কথা ভীষণ মনে পড়ছে। এই বাড়ি থেকে সেদিন যাওয়ার পরও দু’দিন এসেছিল কেয়াকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সংকোচে, লজ্জায় ঐ বাড়িতে পা রাখার সাহস হয়ে ওঠেনি কেয়ার। বারবার তার রিফিউজে অর্ষার রাগ হয়েছে। অভিমান হয়েছে। তাই বাড়িতে আর আসেনি। তবে কুসুমের সাথে ফোনে কথা বলে খোঁজ-খবর নেয় প্রতিদিন। অর্ষার বাচ্চামোর কথা মনে পড়ায় আনমনে কেয়া হেসেও ফেলে।
বৃষ্টিতে ভিজে বাড়িতে ফিরে সিফাত। আনমনে কেয়াকে হাসতে দেখে পা টিপে গিয়ে বিছানায় বসে। কিছুক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে শুধায়,
‘হাসছ কেন?’
চমকে ওঠে কেয়া। পরক্ষণে সিফাতকে দেখে ধাতস্থ হয়। সিফাতও কেয়ার হাত ধরে বলে,
‘আমি! আমি! ভয় পেও না।’
‘বৃষ্টিতে ভিজেছ কেন?’
‘ভিজিনি ইচ্ছে করে। চায়ের দোকান থেকে আসার সময় ভিজে গেছি।’
‘মাথাটা ভালো করে মুছে নাও। নয়তো ঠান্ডা লেগে যাবে।’
সিফাত তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বলল,’বললে না তো একা একা হাসছিলে কেন?’
‘অর্ষার কথা ভেবে।’
‘কী ভাবছিলে?’
‘দিনদিন বাচ্চাদের মতো জেদ ধরা শুরু করেছে।’
‘একবার গেলেই পারো।’
‘তুমি তো সবই জানো। তাও বলছ এসব কথা?’
সিফাত কেয়ার একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,’জানি বলেই বলছি। আহনাফ নিজে মুভ অন করেছে। তার পরিবারও অর্ষাকে মেনে নিয়েছে। যতটুকু রুহুল ভাইয়ার কাছে শুনেছি, বাড়ির প্রতিটা মানুষ অর্ষাকে চোখে হারায়। বুঝতেই পারছ কতটা ভালোবাসে? তাহলে তুমি কেন মনের ভেতর এত দ্বিধা পুষে রাখছ?’
‘কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘ঐ বাড়িতে যাও। নিজের ভুলের জন্য নিজেই ক্ষমা চাও। একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখো সবার সাথে।’
কেয়া ছোটো করে বলল,’দেখি।’
______
ভারী বর্ষণের প্রভাবে দু’চোখে এসে ভর করেছে ঘুম। সাধারণত রাতে এত তাড়াতাড়ি ঘুম আসে না অর্ষার। আজ ঘুম ঘুম ভাবটা তার সকাল থেকেই ছিল সারাদিন। সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে বলেই হয়তো।
ঘুমে ঢুলুঢুলু হয়েও হাতে একটা উপন্যাসের বই নিয়ে বসে ছিল অর্ষা। আহনাফ ল্যাপটপে মগ্ন। আড়দৃষ্টিতে একবার সে অর্ষার দিকে তাকায়।
ক্ষীণস্বরে ডাকে,’অর্ষা?’
ঘুম জড়ানো চোখের পাতা এলোমেলো হয়ে যায়। এলোমেলো দৃষ্টিতে সে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,’হু?’
‘ঘুমিয়ে পড়ো।’
‘ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না।’
‘কেন?’
‘কী জানি।’
‘ঘুমে তো তাকিয়ে থাকতে পারছ না। শুয়ে পড়ো।’
অর্ষা কিছুক্ষণ আহনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপর বলে,’ঠিক আছে।’
বইটা বন্ধ করে মাথার কাছে রেখে শুয়ে পড়ে সে। আহনাফ কিছুক্ষণ ল্যাপটপে কাজ করে। এরপর লাইট নিভিয়ে সেও শুয়ে পড়ে।
আহনাফ শুতেই অর্ষা ঘুম জড়ানো স্বরে বলে,’খুব মিস করছি।’
‘ঘুমাওনি এখনো?’
‘উঁহু।’
‘কাকে মিস করছ?’
‘ক্যাথি আর অ্যানিকে। বাচ্চা দুটো এখন কার কাছে আছে।’
আহনাফ অর্ষাকে টেনে কাছে আনে। চুলের মাঝে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,’হানির কাছে রেখে এসেছি।’
‘লিলিয়া আন্টি আর স্মিথ কোথায়? ওরা কি চলে গেছে?’
‘আপাতত তাদের বাড়িতে আছে। আমি গেলে তারপর আসবে।’
অর্ষা মুখ তুলে তাকায় আহনাফের মুখের দিকে। ডিম লাইটের আবছা আলোতেও দুজন দুজনকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। হয়তো দূরত্ব একদম নেই বলেই!
‘আপনি আবার চলে যাবেন?’ বিষণ্ণ গলায় প্রশ্ন করল অর্ষা।
আহনাফ অর্ষার গালে আলতো করে হাত রাখল। আদুরেকণ্ঠে বলল,’যেতে তো হবেই। আমার অফিস সেখানে না?’
‘ওহ।’
মন খারাপ হয়ে যায় অর্ষার। দৃষ্টি নত করে চুপ হয়ে যায় সে। আহনাফও বুঝতে পারে মন খারাপের কারণ। অর্ষার নাকে, গালে, ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলে,
‘মন খারাপ করে না।’
‘কেন না?’
‘মন খারাপ করবে কেন?’
‘আপনি বুঝবেন না।’
‘আমি সবই বুঝি। তোমার যে কেন মন খারাপ সেটাও বুঝেছি। তবে গুড নিউজ কি শুনবে?’
‘শুনি।’
‘তোমাকেও আমি আমার কাছে নিয়ে যাব। তুমি আমার কাছে থেকেই সুইজারল্যান্ডে পড়াশোনা করবে।’
অর্ষা চোখ-মুখ খুশিতে চকচক করে ওঠে। আহ্লাদী হয়ে বলে,’সত্যি?’
‘সত্যিই।’
‘তিন সত্যি?’
আহনাফ হেসে ফেলে। অর্ষার গালে আলতো করে কামড় বসিয়ে বলে,’তিন সত্যি।’
______
সকাল হতেই আফরিনের বেশ মাথা ব্যথা শুরু হয়। দুপুর পর্যন্ত শুয়েই ছিল। এখনো মাথা-ব্যথা সারেনি। অর্ষা পাশে বসে মাথা টিপে দিচ্ছে।
আহিল একটু পরপরই এসে খোঁজ-খবর নিচ্ছে। আফরিনের মাথা ব্যথা হলেও কষ্ট যেন আহিলের হচ্ছে।
আহিল ফের এলো ইফতারের একটু সময় আগ দিয়ে। আফরিন তখন শুয়ে ছিল। আহিল ওর মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
‘আপু তোর মাথা ব্যথা কমেছে?’
চোখ না খুলেই আফরিন উত্তর দিল,’হু।’
‘মেডিসিন খেয়েছিলি?’
‘হু।’
‘তুই তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যা। কতদিন পর বাড়িতে এলি। আর এসেই অসুস্থ হয়ে পড়লি। ভালো লাগছে না। তুই সুস্থ হলে আমরা শপিং-এ যাব।’
আফরিন নিরুত্তর। আহিলও কিয়ৎক্ষণ নিরব থেকে বলল,’ইফতারের সময় হয়ে গেছে। খাবি না?’
‘ভালো লাগছে না আহিল। তুই যা। লাইট নিভিয়ে যাস।’
আহিল আর ও’কে না ঘাঁটিয়ে চলে গেল। তবে মন তার এখনো বিষণ্ণতায় ছেঁয়ে আছে। ইফতারের পর নামাজ পড়ে আফরিনের জন্য আহিল নিজেই রান্না করতে যায়। আফরিন পাস্তা অনেক বেশি পছন্দ করে। তাই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বোনের জন্য পাস্তা রাঁধবে। আমেনা বেগম, অর্ষা আর রেণু কত করে বলল,’আমরা রান্না করে দিচ্ছি।’ কিন্তু আহিল তো আর কথা শোনার মতো ছেলে নয়। আর বিপত্তিও ঠিক ঐ জায়গাতেই বাঁধল। মরিচ কাটতে গিয়ে চপিং বোর্ডের ওপর রাখা আঙুলেও ছুরি চলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে কেটে গিয়ে গলগল করে রক্ত বের হতে শুরু হয়। ব্যথায় আর্তনাদ করে ওঠে সে।
আর্তনাদ শুনে আমেনা বেগম আর অর্ষা ছুটে যান রান্নাঘরে।
‘কতবার করে বললাম তোর রান্না করার দরকার নেই। শুনলিই না তুই আমার কথা।’ কান্নাভেজা স্বরে বললেন আমেনা বেগম।
আহিল বলল,’তুমি অল্পতেই এত ইমোশোনাল হয়ে যাও কেন? ঠিক হয়ে যাবে। তেমন কিছু হয়নি।’
‘তুই চুপ করে থাক।’
অর্ষা ফাস্টএইড বক্স নিয়ে এসেছে। তুলাতে স্যাভলন লাগিয়ে ক্ষ’ত’স্থা’ন পরিষ্কার করে। বকতে বকতে আঙুলে ওয়ান-টাইমও লাগিয়ে দেয়।
‘তুইও মায়ের সাথে শুরু করলি!’ বিড়বিড় করে বলল আহিল। তবে থমকাল না। কাটা হাত নিয়েই মা এবং অর্ষার বিরুদ্ধে গিয়ে পাস্তা রান্না করেছে। ঘটনা শুধু এই পর্যন্তই ঘটেনি। অর্ষা গ্যাঞ্জাম পার্টির গ্রুপকলে ঘটনাটি শেয়ার করেছিল। কথাটা যে সকালের কাছেও পৌঁছে যাবে তা কে জানত?
রাতে সকাল নিজ থেকে আহিলকে ফোন করে। ফোন রিসিভ করে আহিল হ্যালো বললেও ওপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।
‘হ্যালো? হ্যালো সকাল? কথা বলছ না কেন?’ এক নাগাড়ে বলতে থাকে আহিল।
ওপাশ থেকে ফোঁপানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে।
‘একি! তুমি কাঁদছ? সকাল?’
কাঁদোকাঁদো হয়ে সকাল বলল,’আপনি এত কেয়ারলেস কেন?’
‘কী করেছি আমি?’
‘হাত কেটে বসে আছেন। আবার আমাকেই জিজ্ঞেস করছেন কী হয়েছে?’
‘তুমি জানলে কী করে?’
‘কেন? জেনে কি খুব অন্যায় করে ফেলেছি?’
একটু আগেও যে মেয়েটি কাঁদছিল এখন তার কণ্ঠে রাগের আভাস। মেয়েরা যে কখন কাঁদে, কখন রাগে আর কখন হাসে বোঝাই মুশকিল। আহিল কিছুটা শব্দ করেই হেসে ফেলে।
সকাল তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বলে,’আশ্চর্য! আপনি হাসছেন কেন?’
‘না, হাসিনি তো।’
‘আমি স্পষ্ট শুনেছি আপনি হেসেছেন।’
‘আচ্ছা ভুলে হেসে ফেলেছি স্যরি। এবার বলো আমার হাত কাটার কথা কে বলেছে?’
‘যে বলার বলেছে। আপনি এত কেন যে কেয়ারলেস!’ এবার সকালের কণ্ঠে অভিমান।
আহিল মুচকি হেসে বলে,’হরলিক্স খাওয়া মেয়েও দেখছি আমার কেয়ার করা নিয়ে আঙুল তুলছে।’
‘ধুর! রাগাবেন না একদম। আচ্ছা হাত কি খুব বেশি কেটেছে?’
‘আরে না।’
‘আপনি মিথ্যা বলছেন। ভাবি বলেছে আমায়।’
‘রেশমির কথা বলছ? বাদ দাও তো। ও সবসময় বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলে।’
‘তাই? দেখি ছবি পাঠান তো।’
‘আচ্ছা পাঠাব।’
‘পাঠাব না। এক্ষুণী।’
‘এত অধিকার?’
‘যা মনে করেন।’
‘হায়রে! এমন করলে যদি প্রেমে পড়ে যাই?’
‘আপনি আর প্রেম? নিরামিষের বস্তা!’
‘হোয়াট! আমি নিরামিষ?’
‘একদম। আমিষের ছিটেফোঁটাও আপনার মাঝে অবশিষ্ট নেই।’
‘ঠিক আছে। সময় কথা বলবে।’
‘বলুক। আপনি এখন ছবি পাঠান।’
আহিল দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,’দিচ্ছি।’
ফোন কেটে সে ছবি তোলে। হোয়াটসএপে ছবি পাঠাতে পাঠাতে মনে মনে ভাবে,’শেষমেশ কিনা হরলিক্স খাওয়া বাচ্চা একটা মেয়ে তোকে বশ করল আহিল!’
.
.
রোজা প্রায় শেষের দিকে। ঈদের কেনাকাটা বাকি এখনো। কিন্তু আহনাফের যেন সময়ই নেই। শপিং-এর কথা বললেই রাজ্যের যত কাজ এসে পড়ে যেন তার কাঁধে। জহির চৌধুরীকেও অফিসে যেতে দেয় না। তার বদলে সে নিজে কাজ করছে। সবকিছুর দেখাশোনা করছে। আহনাফকে রাজি করানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অর্ষাকে।
অর্ষা তাই মুখ ভার করে বসে আছে। যাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাকেই তো আহনাফ পাত্তা দিচ্ছে না! কেন রে ভাই, বউয়ের চেয়েও কি কাজ বেশি? পরিবারের চেয়ে কাজ বেশি? মানছি কাজ গুরুত্বপূর্ণ। ভালোভাবে বাঁচার জন্য, একটু আরাম-আয়েশে জীবন কাটানোর জন্য টাকার প্রয়োজন রয়েছে। তাই বলে বউ, পরিবারকে একদম গোল্লায় ফেলে দিবি? মানবতাহীন মানব!
ল্যাপটপে মেইল চেক করতে করতে অর্ষার দিকে তাকায় আহনাফ। কফির মগে চুমুক দিয়ে বলে,
‘ওভাবে বসে আছো কেন?’
‘ইচ্ছে তাই।’
‘মন খারাপ?’
‘মন নাই।’
‘কী হয়েছে?’
‘কিছু হয়নি।’
‘এভাবে কেন কথা বলছ?’
‘আমার ইচ্ছে। আপনি কাজ করেন।’
‘কাছে আসো।’
‘পারব না।’
‘আমি আসতে বলেছি।’
‘না।’
আহনাফ হাত বাড়িয়ে ডেকে বলে,’আসো না!’
অর্ষা তবুও কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকে। এরপর কাঠের পুতুলের মতো গিয়ে পাশে বসে। আহনাফ কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলে,
‘কী হয়েছে জান?’
‘আব্বু-আম্মু বারবার করে বলতেছে শপিং এর কথা। যাচ্ছেন না কেন?’
‘ব্যস্ত তো!’
অর্ষা উঠতে উঠতে বলে,’থাকেন বিজি!’
আহনাফ উঠতে দেয় না। হাত টেনে ধরে আবার পাশে বসায়। সেই সময়ে সুইজারল্যান্ড থেকে নেহার কল আসে।
ফোন রিসিভ করে আহনাফ। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে নেহার হাস্যোজ্জ্বল মুখটি। আহনাফ আর অর্ষাকে একসাথে দেখে নেহা বলে,
‘আয়ে হায়! লাভ বার্ড একসাথে।’
অর্ষা কিছুটা লজ্জা পেয়ে যায়। জিজ্ঞেস করে,’কেমন আছো নেহা?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্ ভাবি। তুমি ভালো আছো?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো। বাড়ির সবাই কেমন আছে?’
‘সবাই ভালো আছে। একটা গুড নিউজ দেওয়ার জন্য ফোন করেছি।’
‘কী?’
‘কালকে আমরা বাংলাদেশে আসতেছি।’
অর্ষা খুশি হয়। বিস্মিত হয়ে বলে,’সত্যিই?’
নেহাও হেসে বলে,’হ্যাঁ।’
‘আগে বলিসনি কেন?’ জিজ্ঞেস করে আহনাফ।
‘মায়ের বারণ রয়েছে ভাইয়া। সারপ্রাইজ দেবে বলেছিল। কিন্তু আমি তো আর থাকতে না পেরে আগেই বলে দিলাম। তোমরা কিন্তু কাউকে কিছু বলবে না! আর হ্যাঁ, আমরা যখন আসব তখন অবাক হওয়ার অভিনয় করবে ঠিকাছে?’
আহনাফ ভেংচি কেটে বলে,’এত নাটক করতে পারব না।’
নেহা ক্ষুব্ধ হয়ে বলে,’তাই? এই প্রতিদান দিচ্ছ এখন তুমি? ভুলে গেলে নাকি সেদিনের কথা? সেদিন তো খুব অনুনয়বিনয় করেছিলে। আমায় মানানোর জন্য তখন তো ঠিকই নাটক করেছিলে। আর আমার বেলায় পারবে না? ছবিটা কিন্তু এখনো আছে আমার কাছে। দেবো ভাবিকে? দেখাব?’
আহনাফ থতমত খেয়ে বলে,’আরে ধুর! তুইও না নেহু। আমার সোনা বোন। লক্ষী বোন। তোর সাথে কি একটু মজাও করা যাবে না নাকি? তুই আর আফরিন কি আলাদা বল? তোরা দুইটা আমার দুই কিডনি। কত দামী জানিস? ভাইয়া তোদের ভালোবাসি না? লক্ষী আমার বোন। তুই দেশে আয়। আমি তোকে রান্না করে খাওয়াব।’
‘শুরু হয়ে গেছে নাটক!’
নেহা রাগ করার ভান ধরেও থাকতে পারে না। আহনাফের কথার ভঙ্গি দেখে হাসিও আটকে রাখতে পারে না। অর্ষা এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল ওদের কথা। এবার সেও গম্ভীর হয়ে বলে,
‘কীসের ছবি নেহা?’
আহনাফ বলল,’আরে ধুর! এমনি। তুমি ওর কথা বিশ্বাস করো?
নেহু লক্ষী সোনা, তোর সাথে পরে কথা বলি।’
অর্ষা ছোঁ মেরে ফোনটা নিজের হাতে নিয়ে নেয়। চোখে ধিকিধিকি আ’গু’ন জ্বলছে। কাঠকাঠ গলায় সে নেহাকে জিজ্ঞেস করে,
‘কীসের ছবির কথা বলছ তোমরা? আমায় কিছু মিথ্যা বলবে না নেহা। তোমার ভাইয়ের কোনো অ্যাফেয়ার ছিল?’
‘কী যা তা বলছ!’ বলল আহনাফ।
নেহা ঠোঁট টিপে হেসে বলল,’হ্যাঁ, ভাবি। ভাইয়া নিশ্চয়ই তোমায় বলেনি এসব? মেয়েটা ভীষণ সুন্দর জানো? ছবিটা তো আরো বেশি সুন্দর। তুমি দেখলে জাস্ট চমকে যাবে।’
অর্ষার দু’চোখ অশ্রুতে টলমল হয়ে যায়। নেহা তখনো ছবিটার বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছিল। আহনাফ মৃদু ধমক দিয়ে বলল,
‘তুই থামবি নেহা? সংসার নষ্ট করিস না বোন আমার।’
নেহা হেসে বলে,’আমার কিউটি ভাবি কাঁদছ কেন তুমি? দাঁড়াও, আমি তোমাকে ছবিটা পাঠাচ্ছি। আমার বর্ণনা অনুযায়ী মিলিয়ে নিও কেমন। আর হ্যাঁ, ছবিটা দেখলে তোমার মন ভালো হয়ে যাবে আমি নিজে গ্যারান্টি দিচ্ছি।’
নেহা নিজেই এবার কল কেটে দিল। ততক্ষণে কেঁদেকেটে অর্ষার অবস্থা নাজেহাল। আহনাফকে কাছেও ঘেঁষতে দিচ্ছে না। অর্ষার হোয়াটসএপে ছবি পাঠায় নেহা। সাথে লিখে দিয়েছে,’প্রিন্স এন্ড প্রিন্সেস।’
আহনাফ ছবিটা দেখিয়ে বলল,’আগে দেখো। তারপর কাঁদো।’
অশ্রুসজল নয়নে ছবির দিকে তাকিয়ে থমকে যায় অর্ষা। ফোন হাতে নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে।
আহনাফ বলে,’এবার দেখলে কার সাথে ছিল আমার অ্যাফেয়ার?’
‘সেদিন রাতের?’
‘জি ম্যাডাম। নেশা করে যখন দুজনই টাল-মাতাল ছিলাম।’
অর্ষা এবার কী করবে বুঝতে পারছে না। নিজের বোকামির জন্য লজ্জাও লাগছে। আহনাফ চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে চোখের পাতায় চুমু খেয়ে বলল,
‘আর কাঁদতে হবে না। আমরা বরং এক কাজ করি। চলো মুহূর্তটি ফের রিপিট করি।’
অর্ষা মৃদু হেসে জড়িয়ে ধরে আহনাফকে।
চলবে…