গোধূলি লগ্নে সেই তুমি – পর্ব 24

0
526

#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_চব্বিশ
দুই দিন পর কলেজের ক্যাম্পাসে পা রেখে সামনের দৃশ্য’টা দেখে থমকে গেলো ফাইজা। পুরো ক্যাম্পাসের সামনে ফারদিন’কে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে একটা মেয়ে। মেয়ে’টাকে পেছন থেকে ঠিক চিনতে পারছেনা ফাইজা। সবাই অবাক নয়নে তাঁকিয়ে আছে ওদের দিকে। ক্যাম্পাসের মোটামুটি সবাই ফাইজা-ফারদিনের সম্পর্কের কথা জানে। সেখানে এইসব দেখে এক মুহূর্তের জন্য মাথা ঘুরে গেলো ফাইজা। দুই পা পিছিয়ে পড়ে যেতে’ই একটা ইটের সাথে পা লেগে পড়ে গিয়ে মৃদু স্বরে ‘”আহ” করে উঠলো। ইটের সাথে লেগে ওর কনুই ছিলে রক্ত বের হতে লাগলো। আরজা জোরে চেঁচিয়ে উঠে ফাইজা’কে আকড়ে ধরলো। আরজার চিৎকার শুনে অনেকের দৃষ্টি এখন ফাইজা’র দিকে। ফারদিনের দৃষ্টি ও ফাইজার দিকে। ফাইজার এলোমেলো চাহনী দেখে ফারদিন এইবার রাগে মেয়ে’টার দুই বাহু শক্ত করে চে’পে ধরে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ধাক্কা’ দিয়ে মেয়েটা’কে মাঠে ফেলে দিলো। তারপর দৌড়ে এসে ফাইজার সামনে বসে চিন্তিত স্বরে বলতে লাগলো…..
–ইস কত’টা কে’টে গেছে। কি করে পড়ে গেলে? তুমি দেখে হাটতে পারো না? কোন দিকে মনোযোগ থাকে তোমার?
ফাইজার মনের কোনে কেনো যেনো অভিমান জমে উঠলো। বার বার কিছু মূহুর্ত আগের দৃশ্য ভেসে উঠছে চোখের সামনে? অভিমানে ফারদিনের থেকে নিজের হাত’টা ছাড়িয়ে নিলো। ফাইজার কান্ডে ফারদিন অবাক নয়নে তাঁকিয়ে রইলো। ফাইজা আরজার হাত’টা শক্ত করে ধরে উঠে দাড়ালো। ফারদিন এখনো এক হাটু ভেঙে বসে আছে। ফাইজার এহেতুক ব্যবহারের কারন আন্দাজ করতে পারলো। কিন্তু তাও কেনো যেনো ফাইজার এমন ব্যবহার একটু খারাপ লাগলো ওর কাছে। ফারদিন সব ভাবনা ঠেলে উঠে দাড়িয়ে পকেট থেকে টিস্যু বের করে ফাইজার হাতে প্যাঁচিয়ে দিতে দিতে আরজা’র দিকে চেয়ে বললো…..
–ও’কে নিয়ে আমার গাড়ি’তে বসাও। আমি আসচ্ছি……
আরজা মাথা নাড়িয়ে সাঁয় দিতে’ই ফাইজা কাঠ কাঠ গলায় বলে উঠলো……
–আমি ঠিক আছি স্যার। এত বেশি হাইপার হবেন না। সামান্য ছি’লে গেছে ঠিক হয়ে যাবে…
বলেই একটা সালাম দিয়ে ক্লাস রুমের দিকে পা বাড়ালো। ফাইজা’র কান্ডে ফারদিন আর আরজা দুজনেই অবাকের শেষ সীমানায়। আরজা ও ওর সাথে সাথে ক্লাসে গেলো। ফাইজা ক্লাস রুমে চলে যেতে’ই ফারদিন ওর পিছু পিছু পা বাড়াতে’ই কিছুক্ষন আগের মেয়ে’টা এসে ফারদিনে হাত টেনে ধরে বলে উঠলো…..
–বিশ্বাস করো ফারদিন আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। আই লাভ ইউ। আই লাভ ইউ। আই লাভ ইউ…..
এইবার আর ফারদিন নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলো না। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে মেয়ে’টা গালে থা’প্প’ড় মে’রে বসলো। তৎক্ষনাৎ মেয়ে’টার গাল চে’পে ধরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো…..
–অনেক ক্ষন যাবৎ তোর নোং’রা’মি সহ্য করে চলেছি। তুই খুব ভালো করে জানিস আমি মেয়েদের দু চোখে সহ্য করতে পারিনা। এখনো আমি সব মেয়ে’কে বিশ্বাস করি’না। আর তোর মতো মেয়েদের তো সবার আগে বিশ্বাস করিনা। আমার থেকে দূরে থাকা তোর জন্য মঙ্গল……
বলেই আবারো ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে ক্লাস রুমে ঢুকে গেলো। উপস্থিত শিক্ষরা সবাই’কে চলে যাওয়ার জন্য ইশারা করতেই সবাই যে যার ক্লাসে ঢুকে গেলো। সবাই চলে যেতে’ই মেয়ে’টা অপমানিত থমথমে মুখ নিয়ে কাঠের ন্যায় শক্ত মুখ নিয়ে দাড়িয়ে রইলো। ভয়ংকর চাহনী দিয়ে দাতে দাত চে’পে বলে উঠলো……
–ফাইজা’র সাথে তোর সম্পর্ক আমি কিছুতে’ই সুখের হতে দিব না। সেই কলেজ লাইফ থেকে তোর পেছনে পড়ে আছি। আজ অব্দি কোনো মেয়ে’ তোর ধারে কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করলেও তাকে হসপিটালে বেডে আমি পাঠিয়েছি। আর সেখানে এই ফাইজা’কে তো আমি দুনিয়া থেকে’ই আউট করে দিব…….
বলেই বাঁকা হেসে ক্যাম্পাস ছেড়ে বেড়িয়ে গেলো।
____________________________________________
ক্লাস রুমে এসে নিশ্চুপ বসে আছে ফাইজা। ওর দৃষ্টি শান্ত। বার বার মনে হচ্ছে। ফারদিন ও’কে ঠকা’তে পারেনা। যেই ছেলে’টা মেয়েদের সহ্য’ই করতে পারতো না সেই ছেলে’টা কি করে? আর ভাবতে পারলো না ও? মাথা ধরে আসচ্ছে ওর। হাতে প্রচন্ড ব্যাথা পেয়েছে। তা ঠোঁট চে’পে সহ্য করে নিচ্চে। ফাইজা বার বার টিস্যু দিয়ে র’ক্ত মুছে যাচ্ছে। ফাইজা’কে কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না ও? কলেজে আসার আগে থেকেই ফাইজা’কে আজ অন্যরকম লাগছে ওর? ক্লাসের কেউ কেউ ওর দিকে চেয়ে আছে৷ ফারদিন হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢুঁকে’ই খপ করে ফাইজা’র কব্জি চে’পে ধরে শক্ত কন্ঠেই বললো…..
–ডো’ন্ট স্যা এ ওয়াড। কাম উইথ মি…..
বলেই ফাইজা’কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সবার সামনে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। ফাইজাও কোনো শব্দ না করে ওর সাথে চলতে লাগলো। ফাইজা’কে গাড়ির সামনে এনে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে ইশারা করতে’ই ফাইজা উঠে বসলো গাড়িতে। ফারদিন নিজেও গাড়িতে উঠে কোনো কথা না বলে গাড়ি স্ট্যাট দিলো। সাড়া রাস্তা ফাইজার দৃষ্টি সামনের দিকে স্থির ছিলো। দুই দিন আগেও যেই মেয়েটা চঞ্চল৷ ছিলো তাকে হঠাৎ এতটা স্তব্দ দেখে ফারদিন বিস্মিত হয়ে আছে। কি এমন হয়েছে? নাকি শুধুই কিছুক্ষন আগের ঘটনা’টা নিয়ে এমন করছে? বুঝতে পারছেনা ফারদিন। নিদিষ্ট সময় পর একটা স্থানে এসে গাড়ি থামতে’ই ফাইজা সামনের দিকে কিছু’টা ঝুঁকে পড়েও নিজেকে সামলে নিলো।
ফারদিন গাড়ি থেকে নেমে ফাইজা’কে গাড়ি থেকে নামালো। ফাইজা চারদিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে দেখলো একটা বড় রেস্টুরেন্টের সামনে ওরা দাড়িয়ে। ফারদিন ওর হাত ধরেই রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করলো। কর্ণারের ফাঁকা জায়গায় দুইটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো দুজন সাথে ফারদিন জোরে চেঁচিয়ে দুই মগ কফি অর্ডার দিলো৷ ফাইজা এখনো নিশ্চুপ। গায়ে কলেজের সাদা ড্রেস। গলায় প্যাচানো হিজাব’টা বার বার আঙ্গুলের সাথে প্যাঁচিয়ে প্যাঁচিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে। ফারদিন নিরবতা ভেঙে প্রশ্ন করে বসলো…..
–হোয়াই আর ইউ ডুয়িং দ্যাট?
ফাইজা নরমাল ভাবেই উওর দিলো…..
–কি করেছি?
ফারদিন তাচ্ছিল্য স্বরে একটু হেসে বললো….
–ওহ রিয়্যালি। তুমি জানো না তুমি কি করেছো?
ফাইজা একটু খামখেয়ালি ভাবে বললো….
–এখান থেকে চলুন। অস্বস্তি হচ্ছে এত মানুষের মধ্যে……
ফারদিন ফাইজার গাল’টা হালকা চে’পে ধরে একবার ডান পাশে ঘুরালো। আরেক বার বাম পাশে ঘুরিয়ে বলে উঠলো….
–লুক! দেয়্যার’স নো’বডি হেয়্যার……
ফাইজা নিজেই ফারদিনের হাত’টা সরিয়ে নিয়ে মৃদ স্বরে বললো…..
–খেয়াল ছিলো না। কি বলবেন বলুন? এখানে কেনো নিয়ে এলেন? আমার ক্লাস ছিলো……
ফাইজার কথা আর কান্ডে ফারদিনের রাগ উঠলেও নিজেকে সামলে নিলো। ঘাড়ের দুই পাশে হাত রেখে ঘাড় একবার বামে ডানে হেলিয়ে বড় একটা নিশ্বাস ছাড়লো। ঘন কালো চুল গুলো দুই হাতে পেছনে ঠেলে শার্টের কলার টেনে ঠিক করলো। ফাইজা ভ্রু কুচকে দেখছে। হঠাৎ করেই ফারদিন শিস বাজাতে বাজাতে। কনুই অব্দি ফোল্ড করা হাতা’টা একবার খুলে আবারো চওড়া করে ফোল্ড করলো। শার্টের প্রথম দুই’টা বোতাম খুলে দিলো। বোতাম খুলতে’ই ওর বুকের লোম গুলো দৃশ্যমান হলো। তা দেখে ফাইজা নিজের দৃষ্টি অন্য দিকে ফিরিয়ে নিলো। হাতের ঘড়ি’টা খুলে টেবিলে রাখলো। ফারদিনের কান্ডে ফাইজা’র রাগ উঠছে। কি করছে লোক’টা এসব? মাথা ঠিক আছে নাকি? ফারদিন শিস বাজানো অফ করে টেবিলের উপর দুই হাত রেখে তারপর থুত’নি রেখে ফাইজার দিকে ঘোর লাগা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। কয়েক সেকেন্ড এভাবে তাঁকিয়ে থাকলো। ফাইজার দৃষ্টি টেবিলের উপর কাচের দিকে বিদ্যমান। ফারদিন আবারো একটা জোরালো নিশ্বাস ছাড়লো। টেবিলের উপরে থাকা পানির বোতল’টা নিয়ে কয়েক ঢোঁক পানি খেয়ে গলা ঝাড়লো। ফাইজা এইবার আর চুপ করে থাকতে পারলো না। চোখ গরম করে প্রশ্ন করে বসলো……
–কি সমস্যা? এমন করছেন কেনো?
ফারদিন শান্ত স্বরেই বলে উঠলো…..
–যেই মেয়ের জন্য তুমি আমাকে ভুল বুঝে আমার উপর অভিমান করে আছো? সেই মেয়ের জন্য’ই এতদিন আমি তোমার সাথে সবার সামনে মিস বিহেভিয়ার করতাম…………
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here