#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_সাতাশ
সামনে দুটো র’ক্তা’ক্ত লা’শ তাতেও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তিথী। সে নিজ খেলায় মত্ত। যে ফারদিনের গাঁয়ে আঘাত করেছিলো। তাকে একেরপর ছু’ড়ি দিয়ে আঘাত করে যাচ্ছে ও। বেশ কয়েকবার আঘাতের ফলে ছেলে’টার হাতের মাংস থেতলে উঠে গেছে তা ও থামছে না। ওর পাশে থাকা গার্ড দুটো দুজন দুজনের দিকে চেয়ে আছে। একটা মেয়ে এতটা ভয়ংকর’ কি হয়? বেশ কয়েকবার আঘাত করে নিজের ক্ষোভ মেটানো শেষে তিথী র’ক্ত মাখা ছু’ড়িটা দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো…..
–এটা’কে সরানোর ব্যবস্থা করো……
বলেই বেড়িয়ে গেলো। তিথী চলে যেতে’ই গার্ডদের মধ্যে প্রথম একজন বলে উঠলো……
–ম্যাডাম বোধহয় ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে গেছে……
তার কথা শুনে দ্বিতীয় গার্ড’টা বলে উঠলো…..
–আমার মনে হয় ম্যাডাম মানসিক ভাবে অসুস্থ….
বলে দুজনেই হাফছেড়ে নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
____________________________________________
হসপিটালের এক কেবিনে পাশাপাশি দু’টি বেডে রয়েছে ফারদিন আর ফাইজা। ফারদিন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আর ফাইজা’র জ্বর কিছু’টা কমায় শরীর বেশ সুস্থ লাগছে তাই ও বেডের সাথে হেলান দিয়ে বসে এক দৃষ্টি’তে ফারদিনের দিকে তাঁকিয়ে আছে। ছেলে’টার কাল রাতে খুব বেশি শ্বাসকষ্ট উঠে গিয়েছিলো তাই বাধ্য হয়ে হসপিটালে নিয়ে আসতে হয়েছে। ফারদিনের খবর কানে যেতে’ই সবার হাতে পায়ে ধরে জ্বর নিয়েই হসপিটালে চলে এসেছিলো। রাতে তুলনামূলক ভাবে বেশি জ্বর থাকায় ও’কেও ফারদিনের সাথে একি কেবিনে রাখা হয়েছে। এই বুদ্ধি’টা অবশ্য জেহেরে’র। ফারদিনে’র মুখে অক্সিজেন লাগানো। সারা মুখ’টা লাল হয়ে আছে রক্ত জবার মতো। দেখে খুব মায়া হচ্ছে ফাইজা। আবার রাগ হচ্ছে নিজের প্রতি। কেনো ভিজতে গেলো? যদি কাল না ভিজতো তাহলে ছেলে’টা আজ এত বেশি কষ্ট পেতো না। এখন ওদের সম্পর্কে’র সবাই জানে। সবাই মিলে কাল রাতে’ই সিদ্ধান্ত নিয়েছে খুব শিঘ্রই ওদের চার হাত এক করে দিবে। ভাবতেই ফাইজা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। মাথা’টা ঝিম ধরে আছে। চিন চিন করে ব্যাথা করছে সাথে পুরো দুনিয়া মিলে ঘুরছে। ফাইজা নিজেকে সামলে বেড থেকে নেমে ফারদিনের মাথার কাছে এসে বসলো। এই মুহূর্তে এই কেবিনে ওরা ছাড়া কেউ নেই। হসপিটালে শুধু জেহের আছে তাও জরুরী কাজে বাইরে গেছে একটু। বাড়ির সবাই সারা রাত ছিলো সকালেই বাড়ি গেছে। এই সুযোগে ফাইজা ফারদিনের মাথার কাছে বসে ফারদিনের ঘন চুলে হাত ডুবালো।আলতো হাতে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। মনের অদম্য ইচ্ছা’টাকে দমিয়ে না রেখে ঠোঁট ছোঁয়ালো ফারদিনের কপালে। আর ভাবনায় ডুব দিলো নিজের অজান্তে বিয়ে হওয়ার সময়’টা…..
____________________________________________
রাতে পড়ার টেবিলে বসে পড়ছিলো ফাইজা। এই সময় বাবা-মা’কে একসাথে রুমে ঢুকতে দেখে ফাইজা একটু অবাক হয় খানিক’টা। তারা কখনোই কোনো দরকার ছাড়া একসাথে এই রুমে প্রবেশ করে না। তাহলে আজ হঠাৎ কি এমন হলো যে দুজন এক সাথে? ফাইজা পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠে হাসি মুখে প্রশ্ন করলো…..
–তোমরা এই সময় একসাথে?
ফাইজার কথা শুনে নাদিয়া বেগম ওর হাত ধরে ও’কে বিছানায় বসিয়ে নিজেও ফাইজার পাশে বসে ওর দুই গালে হাত রেখে বলে উঠলো….
–আমার মেয়ে’টা তো বড় হচ্ছে। তাই বাবা-মা হিসেবে আমার অনেক বড় দায়িত্ব পালন করতে হবে। আজ তোর জীবনে’র সব থেকে বড় ডিসিশন’টা তোকে না জানিয়ে নিয়েছি মা। এতে কি তোর আপত্তি রয়েছে?
নাদিয়া বেগমের কথা ফাইজা ঠিক বুঝতে পারলো না। ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে রইলো তার দিকে। তারপর মা’কে জড়িয়ে ধরে খুশি মনে বললো…..
–তোমরা আমার বাবা-মা। তোমরা আমার কখনো খারাপ চাইবে না। তাই তোমাদের ডিসিশনে আমার কোনো আপত্তি নেই মা। এখন বলো কি ডিসিশন নিয়েছো?
নাদিয়া বেগম কিছু না বলে হাসনাত সাহেবের দিকে ইশারা করতে সে বললো……
—এখনো তুই বেশ ছোট। তাই যেদিন সময় আসবে সেদিন তোকে আমরা সব’টা বলব। আজ কোনো প্রশ্ন না মা।
বলেই ফাইজা’র দিকে একটা কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বললো…..
–শুধু একটা সিঙ্গেন্যাচার করে দে এখানে। আর ভেবে নে বাবা যেটা করছে আমার ভালোর জন্য।
ফাইজা কিছু বুঝতে পারলো না কিছুই। মনে হাজার প্রশ্ন থাকা স্বত্তেও মুখে কোনো প্রশ্ন না করে। সাথে সাথে সিঙ্গন্যাচার করে দিলো। একবার পড়ার সুযোগ’টা অব্দি পায়’নি৷ সেদিন যে নিজের অজান্তে’ই ফাইজা অন্য একজনের অধাঙ্গিনী হয়ে গিয়েছিলো ও নিজেও জানেনা। তারপর থেকে বড় হয়েছে সময়ের সাথে সাথে এইসব কিছু ভুলে’ই গিয়েছিলো ও? তাই ফারদিন যখন ও’কে বিয়ের কথা বলছিলো তখন অবাকের শেষ সীমানায় পৌঁছে গিয়েছিলো। আসলে নাদিয়া বেগম আর হাসনাত হাসেব চেয়েছিলো। ফাইজা প্রর্যাপ্ত বয়স হওয়ার পর বিয়ে’টা হবে। আর ফাইজার থেকে ফারদিন প্রায় ৮-৯ বছরের বড় ছিলো তাই একটু অমত করেছিলো। এখন যখন জানতে পেরেছে ফাইজা ও ফারদিন’কে সমান ভাবে ভালোবাসে। তাই এখন যত দ্রুত সম্ভব ওদেফ বিয়ে’টা জমজমাট ভাবে দিতে চায়।
____________________________________________
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ফাইজা অন্য দুনিয়ায় চলে গিয়েছিলো। ফারদিন নড়ে উঠতে’ই ওর ধ্যান ভাঙে। ফারদিনের দিকে তাঁকাতেই দেখে ফারদিন ওর দিকেই চেয়ে আছে। তাই ফাইজা চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো…..
–আপনার আবার কষ্ট হচ্ছে?
ফাইজার কথা শুনে ফারদিন মুখের থেকে অক্সিজেন মাস্ক’টা খুলে চওড়া একটা হাসি দিয়ে বললো…..
–আ’ম অলরাইট জান।
ফারদিনের মুখে জান শব্দ’টা শুনে ফাইজা একটু হাসলো। পরক্ষনে’ই গম্ভীর মুখ করে বললো….
–আপনি কেনো ভিজেছেন? আগে বলবেন তো বৃষ্টি’তে ভিজলে আপনার এত সমস্যা হয়?
ফাইজা’র কথায় ফারদিন হেসেই জবাব দিলো…..
–এক বৃষ্টি কন্যার বৃষ্টি’ উপভোগ করার মনোরম দৃশ্য দেখছিলাম।
বলে ফাইজা’র হাত’টা টেনে এনে উল্টো পিসে ঠোঁট ছোঁয়ালো। ফাইজা ও লাজুক হেসে মাথা নুইয়ে ফেললো।
____________________________________________
বেশ কয়েকদিন কে’টে গেছে। কলেজের অন্যান্য শিক্ষার্থীদের পরিক্ষা চলছে। যার দরুন ফারদিন’কে সারাদিন ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে৷ ফাস্ট ইয়ারের ক্লাস বন্ধ থাকায় ফাইজা’কে ও সারাদিন বাসায় থাকতে হচ্ছে। তাই আজ সময় পার করতে বাবা-মায়ের সাথে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সকাল সকাল উঠে ফ্রেশ হয়ে জামা-কাপড় গুঁছিয়ে নিলো। সামনের মাসে ওদের বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। তাই খুশি’তে মন’টা ফুরফুরে লাগছে খুব। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে চুল আচড়াচ্ছে ফাইজা। ড্রয়িং রুমের থেকে ডাক পড়তেই। হাতে ঘড়ি’টা পড়তে পড়তে বেরিয়ে গেলো। তারপর সবাই মিলে রওনা হলো। বাসার সামনে থেকে দুইটা রিকশা ডেকে নিলো। যেহেতু ওরা তিনজন তাই কে একা যাবে সেটা নিয়ে বাধলো বিপত্তি। বাবা-মা দুজন’জে থামাতে ফাইজা বলে উঠলো……
–আমি একা যাব। আর তোমরা এই রিকশায়। আমরা তো একসাথেই যাব তাই সমস্যা কি বাবা?
আমার রিকশা’টা না হয় আগে যাবে আর তোমাদের’টা পেছনে। তাই আর কোনো সমস্যা হওয়া’র কথা না। চলো এইবার উঠে পড়ো…..
মেয়ের আবদারে ওরা দুজন ও না করলো না। ফাইজার কথা মতো রিকশা চলা শুরু করলো।
____________________________________________
নাদিয়া বেগম আর হাসনাত সাহেব’দের রিকশা কিছু দূর পেছন থেকে একটা প্রাইভেট কার রিকশা’য় ধাক্কা দিতে’ই তারা দুজনেই রিকশা থেকে উল্টে রাস্তায় পড়তে’ই ব্যস্ত রাস্তার মাঝে একটা বড় ট্রাক এসে ওদের পিশিয়ে রেখে গেলো। চোখের পলকে দুজনের প্রান পাখি উড়ে গেলো।
ফাইজার রিকশা কিছু টা দূরে ছিলো। পেছন থেকে হট্টগোলের শব্দ ভেসে আসতেই ফাইজা’র বুক ধক করে উঠলো। রিকশা থেকে নেমে পেছনে তাঁকাতে’ই মানুষের ভীড় চোখে পড়লো। বাবা-মায়ের রিকশা’টা দেখতে না পেয়ে ভয়ে বুক ধুকপুক করতে লাগলো। ভীড়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে’ই ওর ফোন স্কীনে একটা মেসেজ ভেসে উঠলো। মেসেজের শব্দে ফোন স্কীনে তাঁকাতে’ই আননোন নাম্বার থেকে মেসেজ। কৌতুহল বশত মেসেজ ওপেন করতে’ই ওর হাত থেকে ফোন’টা পড়ে গেলো। দৌড়ে ছুটে গেলো ভীড়ের মধ্যে। ভীড় ঠেলে ভেতরে ঢুকে দুইটা রক্তাক্ত দেহ দেখে। জোরে চিৎকার জ্ঞান হারালো। তখনের মেসেজ’টা ছিলো…
“আজ বাবা-মা হারিয়েছো কাল ভালোবাসা’কে হারাবে। কেমন লাগবে বলো তো””””””
#চলবে