#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_একত্রিশ
মধ্য রাতে অঝোরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ফারদিন এখনো হাটু ভেঙে বসে আছে বৃষ্টির মধ্যে। সারা শরীর ভিজে চুপচুপ হয়ে আছে। জানালার ফাঁক দিয়ে অনেক ক্ষন যাবৎ দেখছিলো ফাইজা। ভেবেছিলো ছেলে’টা নিজের শরীরের কথা চিন্তা করে উঠে যাবে। কিন্তু, এই ছেলে’টাকে তো ও চিনে
। তাই, এখন আর চুপ করে থাকতে পারলো না। ওড়না’টা মাথায় দিয়ে বেড়িয়ে গেলো বাইরে। ফাইজা’কে বেড়িয়ে আসতে দেখে ফারদিনের মুখে হাসি ফুটলো না। হুড়মুড়িয়ে উঠে দাড়িয়ে পড়লো। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ফারদিনের মুখ’টা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চোখ দুটো অসহায় চাহনী দিয়ে আছে। মুখ’টা শুকিয়ে গেছে। ফারদিনে মুখ’টা দেখে ফাইজা’র বুকের ভেতর’ট মুচড়ে উঠলো। ফাইজা এক দৃষ্টি’তে ওর দিকে কিছুক্ষন তাঁকিয়ে রইলো। নরম স্বরে কিছু বলতে যাবে তখনি নাদিয়া বেগম আর হাসনাত সাহেবের সাদা কাফন প্যাচানো মুখ’টা ভেসে উঠলো চোখের সামনে। তখনি, ফাইজা’র মুখ’টা আবার কঠিন রুপ ধারন করলো। কন্ঠস্বর কঠোর করে বললো…….
—আপনি কেনো এসেছেন এখানে?
ফাইজার প্রশ্নে ফারদিনের মন’টা বিশিয়ে গেলো। তাও নিজেকে সামলে ফাইজার হাত দুটো আকড়ে ধরে বলে উঠলো….
—প্লিজ আমাকে দূরে ঠেলে দিও না জান। আমি থাকতে পারছি না। পারছিনা আমি…….
বলতে না বলতে ওর গলা জড়িয়ে আসলো। অঝোরে বৃষ্টির জলের মাঝেও ফাইজা ঠিক বুঝতে পারলো ফারদিন কাঁদছে। দুজনের মনের অবস্থা’ই এক। শ্রাবনের শ্রাবন ধারায় সেদিন ভিজেছিলো খুশি’তে আর আজ ভিজচ্ছে বিষাদের আগুন নেভানোর জন্য। ফাইজা’র চোখ থেকেও পানি গড়িয়ে পড়ার আগে হাত’টা ছাড়িয়ে নিয়ে ফাইজা পূর্বের মতোই কঠোর স্বরে বলে উঠলো…..
—আমাকে আমার মতো ছেড়ে দিন প্লিজ। আমি চাইনা আমার জন্য আর কারোর জীবন হারাতে হোক। এখানে আর কোনো দিন আসবেন না। এটা আমার অনুরোধ…..
বলেই হাত জোড় করে ধরে আবারো বললো…..
–প্লিজ চলে যান। আর কোনো দিন আসবেন না…..
বলেই পা বাড়ালো সামনের দিকে। ফারদিন এইবার কান্নারত কন্ঠে চেঁচিয়ে বলে উঠলো…..
—আমি ম’রে যাবো সত্যি। অনেক বেশি ভালোবাসি তোমাকে। প্লিজ ডোন্ট লিভ মি জান…….
ফারদিনের আকুতি ভরা কন্ঠ শুনে থেমে গেলো ফাইজার পা। বুকের ভেতরের লুকানো ভালোবাসা গুলো মুহূর্তেই খা খা করে উঠলো। দুমড়ে মুচড়ে উঠলো ভেতর’টা৷ ভালোবাসা এত’টা অসহায় না হলেও পারতো। মনে প্রেম ভালোবাসা থাকে কিন্তু চা’পা পড়ে অভিমানের আড়ালে। আড়াল থেকে চাইলেও বেড়িয়ে আসা যায়না। ভালোবাসার মানুষের কাছে দুনিয়ার সব থেকে শক্তিশালী ব্যাক্তি’টাও অসহায়। নিজেকে ধরে রাখার শক্তি আর পেলো না। ছুটে গিয়ে হামলে পড়লো ফারদিনের বুকে। মুশলধারার বৃষ্টির সাথে মিশে গেলো বাধ ভাঙা কান্নার স্বর। ফারদিন এক মুহূর্তের জন্য ঘোরে চলে গিয়েছিলো। ফাইজা’র কান্নার স্বরে নিজেকে আর সামলাতে পারলোনা নিজেও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মুশলধারের বৃষ্টির মাঝে দুজন ব্যাক্তি হারানো ভালোবাসা ফিরে পেয়ে অঝরে কাঁদছে। আর কান্না’টা খুশির কান্না। ভালোবাসা ফিরে পাওয়ার কান্না। ফাইজা ফারদিনের ভেজা শার্ট’টা খামচে ধরে কান্না করতে করতে বলে উঠলো…..
–আমি ও ভালো নেই আপনাকে ছাড়া। বিশ্বাস করুন বাবা-মায়ের এইভাবে চলে যাওয়া’টা আমি কিছুতে’ই মেনে নিতে পারছিনা। আমি ভেঙে গেছি। খুব বাজে ভাবে ভেঙে গেছি। নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলার শক্তি, ক্ষমতা, আত্মবিশ্বাস নেই আমার। ও তো আমাকে মে’রে ফেলতে পারতো। ওর শত্রু’তা আমার সাথে। তাহলে, কেনো আমাকে এতিম করে দিলো…..
বলেই আবারো কাঁদতে লাগলো। ফারদিন প্রতিউওরে কিছুক্ষন চুপ থেকে শান্ত কন্ঠে বললো……
–আন্টি আংকেল আর কোনো দিন ফিরে আসবে না। এই কঠিন সত্য’টা একদিন সবাই’কে মেনে নিতে হবে। কিন্তু আমি শুধু তোমাকে একটা কথা দিতে পারি। আন্টি আংকেল’কে যারা নির্মম ভাবে তোমার থেকে কেড়ে নিয়েছে তাদের দুজন’কে আমি ভয়ানক মৃ’ত্যু দিব। তোমার চোখের সামনে……..
ষ্টির বেগ কিছু’টা কমেছে। দুজনেই অনেকক্ষন যাবৎ ভিজছে। দুজন শব্দ’টা শুনে ফাইজা’র কান্না থেমে গেলো। মস্তিষ্ক প্রশ্ন করে বসলো” দুজন কারা?”। প্রশ্ন’টা করার জন্য ফাইজা মুখ খুলতে’ই ফারদিন বলে উঠলো….
–ভেতরে চলো। আগে ফ্রেশ হয়ে নেও। নয়তো শরীর খারাপ হবে….
;বলে ওর হাত ধরে ভেতরে নিয়ে আসলো। এতক্ষন নিজে ভিজে গেছে। নিজের শরীরের কথা একবার ও ভাবে’নি অথচ এখন কি সুন্দর নিজের ভালোবাসার মানুষ’টার কথা আগে ভাবলো। ভাবতে’ই নিজের অজান্তে ফাইজার মুখে হাসি ফুটলো। এই মানুষ’টা ও’কে সত্যি বড্ড বেশি ভালোবাসে। ভেতরে এসে প্রথমে ফাইজা ফ্রেশ হয়ে কিচেনে চলে গেলো। ফারদিন ফ্রেশ হয়ে জেহেরের থেকে টি-শার্ট আর টাউজার পড়েছে। চুল মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে ফাইজা দুই মগ ধোয়া উঠা কফি হাতে দাড়িয়ে আছে। ফারদিন’কে দেখে’ই মগ দুটো ট্রি-টেবিলে রেখে ওর দিকে এক গ্লাস পানি হাতে এগিয়ে আসলো। তারপর একটা ওষুধ ফারদিনের হাতে দিয়ে খেয়ে নিতে বললো। এটা জ্বরের ওষুধ। ফারদিনের শরীর প্রচন্ড গরম। সাথে চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। ফারদিন হালকা হেসে আপত্তি না করে ওষুধ’টা খেয়ে নিলো। ফাইজা ওষুধ’টা দিয়ে পেছনে ফিরে সামনে আগানোর জন্য পা বাড়াতে’ই ফারদিন ওর হাত ধরে ফেললো। হঠাৎ হাত ধরায় ফাইজা ফারদিনের দিকে ভ্রু কুচকে তাকা’তেই ফারদিন ও’কে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলে উঠলো….
–চুল দিয়ে পানি পড়ছে সে খেয়াল আছে। কতক্ষন বৃষ্টি’তে ভিজেছো তারপর এখনো চুল ভেজা। শরীর মারাত্মক খারাপ করবে। একটু ও চিন্তা নেই নিজের জন্য তাইনা……
বলে’ আলতো হাতে যত্নসহকারে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছে দিতে লাগলো। আর ফাইজা অশ্রু মাখা চোখে তাঁকিয়ে আছে ওর দিকে। এই ছেলে’টাকে এই কয়েকদিন কষ্ট দিয়েছে ভাবতে’ই ওর বুক ফে’টে যাচ্ছে কষ্টে। ফারদিন চুল মুছিয়ে ফাইজার দিকে তাঁকাতে’ই ওর চোখে জল দেখে অস্থির কন্ঠে বললো…
–কাদঁছো কেনো? খারাপ লাগছে? মাথা ব্যাথা করছে?
ফাইজা প্রশ্নের উওর না দিয়ে ফারদিন’কে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো…..
–এত বেশি ভালোবাসেন কেনো বলেন তো?
ফাইজার প্রশ্নে ফারদিন শব্দ করে হেসে ওর কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে বলে উঠলো…..
–তুমি আমার বেঁচে থাকার ওষুধ। তোমাকে ভালো না বাসলে বেঁচে থাকব কি করে জান?
ফারদিনের কথায় ফাইজা ওর দিকে ঘোর লাগা চাহনি দিয়ে অন্যরকম স্বরে বললো….
–আপনার গালে একটা চুমু খেতে পারি মিস্টার অভদ্র…..
ফাইজার কথা শুনে ফারদিন বাঁকা হেসে ভ্রু নাঁচিয়ে বলে উঠলো…..
–তুমি চাইলে অন্য জায়গায় ও চুমু খেতে পারো জান……
বলে ঠোঁটের দিকে ইশারা করলো। ফাইজা মুখ চেপে হেসে পরম আবেশে ফারদিনের গালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। ফারদিন তো আর থেমে থাকার ব্যাক্তি না সে একে একে ফাইজার দুই গালসহ কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। তারপর ফাইজা’কে নিয়ে ধপ করে সুয়ে পড়লো। ফাইজা’কে বুকের মধ্যে চেপে ধরে বলে উঠলো…..
–কয়েকদিন শান্তি’তে ঘুমাতে পারি’নি জান। তাই আজ নো সাউন্ড। আমি তোমাকে বুকে জড়িয়ে শান্তি’র ঘুম চাই।
ফারদিন আকুল আবেদনে ফাইজা আর আপত্তি না করে ওর বুকে চুপ’টি করে মাথা রেখে চুপ করে রইলো। মস্তিষ্ক ভুলে যাওয়া প্রশ্ন’টা মনে করিয়ে দিতে’ই ফাইজা ফট করে প্রশ্ন করে বসলো……
–আপনি তখন দুজন কেনো বললেন? কে আছে তিথীর সাথে?
ফারদিন চোখ বন্ধ করেই শান্ত কন্ঠে উওর দিলো…..
–যাকে বেস্ট ফ্রেন্ড ভেবে ভাই এর মতো সম্মানীয় আসন দিয়েছিলাম। সেই বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে আমার সাথে। আমার জানের দিকে হাত বাড়িয়েছে। আমাকে’ই জোর গলায় বলেছে “ও আমার জান’কে ভালোবাসে”।
ফাইজা থম মে’রে আছে। কি বলছে এগুলা? মনে মনে একটাই নাম ভেসে আসলো” নিরব ভাইয়া “। যে মানুষ’টা ফারদিনের অনুপস্থিতিতে আমাকে আগলে রেখেছিলো। সেই, মানুষ’টা কি করে এত’টা খারাপ হবে?
#চলবে