গোধূলি লগ্নে সেই তুমি -অন্তিম পর্ব [প্রথমাংশ]

0
574

#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#অন্তিম_পর্ব [প্রথমাংশ]
ফারদিনের খালি বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে ফাইজা। আর ফারদিন পরম যত্নে ফাইজা’র মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। চারদিকে ভোরের আলো ফুটেছে ফাইজা এখন গভীর ঘুমে ব্যস্ত। ফারদিনের আজকে রাত’টা স্মৃতির পাতায় থাকবে সারাজীবন। খোলা জানালা’র পর্দা ভেদ করে বাতাস হুরহুর করে ঢুকছে রুমে। রুমের এসি’টাও বাড়ানো। তাই ফাইজা শীতে বার বার হাত পা এক জায়গায় একত্রে করে কেঁপে উঠছে। ফারদিন তা খেয়াল করলেও নড়লো না। বিছানার চাদর’টা একদিক’ থেকে টেনে গায়ে জড়িয়ে দিলো ফাইজা’র। ফারদিন সারারাত ও ঘুমায়’নি। এখন চোখ জ্বালা পো’ড়া করছে। তাই ফাইজা’কে নিজের সাথে শক্ত করে আকড়ে ধরে চোখ বুঝে নিলো।
____________________________________________
কাল আরজা ঘরে ঢুঁকেই জেহের’কে পাত্তা না দিয়ে সুয়ে পড়েছিলো। জেহের পাশে ঘুমাতে যাওয়ার জন্য খাটে উঠতে’ই আরজা এক ধা’ক্কায় জেহের’কে নিচে ফেলে দিয়েছে। জেহের বেচারা ব্যাথায় “আহ” করে শব্দ করে উঠতে’ই ফাইজা ভিলেন মার্কা হাসি দিয়ে বলে উঠলো……
–এতদিন আমাকে কষ্ট দিয়ে আজ এসেছেন ভালোবাসা দেখাতে।
জেহের নিজেকে সামলে কোনোমতে বলে উঠলো….
–নিজের বউ’কে ভালোবাসা দেখাব নাতো কি অন্য কে দেখাব?
এইবার আরজা ভেংচি কে’টে দাতে দাত চেপে বলে উঠলো….
–হ্যাঁ তো আপনার ওই প্রিয়াঙ্কা আছে না। তাকে গিয়ে বলুন। একদম আমার ধারে কাছে আসার চেষ্টা করলে আপনার কোমরের সব গুলা হাড্ডি আমি ভেঙে গুড়িয়ে দিব। মাইন্ড ইট……
বলে খাটে সুয়ে পড়লো। তারপর বিছানা থেকে একটা বালিশ জেহেরের মুখে ছুড়ে ফেলে বললো…
–খবর দার এই মেঝে থেকে এক পা নড়বেন না। সোফায় ও না। ওকে বাই গুড নাইট….
বলে ভেংচি কেটে সুয়ে পড়লো। জেহেরের অবস্থা তখন ছিলো “ছলছল নয়নে হাসি মাখা বদনে”। আর কি করার নিরুপায় হয়ে নিচে’ই সুয়ে পড়লো। সারারাত এপাশ-ওপাশ করতে করতে কখন চোখ লেগে গেছিলো নিজেও জানেনা। ভোরের দিকে আড়মোড়া হওয়ার জন্য নড়তে গিয়ে বুকের মধ্যে ভারী কিছু অনুভব করলো। ঘুম ঘুম চোখে চোখ মেলেও বুঝে নিলো। আবারো চোখ খুলতে বুকের উপর আরজা’কে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে ওর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। দুইহাতে চোখ কচলে আবার তাঁকালো না ও তো ভুল দেখছেনা। আরজা’কে নিজের বুকে দেখে রাতের সব বিষাদ নিমিশেই কে’টে গেলো। শক্ত করে দুই হাতে আকড়ে ধরলো আরজা’কে। ওর কপালে যত্ন সহকারে ঠোঁট ছোঁয়ালো। জেহের একটু নড়তে’ই আরজা ঘুম ঘুম কন্ঠে বললো…..
–একদম নড়বেন না। এটা আমার শান্তির জায়গা। তাই নড়াচড়া করে আমার শান্তির জায়গা’টা নষ্ট করবেন না…..
আরজা’র ঘুম কাতুরে কন্ঠ এক মাধুরতা ছুঁয়ে গেলো জেহেরের মনে। তাই আরজা’কে রাগানোর জন্য বললো….
–এখন আমার বুকে ঘুমাতে লজ্জা করছেনা। কাল রাতে আমার বিছানা থেকে আমাকে ফেলে দিছো। তখন কই ছিলো এত দরদ….
আরজা তৎক্ষনাৎ চোখ মেলে তাঁকালো। থুতনি জেহেরের বুকে ঠেঁকিয়ে পিটপিট করে তাঁকালো ওর মুখ পানে। আড়মোড়া হয়ে উওর দিলো….
–আহ ম’রন দশা। আমিও তোমার সাথে নিচেই ঘুমিয়ে ছিলাম। নিজেতো গভীর ঘুমে মগ্ন ছিলেন। কই ভেবেছিলাম আমার জামাই আমাকে চু’মু টু’মু দিয়ে রাগ ভাঙাবে। তা না করে সে ঘুম….
জেহের আরজা’র দিকে চু’মু খাওয়ার জন্য যেতে’ই আরজা উঠে গেলো ওর বুক থেকে। জেহেরের পাশে বসে নাক ছিটকে উওর দিলো…..
–ইয়াক আপনার মুখে গন্ধ। গন্ধওয়ালা মুখ নিয়ে একদম চুমু খাবেন না…..
কথা’টা শুনেই জেহেরের চোখ রসগোল্লার মতো বড় হয়ে গেলো। লাফিয়ে উঠে বসতেই কোমরে তীব্র ব্যাথা অনুভব করে। কোমর ধরে জোরে’ই “আহ” করে উঠলো। আরজা জেহের’কে রাগানোর জন্য মজা করে গন্ধের কথা’টা বলেছে। এখন জেহের’কে ব্যাথায় কুকিয়ে উঠতে দেখে চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লো। ছটফটে কন্ঠে জেহেরের দিকে এগিয়ে বললো…..
–কোথায় লেগেছে? কি হলো হঠাৎ করে? ব্যাথা পেয়েছেন?
আরজা’র চিন্তিত স্বর শুনে জেহের খানিকক্ষণ হাসলো। তারপর হাত বাড়িয়ে আরজা’র হাত টেনে আরজা’কে নিজের বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললো….
–কিছু হয়নি। আমার বউ আমার কাছে থাকলে আমার কিছু হতে’ই পারেনা। বুঝলে বাচ্চা….
বাচ্চা শব্দ’টা শুনে আরজা রাগান্বিত হয়ে বললো…..
–একদম বাচ্চা বাচ্চা করবেন না। আমি এখন জেহেরের বউ। বুঝতে পেরেছেন তাই আমি ইয়া বড়….
আরজা’র বাচ্চা বাচ্চা কথা শুনে জেহের শব্দ করে হাসলো। তারপর দুজন দুজন’কে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষন চুপ থাকলো। সারারাত নিচে ঘুমিয়ে বেচারা জেহেরের কোমরে ব্যাথা হয়ে গেছে তাই নড়তে চড়তে কষ্ট হচ্ছে তাও নিজেকে সামলে রেখেছে। কিছুক্ষন নিরব থেকে আরজা শান্ত কন্ঠে বললো…..
–আপনাকে না জানিয়ে আমি একটা বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আই হোপ আপনিও আমার সিদ্ধান্তের অ’মত করবেন না।
আরজা’র এমন কথা শুনে জেহেরের কপালে কয়েক’টা ভাঁজ পড়লো। অবাক স্বরে বললো….
–কি এমন সিদ্ধান্ত শুনি?
জেহেরের কথায় আরজা কয়েক’টা ঢোঁক গিললো। বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলো। জেহের’কে ছেড়ে উঠে দাড়ালো। জেহের ও কোমর ধরে উঠে দাড়ালো। আরজা শান্ত কন্ঠে বলতে লাগলো…..
–দেখুন আমি জানিনা আমার সিদ্ধান্ত’টা আপনার পছন্দ হবে কিনা। আপনার পছন্দ না হলেও আমি এই সিদ্ধান্ত থেকে এক পা নড়ব না। কাছের মানুষের জন্য যদি এইটুকু স্যাক্রিফাইস না করতে পারি তাহলে আমি কেমন বেস্টু হলাম বলেন?
বেস্টু শব্দ’টা শুনে জেহের বুঝতে পারলো আরজা ফাইজা’কে নিয়ে কিছু বলবে। কিন্তু কি এমন সিদ্ধান্ত নিলো যা জেহেরের পছন্দ হবেনা। তাই জেহের অধৈর্য কন্ঠে বললো…..
–যা বলার বুঝিয়ে বলো আরজা। আমি বুঝতে পারছিনা….
আরজা জেহেরের হাত’টা দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে জেহেরের দিকে শান্ত শীতল চাহনী দিয়ে বলতে লাগলো…..
–ফাইজু কোনোদিন মা হতে পারবে না। এই ভয়ংকর যন্ত্রনা, কষ্ট ও’কে ভেতরে ভেতরে শেষ করে দিচ্ছে। ওর মুখের দিকে তাঁকালে আমার সমস্ত সুখ বিষাদে পরিনত হয়। এগারো বছর ধরে ও’কে আমি নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড না নিজের বোনের মতো ভাবি। আর বোন’কে কষ্টে রেখে আমি কি করে সুখে থাকব বলেন? ওর চোখের সামনে যখন আমি মা হবো তখন ওর কত’টা কষ্ট হবে বুঝতে পারছেন? ও ভেতরে ভেতরে গুমড়ে ম’রে যাবে। আমি এটা কিছুতেই সহ্য করতে পারব না। তাই আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অনেক ভেবে নিয়েছি। তাই আমার সিদ্ধান্ত’টা শোনার পর আপনি আমাকে কিছু বুঝাতে আসবেন না দয়া করে…..
আরজা’র কথা শুনে জেহের বিস্ময়ের চরম পর্যায়। কোনো মানুষ নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডের জন্য এত’টা ভাবতে পারব। তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতো না জেহের। কিন্তু কি সিদ্ধান্ত নিয়েছে আরজা। ভয়ে ভেতর’টা কুঁকিয়ে উঠলো জেহেরের। অশান্ত কন্ঠে বললো….
–আমার টেনশন হচ্ছে? কোন সিদ্ধান্তের কথা বলছো তুমি?
আরজা এইবার একটা আরো একটা নিশ্বাস ছাড়লো। তারপর মুখে হাসি টেনে বললো….
–আমাদের প্রথম বাচ্চা’টা আমি ফাইজা’কে দিয়ে দিব। কিন্তু ফাইজা জানবে না ওটা আমাদের সন্তান। হসপিটালে যেদিন আমি বাচ্চা জন্ম দিব। সেদিন আপনি আগে থেকে অন্য একটা সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চা দত্তক নিবেন যে করে হোক। এটা আমার অনুরোধ। সেই দত্তক নেওয়া বাচ্চা’টা হবে আমার বাচ্চা আর আমার সন্তান’কে আমি তুলে দিব ফাইজুর হাতে। অবশ্যই নিজের বাচ্চা’র পরিচয়ে তুলে দিব না ও’কে বলবো এই বাচ্চা’টা আমরা ওর জন্য দত্তক নিয়েছি। তারপর আর কোনোদিন আমি মা হবো না। গর্ভধারণ করব না। চিরকালের জন্য মা হওয়া থেকে বঞ্চিত করব নিজেকে…..
সব শুনে জেহেরের মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো। জোরে চেচিয়ে বলে উঠলো….
–মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার। কি আবোল তাবোল বলছো এইসব৷ আমাদের প্রথম সন্তান’কে তুমি অন্য একজনের হাতে তুলে দিবে আরজা। কি করে এই কথা বলছো বুক কাঁপছে না তোমার…..
জেহেরের কথা শুনে আরজা শান্ত কন্ঠেই জবাব দিলো….
–নাহ বুক কাঁপছে না। কারন আমি আমার সন্তান’কে ফেলে দিচ্ছিনা বা মে’রে ফেলছিনা। আমি আমার সন্তান’কে ওর মায়ের হাতে তুলে দিব। আপনি আমাদের কথা আগে ভাবছেন কেনো? আপনি ফাইজু’র কষ্ট’টা দেখতে পারছেন না…..
আরজা’র কথা শুনে জেহের নিজের রাগ কন্ট্রোল করলো। আরজা’র দুই কাঁধে হাত রেখে শান্ত কন্ঠে বললো…..
–আমি আমার নিজের জীবনের চাইতেও ফাইজা’কে বেশি ভালোবাসি। ইভেন তোমার থেকেও বেশি ভালোবাসি আমার বোন’কে। কিন্তু, নিজের বোনের জন্য আমি স্বার্থপরের মতো তোমার প্রথম মা হওয়ার সুখ কেড়ে নিতে পারিনা। এমন একটা সিদ্ধান্ত তুমি কি করে নিয়েছো?
জেহেরের কথা শুনে আরজা মলিন হাসলো। তারপর জেহেরের দুই গালে হাত রেখে বলতে লাগলো…..
–আমার আপনি আছেন তো। আর কে বললো আমার মা হওয়ার সুখ কেড়ে নিবেন। আমি মা হবো আর এটাই আমার মাতৃত্বের সুখ। জেহের প্লিজ আপনি না করবেন না। যদি আপনি না করেন তাহলে আমাকে আপনার বিরুদ্ধে যেতে হবে যা আমি করতে চাইনা। প্লিজ না করবেন না। আমার প্রথম ও শেষ আবদার আপনার কাছে এটা….
জেহের টলমলে চোখে আহত কন্ঠে বললো…..
–কিন্তু, আমি এমন একটা অন্যায় আবদার আমি মেনে নিতে পারছিনা আরজা। আমরা যে বাচ্চা’টা দত্তক নিব সেটা ফাইজুকে দিয়ে দিব। কিন্তু আমাদের প্রথম সন্তান’কে কি করে…..
আরজা জেহেরে মুখ চে’পে ধরলো। জেহের’কে আকুতির স্বরে বললো….
–কেনো আপনি বুঝি দত্তক নেওয়া বাচ্চা’টাকে নিজের বাচ্চা বলে মানতে পারবেন না। ভালোবাসতে পারবেন না….
জেহের পূর্নরায় আহত কন্ঠে বললো….
–আরজা কি বলছো? বাচ্চা’রা হলো নিষ্পাপ। ওদের ভালো না বেসে কি করে থাকব। কিন্তু তাও আমার মন সাঁয় দিচ্ছে না….
আরজা জেহেরের উওরে খুশি হয়ে বললো….
–ব্যস আর কিছু চাইনা আমি। আমরা আমাদের বাচ্চা’কে খুব সুন্দর করে বড় করবো। আমাদের সুন্দর ফুটফুটে একটা মেয়ে বাচ্চা থাকবে তাকে আমরা রাজকন্যার মতো করে মাথায় তুলে রাখব….
জেহের আর উওর দেওয়ার ভাষা খুঁজে পেলো না। চোখের পানি গড়িয়ে পড়লো ওর। শক্ত করে আরজা’কে বুকে চে’পে ধরলো। এমন সিদ্ধান্ত আদৌ কেউ নিতে পারে জানা ছিলো না ওর? নিজেকে এই মুহূর্তে পৃথিবীর সেরা ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। এমন একটা জীবন সঙ্গী কয় জনের কপালে জুটে…..
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here