#পর্ব_১৯(রহস্য উদঘাটন১)
#প্রহর_শেষে_আলোয়_রাঙা
লেখিকাঃ #নুুরুন্নাহার_তিথী
বিকেলে সব মেডিকেল টেস্ট করিয়ে আনা হয়। এই পর্যন্ত প্রহর বেশ কয়েকবার আরমান শেখের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু ফলাফল শূণ্য। তিনি শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েই থাকেন। খিদে পেলে আকারে ইঙ্গিতে বুঝান। প্রহরের সন্দেহ হয় কিন্তু নিজের মনের সন্দেহকে সে পাত্তা দিতে চাচ্ছে না। মেডিকেল টেস্ট করার সময় ডাক্তারকে প্রহর এগুলোও বলেছে। এমআরআই, সিটিস্ক্যান সহ আরও অনেক টেস্ট করায়। প্রহর অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে কি হয়েছে জানার জন্য। সুদীপ্ত প্রহরের অস্থীরতা দেখে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রেখে বলে,
“এতো চিন্তিত হয়ো না। সব ঠিক হবে। চলো সামনে ওই চায়ের দোকান থেকে তান্দুরী মালাই চা খেয়ে আসি। নেপালের এই আবহাওয়াতে চা তো মাস্ট। দেখবে মন একেবারে চনমনে হয়ে যাবে।”
প্রহর মুচকি হেসে সুদীপ্তের সাথে চলতে থাকে। চায়ের দোকানে গিয়ে চা অর্ডার করে ওরা বেঞ্চে বসে। প্রহর জিজ্ঞেসা করে,
“আপনার পরিবার কোথায় থাকে? দেখেছেন? আমি এতো সময়ে আপনার সম্পর্কে প্রফেশনালি ছাড়া কিছুই জানিনা।”
সুদীপ্ত হেসে বলে,
“আমার পরিবার এখন কাশ্মীরে থাকে। কলকাতায় ভিটেমাটি আছে সেখানে জেঠুরা থাকে। বাবা চাকুরীসূত্রে কাশ্মীরে চলে এসেছিল। আমার মা আবার নেপালি। তাই নেপালেই বেড়ে উঠা। মা নেপালি হলেও বাবার সাহচর্যে বাংলা ভাষা আয়ত্ত করে ফেলেছেন অনেক আগেই সেইসাথে আমিও। কলকাতায় জন্ম হলেও বাবা কাশ্মীরে চলে যাওয়ার পর মা নেপালে এসেই বেশি থাকার দরুণ আমার নেপালের প্রতি ঝোঁকটা বেশি তৈরি হয়েছে। বাবা চায়নি আমাদের তখন কাশ্মীরে নিতে। তখনকার অবস্থা তো জানোই। শেষে বিয়েও করলাম এক ভারতীয় নেপালে বসবাস করা মেয়েকে। আমার ওয়াইফের মা কলকাতার আর বাবা নেপালি।”
ততক্ষণে চা চলে এসেছে। প্রহর মাটির তৈরি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চুমুক দেয় অতঃপর বলে,
“বাহ! দারুণ তো। আপনাদের দুজনের মিলটা বেশ। একজনের মা ভারতীয় বাঙালি তো আরেকজনের বাবা। তা ভাবীকে নিয়ে এখানে কোয়াটারে থাকেন?”
“নাহ। আমার ওয়াইফের বাবার বাড়ি আবার এখানেই। আমিই বলতে পারো ঘরজামাই! কোনো জরুরী কাজ থাকলে বরাদ্দকৃত কোয়াটারে থাকি। ছুটিতে কাশ্মীর ও কলকাতায় ঘুরে আসি।”
প্রহর বলে,
“দুই দেশেই নাগরিক আপনারা। এতে সুবিধাও আছে।”
“হ্যাঁ তা ঠিক। তুমি কি আগামীকালই ফিরে যাবে?”
“হ্যাঁ। স্যারের যাওয়ার ব্যাবস্থা আজকে হলে কালকেই চলে যাব। আপনি তো জানেনই আমার স্ত্রী কো*মাতে। শ*ত্রুপক্ষের টার্গেটেড ও। তাই ইচ্ছাকৃত দেরি করব না।”
“কালকে থেকে গেলে তোমাকে ইনবাইট করতাম আমার শ্বশুরবাড়িতে দুপুরে কিছু খেতে। শ্বশুরবাড়ি থাকি বলে শ্বশুরবাড়িই বললাম। কিছু মনে করো না। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি অনেক মিশুক ও ভালো মনের মানুষ।”
“আরে না না। কিছু মনে করব কেনো? কাছের লোকদের সাথে থাকাও আনন্দের।”
“তুমি আজ রাতে আমার কোয়াটারেই থাকো। আরমান স্যারকেও আমার কোয়াটারে নিয়ে যাই। পারমিশন নিতে ঝামেলা হবে না।”
প্রহর কৃতঙ্গতা স্বরূপ বলে,
“তার দরকার নেই। এখানেই ভালো আছি। শুধু শুধু কষ্ট করবেন।”
“কোনো কষ্ট না। আমি পারমিশন নিচ্ছি। তুমি আর ডঃ আরমান শেখ আজকের রাতটা আমার কোয়াটারেই থাকবে।”
সুদীপ্তের জোড়ালো আবদারে না করতে পারল না প্রহর। পারমিশন নিয়ে আরমান শেখকে নিয়ে সুদীপ্তের কোয়াটারে যায়।
_____________
সকালে কিয়া ও রেদওয়ান এসে হাজির প্রহরের বাড়িতে। দারওয়ান ওদের নাম বললে শিতল আপত্তি করেনা কারণ দুজনেই পরিচিত। কিয়া তো বান্ধুবী আর রেদওয়ান একদিকে সিনিয়র ভাই আরেকদিকে বান্ধুবীর হাসবেন্ড। শিতল ওদের বসতে দিয়ে নাস্তা আনতে যাওয়ার আগে রম্যস্বরে রেদওয়ানকে বলে,
“আপনার তবে সময় হলো কিয়াকে নিয়ে আসার! এতে ব্যাস্ত থাকেন যে দুই-দুইবার আমাদের গেট-টুগেদারেও আসলেন না।”
রেদওয়ান হেসে বলে,
“কী করব বলো? ব্যাবসার কাজে সত্যি ব্যাস্ত থাকি। চট্টগ্রামেই থাকা হয় বেশি। এরজন্য তোমার বান্ধুবীর অভিমানও সহ্য করতে হয়।”
কিয়া চোখ ছোটো করে তাকিয়ে বলে,
“তাই না? তুমি এতো কাজ করো যে সময়ই থাকেনা তোমার আমার জন্য।”
শিতল ওদের দুজনের কথা শুনেই হেসে বলে,
“আচ্ছা সেসব তোমরা নিজেরা নিজেরা বুঝে নিও। বসো আমি চা-নাস্তা আনি।”
রেদওয়ান উদগ্রীব কণ্ঠে বলে,
“আলোর কি অবস্থা এখন?”
“কোমাতে ভাইয়া।”
শিতলের মলিন কণ্ঠে রেদওয়ান উৎকন্ঠিত হয়ে বলে,
“কিয়া এটা জানতে পেরেই আমাকে জানিয়েছে। আমিও দুইদিনের মধ্যে কাজ গুছিয়ে ছুটে এসেছি।”
কিয়া বলে,
“আমাকে আলোর কাছে নিয়ে চল। আর প্রহর কই?”
শিতল আমতা আমতা করে ভাবছে কি জবাব দিবে প্রহর কই প্রশ্নের।
“ওর ইদানীং কাজের অনেক প্রেশার তো। বুঝিসই তো। আলোর অবস্থার জন্য কাজে একটু গড়িমসি হয়েছে তাই এখন সেগুলো পুষিয়ে নিচ্ছে।”
“ওহ আচ্ছা। চল আমিও তোর সাথে যাই।”
“চল।”
কিয়াকে নিয়ে শিতল রান্নাঘরে চলে গেলে রেদওয়ান আশেপাশে ভালো করে লক্ষ্য করে দেখে কেউ নেই। রঞ্জনা খালাও রান্নাঘরে। এই সুযোগে সে আলোর কাছে পৌঁছে যায়। দরজা থেকে আলোকে নিথর হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে মনে মনে পৈ*শাচিক হাসে অতঃপর খুব সাবধানে দরজা ভীড়িয়ে আলোর সামনে যায়। রম্যস্বরে আফসোস করে বলে,
“ইশ! বেচারি আলো! কি সুন্দর করে ঘুমিয়ে আছে। ডঃ আরমান শেখের ওয়ারিশ আলো শেখ। স্যার যার কাছে তার ক*লিজার টু*করোকে রেখে গেছেন সেই প্রহরও পারলো না তোমাকে রক্ষা করতে। বড্ড আফসোস হয় জানো? স্যারের প্রিয় ছাত্র আমাকেই যদি তোমার দায়িত্ব দিতো তবে আজ এই অবস্থায় তুমি কাস্মিনকালেও থাকতে না। কিয়ার মতো তোমায় রানী করে রাখতাম। থাক সেসব যাক। তোমার তো কৈ মাছে প্রাণ! অতো বি*ষাক্ত বি*ষেও মরলে না। একদম তোমার বাবার মতো হয়েছ যে। ব্যাটা ম*র*বে তবু মুখ খুলবে না। এতোকিছু করলাম তাও না। যাক ব্যাপার না। আমার টার্গেট এখন শুধু ওই ভা*ইরা*সটা না। পুরোনো হিসেব বাকি আছে তো। পাই টু পাই হিসেব হবে। এই প্রহর সবসময় আমার সবকিছু কেড়ে নেয়। প্রহর আসার পর থেকে আমি হয়ে গেলাম স্টুডেন্টদের মধ্যে স্যারের সেকেন্ড প্রায়োরিটি। প্রহরের কারণে আমি অনেককিছু মিস করেছি। প্রহর ভেবেছে কী! স্যারকে উদ্ধার করে আমার নাগাল পাবে? স্যারের যা অবস্থা তাতে জানতেও পারবে না। তবে আজকে তোমার কাহিনী খ*তম করতে আমি হাজির মিসেস প্রহর শেহমাত!”
হাতে গ্লাভস পরে আলোর গলা চে*পে ধরেছে সবে তারইমধ্যে পিকু উচ্চস্বরে ঘে*উঘে*উ করে উঠল। রেদওয়ান খাটের অপরপাশে ফ্লোরে ম্যাটের উপর চুপটি করে ঘুমিয়ে থাকা পিকুকে খেয়াল করেনি। হঠাৎ পিকুর জোড়ালো ডাকে থতমত খেয়ে জলদি করে গ্লাভস খুলে উঠে দাঁড়ায়। পিকুর ডাকে রঞ্জনা খালা, শিতল, কিয়া ও রিও দৌঁড়ে আসে। শিতল সবার আগে দৌঁড়ে এসে ঠাস করে দরজা খুলে আলোর বিছানার পাশে মনিটরের কাছে রেদওয়ানকে অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। হঠাৎ সবকিছুতে ঘাবড়ে গিয়ে বলে,
“কী হয়েছে? ভাইয়া আপনি ওখানে দাঁড়ানো কেনো? পিকু চিৎকার করল কেনো?”
রেদওয়ান থতমত খেয়ে বলে,
“বুঝতে পারছি না। ওই কু*কু-রটা মানে পিকুর কাছে তো আমি অপিরিচিত। তাই হয়তো আমাকে আসতে দেখে চিৎকার করে ডেকে উঠেছে। আমি তো আলোকে দেখতে এসেছিলাম। স্যার তো চার বছর যাবত নিঃখোঁজ। এখন আবার স্যারের মেয়ে কোমাতে। তুমি তো জানোই আমি স্যারের প্রিয় ছাত্র। স্যারও আমার বাবার মতো। তাই আরকি..!”
শিতল স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“ওহ আচ্ছা। আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
“তোমরা সবাই রান্নাঘরে চলে গেছিলে তাই ভাবলাম বাড়িটা ঘুরে দেখি। আলোকে দেখতে পেয়ে এখানে চলে এসেছিলাম।”
কিয়া বলে,
“আচ্ছা এখন আসো। পিকু তোমায় চিনেনা তনই এমন করেছে।
শিতলও বলে,
“চলেন ভাইয়া। নাস্তা রেডি। আলো সবকিছু ফ্রোজেন করেই রেখে দিতো তাই সময় লাগেনি।”
ওরা চারজনে আলোর ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। রেদওয়ান সবার পরে বের হয় আর বেরোনোর আগে আলোর দিকে তীক্ষ্ম নজর ফেলে যায়।
চলবে ইনশাআল্লাহ,