বিবর্ণ-১ম পর্ব

0
1715

ঘরে ঢুকতেই মা বলে উঠলো কিরে তুই একা কেন? জামাই কোথায়?

মাকে জড়িয়ে ধরে ওরা আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমার আর হয়তো সংসার করা হবে না।

মা কথাটা শোনার সাথে সাথেই একটা ধাক্কা দিয়ে আমাকে দূরে সরিয়ে দিলো। আমি ভীষণ অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকালাম।

মা: রত্না মেয়েদের মানিয়ে চলতে হয়। নিশ্চই তুই কোন অপরাধ করেছিস তার জন্য তোকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আর ওরা তাড়িয়ে দিলেই তোকে চলে আসতে হবে?

আমি কি করবো মা? আমিতো শুধু একটাই অন্যায় করেছি তা হলো নারী হয়ে জন্ম নিয়েছি। তাইতো অপরাধ না করেও অপরাধী হতে হচ্ছে।

মা আর কোন রকম কথা না বলে রুমের ভিতর চলে গেলো। আমি তাকিয়ে মায়ের চলে যাওয়া দেখছি। বিয়ের পর কি তবে সত্যি সত্যিই মেয়েরা বাবা মায়ের পর হয়ে যায়?

সন্ধ্যায় বাবা বাসায় ফিরে আমাকে দেখতে পেয়ে মনে হয় ভীষণ অবাক হলো। সব কিছু শোনার পর বাবাও মায়ের মত আমার দোষ দিতে লাগলো। বাবার রাজকন্যা নাকি ছিলাম আমি। সেই বাবাও আমার বিন্দু পরিমাণ সাপোর্ট নিলো না। বরং আমাকে অপরাধীর কাঠ গড়ায় দাঁড় করিয়ে মুখের উপর বলে দিলো। তোমার জন্য আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশীদের সামনে মান ইজ্জত সব যাবে।

আমি জানি না আমার অপরাধ কি। কোন অপরাধ ছাড়াই বিয়ের দুই বছরের মাথায় শ্বশুড় বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে আমাকে। বাবা মা পছন্দ করেই আমার বিয়ে দিয়েছিলেন। বিয়ের পর থেকেই নানান রকম অত্যাচার হতে থাকে আমার উপর। কখনো কোন প্রতিবাদ করিনি কিংবা বাবা মাকেও জানাইনি। সব কিছু মেনে নিয়েই সংসার করার চেষ্টা করেছি। অনেক অনুরোধ করেছি, হাতে পায়ে ধরেছি শুধু একটু থাকতে দেবার জন্য। কিন্তু তারা আমাকে থাকার জন্য একটু জায়গা দিলো না। বরং কুকুরের মত তাড়িয়ে দিলো।

মা বাবা এমন কি আমার ছোট ভাইটাও আমাকে কেন জানি আর আগের মত করে দেখতে পাচ্ছে না। যে ছোট ভাই আপু আপু করে জান দিয়ে দিতো। সেই ছোট ভাইও একবারের জন্য আমাকে কাছে এসে শান্তনা দিলো না। বরং মনে হচ্ছে আমার আসাতে ওর খুব অসুবিদাই হয়ে গিয়েছে।

ঘর থেকে বের হতে ইচ্ছে করে না। আশেপাশের বাড়ির মহিলারা নানান রকম কথা বলে। তাদের মতে সব দোষ আমার। নিশ্চই আমার কারো সাথে অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে আর তা আমার শ্বশুড় বাড়ির লোকজন জানতে পেরে আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। নয়তো আমার মত সুন্দরি মেয়েকে কেন স্বামী বাড়িতে রাখবে না। তাদের এসব কথা শুনলে মনে হতো আমি নষ্ট গলিতে জন্ম হওয়া কোন নারী। অথচ এদের সামনেই আমি বড় হয়েছি। কত গল্প করেছি এক সময় এদের সাথে। তখন সবাই হাসি মুখে বলতো রত্নার মত মেয়ে পুরো এলাকাতে একটাও নেই। অথচ আজ আমার কষ্টের সময় তারা আমাকে সাপোর্ট না করে। কোন কিছু না জেনে না শুনে সব দোষ আমার উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। আমার চরিত্রে কলংকের দাগ লাগিয়ে দিচ্ছে। কি অদ্ভুত হয় মানুষ, আর এখন দেখছি নারীরাই নারীর আসল শত্রু, এ সমাজে।

দেখতে দেখতে প্রায় পনের দিন হয়ে গেলো শাকিল একটি বারের জন্যও আমার সাথে যোগাযোগ করলো না। আমি তার ফোনের আসাও করিনা। কেননা জানি সে পরনারীতে আসক্ত। তার আমাকে ফোন দেবার সময় কোথায়? সেতো আমাকে তাড়াতে পেরে ভীষণ খুশি বরং তাদের সাথে রাত দিন কথা বলতে পারবে। দেখা করতে পারবে, আমিতো ছিলাম তার গলার কাঁটার মত আটকে কোন রকমে যেহেতু একবার সেখান থেকে বের করতে পেরেছে আর কি আটকাতে দিবে?

আমি নারী তাইতো সবাই আমার দোষ খোঁজে। একবারও কেউ আমার স্বামী বা শ্বশুড় বাড়ির লোকজনদের খোঁজ নেয় না। দু’টো বছর কতটা কষ্ট করে সে বাড়িতে আমি কাটিয়ে এসেছি তা শুধু আমি আর আমার আল্লাহ জানেন। ভেবেছিলাম দুঃখের পর কোন একদিন সুখ পাবো। কিন্তু তা আর হলো কই। শাকিল পুরো প্লান করেই আমাকে বাড়ি থেকে বের করেছে। আমি বেশ বুঝতে পারছি সে বাড়িতে আর কোন দিনও আমার ঢোকা হবে না।

দু’টো বছর একেবারে কম সময় না। এই দুই বছরে আমি শাকিলের মনে জায়গা করতে পারিনি। কেন পারিনি আমি জানি না। আমি যে দেখতে অতোটা অসুন্দর নই এটা জানি। কিন্তু আমার সুন্দর্য্যর চেয়ে অন্য নারী তাকে অনেক বেশী টানে। তাইতো ঘরে সুন্দরি স্ত্রী রেখেও সে দিনে পর দিন বাহিরে কাটিয়ে দেয় তার প্রেমিকাদের সাথে নিয়ে। তার জন্য শ্বশুড় শাশুড়ি দোষ দেয় আমার। প্রথম প্রথম কয়েকবার এসব নিয়ে কথা বলায় শাকিল আমার শরীরে হাত তুলে। একটা সময় পর আর কিছু বলি না। গভীর রাতে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরে নানান ভাবে অত্যাচার করতো। ঘরের স্ত্রী আর অন্যনারীর মাঝে কোন পার্থক্য সে বুঝতো না। আমি শুধু দাতে দাত চেপে সব সহ্য করে যেতাম। যাতে করে ঐ বাড়িতে একটু থেকে যেতে পারি। এতো কিছু সহ্য করার পরেও সব দোষ সব অপরাধ নাকি আমার। তাইতো সব শেষ ঘাড় ধাক্কা দিয়ে আমাকে সে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলো।

ভেবেছিলাম মা, বাবা আর ছোট ভাইটাকে এই বিপদের সময় পাশে পাবো। কিন্তু তা ছিলো আমার ভুল ধারণা। কেননা তারাও এখন আমাকে পর পর ভাবে। আর পাড়া প্রতিবেশীরাতো আমাকে দেখলে কাপড়ের আঁচল দিয়ে মুখ ডাকে। আর মনে মনে ছিঃ ছিঃ করে। দেখতে দেখতে মাস খানিক পার হয়ে গেলো। আমি এখন সব কিছু সবার কটূকথা মেনে নিতে শুরু করেছি। মায়ের সাথে বসে টিভি দেখছিলাম এমন সময় কলিং বেলটা বেজে উঠতেই যেয়ে দরজা খুলতে একটা ছেলে হাতে।কুরিয়ার ধরিয়ে দিলো। ঘরে এসে খুলতেই আমার চোখ কপালে উঠে গেলো। চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পরতে শুরু করলো।

মা: প্রশ্ন করলো কি হয়েছে তোর?

আমি মায়ের দিকে চিঠিটা বাড়িয়ে দিলাম। মা চিঠিটা নিতেই আমি দৌঁড়ে যেয়ে নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে দিলাম। চিঠিটা সাধারণ কোন চিঠি না। ঐটা আমার ডিভোর্স লেটার। আমার চোখের পানি থামছে না। ইচ্ছে করছে নিজের জীবন শেষ করে দিতে। আমি জানি এই সমাজ এতোটা সহজে মেনে নিবে না আমাকে। এই সমাজ ডিভোর্স হলে সব দোষ একটা মেয়ের উপরেই চাপিয়ে দেয়। এতোদিন দূরে হলেও স্বামী ছিলো। আজ থেকে সেও নাই। আজ থেকে আমার নতুন একটা পরিচয় হলো ডিভোর্সি নারী।

মুহুর্তেই যেনো খবর সরিয়ে পরে। এক কান থেকে আরেক কানে। আমি প্রতিবেশীদের চাহনী আর কথা গুলো শুনে পারলে এখুনি আত্মহত্যা করি যদিও জানি আত্মহত্যা মহাপাপ। তাদের কথামতে, আমি স্বামী থাকতেও অন্য পুরুষের সাথে সম্পর্ক করেছি। তাইতো স্বামী আমাকে ডিভোর্স দিয়েছে। নয়তো কেন এতো রূপ সুন্দর্য থাকার পরেও সে আমাকে ডিভোর্স দিবে?

আশেপাশের মানুষের কথা শুনে আর বাহিরে যেতে ইচ্ছে করে না। একদম ঘরেরর ভিতর বন্দী হয়ে পরে রইলাম। কোন কিছুই ভালো লাগে না পান থেকে চুন খসলেই মা মুখের উপর বলে দেয় বাড়ি থেকে বের হয়ে যা। কি এক অদ্ভুত নিয়ম পৃথিবীর আমার মা সেও তো একজন নারী তবে কেন সে বুঝে না একজন নারীর মনের ব্যথা। অন্য মানুষজনের কথায় যতটা না আঘাত লাগে তার চেয়ে বেশী আঘাত লাগে আপন জনের কথায়। এটা কবে বুঝবে তারা। ছোট ভাইটা আমার থেকে দূরে দূরে থাকে বাবাও প্রয়োজন ছাড়া একটা কথাও বলে না। আর ঘর বন্দী হয়ে থাকতে যেয়ে বুঝতে পারছি আত্মহত্যা বার বার আমাকে ডেকে চলছে। আত্মহত্যা মহাপাপ না হলে হয়তো ডিভোর্সি নারীরা কম বেশী সকলেই আত্মহত্যা করতো।

গ্রীষ্মের গরমে ঘরে বসে থাকতে থাকতে অতৃষ্ট হয়ে উঠেছি। কিন্তু ঘর থেকে বের হলেই মানুষজন নানান কথা বলে। বাড়ির বাহিরে যাবার ও সাহস পাইনা। বাবা মা ছোট ভাই কারো সাথেই মন খুলে কথা বলতে পারি না। তারা কেউ আসলে আমার ডিভোর্সে খুশি না। তারা চায়না আমি এ বাড়িতে থাকি। এতো অপমান নিয়ে একটা মুহুর্তও আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না। ব্যালকনিতে এসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখছি কত বড় বড় ট্রাক বাস আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে ছুটে চলছে।

রাত আনুমানিক দুইটার মত বাজে দু’চোখের পাতা এক করতে পারছি না। টপটপ করে দু’চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরছে। ভিতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। না পেরে সবার অজান্তে বাড়ি থেকে নিচে নেমে আসলাম। রাস্তা দিয়ে দ্রুত গতিতে গাড়ি ছুটে চলছে। আমার চোখ দু’টো সেদিকে তাকিয়ে রাস্তার মাঝের দিকে হেঁটে চলছে। সামনে থেকে বেশ বড় বড় গাড়ি ছুটে আসছে আমিও দ্রুত পা বাড়ালাম। সামনে দিয়ে এতটা প্রাইভেট কার শোঁ শোঁ শব্দ করে চলে গেলো। আমি গাড়িটার সামনে যেয়ে দাঁড়াতে পারলাম না। কারণ কেউ একজন আমার হাত টেনে ধরেছে। অপরিচিত কণ্ঠ বলে উঠলো আরে আরে কি করছেন? এরপর দ্রুত আমাকে টেনে রাস্তার সাইডে নিয়ে আসলো।

আমি ছেলেটার দিকে ঘুরে তাকালাম। তাকে আমি চিনি না। অথচ এই মুহুর্তে তাকেই আমার খুব আপন মনে হচ্ছে। আমি তার সামনেই হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলাম।

অপরিচিত ছেলেটা বলে উঠলো কাঁদতে পারেন যত সময় মনে চায় কাঁদতে থাকুন মন হালকা হবে। তবে আত্মহত্যা কোন সমস্যার সমাধান নয়। আমি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললাম আমার অনেক সমস্যা যার কোন সমাধান নেই।

ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো। আল্লাহ পৃথিবীতে সকল সমস্যার সমাধানের ব্যবস্থা করে রেখেছে। আপনি বাসায় যেয়ে অযু করে জায়নামাজে বসে নামাজ পড়ে আল্লাহকে ডাকুন দেখবেন সব কিছুর সমাধান হয়ে যাবে।

আমি মুগ্ধ হয়ে ছেলেটার কথা শুনলাম। কোন উত্তর না দিয়ে হেঁটে বাড়ির ভিতর ঢুকে পরলাম। আস্তে আস্তে হেঁটে নিজের রুমের ভিতর ঢুকে পরলাম।

#চলবে…

বিবর্ণ-১ম পর্ব
#লেখনীতে_শাহরিয়ার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here