#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্ব-৯
#আর্শিয়া_সেহের
আজ প্রায় এগারো দিন পর আরাফাত আবারও ভার্সিটির গেটে এসে বসেছে। বেলা গড়িয়ে দুপুর বারোটায় এসে ঠেকেছে তখন।
রুমঝুম আর মেঘা গল্প করতে করতে ক্যাম্পাসের পথ ধরে গেটের দিকে এগোচ্ছে। কথা বলতে বলতেই মেঘার দৃষ্টি খেলো গেটের দিকে। আরাফাত ভয়ানক চাহুনি নিক্ষেপ করে আছে তাদের দিকে।
মেঘা আরাফাতকে দেখেই দাঁড়িয়ে পড়লো।রুমঝুম মেঘাকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে নিজেও দাঁড়িয়ে পড়লো। মেঘার ভয়ার্ত দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো রুমঝুম। গেটের কাছে আরাফাতকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আঁতকে উঠলো খানিকটা। সামনে এগোবে কি না ভাবছে। তবে না এগিয়েও বা যাবে কোথায়?
-“হেই , দুজন মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
প্রান্তের কন্ঠে পেছনে তাকালো রুমঝুম আর মেঘা। শান বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পেছনে। শানকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো রুমঝুম। শান একটু উঁকি মেরে দেখলো গেটের কাছে বসা আরাফাতকে। শানকে দেখে আরাফাত মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো দ্রুত।
সেদিন আরাফাতকে বেধড়ক মারধর করার পর ওর বাবা শাসিয়েছিলো শান কে। তবে শান সেসবে পাত্তা দেয় নি। তার চন্দ্রকন্যার দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছিলো । এগুলো তো কম হয়েছে ওর জন্য।
শান হালকা হেঁসে বললো,
-“এতো ভয় পেলে পড়াশোনা করার দরকার কি? পড়াশোনা ছেড়ে বাড়িতে বসে থেকো পা গুটিয়ে।”
রুমঝুম মাথা নিচু করে নিলো। আরাফাত ছেলেটাকে সে ভয় পায় না,ঘৃনা করে। এমন ছেলের আশেপাশে যাওয়াটাও রিস্ক।
প্রান্ত হালকা গলা ঝেড়ে বললো,
-“তো বাড়ি যাচ্ছো নাকি দুজন?”
-“জ্বি ভাইয়া।”
মেঘা সাবলীল ভাবে উত্তর দিলো।
-“শান,তুই রুমঝুমকে নিয়ে আয়। আমার কিছু কথা আছে মেঘার সাথে।”
-“আব.. ভাইয়া আমাদের সামনেই বলুন না। আলাদা যাওয়ার কি দরকার?”
-“আহ রুমঝুম,আলাদা দরকার বলেই তো আলাদা যাচ্ছি।”
রুমঝুম মুখটা ছোট করে দাঁড়িয়ে রইলো। প্রান্ত মেঘার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“চলো মেঘা।”
মেঘা এদিক সেদিক তাকিয়ে মেহেদীর উপস্থিতি দেখছিলো। আশেপাশে কোথাও ভাই কে না দেখে তাড়াহুড়ো করে বললেন,
-“চলুন ভাইয়া। তাড়াতাড়ি পা চালান।”
প্রান্ত হেঁসে মেঘার সাথে হাঁটা ধরলো।
-“বাইকে উঠো।”
শানের কথা রুমঝুম শুনেছে কি না সন্দেহ। সে বিন্দুমাত্র নড়লো না। শান বিরক্ত ভঙ্গিতে বললো,
-“কোলে করে তুলতে হবে?”
রুমঝুম চকিতেই মাথা তুলে মৃদু চিৎকারে বললো,
-“নাউজুবিল্লাহ।”
শান আওয়াজ করেই হেঁসে ফেললো।রুমঝুম মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শানের হাঁসিমাখা মুখের দিকে।
-“চোখ দিয়ে গিলে না খেয়ে উঠে বসুন মহারানী।”
রুমঝুম থতমত খেয়ে গেলো। এদিক সেদিক তাকিয়ে ধীর গতিতে উঠে বসলো বাইকে।
-“ধরে বসো।”
রুমঝুম ইতস্তত করে হালকা ভাবে হাত রাখলো শানের কাঁধে। রুমঝুমের হালকা স্পর্শেও প্রশান্তিতে ভরে গেলো শানের বুক। মৃদু হেঁসে বাইক স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেলো ভার্সিটি থেকে। আরাফাত হা করে তাকিয়ে রইলো সেদিকে।
…
দুদিন পর রুমঝুমের জন্মদিন। সেদিনই রুমঝুমকে মনের কথা জানাবে শান। তাদেরকে সব বিষয়ে সাহায্য করছে মেঘা তবে সেটা রুমঝুমের আড়ালে। রুমঝুমকে অনেক বড় সারপ্রাইজ দেওয়ার ইচ্ছা আছে সেদিন।
যে যা নিয়ে ভাবুক না কেন সিন্থিয়া আছে মেহেদীর চিন্তায়। সেদিন মেঘার থেকে ছলে বলে মেহেদীর পছন্দ সম্পর্কে জেনে নিয়েছে। সিন্থিয়াও ভেবে রেখেছে রুমঝুমের জন্মদিনে সে ও মেহেদীকে ভালোবাসার কথা বলবে।
শান ,প্রান্ত,তিহান আর সিন্থিয়া রেস্টুরেন্ট বুকিং দিতে এসেছে। হাতে সময় আছে আর একদিন। সবকিছু ঠিকঠাক করে বের হবে তখনই শানের ফোনে তার বাবার নাম্বার থেকে কল এলো। শান রিসিভ করে সাইডে গিয়ে কথা বলে এলো।
-“আচ্ছা তোরা যা। আমাকে অফিসে যেতে হবে এখন।”
প্রান্ত ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“এখন অফিসে যাবি কেন? কোনো সমস্যা?”
-“আরে না,ইয়ার। বাবা চট্টগ্রামের বাইরে আছে। তাই আমাকে বললো একবার অফিস থেকে ঘুরে আসতে।”
-“আচ্ছা যা। ”
শান ওদেরকে বিদায় দিয়ে অফিসে চলে গেলো।
সিন্থিয়া প্রান্ত আর তিহানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আমার সাথে একটু শপিংমলে চল না রে।”
তিহান ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“এখন শপিংমলে কেন?”
-“একটা আকাশি রঙের শাড়ি কিনবো। চল না প্লিজ।”
তিহান মুখ ভেঙচি দিয়ে বললো,
-“তুই শাড়িও পড়িস নাকি? জানতাম না তো।”
-“তোর জানা লাগবে না। চল।”
প্রান্ত বললো,
-“তোরা দুজনে যা। আমার এসব শপিং ভাল্লাগে না জানিসই তো।”
-“তোর ভাল্লাগতে হবে না। তুই আমার সাথে যাবি এটাই ফাইনাল।”
সিন্থিয়ার জেদের কাছে হার মেনে দুজকেই ওর সাথে শপিং এ যেতে হলো।
…
-“আচ্ছা মা,পরশু তো রুমঝুমের জন্মদিন। সেদিনটা একটু স্পেশাল হওয়া উচিত তাই না?”
মাহেরা খাতুন মেহেদীর কথা শুনে মুচকি হাসলেন। মায়েরা সন্তানকে খুব ভালো করে বুঝতে পারে। মাহেরা খাতুনও বোঝে তার ছেলেটা রুমঝুমকে কতখানি পছন্দ করে। তার নিজেরও রুমঝুমকে খুব পছন্দ।
-“কি হলো মা?”
-“হ্যাঁ হ্যাঁ, উচিত তো। কিন্তু কিভাবে স্পেশাল করা যায় বলতো?”
-“ভাবছি বাড়িতেই ছোট্ট একটা পার্টি করবো। আমাদের চারজনের জন্য শুধু। মেঘাকে বলবো সেদিন রুমঝুমকে বাইরে ঘুরিয়ে বাসায় আনতে আনতে যেন সন্ধ্যা করে ফেলে।বাকিটা আমরা দুজন করে ফেলবো।”
-“পাগল ছেলে। তুই যা ভালো বুঝিস তাই কর।”
মাহেরা খাতুন হাসতে হাসতে বললেন।
-“তোমরা কি নিয়ে কথা বলছো মা?”
মেঘা আপেল খেতে খেতে প্রশ্ন করলো।মাহেরা খাতুন কিছু বলার আগে মেহেদী বললো,
-“তোর ওতো জানতে হবে না। ”
মেঘা গাল ফুলিয়ে বললো,
-“হুহ। যাও বলতে হবে না।”
-“বলবো ও না। শোন ,রুমঝুমকে নিয়ে পরশু একটু দেরি করে বাড়ি ফিরবি। ওকে ছোটখাটো একটা সারপ্রাইজ দেওয়ার চেষ্টা করবো ওইদিন।”
মেঘার খুশিতে চোখ চকচক করে উঠলো। সে তো এটাই চেয়েছিলো। ওইদিন কত্ত কাজ আছে। এমনিতেও তো দেরি হবে সেদিন ফিরতে।
সবকিছু অল্পেতে বুঝে যাওয়া মেঘা ঘুনাক্ষরেও নিজের ভাইয়ের মনের কথা বুঝতে পারলো না। মেঘার ধারনা ,রুমঝুমকে খুশি করার জন্যই তার মা ভাই সারপ্রাইজ প্লান করেছে।
মেঘা নাচতে নাচতে রুমে এসে দেখলো রুমঝুম ফোনে কথা বলছে। মেঘা শয়তানি হাসি দিয়ে এক ভ্রু উচু করে বললো,
-“কার সাথে কথা বলছিস ,হুম?
রুমঝুম কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
-“রুশানের সাথে কথা বলছি ,স্টুপিড।”
মেঘা দাঁত কেলিয়ে বললো,
-“ওহ আচ্ছা। আমি ভাবলাম কে না কে।”
রুমঝুম ড্রেসিং টেবিল থেকে চিরুনি নিয়ে মেঘার দিকে ছুঁড়ে মারলো। মেঘা হাসতে হাসতে দৌড় দিলো সেখান থেকে।
-“আপু?”
রুশানের কন্ঠে আবার ফোনের দিকে খেয়াল এলো রুমঝুমের।
-“হ্যাঁ রুশান ,বল।”
-“এটাই তোমার প্রথম জন্মদিন যেটা আমাকে ছাড়া করবে ,তাই না?”
রুশানের কথায় রুমঝুমের ভীষণ মন খারাপ হলো। রুশানই তো তার একমাত্র সঙ্গী ছিলো এতদিন। আর আজ সেই ছেলেটা ছাড়া কত সঙ্গী হয়েছে তার। রুমঝুম দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
…
-“পরশু রুমঝুমের জন্মদিন,তাই না রুশান?”
হাতে একটা এলবাম নিয়ে রুশানের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে কথাটা জিজ্ঞেস করলো তাহমিনা বেগম।
রুশান রুমঝুমের সাথে কথা শেষ করে খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে ফোন টিপছিলো তখন। তাহমিনা বেগমের প্রশ্নে সে কিছুটা অবাক হলো। তার মা আবার আপুর ব্যাপারে আগ্রহী হলো কবে থেকে?
রুশান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-“হ্যাঁ। কেন বলো তো?”
তাহমিনা বেগম চুপ করে রইলেন। রুশানের বিছানার এক কোনায় বসে ছবির এলবামটা দেখতে শুরু করলেন। হঠাৎ করেই তিনি হুহু করে কেঁদে উঠলেন। রুশান তার মা কে এভাবে কাঁদতে দেখে বেশ অবাক হচ্ছে। রুশান তাহমিনা বেগমের কাছে এসে বসে বললো,
-“কাঁদছো কেন মা? অপরাধবোধে?”
তাহমিনা বেগম ছলছল চোখে ছেলের দিকে তাকালো। রুশান মুচকি হেসে বললো,
-“পাপের শাস্তি তো পেতেই হয় আম্মু। অনেক অপরাধ করেছো যে।”
তাহমিনা বেগম মাথা নিচু করে নিলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
-“আজ তোর সামনে একটা পুরোনো বিভৎস অধ্যায় তুলে ধরতে চাই ,রুশান।”
রুশান মায়ের কন্ঠে কেঁপে উঠলো। এই কথাটায় কি যেন একটা ছিলো যা তাকে নড়িয়ে দিলো। তাহমিনা বেগম এলবামটি বিছানায় রেখে উঠে দাঁড়ালেন। রুশান এলবামটির দিকে তাকালো একনজর। সাথে সাথেই চোখ বড় হয়ে গেলো রুশানের।
তাহমিনা বেগম জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বললেন,
-“ঠিকই ধরেছিস, রুশান। আজ ওর ব্যাপারেই তোকে বলবো আমি। এটা বলতে পারলে হয়তো কিছুটা শান্তি পাবো মনে।”
রুশানের কেন জানি শুনতে ইচ্ছে হলো না। তবুও শুনতে হলো।
রুশান স্তব্ধ হয়ে বসে আছে মেঝেতে। এই নির্মম সত্যিটা তার সামনে কেন এলো? খুব ক্ষতি হতো এটা অগোচরেই থেকে গেলে?
তাহমিনা বেগম জানালার কাছ থেকে এগিয়ে এসে এলবামটা হাতে নিলেন। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন,
-“রুমঝুমকে আমার পক্ষ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে দিস।”
রুশান শুনলো কিন্তু ফিরে তাকালো না তার মায়ের দিকে। ঘৃনা হচ্ছে ওই জঘন্য মহিলার প্রতি ওর।
তাহমিনা বেগম জানতেন এমনটাই হবে। তিনি দরজা থেকেই ছেলের দিকে একবার তাকালেন। তারপর নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন।
ছেলে তাকে যত খুশি ঘৃনা করুক, তবুও আজ তার শান্তি।
…
শপিংমল থেকে বের হতে হতে সাড়ে পাঁচটা বেজে গেলো। তিহান আর সিন্থিয়াকে বিদায় জানিয়ে প্রান্ত তার বাড়ির পথ ধরলো।
ছয়টার সময় একটা টিউশনি আছে তার। মধ্যবিত্ত ছেলেগুলো খুব ভালো করেই জানে জীবনের মানেটা আসলে কি।
শান,তিহান,প্রান্ত,সিন্থিয়া আর বিথীর মধ্যে শান আর সিন্থিয়া উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। সিন্থিয়ার বাবা-মা কানাডা থাকে। তবে সিন্থিয়া বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে রাজি না বলে সে এখানেই ফ্ল্যাট কিনে থাকে।
তিহান উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। প্রান্ত আর বিথী মধ্যবিত্ত পরিবারের। এক একজন এক এক সোসাইটিতে বিলং করার পরও ওদের বন্ধুত্বের বন্ধন অটুট।
প্রান্ত রিকশা করে যাওয়ার সময় রাস্তার একপাশে শিরীনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। এই সময়ে শিরীন কোচিং থেকে ফেরে। আজ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে কেন? গাড়িও তো নেই সাথে।
শিরীনের পেছনে তিনজন ছেলে দাঁড়ানো। অনবরত ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলছে। শিরীনের মুখের অভিব্যক্তিতে প্রান্ত বুঝলো ওরা শিরীনকে ইঙ্গিত করেই কিছু বলছে। প্রান্ত রিকশা থামিয়ে ভাড়া চুকিয়ে এগিয়ে গেলো সেদিকে। গম্ভীর কন্ঠে বললো,
-“এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন , শিরীন? গাড়ি কই তোমার?”
বহু পরিচিত কন্ঠে শিরীনের বুকটা ধক করে উঠলো। তড়িৎ বেগে ঘুরে তাকালো পেছন দিকে।প্রান্তকে দেখে আপনা আপনি মুখ হা হয়ে গেলো তার। কতগুলো দিন পর দেখছে এই প্রিয় মুখটা। তার তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে আজ প্রান্ত তার সামনে এসে দাড়িয়েছে। শিরীন অপলক দৃষ্টিতে দেখছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তার হৃদয়রাজকে।
চলবে………