#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-5+6
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
সকালের সোনালী রোদ্দুর জানালার ফাঁক গলিয়ে ধারার মুখে পড়তেই ধারার ঘুম ভেঙে গেল। ঘন পল্লব বিশিষ্ট চোখজোড়া খুলতেই লাফিয়ে উঠলো। অনেক বেলা হয়ে গেছে! এতক্ষণ কিভাবে ঘুমিয়ে রইলো সে? ঝটপট বিছানা থেকে নেমে মাথার এলোমেলো চুলগুলো হাত খোঁপা করে নিল। ফ্রেশ হয়ে এসে বাইরে বেড়িয়ে দেখলো বাড়িতে কেউ নেই। উঠোনের কোণায় চোখে পড়লো শুদ্ধকে। একটা নাম না জানা গাছের চারা নিয়ে কি যেন করছে সে। শুদ্ধদের বাড়ির সামনেই একটু বা দিকে মাটির রান্নাঘর। রান্নাঘরের সামনেই টিন দিয়ে বেড়া দেওয়া ডিপ কলের গোসলখানা। এর পর থেকে পাশের বাড়িগুলোর সীমানা শুরু। ডান দিকে বড় বড় মেহগনি গাছ দাঁড়িয়ে জঙ্গলের মতো হয়ে আছে। তারপরেই স্বচ্ছ পানির পুকুর। শুদ্ধ সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। ধারা একবার রান্নাঘরের ভেতর উঁকি দিল। শুদ্ধ নিজের কাজে মগ্ন থেকেই বলল, ‘আম্মা গেছে পাশের বাড়ি। চুমকি গেছে স্কুলে। পাবেন না কাউকে এখন।’
ধারা একটু থতমত খেয়ে গেলো। এই লোকটার কি কোনভাবে মানুষের মন পড়ে ফেলার ক্ষমতা আছে? ধারা যখনই যা ভাবে সবটা কিভাবে ঠিকঠাকই বলে দেয়! ধারা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। শুদ্ধ ধারাকে পাশ কাটিয়ে ঘরে চলে গেল। ফিরে এলো একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে। ধারার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এর মধ্যে দুটো থ্রি পিছ আছে। শাড়ি পড়ায় যেহেতু অভ্যস্ত নন পড়তে হবে না।’
ধারা এবারও অবাক হলো। সারাক্ষণ শাড়ি পড়ে থাকতে তার সত্যিই অসুবিধা লাগছিল। বিয়ের আগে তো তেমন পড়া হয়নি। কিন্তু এই কথাটা তো সে কাউকে বলেনি। তাহলে জানলো কি করে?
শুদ্ধ বলে উঠলো, ‘শাড়ি পড়ে যেভাবে হাঁটেন দেখলেই বোঝা যায়। এটা মুখ ফুটে বলতে হয় না।’
ধারা এবার সাংঘাতিক চমকে উঠে ব্যাগটা ধরে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালো। এই লোকটার থেকে সাবধানে থাকতে হবে। এ তো দেখছি সে যা ভাবে সবই ধরে ফেলে। শুদ্ধ চলে যেতে নিয়েও আবার দাঁড়িয়ে ধারাকে বলল, ‘গোসলখানা এদিকে। সাবধানে যাবেন। দেখবেন, আবার অজ্ঞান হয়ে যান না যেন! আপনি তো আবার কথায় কথায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। কুকুর দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন, কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তারপর আবার আমাকে আপনার শাড়ি পাল্টে দিতে হবে আর আপনি জ্ঞান ফিরে আকাশ থেকে টপকে পড়ার মতো এক্সপ্রেশন দিবেন।’
শুদ্ধ চলে যেতে নিল। ধারা ঝট করে ঘুরে শুদ্ধ’র দিকে তাকালো। এই লোকটা এমন কেন? ধারা এখন ভালো মতই জানে সেদিন রাতে শুদ্ধ তার শাড়ি পাল্টায়নি। তবুও এখনও এমন ভাবে বলছে যেন সেই করেছে। ধারা দ্রুত বলে উঠল,
‘আমি জানি আপনি সেদিন আমার শাড়ি পাল্টাননি। চুমকি বলেছে।’
শুদ্ধ দাঁড়িয়ে পড়লো। পেছনে ধারার দিকে ঘুরে ঠোঁটের রেখা প্রসারিত করে মৃদু হাসির ঝলক তুলে বলল,
‘বাহ! আপনাকে কেউ বলল আর আপনি সত্যিই নিজের থেকেই বিশ্বাস করে ফেলেছেন! অবিশ্বাস্য! না মানে এইবার আপনাকে কেউ বলে দেয়নি যে এটা বিশ্বাস যায় কি করা যায় না? একা একাই বিশ্বাস করে ফেললেন? ইমপ্রেসিভ!’
শুদ্ধ চলে গেল। আর সেদিকে তাকিয়ে ধারা সরু চোখে তাকিয়ে রইলো। দু তিন বাক্যের একটা কথাতেও ধারাকে কয়বার ঠান্ডা ভাবে খোঁচা মেরে দিল লোকটা। খোঁচা মারার একটা সুযোগও ছাড়তে চায় না। খোঁচা মারার রাজা যেন! এর নাম শুদ্ধ না রেখে খোঁচারাজ রাখা উচিত ছিল। ধারা বিরবির করে বলে উঠলো, ‘খোঁচারাজ!’
একটু পর ধারা শুদ্ধ’র দেওয়া একটা থ্রি পিছ পরিধেয় করে আরেকটা থ্রি পিছ আর গামছা হাতে নিয়ে বেড়িয়ে এলো। সকালে উঠার পর থেকেই কেমন যেন ভ্যাবসা গরম লাগছে। ভাবলো গোসলটা তাড়াতাড়িই করে নেয়া যাক! কিন্তু গোসলখানার সামনে যেতেই ধারা থমকে দাঁড়িয়ে রইলো। গ্রামের বাড়ির কল। বেড়ার গায়ে দরজায় শুধু একটা কাপড়ের পর্দা ঝুলানো। বাড়ির আশেপাশের মানুষ জন একটু পরপরই এই আসছে আর যাচ্ছে। কেউ খাবার পানি নিতে আসে, কেউ জামা কাপড় ধুতে আসে। ধারার ভীষণ সঙ্কোচ হতে লাগলো৷ গ্রামে হলেও ওদের নিজেদের বাড়িটা পাকা দালানের। ঘরের মধ্যেই পাকা বাথরুম, গোসলখানা। ছোট বেলা থেকেই তাই ব্যবহার করে আসছে সে। এখন হঠাৎ করে এমন খোলা গোসলখানায় গোসল করতে ধারার কেমন যেন লাগছে। গোসল করার সময় যদি কেউ এসে পড়ে! গ্রামের মহিলাদের কাছে এসব তো আবার কোনও ব্যাপারও না। এরা একজনের গোসলের মধ্যে অনায়াসে ঢুকে পড়ে। যদিও মেয়েরা মেয়েরাই। তবুও ধারার তো অভ্যেস নেই এসবের। ও’র ভীষণ অস্বস্তি হয়। শুদ্ধ বাড়ির পাশে ঐ চারাটা লাগিয়ে ক্ষেতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ধারাকে এভাবে কলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হয়তো কিছু বুঝতে পারলো। ক্ষেতে যাওয়া বাদ দিয়ে তাই সে ধারার কাছে এসে বলল,
‘ধারা, কোন সমস্যা?’
হঠাৎ শুদ্ধ’র কণ্ঠ শুনতে পেয়ে ধারা খানিকটা চমকে উঠলো। তাকিয়ে বলল,
‘না। কিছু না।’
শুদ্ধ একবার গোসল খানার দিকে তাকিয়ে কিছু ভেবে বলল, ‘আপনার ওড়নাটা দেখি, দিন তো।’
ধারা ও’র গায়ের ওড়নাটা হাত দিয়ে চেঁপে ধরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, ‘কি?’
ধারা কি ভেবেছে বুঝতে পেরে শুদ্ধও একটু লজ্জাবোধ করে দ্রুত বলল, ‘আরে! আপনার হাতের ওড়নাটার কথা বলেছি। যেটা গোসলের পর পড়বেন। গায়ের ওড়নার কথা বলিনি।’
ধারা ভীষণ লজ্জা পেলো। আনত মুখে হাতের সুতি ওড়না টা শুদ্ধ’র হাতে দিল। ওড়না নিয়ে শুদ্ধ টিনের বেড়ার পর্দা ভালো মতো টেনে দিয়ে তার উপর আবার ওড়না দিয়ে দিলো। পর্দার কোনা টেনে টিনের বেড়ার গায়ে আটকে দিলো যাতে বাতাসে না উড়ে যায়। তারপর ধারাকে বলল,
‘এখন বাইরে থেকে কিছুই দেখা যাবে না। আপনি যান। কেউ আসবে না। আসলে আমি মানা করে দিবো। আপনার গোসল না হওয়া পর্যন্ত আমি বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকবো।’
‘না থাক! আপনি শুধু শুধু কষ্ট করে….!’
ধারাকে থামিয়ে দিয়ে শুদ্ধ আবারও বলল,
‘আপনি যান।’
ধারা আর কিছু বলল না। গোসলখানার ভেতরে গিয়ে হাতের জামা কাপড় টিনের বেড়ার উপরে রেখে দিল। বেড়া ভালোই উঁচু করে দেওয়া। বাইরে থেকে তাকালে শুধু ধারার চোখ দেখা যাবে এমন। মাথার উপর খোলা আকাশ। দিনের আলোতে ভেতরটা একদম ফকফকে উজ্জ্বল। ধারার জন্য এমন পরিবেশ একেবারেই নতুন। ও’র ভীষণ লজ্জা হতে লাগলো। নিজেকে অনাবৃত করে লাজুক মুখে ওঁ একবার বাইরে শুদ্ধ’র দিকে তাকালো। হাতে একটা ডাল নিয়ে আনমনেই লোকটা নিচের দিকে তাকিয়ে মাটিতে আঁকিবুঁকি করছে। তখন থাকতে মানা করলেও শুদ্ধ থেকে যাওয়ায় ধারার কাছে ভালোই লেগেছে। একটু আশ্বস্ত তো হতে পারলো। এরপর অনেকটা সময়ই কেটে যায়। ধারা যখন বসে বসে বালতি থেকে মগ দিয়ে গায়ে পানি ঢালছিল তখন হঠাৎ ও’র কানে আসে কারো পায়ের শব্দ। মনে হচ্ছে যেন গোসল খানার দিকেই এগিয়ে আসছে সে। ধারা খেয়াল করলো অনেকক্ষণ ধরেই শুদ্ধ’র কোন শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। এতক্ষণ তো তবুও গাছের ডালের নাড়াচাড়ার খানিক শব্দ আসছিল। এখন তো ঐ পায়ের শব্দ ছাড়া সবই নিশ্চুপ। শুদ্ধ কি তবে চলে গেল? কে আসছে কে জানে! পায়ের শব্দটা শুনে মনে হচ্ছে অনেকটাই কাছে চলে এসেছে। আতঙ্কে জমে গিয়ে ধারা সিমেন্টের পাকা থেকে ভেজা জামাটাই গায়ে জড়িয়ে ধরলো। ঠিক তখনই ও’র কানে আসে শুদ্ধ’র কণ্ঠ। শুদ্ধ কাউকে বলছে,
‘ভাবী, প্লীজ এখন যাবেন না। ধারা গোসল করছে। একটু পরে আসুন।’
পাশের বাড়ির বড় বউ নাজমা কাঁধ থেকে কলসিটা নামিয়ে রেখে বলল, ‘তাতে কি হইছে ভাই? আমি কি পুরুষ মানুষ নাকি! আমি গেলে কি অসুবিধা? পানিটা যাইয়া নিয়া আসি গা। বেশিক্ষণ লাগবো না।’
কথাটা বলে নাজমা আবারও কলসি নিয়ে এগোতে নিল। শব্দ পেয়ে ধারা জামা পেঁচিয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলল। শুদ্ধ তাড়াতাড়ি নাজমাকে আটকে বলল, ‘না ভাবী। একটু পরে আসুন প্লীজ। ধারা লজ্জা পায়। আসলে ও’র অভ্যেস নেই তো। আপনি না হয় কলসটা রেখে যান। দরকার পড়লে আমি গিয়ে পানি ভরিয়ে আপনাকে দিয়ে আসবো।’
নাজমা ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘ ও…বুঝলাম এখন ভাই, তুমি তাইলে দাঁড়ায় দাঁড়ায় বউরে পাহাড়া দিতাছো। বউরে একলাই একলাই দেখবা। অন্য কাউরে আর দেখতে দিবা না!’
ভেতর থেকে ওদের কথা শুনে ধারা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। শুদ্ধ আর কি বলবে? এখন যে করেই হোক নাজমার গোসলখানায় যাওয়া আটকাতে হবে। অন্য ভাবে কিছু বললে আবার সেটা নিয়ে মাইন্ড করে বসতে পারবে। তাই নাজমার কথাতেই তাল মিলিয়ে মুখের হাসি প্রসারিত করে লাজুক ভাব ধরলো। নাজমা দুষ্টুমির ছলে বলতেই লাগলো,
‘আচ্ছা তাইলে আমি যাই। তোমার আর আমারে কষ্ট কইরা পানি ভইরা দিতে হইবো না। আমি কলস নিয়াই যাই। দেবর গো দিয়া কি আর এতো কাজ করাইতে পারি! তুমি না হয় তোমার বউরেই পাহাড়া দাও।’
নাজমা চলে যাওয়ার পর আরো দু তিন জন মহিলা এলো। সবাইকেই একইভাবে আটকালো শুদ্ধ। শেষমেশ সবাইকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়ে শুদ্ধ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ধারা মৃদু হাসলো। না! মানুষটা কথা দিয়ে কথা রাখে। ধারাকে একা ফেলে যায়নি। একে বিশ্বাস করাই যায়।
চলবে,#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-৬
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
চুমকি সন্ধ্যা থেকেই বই নিয়ে ঘুমে ঢুলছে। তার ইচ্ছা করছে এখন একটা বালিশ মাথায় দিয়ে ঘুমিয়ে থাকতে। এই মুহুর্তে যদি সে একটু ঘুমাতে পারতো তাহলে তার চাইতে শান্তির ব্যাপার বোধহয় পৃথিবীতে আর অন্য কিছু হতো না। কিন্তু এই শান্তির ব্যাপারটা এখন সংঘটিত হতে দেওয়া যাবে না। মাহতাব ভাই যদি দেখে চুমকি পড়া বাদ দিয়ে ঘুমাচ্ছে তাহলে চুমকির খবর আছে। তাও যদি এক দু দিন এরকম হতো! চুমকির তো প্রতিদিনই পড়তে বসলেই ঘুম পায়। সে ঝিমিয়ে পড়ে আবারো মাথা ঝাঁকি দিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকায় বইয়ের দিকে। এই চোখ বন্ধ হতে দেওয়া যাবে না। কিছুতেই না। খোদেজা সিমেন্টের মেঝেতে বসে বটি দিয়ে কচুর লতি বেঁছে রাখছিল। কাজের প্রতি দৃষ্টি থাকলেও তার মন খানিকটা অন্যমনষ্ক। আজকেই সে জানতে পেরেছে তার ছেলের বউ বিয়েতে রাজী ছিল না। বাপে জেদের বশে বিয়ে দিয়েছে। প্রথম থেকেই খোদেজার একটু কেমন কেমন যেনই লাগছিল। সবকিছু কেমন যেন স্বাভাবিক লাগছিল না ওদের স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের ভেতর। শুদ্ধ’র রুমের জানালাটা ভেঙেছে আজ কতদিন হলো। তবুও শুদ্ধ’র মধ্যে ওটা মেরামতের কোন লক্ষণও নেই। স্বামী স্ত্রী আলাদা ঘুমাচ্ছে। তবুও দুজনের মধ্যে কারো কোন গরজ নেই। দুজনেই স্বাচ্ছন্দ্যে নিজেদের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। এসব সহ আরো নানা কারণেই খোদেজার খটকা লাগছিল। একারণে আজ নিজ থেকেই খোদেজা একজন মিস্ত্রী ডেকে জানালা ঠিক করিয়েছে। তারপর নিজের সন্দেহ আর চেঁপে না রাখতে পেরে কথায় কথায় শুদ্ধকে সবটা জিজ্ঞাসাই করে বসে খোদেজা। শুদ্ধ স্পষ্ট কথার ছেলে। কথার মধ্যে কোন মিথ্যা, হেঁয়ালিপানা, ছলচাতুরী, ভাণ টান রাখা তার স্বভাবে নেই। তাই সে সবটা খুলেই বলে তার মাকে। তাছাড়া ভবিষ্যতেও এ নিয়ে ও’র মায়ের সাহায্যের প্রয়োজন হতে পরে এটা ভেবেই শুদ্ধ বলে দেয়। কথাটা শোনার পর থেকেই খোদেজার ভালো লাগছে না। একটাই ছেলে তার। কত শখ করে পছন্দের মেয়ের সাথে বিয়ে দিল সেটাতেও হয়ে গেলো গড়মিল। মেয়েটার উপরও রাগ হচ্ছে না। মেয়েটার কি দোষ? বাপ মা চাইলে কি আর মাইয়া মানুষ না করতে পারে! মাইয়াটার চেহারাটাই এতো নিষ্পাপ যে তাকালে খোদেজা রাগ বা বিরক্তি অন্য কিছুই ভাবতে পারে না। তার শুধু রাগ হয় নিজের ভাগ্যের উপর। সবটা কি স্বাভাবিক হতে পারতো না!
শুদ্ধ নিজের রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচে রাস্তায় দাঁড়ানো আবুলের সাথে চেঁচিয়ে কথা বলছিল। ধারা একগাদা জামা কাপড়ের স্তূপ নিয়ে রুমের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইলো। জামাগুলো তার নিজেরই। রুমের জানালা যেহেতু ঠিক হয়ে গেছে তাই খোদেজা বলেছে তার জামাকাপড় সব লাগেজ থেকে বের করে শুদ্ধ’র রুমে গিয়ে গুছিয়ে রাখতে।
কিন্তু কতক্ষণ ধরে এভাবেই জামা কাপড় হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ধারা। শুদ্ধ’র কোন টেরও নেই। সে তো বারন্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলায় ব্যস্ত। এখন ধারা জামাকাপড় গুলো কোথায় রাখবে সেটা তো জিজ্ঞেস করে নিতে হবে নাকি! সে বারান্দাতেও যেতে পারছে না। নিচে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। এভাবে সেখানে যাওয়া ঠিক হবে না। ধারা বুঝতে পারলো এভাবে হবে না। শুদ্ধকে ডাকতে হবে। কিন্তু ডাকবে কিভাবে এটাই বুঝতে পারছে না। ধারা কিছুক্ষণ মৃদু মৃদু স্বরে শুনুন শুনুন বলে ডাকলো। কিন্তু শুদ্ধ শুনলো না। এরপর মুখ দিয়ে কিছু অদ্ভুত আওয়াজ করলো শুদ্ধ’র ধ্যান পাওয়ার জন্য। তাতেও কাজ হলো না। এরপর কি করবে না করবে বুঝতে না পেরে টি টেবিলে রাখা একটা স্টিলের বাটি মেঝেতে ফেলে দিল। ঝনঝন আওয়াজ পেয়ে শুদ্ধ দ্রুত ভেতরে চলে এলো। এসে বলল,
‘কি হয়েছে?’
ধারা বলল, ‘বাটি পড়ে গেছে।’
শুদ্ধ দুষ্টমির ছলে বলল, ‘ও…আমি তো ভাবলাম আপনিই পরে গেছেন।’
ধারা সরু চোখে তাকালো। লোকটার মুখটা লম্বাটে। হালকা ফর্সা মুখে কুচকুচে কালো ঘন ভ্রু সবসময় একটা ব্যক্তিত্বের আভা ধরে রাখে। চেহারার মধ্যেই একধরণের স্পষ্ট ভাব বিরাজমান। কোন সঙ্কোচ নেই, কোন জড়তা নেই। সবকিছু যেন পানির মতো স্বচ্ছ। আর এই পানির মতো স্বচ্ছতায় সারাক্ষণ শুধু ধারাকে খোঁচা মারার ফন্দি। শুদ্ধ বলল,
‘পড়েছে কিভাবে? ধাক্কা খেয়েছিলেন টেবিলের সাথে?’
‘না মানে…আমি ইচ্ছে করে ফেলেছি।’
শুদ্ধ অবাক হয়ে বলল, ‘কেন?’
‘আপনাকে ডাকার জন্য।’
‘কেন আমার নাম কি দোষ করেছিল?’
‘এটা তো আর শহর না গ্রাম। আমি নাম ধরে ডাকলে অন্যরা খারাপ বলতে পারে।’
‘অন্যদের খারাপ বলার কি আছে! আমি তো নিজেই আপনাকে বলছি আমার নাম ধরে ডাকতে। নয়তো এভাবেই যদি আপনি আমার সুন্দর নামটাকে ইগনোর করে এরকম দূর থেকে শুধু শুনুন, শুনুন করতে থাকনে তাহলে না জানি কবে আমি আমার নিজের নামই গুলিয়ে ফেলি আর কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে ফেলি, আমার নাম হচ্ছে ‘শুনুন।’
কথাটা বলে শুদ্ধ হেসে দিল। ধারা এই প্রথমবার খেয়াল করলো শুদ্ধ যখন হাসে তখন ও’র বাম গালে একটা সুন্দর ডিম্পল ভেসে উঠে। ধারা অনেক মেয়েদের গালে ডিম্পল দেখেছে কিন্তু নাটক সিনেমা ছাড়া বাস্তবে এভাবে কোন ছেলের গালে এমন সুন্দর ডিম্পল দেখেনি। তাই শুদ্ধ’র হাসিতে ও’র এই কথাটাই প্রথম মাথায় এলো, বাহ! সুন্দর তো!
রাতের খাবার শেষে ধারা রুমে আসতেই শুদ্ধ জিজ্ঞাসা করলো,
‘আচ্ছা, ধারা আপনাকে নাকি এ প্লাস না পাওয়ার কারণে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে?’
প্রশ্নটা শুনতেই ধারা মাথা নিচু করে ফেলল। এমনিতেই শুদ্ধ’র রুমে আসায় কেমন যেন সঙ্কোচ হচ্ছিল। রাত তো এখনও বেশি হয়নি। এতো তাড়াতাড়ি রুমে আসার কোন ইচ্ছা ছিল না ধারার। কিন্তু ধারার শ্বাশুড়িই বলল, রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে থাকতে। সত্যি বলতে একপ্রকার খেয়ালেই ছিল না ধারার যে আজ থেকে আবারও এই রুমেই ধারাকে থাকতে হবে। সে তো বেশ ভালোই ছিল শ্বাশুড়ি আর চুমকির সাথে ঘুমাতে।
ধারা বলল, ‘আপনি জানলেন কি করে?
‘সেদিন যখন আপনাদের বাড়ি গিয়েছিলাম আপনার ভাই কথায় কথায় বলেছিল। আমি তো শুনে প্রচুর অবাকই হয়েছিলাম তখন।’
ধারা আর কিছু বলল না। মাথা নিচু করেই রইলো।
ধারাকে চুপ করে থাকতে দেখে ল্যাপটপের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে শুদ্ধ বলল,
‘আপনার তখন কিছু বলা উচিত ছিল ধারা।’
প্রসঙ্গ পাল্টাতে ধারা বলল,
‘আচ্ছা আপনি নাকি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন? আমি তো প্রথমে ভেবেছিলাম আপনি….’
ধারাকে সম্পূর্ণ কথা শেষ না করতে দিয়েই শুদ্ধ বলে উঠলো, ‘চমৎকার! আপনার হাজবেন্ড কি কাজ করে সেটা না জেনেই আপনি বিয়ে করে ফেলেছেন ধারা!’
ধারার ইচ্ছা করলো নিজের মাথায় একটা বাড়ি দিতে। আজ শুদ্ধকে একটু হেসে কথা বলতে দেখে সেও ফ্রি মাইন্ডে প্রশ্নটা করে ফেলেছে। কিন্তু ধারা এটা কিভাবে ভুলে গেলো, ইনি তো খোঁচারাজ। খোঁচা না মেরে কথা বললে তো উনার পেটের ভাত হজম হবে না। নাও ধারা, এবার সুযোগ করে দিয়েছো যখন ইচ্ছে মতো খোঁচা খাও!
শুদ্ধ বলতে থাকলো, ‘আপনার ভাগ্য ভালো যে আপনার বাবা রাগ করে কোন পাগলের সাথে আপবার বিয়ে দিয়ে দেননি। নয়তো আমাকে দেখে তো শুধু কান্নাকাটি করেছেন পাগল বরকে দেখলে তো বোধহয় নির্ঘাত খুনই হয়ে যেতেন।’
ধারা সটান হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ঠোঁট চেঁপে শুদ্ধ’র কথাগুলো হজম করতে লাগলো। আর শুদ্ধ’র কথার ভাঁজে ভাঁজে পেছনে হাত নিয়ে আঙ্গুল দিয়ে মনে মনে গুণতে লাগলো, ‘এক নাম্বার খোঁচা, দুই নাম্বার খোঁচা, তিন নাম্বার খোঁচা….।’
শুদ্ধ বকবক করতেই লাগলো। আর ধারার আঙ্গুলের সংখ্যাও বাড়তেই লাগলো। একসময় পেটের সব কথা বের করে একটা হাই তুলে উঠে দাঁড়ালো শুদ্ধ। আর ধারা নিজের আঙ্গুলগুলো সামনে এনে দেখলো মোট সাতটা খোঁচা। বাহ! সাত মিনিটের কথায় খোঁচারাজ মহাশয়ের সাতটা খোঁচা। খারাপ কি!
ল্যাপটপটা বন্ধ করে শুদ্ধ গিয়ে বিছানার একপাশে শুয়ে পড়লো৷ ধারা এবার আবারও সঙ্কোচে পড়ে গেলো। শুদ্ধ’র পাশেই কি ঘুমাতে হবে? অন্য কোন উপায় কি আর নেই? কি করবে না করবে কিছু বুঝতে পারলো না। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে শুধু কাঁচুমাচু করতে লাগলো। সেদিকে তাকিয়ে একটা ডেম কেয়ার ভাব নিয়ে শুদ্ধ বলল,
‘একসাথে ঘুমাতে আমার কোন আপত্তি নেই। আমার নিজের উপর কন্ট্রোল আছে। আপনার যদি মনে হয় আমার সাথে ঘুমালে আপনার নিজের উপর কন্ট্রোল থাকবে না তাহলে আপনি আলাদা ঘুমাতে পারেন।’
কথাটা শুনে কিছুক্ষণ ব্যাক্কেল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ধারা। তারপর কটমট করে একটা বালিশ নিয়ে শুদ্ধ’র পাশে শুয়ে পড়লো। অন্ধকারে মিটমিটিয়ে হাসতে লাগলো শুদ্ধ।
__________________________________________
সাঁঝের ছায়া নামতেই খোদেজা ব্যস্ত হয়ে পড়লো হাঁস মুরগী নিয়ে। একটু পরই মাগরিবের আযান দিবে। অন্ধকার নেমে পড়বে চারদিকেই। খোদেজা মুরগীগুলোকে ধান খেতে দিয়ে পুকুর থেকে হাঁসগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে এলো। চুমকি ঘরের দাওয়ায় বসে চিরুনী দিয়ে উকুন মারছিলো। তার মাথার বড় বড় চুলগুলো মাঝখানে সিঁথি করে সামনে এনে রাখা। সেদিকে একবার তাকিয়ে খোদেজা ধমক লাগিয়ে দিলো। বলল,
‘ঐ মাইয়া, তোর কি আক্কেল পছন্দ বলতে কিছু নাই। সন্ধ্যার কালে এমন চুল ছাইড়া দাওয়ায় বইসা আছোস! খারাপ জিনিস আইসা যখন ধরবো তখন বুঝবি।’
চুমকি ভয় পেয়ে গেলো। এইসব জিনিস প্রচন্ড ভয় পায় সে। তারউপর আজকে স্কুলে তার বান্ধবীরা মিলে ভূতের গল্প করছিল। চুমকির বান্ধবীর ফুফুকে নাকি অনেক বছর আগে মাঝরাতে পানিতে ভাসা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। সবাই বলে তাকে নাকি খারাপ জিনিসই মেরেছে। চুমকি তাড়াতাড়ি মাথায় কাপড় দিয়ে ঘরের ভেতরে চলে গেলো। তখন ধারা এলো দরজার সামনে। দেখলো খোদেজাকে খানিক বিচলিত দেখাচ্ছে। এই মহিলাটাকে ধারার ভীষণ ভালো লাগে। এতো মায়া নিয়ে কথা বলে যে ধারার বড্ড আপন লাগে। খোদেজাকে এমন চিন্তিত দেখে ধারা বলল, ‘কি হয়েছে মা?’
খোদেজা ধারার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আর বলো না মা, একটা হাস পাইতাছি না। কম দেখতাছি। এদিকে বেলাও পইরা যাইতাছে। আমি নামাজ পড়তে যাবো নাকি এগুলা নিয়াই ঘুরবো! নিশ্চয়ই ডোবার ধারে কোন ঝোপের মধ্যে গেছে।’
ধারা বলল, ‘আপনি যান মা। আমি গিয়ে ওটা খুঁজে আনছি। আর বাকি গুলো তো খোঁয়াড়ে ঢুকেই গেছে।’
‘না না থাক! তোমার যাওয়া লাগবো না।’
‘সমস্যা নেই মা। আমি পারবো। আপনি যান।’
খোদেজা আর আপত্তি করলো না। ঘরের পেছনে শুকনো পাতা পড়ে আছে। সেগুলোকেও একটা ব্যাগে ভরে রান্নাঘরে নিয়ে আসা দরকার। এখন সে এসবের পেছনে থাকলে সত্যিই দেরি হয়ে যাবে। খোলা চুলগুলোকে হাত খোঁপা করে ধারা হাঁস খুঁজতে খুঁজতে পুকুরের অপর প্রান্তে চলে গেলো। পুকুরটা অনেক বড়। সেটা পেরোলেই আবার একটা ছোট্ট ডোবা। তারপরেই বাঁশের ঘন ঝাড়। আলো যেন এদিকে প্রবেশ করা অনেক আগেই বন্ধ করে দিয়েছে। অন্য স্থানের তুলনায় এদিকে একটু বেশিই আঁধার হয়ে এসেছে। হাঁস সহজে খুঁজে পেলো না ধারা। অনেকটা দেরি হয়ে গেলো। অন্ধকার হয়ে এসেছে প্রায়। শেষমেষ যখন দেখা পেলো তখন দেখলো ডোবার ধারে পাশের বাসার লোকেরা ডাঁটার বীজ বুনে যেই একটা নেট দিয়ে ঘেরাও করে দিয়েছিল, তারই মধ্যে পা আটকে বসে আছে হাঁসটা। ধারা গিয়ে নেট থেকে হাঁসটার পা ছুটিয়ে দিলো। এতক্ষণ বদ্ধকর এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতেই হাঁসটা প্যাক প্যাক করতে করতে তুমুল বেগে বাড়ির দিকে ছুট লাগালো। ধারা মৃদু হেঁসে আবার উল্টো দিকে হাঁটা দিলো। চারিদিক আধো আলো আধো অন্ধকারের সমাহার। আলোকে অতিক্রম করে অন্ধকারের আধিক্য হওয়ার তোড়জোড় যেন একটু বেশিই। ধারা নিজের মনে পথ দেখে দেখে বাড়ির দিকেই আসছিল। হাত খোঁপাটা কখন যেন খুলে গিয়ে পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে তার চুলের রাশি। বাঁশ ঝাড়ের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ ই পেছন থেকে একটা শীতল হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিল তাকে। অথচ এখন গরমের দিন। ধারার একটু কেমন যেন লাগলো। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। তার কেমন যেন মনে হচ্ছে তার পেছন পেছন কেউ যেন আসছে। এই বুঝি তাকালেই সে দেখতে পাবে। ধারার একবার মনে হলো পেছনে তাকায়। আবার তাকানোর কথা ভাবতেই একধরনের অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগলো। শেষমেশ সে আর তাকালো না। দ্রুত পা চালিয়ে একপ্রকার ছুটেই চলে এলো বাড়িতে। খোদেজা তখন খোয়াড়ের দুয়ার আটকাচ্ছিল। শুদ্ধ সবেই বাজার থেকে এসেছে। ধারাকে এভাবে হন্তদন্ত হয়ে পুকুর পাড় থেকে আসতে দেখে দুজনেই অবাক। খোদেজা এগিয়ে এসে ধারার হাত ধরে বলল,
‘কি হয়েছে মা, তুমি এমন করতাছো কেন?’
শুদ্ধও ভ্রু কুঞ্চিত করে ধারার দিকে তাকিয়ে রইলো। পুকুর পাড়ের দিকে তাকিয়ে ধারা একবার ঢোক গিলে বলল, ‘বাঁশ ঝাড়ের নিচ দিয়ে যখন আসছিলাম আমার মনে হচ্ছিল আমার পেছনে কেউ আছে। অথচ আমার যাওয়ার সময় কেউ সেখানে ছিল না। কেমন যেন অন্যরকম লাগছিল।’
শুদ্ধ ফট করে বলে দিলো,
‘আপনার মনে হচ্ছিল তো? তাই ওটাকে কোন পাত্তাও দিয়েন না। কারণ আপনি নিজেই নিজের কিছু বুঝতে পারেন না। সেটা ভালো মন্দ হোক বা অন্যকিছু। একটা কাজ করুন চুমকিকে না হয় সেখানে নিয়ে যান। তারপর চুমকি যদি বলে হ্যাঁ এটা ভয় পাওয়ার মতোই তখন না হয় ভয় পাবেন।’
ধারার চোখে পানি চলে আসলো। প্রচন্ড রাগও উঠলো তার। ধারা কতটা ভয় পেয়েছে তার সত্ত্বেও এই মুহুর্তে এরকম নিষ্ঠুর কথা কি না বললেই নয়! ছলছল চোখেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার শুদ্ধ’র দিকে তাকিয়ে ধারা গটগট করে ভেতরে চলে গেলো। খোদেজা সেদিকে তাকিয়ে শুদ্ধকে বলল,
‘এইসব কি মাহতাব? তুই সবসময় মাইয়াটার সাথে এরকম করে কথা বলোস কেন? বউ এমনিতেই ভয় পাইয়াছিল তুই তার উপর আবার রাগিয়ে দিলি।’
মাটির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে শুদ্ধ বলল
‘আমি ইচ্ছে করেই ধারার সাথে এভাবে কথা বলি আম্মা। যাতে ও’র রাগ হয়, জেদ চাপে। ও নিজের জন্য হয়ে একটু হলেও স্ট্যান্ড নেয়। যে যা বলে সব যেন শুধু চুপচাপ শুনেই না যায়। আর দেখলো তো আজকে একটু হলেও ও ক্ষেপে গিয়েছে। আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়েছে। আর আজকে এভাবে বলার পেছনে আরেকটা কারণও আছে। ধারা সত্যিই ভয় পেয়েছে। এখন অন্যকিছুও হতে পারে আবার পরিবেশটাই এমন ও’র মনের ভুলও হতে পারে। কিন্তু ভয়টা ও’র ভেতরে সারা রাত গেঁথে থাকতো। মস্তিষ্ক বারবার এটা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে থাকতো। এই যে এখন আমি ওকে কটাক্ষ করে কথা বললাম তাই এখন ও’র মাথা গরম হয়ে থাকবে। ও’র বারবার আমার কথাটাই মনে পড়বে আর রাগ লাগতে থাকবে। বাঁশ ঝাড়ে ভয়ের ব্যাপারটা ততোটা মাথায় আসবে না।
দুটো অনুভূতি কখনো একসাথে একই মুহুর্তে অনুভব হয় না। রাগান্বিত মনে কখনো আনন্দ লাগে না, ব্যথিত মন কখনো অশরীরী ভয় পায় না। ঘৃণিত মনে কখনো ভালোবাসা অনুভূত হয় না। মন জিনিসটা বড্ড অদ্ভুত। এখানে একটা অনুভূতির উপস্থিতিতে আরেকটা অনুভূতিকে তার জায়গা ছাড়তে হয়। বিয়ের পর পর ও’র সাথে রুক্ষ হয়ে কথা বলতাম রাগের কারণে। কিন্তু এখন ইচ্ছে করেই এটা চালিয়ে গেছি ও’র ভালোর জন্যই।’
খোদেজা সন্ধিগ্ন চোখে শুদ্ধ’র দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে একটা দুষ্ট হাসির রেখা টেনে বলে,
‘কেন? প্রথমদিকে রাগ কইরা যখন এমনে কথা বলছোস। তোর মাথায় এতো রাগ ছিল তাইলে এখন অন্য কারণে এমন করতাছোস কেন? ধারার জন্য এতো কেন চিন্তা তোর?’
শুদ্ধ ঝট করে মায়ের দিকে তাকালো। আর তখনই মাগরিবের আযান পড়ে গেলো।
চলবে,,