লাভ গেম -Part 33+34

0
357

#লাভ_গেম
#ফাবিহা_নওশীন
৩৩+৩৪
টেবিলের উপরে ছোট ছোট দুইটা নোটবুক, বাদামী রঙের মোটা ডায়েরি, কিছু ফাইল পত্র। রুশা বিরস মুখে এসবের সামনে বসে আছে। আদ্রিশ ঘরে ঢুকে রুশাকে এভাবে দেখে বলল,
“এসব কী?”
রুশা টেবিলের উপরে ইশারা করে বলল,
“এখানে কিছু পাইনি।”
আদ্রিশের চোখ পড়ল বাদামী রঙের ডায়েরির দিকে। এখান থেকে একটা পাতা ছিড়েছে যেটা এখনো ওর পকেটে। আদ্রিশ রুশার পাশে বসল। তারপর ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভেবে রুশার দিকে চেয়ে বলল,
“তোমার ভাই কাকে নিয়ে ডিপ্রেসড ছিল? তোমাকে নিয়ে না শানকে?”
রুশার কপাল কুঁচকে এল।
“মানে কী? ভাইয়া আমাদের কাউকে নিয়ে ডিপ্রেসড ছিল না।”
“ছিল তো অবশ্যই। নয়তো আক্ষেপ করার কথা না। আক্ষেপ করে বলত না মানুষ করতে পারিনি।”
রুশা কিছুই বুঝতে পারছে না। উৎসুকভাবে আদ্রিশের দিকে চেয়ে আছে। আদ্রিশ ওকে বুঝতে পেরে পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে দেখিয়ে বলল,
“তোমার ভাইয়ের এই ডায়েরি থেকে ছিড়েছি।”
রুশা ওর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বলল,
“তুমি আমার ভাইয়ের ডায়েরিতে কার পারমিশন নিয়ে হাত দিয়েছো? আর পাতা ছিড়েছো কেন? আমি ডায়েরির পাতা ছেড়া দেখেছি কিন্তু তুমি যে ছিড়েছো বুঝতে পারিনি।”
“পারমিশন ছাড়া হাত দেওয়ার জন্য সরি কিন্তু চুপ করে বসে থাকতে পারছিলাম না কারণ এলিগেশন তো আমার নামে আনা হয়েছে তাই। এই পাতাটা খুলে পড় আর বলো আমাকে এই লাইনগুলো লেখার কী কারণ।”
রুশা দ্রুত পাতাটা খুলল। সেখানে জেল পেন দিয়ে গুটিগুটি হাতে লেখা,
“আমি ওকে মানুষ করতে পারিনি। হয়তো আমার শিক্ষায় কমতি ছিল কিন্তু আমার ভালোবাসায় খুঁত ছিল না। আমাকে মাফ করে দিও বাবা, আমাকে মাফ করে দিও মা। আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে পারিনি।”
রুশা স্তব্ধ হয়ে চেয়ে আছে লেখাগুলোর দিকে। কাকে নিয়ে এত আক্ষেপ করছে, কেন আকুতি নিয়ে মাফ চাইছে। রুশা ডায়েরি বের করে পাতাটা মেলাল। হ্যা এই ডায়েরির পাতাটা আর লেখাটাও ওর ভাইয়ের। ও তো ভাইয়ের শিক্ষায় বড় হয়েছে, ভাইয়ের সব কথা মেনে চলত, ওকে নিয়ে ভাইয়ের কোন অভিযোগ ছিল না। তাহলে?
আদ্রিশ দ্রুত প্রশ্ন ছুড়ে দিল, “তুমি? তোমাকে নিয়ে আক্ষেপ ছিল?”
রুশা ছলছল চোখে আদ্রিশের দিকে চেয়ে বলল,
“আমি ভাইয়াকে কখনো এতটা হার্ট করিনি যে আমাকে অমানুষ মনে করবে। আমার বিরুদ্ধে তার কোন অভিযোগ ছিল না। সব সময় আমাকে নিয়ে গর্ব করত।”
আদ্রিশ যা বোঝার বুঝে গেল। ও বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“প্রকৃত অপরাধীকে খুঁজতে হলে সবাইকে অপরাধীর তালিকায় রাখা উচিত। অন্তত মনে মনে।”
“কী বলতে চাইছো?”
“শানকেও সে তালিকায় স্থান দেও। সবার জন্য আইন যেমন সমান তেমনি সবার জন্য তোমার দৃষ্টি ভঙ্গি সমান রাখো।”
রুশা কটাক্ষ করে বলল,
“শান ভাইয়াকে? তুমি কি বলতে চাইছো? শান ভাইয়া এর পেছনে আছে?”
আদ্রিশ বিরক্তি নিয়ে বলল,
“তুমি অযথা রিয়েক্ট করো। আমি বলেছি ও এর পেছনে আছে? বলেছি ওকেও তালিকায় রাখতে।”
“তাই বলে শান ভাইয়া… ”
“তুমি আমাকে সময় ও সুযোগ উভয়ই দিয়েছো নিজেকে প্রমাণ করার। তাই প্লিজ কো-অপারেট। তুমি তো হ্যাকিং জানো, শানের ল্যাপটপটা হ্যাক করতে পারবে?”
“পারব কিন্তু করব না। আমি শান ভাইয়ার ল্যাপটপ কিছুতেই হ্যাংক করব না। তুমি আমাকে ব্যবহার করে তার প্রয়োজনীয় সমস্ত
ডাটা লিক করতে চাইছো।”
“শাট আপ! তুমি একটা মাথা মোটা। কী করে যে সহ্য করছি। উফফ! আমি তোমাকে বলেছি চেক করতে। তুমি ক্লো খুঁজবে। আমাকে হ্যাক করে দিতে বলিনি। এখন বলো তুমি করবে না অন্য ব্যবস্থা নেব?”
রুশা ভেবে দেখল আদ্রিশ যখন একবার বলেছে চেক করেই ছাড়বে। তারচেয়ে বরং ও নিজেই দেখুক। ভাইয়ের প্রয়োজনীয় ডাটা হ্যাক হবে না।
“ঠিক আছে আমি দেখছি।”
“গাইস, নিড টু হ্যাক এ ল্যাপটপ। আই ওয়ান্ট ইউর হেল্প।” রুশা ওর বিদেশে থাকা বন্ধুদের গ্রুপে ছোট্ট করে মেসেজ করল সাহায্য প্রাপ্তির জন্য।
রুশা ল্যাপটপ নিয়ে বসে গেছে। ঘাড় ব্যথা করছে। ডানে-বামে ঘাড় ঘুরিয়ে কফিতে চুমুক দিল। আর্দ্র ঘুমাচ্ছে। রুশার বেশ বিরক্ত লাগছে। সারাদিন ছেলের পেছনে সময় দেওয়ার পর রাতে একটু ঘুমাবে তার জো নেই। খুব ক্লান্ত লাগছে। স্ট্রং সিকিউরিটি দেওয়া তাই যথেষ্ট সময় লাগবে। রুশার রাগ লাগছে। আদ্রিশ অযথা ফালতু কাজে ওকে ফেলে দিয়েছে।
হঠাৎ করে আর্দ্র কেঁদে উঠল। আদ্রিশ ইশারা করে বলল ও দেখছে। আদ্রিশ আর্দ্রকে কোলে তুলে নিল। কিন্তু ওর কান্না থামছে না। রুশা কাজে মন বসাতে পারছে না। ছেলের কান্না উপেক্ষা করে কাজ করা কি সম্ভব। রুশা উঠে গেল। আদ্রিশের কাছ থেকে ওকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে কান্না থামাল। ওকে খাওয়াল। তারপর আবার কোলে নিয়ে পিঠে হাত রেখে হেঁটে হেঁটে ঘুম পাড়াচ্ছে। আর্দ্র ওর ঘাড়ে মাথা রেখে আলতো শব্দ করছে। কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর আর্দ্রের নড়াচড়া, শব্দ না পেয়ে আদ্রিশকে ইশারায় জিজ্ঞেস করল,
“ঘুমিয়েছে?”
আদ্রিশ আর্দ্রকে দেখে মাথা নাড়িয়ে না করল। রুশা আবার হাঁটছে। এভাবে কিছুক্ষণ হাঁটার পর আদ্রিশকে আবারও জিজ্ঞেস করল ঘুমিয়েছে কি না। আদ্রিশ জানালো ঘুমিয়েছে। রুশা খুশি হয়ে ওকে শোয়াতে নিয়ে গেল। ধীরে ধীরে ওকে নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল যাতে না জেগে যায়। হঠাৎ করে আর্দ্রের বন্ধ চোখ খুলে গেল। পিটপিট করে চেয়ে আছে। রুশা আর্দ্রকে দেখে টাস্কি খেল। মাত্রই ঘুমিয়েছে। শুইয়ে দিতেই ঘুম উবে গেল।
“কি রে বাপ! তুই কি আমার কোলে ঘুমাতে চাইছিস? তুই ঘুমাবি আর আমি তোকে নিয়ে হাঁটব? এখন হাঁটার সময় না৷ অনেক রাত হয়েছে ঘুমাও আমার সোনা বাবুটা।”
রুশা ওর বুকে আলতো করে বারবার স্পর্শ করে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু ও বড়বড় চোখ করে চেয়ে আছে।
রুশা হতাশ হয়ে বসে পড়ে বলল,
“বাপ-বেটা চুক্তি করেছিস? ঠিক করে নিয়েছিস এই মাঝরাতে আমাকে শান্তি দিবি না। আমার ভালো লাগে না। তোমার ছেলেকে তুমি দেখো। আমি পারব না।”
আদ্রিশের দিকে কাঁদোকাঁদো হয়ে চেয়ে বলল।
আদ্রিশ গিয়ে আর্দ্রের পাশে বসল। ওর হাসি পাচ্ছে রুশার অবস্থা দেখে। আদ্রিশ ছেলের সাথে খেলায় মেতে উঠল। রুশা উঠে চলে গেল নিজের কাজে।
রুশা কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ল্যাপটপের উপরে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। আদ্রিশ নিজেও জেগে ছিল আর্দ্র ঘুমিয়ে যাবার পরে। রুশাকে ঘুমিয়ে পড়তে দেখে কিছু বলল না। বুঝতে পারছে ও খুব ক্লান্ত।
ঘাড়ে তরল কিছুর স্পর্শে রুশার ঘুম ভেঙে গেল। রুশা নড়ে-চড়ে মাথা তুলতে গেলে আদ্রিশ ফিসফিস করে বলল,
“হিসস! উঠো না। তোমার ঘাড় ব্যথা করছে তো ওষুধ লাগিয়ে দিচ্ছি। তুমি যেভাবে ছিলে সেভাবে থাকো।”
রুশার এমনিতেই ক্লান্ত লাগছে। তাই আদ্রিশের সাথে তর্ক করার মানে হয় না। রুশা মাথা নিচু করে রাখল।
আদ্রিশ ওর ঘাড়ে ওষুধ লাগিয়ে উঠে গেল।
“গিয়ে শুয়ে পড়। বাকি কাজ আগামীকাল করো।”
রুশা উঠে হাই তুলতে তুলতে গিয়ে শুয়ে পড়ল। ঘুমে ওর চোখ ভেঙে যাচ্ছে।
সন্ধ্যা বেলা। রুশা রাগী রাগী ফেস করে আদ্রিশের দিকে চেয়ে আছে।
“কি আছে এখানে? কিছু নেই। অযথা রাতভর খাঠলাম। মাথা ধরে গেছে আমার। ছোট্ট একটা ছেলে নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকি। ব্যবসায়ীক ডাটা, পার্সোনাল কিছু ফাইল ছাড়া কিছু নেই।”
আদ্রিশ রুশার জ্বলজ্বল করা চোখের দিকে চেয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল,
“ব্যাপার না। সেলফোন থেকে কিছু পাওয়া যেতে পারে।”
“কোথাও কিছু নেই। তুমি শুধু শুধু এসব করছো। নিজের দোষ ঢাকতে এসব করছো।”
“সেটা প্রমাণ করো। প্রমাণ করো শান নির্দোষ আমি দোষী।”
রুশার মনে জেদ চেপে বসল। ও শানকে নির্দোষ প্রমাণ করবে। আদ্রিশের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিবে কে অপরাধী।
রুশা হনহন করে হেঁটে চলে গেল।
শান আজ দীর্ঘদিন পরে দেশে ফিরেছে। রুশা ভাবছে ওর সাথে দেখা করতে যাবে। মোবাইলে নিজেদের সমস্যা মিটিয়ে নিলেও সামনা-সামনি সেই ঘটনার পর আর দেখা হয়নি।
রুশার আসার খবর শুনে শান বেডরুম থেকে ড্রয়িংরুমে এসে উপস্থিত হয়। রুশা ভাইয়ের দিকে কিছুক্ষণ অপলক নয়নে চেয়ে রইল। শানের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটেছে ওকে দেখে। চেহারায় ম্যাচিয়ুর ভাব এসেছে। গালে বড়বড় দাঁড়ি। আগের চেয়ে শুকিয়ে গেছে। বুঝাই যাচ্ছে অনেক প্রেসার যাচ্ছে ওর উপর।
“ভাইয়া, নিজের কী অবস্থা করেছো?”
“খুব প্রেসারে আছি পিউ। আগে তো ভাইয়া আর আমি মিলে সব সামাল দিতাম কিন্তু এখন একাই আমাকে সব করতে হয়। ভেবেছিলাম সব সহজ। এখন বুঝতে পারছি এত সম্পত্তি আর ব্যবসায় সামলানো কত কষ্ট। ভাইয়া ঠিকই বলতো দেখতে যতটা সহজ, বাস্তবিক অর্থে তা নয়। লন্ডনে ছিলাম দুই মাস। এখন এসেও কাজ। আর ভালো লাগে না।”
রুশা টি টেবিলের উপরে ব্যাগ রেখে বলল,
“তুমি বসো, আমি কফি করে আনছি।”
রুশা রান্নাঘরে চলে গেল। শান ল্যাপটপ খুলে বসল। কিছুক্ষণ পরে দুই মগ কফি নিয়ে ফিরল। শান কফি খেতে খেতে বলল,
“তোর ছেলের কী খবর?”
“ভালো। ওকে তো এখনো দেখলে না। ও একা আদ্রিশের না আমারও ছেলে।”
“জানি কিন্তু মন মানে না। আদ্রিশকে আমার সহ্য হয় না। আমি ওর ধ্বংস দেখতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমার বোন তো নিজের ধ্বংস ডেকে এনেছে।”
“ভাইয়া, ওসব বাদ দেও৷ আর্দ্র আমার সব৷ ওর জন্য জীবনটা এখনো এত সুন্দর। এখনো বাঁচতে ইচ্ছে করে। ওকে নিয়ে আসতাম কিন্তু তোমার যদি ভালো না লাগে তাই বাচ্চা ছেলেটাকে রেখে এসেছি। ওর একটু খোঁজ নেই। কল করে দেখি কাঁদছে কি না।”
রুশা ব্যাগটা হাতে নিয়ে মোবাইল খুঁজছে কিন্তু পাচ্ছে না। সব জায়গায় খুঁজে নিজে নিজে বলছে,
“মোবাইল কোথায় গেল? আমি তো নিয়ে এসেছিলাম।’
শান ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে ওর দিকে চেয়ে বলল,
” কী হয়েছে?”
“মোবাইল পাচ্ছি না।”
“ভালো করে খুঁজে দেখ। বাড়িতে রেখে আসিস নি তো?”
রুশা পুরো ব্যাগ খুঁজে অসহায় মুখ করে বলল,
“নেই৷ কোথায় গেল বুঝতে পারছি না। তোমার মোবাইলটা দিবে একটা কল করব।”
শান মোবাইলের লক খুলে রুশার হাতে নিল। রুশা মোবাইল নিয়ে নাম্বার ডায়েল করে ওঠে গেল। শান আবার ল্যাপটপে মনোযোগ দিল। রুশা কিছুটা দূরে সরে শানের দিকে তাকাল। ও নিজের কাজে ব্যস্ত। রুশাও দ্রুত নিজের কাজ করতে লাগল। কাজ শেষ করে শানের মোবাইল দিয়ে ব্যাগ নিয়ে বলল,
“আর্দ্র কাঁদছে। আমি অন্যদিন আসব৷ আজকে যাচ্ছি।”
“আচ্ছা আসিস।”
রুশা বাড়িতে গিয়ে দ্রুত ল্যাপটপ খুলে বসল। ঘন্টার পর ঘন্টা সময় ব্যয় করে শানের সমস্ত এক্টিভিটি, ফাইল চেক করল। হঠাৎ রুশার চোখ আঁটকে যায়। তারপর বেশি সময় ব্যয় না করে দ্রুত পড়তে লাগল। ওর বুকটা কেঁপে উঠল। চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। নড়তে পারছে না। হাত পা জমে যাচ্ছে। শরীর অসার হয়ে আসছে৷
চলবে……
#লাভ_গেম
#ফাবিহা_নওশীন
৩৪.
আদ্রিশ আর সেজান অফিস থেকে ফিরেছে। ওরা মেইন ডোর দিয়ে কথা বলতে বলতে ঢুকছে। রুশা অনুভূতি শূন্য হয়ে উঠে দাঁড়াল। ওর মনে হচ্ছে ভেতরে, বাহিরে কিছু নেই। হাওয়ায় ভাসছে। কিছু ভাবতেও পারছে না। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। দু পা এগিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। আদ্রিশ আর সেজান এগিয়ে আসতে আসতে কথা রুশাকে ধরে বলল,
“আপু কী হয়েছে? কীভাবে পড়লে?”
রুশা কিছু বলল না। কথাকে সরিয়ে নিজেই উঠে দাঁড়াল। কথা, আদ্রিশ, সেজান ওকে অবাক চোখে দেখছে। রুশাকে স্বাভাবিক নয় বিধ্বস্ত লাগছে। ওর কিছু একটা হয়েছে। আদ্রিশ ওর দিকে এগিয়ে এল। রুশা ঘরের দিকে যাচ্ছে আর বিরবির করে একা একাই বলল,
“ভাই ভাইকে কী করে খুন করতে পারে? বাবার মতো ভাইকে খুন করতে হাত কাঁপেনি? ছোট থেকে যে মানুষ করল তাকে মারতে বিবেকে বাঁধেনি? আমি বিশ্বাস করি না। সব মিথ্যা। হ্যা, সব মিথ্যা।”
রুশা সিড়ি দিয়ে উঠে যাচ্ছে। আদ্রিশ এক পলকে ওর দিকে চেয়ে আছে। সেজান কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“ভাই, ভাবি কী বলছেন?”
“যা ভেবেছিলাম তাই। শান প্রকৃত খুনি। আর রুশা তার প্রমাণ পেয়ে গেছে। ও শকে আছে। ছিহ! ভাই হয়ে ভাইকে খুন করল? আর সে দায়ভার আমার উপর চাঁপিয়ে দিল। এক মাত্র বোনকে আমার পেছনে লেলিয়ে দিল। শান রুশাকেও ভালোবাসে না। যদি ভালো বাসত তবে রিক্স নিয়ে আমার কাছে পাঠাতো না। শান খুব ভালো করে চিনে আমাকে। এতগুলো দিন রুশার রাগকে পুঁজি করে আমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। রুশাকে বলেছিলাম আফসোস করতে হবে এখন তাই করছে।”
রুশা দরজা বন্ধ করে দিল। হোঁচট খেয়ে আবারও মেঝেতে পড়ে গেল কিন্তু উঠল না। চিৎকার করে কাঁদছে। ও কিছুতেই মানতে পারছে না। সবকিছু বিষাদ লাগছে। রাগে, কষ্টে দু’হাতে নিজের চুল ধরে টানছে আর কাঁদছে৷ ও হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। দুই হাতের নখ দিয়ে নিজের দুই হাত, গাল আঁচড় কাটছে। ব্যথা, যন্ত্রণা যেন ফুরিয়ে গেছে। গাল, দুই হাত, শরীর খাঁমচে রক্তাক্ত করে ফেলেছে। মেঝেতে দুই হাত দিয়ে ঘুঁষি মারছে। হাত ফেটে রক্ত পড়ছে। ওর চিৎকার করে কান্নার শব্দ নিচে চলে গেছে। রুশা উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের জিনিসটা ছুড়ে মারছে। ওর সবকিছু বিষাক্ত লাগছে। মুক্তি পেতে ইচ্ছে করছে সবকিছু থেকে। ও কিছুতেই মানতে পারছে যে ভাইকে এত ভালোবাসে, বিশ্বাস করে সে আরেক ভাইকে মেরে ফেলেছে। আর ওকে মিথ্যা বলে, নিজের স্বার্থের জন্য ব্যবহার করেছে৷ প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে এতদিন কি কি না করেছে। আদ্রিশ বারবার বলা স্বত্তেও বিশ্বাস করেনি ওকে। ওর সামনে কোন মুখে গিয়ে দাঁড়াবে। রুশা জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে। ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেছে। হাত থেকে রক্ত ঝড়ছে। এই মুহুর্তে ওর কারো কথা মাথায় আসছে না, কারো কথা ভাবতে পারছে না। পাগলের মতো আচরণ করছে। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় ডান হাত দিয়ে সজোরে আঘাত করল। ঝনঝন শব্দে কাচের টুকরো নিচে পড়ে গেল।
কিছু ভাঙার শব্দে আদ্রিশ উপরের দিকে তাকাল। অজানা আতঙ্কে বুক কেঁপে উঠে। দৌড়ে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল। দরজা বন্ধ। ভেতরে থেকে গোঙানির শব্দ আসছে। আদ্রিশ দরজা খোলার অপেক্ষা না করে দরজায় কয়েকটা লাথি মারল। তিন চারবার লাথি মারার পর দরজা খুলে গেল। রুশা চোখে ঝাপসা দেখছে৷ পুরো পৃথিবী দুলছে। হাত, পা, গাল, কপাল, মাথা, গলা বিভিন্ন জায়গা দিয়ে রক্ত ঝড়ছে। আদ্রিশ ওকে দেখে আতংকিত হয়ে তাকাল। রুশা যে নিজের সাথে এমন কিছু করবে ঘূর্ণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি। আদ্রিশ দৌড়ে এসে ওকে ধরতে ধরতে রুশা মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে৷ আদ্রিশ রুশার মাথা তুলে নিয়ে বারবার ওর নাম ধরে ডাকছে। রুশা বন্ধ চোখে বিরবির করে বলছে,
“আমি বাঁচতে চাই না।”
সেজান আর কথাও চলে এসেছে। রুশার অবস্থা দেখে সবাই ভয় পেয়ে গেল। কেউ ভাবতে পারেনি রুশা এমন কিছু করবে। আদ্রিশ রুশাকে বারবার ধাক্কা দিচ্ছে। কিন্তু রুশা চোখ মেলছে।
সেজানের দিকে অসহায় মুখ করে চেয়ে বলল,
“ও চোখ খুলছে না। চোখ কেন খুলছে না? ওর কিছু হলে আমি বাঁচব না।”
তারপর রুশাকে আকুতি মিনতি নিয়ে বলল,
“রুশা, প্লিজ চোখ খোল। তুমি এসব কেন করলে? আমার কথা নাহয় না ভাবলে কিন্তু আর্দ্রের কথা ভাবলে না? তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি কি করব? চোখ খোল প্লিজ।”
“ভাই, ভাবি সেন্স হারিয়ে ফেলেছে। উনাকে হাসপাতালে নিয়ে চলুন।”
সেজান গাড়ি বের করতে চলে গেল। কথাকে আর্দ্রের দায়িত্ব দিয়ে গেল।
আদ্রিশ রুশাকে আঁকড়ে ধরে বসে আছে। ওর অস্থির লাগছে। রুশা নিজের কি অবস্থা করেছে। রুশা নিজের চেহারা বিভৎস করে ফেলেছে আঁচড় দিয়ে। রুশা এমন বিহেভ করবে বুঝতে পারলে ওকে একা ছাড়ত না।গাড়ি চলছে হাসপাতালের দিকে।
.
রুশাকে আরো উদ্ভট লাগছে। ওর গালে, হাতে, গলায়, কপালে, পায়ে ব্যান্ডেজ করা। চোখ মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। কথা আর্দ্রকে নিয়ে হাসপাতালে চলে এসেছে। ও কেঁদেই যাচ্ছে। কথা আর সেজান ওকে সামলাতে পারছে না। আদ্রিশ ডাক্তারের সাথে কথা বলছে।
“উনার মানসিক অবস্থা ভালো না। কোন কারণে মানসিক ভাবে আঘাত পেয়েছে। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। কাছের মানুষের সাপোর্ট প্রয়োজন। জ্ঞান ফেরার পর উনার সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করতে হবে। বিশেষ করে আপনার সাপোর্ট প্রয়োজন। আমি কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি।”
“জি, ধন্যবাদ। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। আপনি আপনার মতো চেষ্টা করুন। ওকে সুস্থ করে তুলুন প্লিজ।”
আদ্রিশ ভেবেছিল যখন রুশা সত্যিটা জানতে পারবে ওর কাছে ক্ষমা চাইবে তখন ওকে খুব সহজে মাফ করবে না। রুশাকেও কষ্ট দিবে, যেমন কষ্ট ও দিয়েছে। কিন্তু এখন সেটা পারছে না। রুশার জন্য এই বিষয়টা মেনে নেওয়া এত সহজ না। ও অনেক বড় আঘাত পেয়েছে। কারণ ভিক্টিম আর খুনি দুজনই ওর ভাই। এক ভাই খুন হয়েছে আরেক ভাই খুন করেছে। কি করে মেনে নিবে? এছাড়া এতদিন রুশাকে ব্যবহার করেছে, ভুল পথে চালিত করেছে, ধোঁকা দিয়েছে সেটাও কম গুরুতর ব্যাপার নয়।
আদ্রিশ রুশার রুমের সামনে গিয়ে দেখে ও পাগলামি করছে। নার্স ওকে সামলাতে পারছে না। ও সবকিছু ভেঙে ফেলছে। আদ্রিশ দৌড়ে ভেতরে ঢুকল। রুশা চিৎকার করছে। আদ্রিশ ওকে ঝাপটে ধরল। রুশা কিছুক্ষণ ছটফট করে থেমে গেল। আদ্রিশের বলিষ্ঠ শরীরের সাথে পেরে উঠেনি।
“রুশা, শান্ত হও। এমন করছো কেন? কেন এমন করছো?”
রুশা হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল,
“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি মুক্তি চাই। বাঁচতে চাই না।”
“আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাও? আর আর্দ্র ওর কথা ভাবলে না? বাচ্চা একটা ছেলে মা ছাড়া কি করে বড় হবে?”
রুশা মাথায় হাত দিয়ে বলল,
“আমি কারো কথা ভাবতে পারছি না। পারছি না আমি। আমার বুকের ভেতরে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে।”
“আমি আছি তো। আমি আছি তোমার সাথে। সব এক সাথে মোকাবিলা করব।”
“আমি কোন মুখে তোমার কাছে ক্ষমা চাইব? অনেক অন্যায় করেছি তোমার সাথে। অনেক ক্ষতি করেছি তোমার, ভুল বুঝে এসেছি এতগুলো দিন। কী করেছি আমি এতগুলো দিন? নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে। আমার এক ভাই আরেক ভাইকে মেরেছে।”
রুশা আবারও কাঁদছে। কথা আর্দ্রকে নিয়ে ভেতরে এলো। আর্দ্র কাঁদছে। কথা ওকে সামলাতে পারছে না। আদ্রিশ রুশাকে নিজের বুক থেকে তুলে বলল,
“আর্দ্র অনেকক্ষণ ধরে কাঁদছে। তুমি একজন মা। তোমাকে আরো শক্ত হতে হবে। ওকে একটু নেও। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে গেছে।”
রুশা কাঁদতে কাঁদতে আর্দ্রকে কোলে নিল। কোলে নিয়েও কাঁদছে।
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here