#প্রেম_এসেছিলো_নীরবে (২)
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
‘ আহহ!’ বলে ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলো প্রাহি।ওর শরীরে মলম লাগানো হচ্ছে।মলমটা লাগিয়ে দিচ্ছে ওর খালামুনি মানে হেমন্ত’র মা।উনার নাম মিসেস হেনা।হেনার চোখে পানি টলমল করছে।এইটুকু একটা বাচ্চা মেয়ের শরীরের যাচ্ছে তাই অবস্থা করে দিয়েছে নিষ্ঠুর লোকগুলো।হেনা নিজের চোখের জলগুলো মুছে প্রাহিকে বুকে টেনে নিলেন।আদুরে গলায় বলে,
-” আমার মা’টার বুজি অনেক কষ্ট হচ্ছে?”
প্রাহি চোখে পানি নিয়েও ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি নিয়ে খালামুনির দিকে তাকায়।তারপর ডানে-বামে মাথা দুলিয়ে আস্তে করে বলে,
-” তোমার মাটা এখন তার মায়ের বুকে আছে তাই তার কোন কষ্টই হচ্ছে না।”
-” আচ্ছা তাই?”
-” হুম।”
হেনা প্রাহিকে ছেড়ে সোজা করে বসালেন।তারপর সাইড টেবিল থেকে দুধের গ্লাসটুকু নিয়ে জোড় করে প্রাহিকে খাইয়ে দিলেন।মেয়েটা একদম দুধ খেতে চায়না।তারপর প্রাহিকে ঘুমিয়ে পরতে বললেন।কারন প্রাহিকে ডক্টর কয়েকদিন ভালোভাবে ঘুমোতে বলেছে।প্রাহিও খালামুনির কথামতো ঘুমানোর চেষ্টা করলো।
.
প্রাহিকে নিয়ে যখন হেমন্ত বাড়িতে ডুকেছিলো হেনা তো প্রায় একপ্রকার হামলে পড়েছিলো প্রাহিকে দেখার জন্যে।সেই ছোট্ট প্রাহি আজ কতো বড় হয়ে গিয়েছে।হেনা শুধু তাকিয়েই ছিলো মেয়েটার দিকে।তারপর প্রাহির গায়ে নানান রকম ক্ষত দেখলেন অস্থির হয়ে উঠেন পুরো।হেমন্ত তার মাকে কোনরকম বুজিয়ে শুনিয়ে শান্ত করায়।বাড়ির প্রতিটি মানুষ প্রাহির এই অবস্থা দেখে আৎকে উঠেছিলেন।এই বাড়িটা অনেক বড়। কারন হেমন্তদের পরিবারটাও যে বড়।বাড়িতে থাকে হেমন্ত’র দাদা, চাচা,চাচি,মা, বাবা, আর ওর চাচাতো বোন।আরেকজন ও আছে যে আপাততো বাড়িতে নেই।হেমন্তও দেশের বাহিরে ছিলো।এসেছে বেশিদিন হয়নি। এইতো ১০,১২ দিন হলো।এসেই তো প্রাহিকে খোজার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে।প্রাহির মা রাবেয়া আর হেনা কিন্তু আপন বোন না তারা সৎ ভাই বোন।প্রাহির মা আর মামা হলেন প্রাহির নানার প্রথম স্ত্রীর সন্তান।আর হেনা হলেন দ্বিতীয় স্ত্রীর।প্রাহির মামা খুবই খারাপ একজন লোক।তাই তো ওর নানা রাবেয়া আর হেনাকে সম্পত্তির একশোভাগের আশি ভাগ তাদের দুবোনকে আর মাত্র বিশভাগ প্রাহির মামাকে দিয়ে যান।প্রাহির যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তাদের বাড়িতে আগুন লেগে যায় যার ফলে তার মা বাবা মারা যায়।কিন্তু ছোট্ট প্রাহি তখন আল্লাহ্’র রহমতে বেচে যায়।কারন প্রাহি সেদিন হেমন্তদের বাড়িতে ছিলো।কারন সেদিন হেমন্ত চলে যাবে দেশের বাহিরে।ওর মা, বাবাও আসতেন সেই বাড়িতে কিন্তু আসার আগেই উনাদের মৃত্যু হয়ে যায়।হেমন্ত’র ফ্লাইটের টাইম হয়ে যাচ্ছিলো আর সবাই অপেক্ষায় ছিলেন।ফোনও করছিলেন কিন্তু প্রাহির মা বাবা কেউ রিসিভ করেননি।হেমন্ত’র দেরি হয়ে যাচ্ছিলো বলে হেমন্ত আর থাকতে পারে না।চলে যায় সে দূর দেশে।হেমন্ত চলে যাওয়ার পর যখন সবাই বাড়ি ফিরে আসে।এসেই জানতে পারে। প্রাহির মা, বাবা আর নেই।
ছোট্ট প্রাহির কিছুই বুজেনি সেদিন।শুধু সবাইকে কান্না করতে দেখে নিজেও কেঁদেছিলো। এদিকে প্রাহির মামা নিজেকে ইনোসেন্ট প্রকাশ করে প্রাহিকে তার কাছে কয়েকদিন রাখার কথা বলে নিয়ে যান।কিন্তু কে জানতো তারা প্রাহিকে নিয়ে পালিয়ে যাবে? তারা প্রাহিকে নিয়ে পালিয়ে যায়।প্রাহিকে অনেক খোজাখুজি করেও তারা পাননি।
আজ আবার এগারো বছর পর হেমন্ত যখন ফিরে আসে দেশে তখন গাজিপুর ওদের একটা অনাথ আশ্রমের কাজে সে গাজিপুর গিয়েছিলো সেখানেই সে তার আদরের ছোট্ট বোনটাকে খুজে পায়।কিভাবে খুজে পায় জানেন?ওর গলায় একটা লকেট আছে যেটা হেমন্ত’র মা মানে হেনাই দিয়েছিলো প্রাহির চতুর্থ জন্মদিনে।সেটা দেখেই হেমন্ত বুজে ফেলে এটা প্রাহি।আবার চোখের মনিগুলোও ওর মতোই।তবুও হেমন্ত পুরো ১০০ পার্সেন্ট সিউর হওয়ার জন্যে ওর সম্পর্কে সব প্রকার তথ্য জোগাড় করে।তারপর জানতে পারে। হ্যা, এটা প্রাহি।তারপরেই বোনটাকে নিয়ে আসে নিজের সাথে করে।
.
ড্রয়িংরুমে বসে আছেন বাড়ির সবাই। হেমন্ত’র দাদা নুরুল আমিন সিকদার, হেমন্ত’র বাবা হিয়ান্ত সিকদার, হেমন্ত’র মা হেনা, চাচা হিয়াজ সিকদার আর চাচি রায়হানা বেগম ।সবাই প্রাহির বিষয়েই আলোচনা করছে।নুরুল আমিন সিকদার গম্ভীর কণ্ঠে বলেন,
-” কি করবা ছোট বউমা?তোমার ভাই আর ভাইয়ের বউ যে এতো খারাপ সেটা ভাবতেই পারিনি।আমার নাতনিটাকে কি অবস্থা করেছে দেখেছো?আমার তো মন চাচ্ছে ওকে ধরে জেলে পুরে দেই।”
হেনা চোখে পানি নিয়ে ধরা গলায় বলে,
-” কি বলবো আব্বা?সৎ হোক তবুও তো ভাই আমার তাই না?কি করে পারি তার সাথে এমনটা করতে আমি।”
হেমন্ত চিৎকার করে বলে,
-” আহহ দরদ উতলে পড়ছে ভাইয়ের জন্যে।তোমার ভাইয়ের তো কোন মায়া মমতা লাগেনি প্রাহির জন্যে।তাহলে? হ্যা কথা বলো?”
হিয়াজ সিকদার হেমন্তকে চোখ রাঙ্গানি দিয়ে বলেন,
-” হেমন্ত! এটা কেমন স্বভাব?মায়ের সাথে এইভাবে কথা বলছো কেন?”
হেমন্ত চুপ হয়ে যায়।মাথা নিচু করে আস্তে করে বলে,
-” সরি বড়বাবা আর হবে না।”
হেনা বললেন,
-” এইবারের মতো ক্ষমা করে দে ওদের।আবার কখনো যদি প্রাহির কোন ক্ষতি করার চেষ্টা করে তাহলে পর্বতীতে এর ব্যবস্থা করবো।”
রায়হানা বেগম হেনা’র কথায় সায় দিলেন।বললেন,
-” ছোট ঠিকই বলছে হেমন্ত।তারপরেও তোর মনে যদি কোন প্রকার ভয় থাকে তুই একবার অর্থ’র সাথে কথা বলে নিস।”
হেমন্ত চিন্তিত স্বরে বলে,
-” কিন্তু ভাইয়াকে কি বলবো।ভাইয়া তো বিজন্যাসের কারনে ডুবাই গিয়েছেন এক সপ্তাহ হলো।ভাইয়া আসুক তারপর নাহয় ভাইয়ার সাথে কথা বলে নিবো।এমনিতেও প্রাহির আরো দুটো বছর সাবধানে থাকতে হবে।কারন আঠারো বছর হলেই সব সম্পত্তি ওর নামে হয় যাবে।এই কারনে ওকে সাবধানে রাখতে হবে।আর প্রাহিকে যেহেতু খুজে পেয়েছি এইবার খালামুনি আর খালুজানের কেস রি-ওপেন করবো। পুলিশ তো বলেছে এটা এটা একটা দূর্ঘটনা কিন্তু আমার তা মনে হয় না।বিদেশ ছিলাম তাই ভালোভাবে তদন্ত করতে পারিনি।এইবার ভাইয়া আর আমি আছি আমরা দুজন মিলে তাদের মৃত্যুর আসল রহস্য বের করবো।”
হিয়ান্ত সিকদার ছেলের কথায় পরিপ্রেক্ষিতে বলেন,
-” বাবা, যা করিস ভেবে চিন্তে করিস।তোদের আমরা বারন করছি না কিছু করতে।আমরাও চাই প্রাহির প্রতি হওয়া সকল প্রকার অন্যায় করা লোকদের শাস্তি হোক।তবে আগে নিজেদের প্রতি আগে ভালোভাবে খেয়াল রাখিস বাবা।”
হেমন্ত তার বাবাকে ভরসা দিয়ে বলে,
-” বাবা তুমি চিন্তা করো না।আর যেহেতু এইবার অর্থ ভাইয়া আমার সাথে আছে।আমাদের কিছুই হবে না।ভাইয়া আর আমি মিলে সব ঠিক করে দিবো।”
নুরুল আমিন সিকদার উঠে দাড়ালেন।হেমন্ত’র মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।নাতি, নাতনি তিনজন তার খুবই ভালো।আর ভালো হবেনই না বা কেন?তার ছেলে আর ছেলের বউগুলোও অনেক ভালো।আর তাদের সন্তান বুজি খারাপ হবে।
রায়হানা বেগম রান্না ঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন,
-” হেমন্ত বাবা হিয়ার কলেজ বুজি ছুটি হয়ে গিয়েছে।বাবা তুই গিয়ে ওকে একটু নিয়ে আসবি?ড্রাইভার কাকার শরীরটা ভালো নেই তাই তিনি আজ আসেন নি।আর রহিম কাকাকেও আমি বাজারে পাঠিয়েছি প্রাহির পছন্দের জিনিসগুলো আনতে।আজ মেয়েটার জন্যে আমি ভালোমন্দ রান্না করবো। যা না বাবা।”
হেমন্ত উঠে রওনা হলো তার আরেক কলিজার বোনকে আনতে।হিয়া হলো এই বাড়ির সবচেয়ে ছোট সন্তান।এই বাড়িতে ছেলেমেয়ে মোট তিনজন সবার ছোট হিয়া,মেজ হলো হেমন্ত সে তার বাবার ঘরে একজনই তার আর কোন ভাই বোন নেই।আর সবার বড় হলো অর্থ সিকদার। তার সম্পর্কে নাহয় সে আসলেই জানা যাবে।
#চলবে,,