এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ #নুরুন্নাহার_তিথী #পর্ব_২২

0
363

#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২২
মাগরিবের আজান এখনি পরবে। দ্রুত পা চালাচ্ছে তিতির। পশ্চিমাকাশে গোধূলি রঙে রক্তিম আভায় পরিপূর্ণ। ভাড়া বাসাটায় নিজের সাথে থাকা কিছু কাচের জিনিসপত্র রাখতে গিয়েছিল যাতে কাল হুড়োহুড়ি না লাগে। হুড়োহুড়িতে ভেঙে গেলে ঝামেলা। মেডিকেল কলেজ থেকে বাসাটা বেশি দূরে না। যাওয়ার পথে রিকশাতে গেলেও আসার পথে হেঁটে ফিরছে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে বলে রিকশার দাম চওড়া। এই সময়টা যেনো রিকশাওয়ালাদের নিজস্ব সময়! মেডিকেলের গেইটে ঢুকবে তখনি একটা বাচ্চা ছেলে ছুটে এসে তিতিরের পথ আগলে দাঁড়ায়। তিতির ভ্রুঁ কুঞ্চন করে তাকিয়ে বাচ্চা ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করে,

“কী হয়েছে? কিছু বলবে?”

ছেলেটি তার ফোঁকলা দাঁতে হাসি দিয়ে বলল,
“আপা আপনে খুব সুন্দর। একদম পরীর লাহান!”

বাচ্চা ছেলেটির কথায় ঠোঁট এলিয়ে হাসল তিতির। অতঃপর জিজ্ঞেসা করল,
“ওমা তাই নাকি? তুমি এই কারণে আমার পথ আগলে দাঁড়িয়েছ?”

“না আপা।”

প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“তাহলে কেনো?”

ছেলেটি এবার তার পেছোনে লুকানো হাতের দিকে তাকাল। তিতিরও দেখতে চাইল ছেলেটির হাতে কী? ছেলেটি আরেকটু সরে গিয়ে বলল,
“আপনারে কিছু দিতে আইছি।”

“কী দিবে?”

এবার ছেলেটি তার হাত সামনে আনে। হাতে একটা র‍্যাপিং করা বক্স। বক্সটা তিতিরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
“এই বক্সটা রাখেন আপা।”

তিতির সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে ভ্রুঁ কুঁচকে চেয়ে বলল,
“কী আছে এতে?”
“আপনেই দেইখা লন।”

এই বলে ছেলেটি তিতিরের হাতে জোড় করে বক্সটা ধরিয়ে দিয়ে দৌঁড়ে চলে যায়। তিতির বোকার মতো কিছু সময় চেয়ে থাকে। যখনি মাগরিবের আজানের ধ্বনি মসজিদ থেকে ভেসে আসে তখনি হুঁশে ফিরলে বক্সটাতে কী আছে না ভেবে বক্সটা নিয়েই দ্রুত হোস্টেলের পথ ধরে।

হোস্টেলে ফিরে তিতির আগে নামাজটা পড়ে বক্সটা নিয়ে বসে। সুন্দর সাদা র‍্যাপিং পেপারে মোড়ানো। ছোটো থেকে তার র‍্যাপিং পেপার খুব পছন্দের। তাই সাবধানে র‍্যাপিং পেপারটা খুলল। তারপর বক্সটা খুলে দেখল তাতে একটা সুন্দর হালকা লেমন কফি কালারের হিজাব ও দুই জোড়া ডিজাইনার চুড়ি রাখা। সাথে একটা কাগজও আছে। তিতির আগে কাগজটাই হাতে নিল। খুলে দেখল তাতে লেখা,

“এই তিতিরপাখি, কেমন আছো? উপহার সামগ্রী পছন্দ হয়েছে? উপহার আমার পাওয়ার কথা থাকলেও পাচ্ছ তুমি! কী সৌভাগ্য বলো। তবে আমিও আমার উপহার বুঝে নিব। চিরকুটটা তুমি যখন পাবে, ততক্ষণে আমার উপহার বুঝে নেওয়াও শেষ! তোমার ঠোঁটের মিষ্টি হাসিই যে আমার উপহার!”

তিতির চিরকুটটা ভাজ করে রাখল। তার সন্দেহের তি’র লক্ষ্যে পৌঁছাচ্ছে বলেই তার মনে হচ্ছে। কতোটা মিল! তিতির মনে মনে সমীকরণ মিলাতে থাকে। ‘তিতিরপাখি সম্বোধন, পত্রদাতা মেজর M.I, সেদিন বৃষ্টির সন্ধ্যায় আগুন্তকের নাম মাশরিফ, সিনিয়র ভাইদের বন্ধুর নাম মাশরিফ ইকবাল আবার সে মেজরও, উপহার পত্রদাতার পাওয়ার কথা তার মানে কোনো বিশেষ দিন। আবার উপহার পৌঁছানোর আগেই পত্রদাতা তার উপহার বুঝে নিয়েছে, আজ আবার মাশরিফের জন্মদিন!’ এতো এতো ক্লু যে কী নির্দেশ করে তা ভেবেই তিতির দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বক্সটা টেবিলের উপর রেখে দেয়।

লিরা ও জুলিয়া তিতিরকে এতক্ষণ দেখছিল। এবার জুলিয়া জিজ্ঞেসা করে,
“এসব কী টিটির?”

তিতির চোখ বন্ধ করে ঘন নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“কারও অযাচিত উপহার।”

লিরা তিতিরের বলা ‘অযাচিত’ শব্দটা বুঝতে না পেরে বলল,
“অযাযিট মানে!”

লিরার উচ্চারণ শুনে তিতির অজান্তেই হেসে ফেলল। বলল,
“অযাচিত মানে আনওয়ান্টেড গিফট।”

“ওহ। গিফট তো আনওয়ান্টেডই হয়।”

“হুম। তবে সে এটার অধিকার একেবারেই রাখে না। পরবর্তীতে আমি তাকে নিজে বুঝিয়ে দিব।”

লিরা ও জুলিয়া একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। তারপর কী বলবে আর কথা খুঁজে পেলো না।

________

হোস্টেলে নিজের বেডে বসে আরভি থেমে থেমে কাঁদছে আর টিসু দিয়ে রুমটাকে ভরিয়ে ফেলছে। ইনায়া বিরক্ত হয়ে আরেক রুমমেটের দিকে তাকায়। সেই রুমমেটও মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। ইনায়া এবার উঠে গিয়ে আরভির হাত থেকে টিসুর বক্সটা ছিনিয়ে নিয়ে বলল,

“কী সমস্যা তোর? রাফিও তো আমাকে কতোকিছুই বলে। আমি কি তোর মতো ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদি?”

“তুই বুঝবি না রে। রাফি ভাই ও অর্ক ভাই এক না। তাদের স্বভাব ভিন্ন। রাফি ভাই কি বলছে? সে ডাক্তার মেয়ে বিয়ে করবে না? বলে নাই তো। কিন্তু অর্ক ভাই বলছে। সে আমাকে আপুও ডাকছে।”

“আচ্ছা থাম না।”

“না আমি থামব না।”

আরভি আরও কাঁদতে লাগল। লাগাতার এক ঘণ্টা যাবত থেমে থেমে কাঁদছে। এর জন্য ইনায়াকে ডিউটি ছেড়ে আসতে হয়েছে। ইনায়া এবার অর্কর নাম্বারে কল করল। দুইবার রিং হওয়ার পর ফোন রিসিভ হলে কোনো হাই, হ্যালো না করে সরাসরি বলে,

“এই অর্ক ভাই, যা বলার সরাসরি বলবেন। কথা একদিন একটু, আরেকদিন একটু এভাবে বলবেন না। আর আপনার রগচটা বন্ধুর মতো তো প্যাঁচালো কথা বলবেনই না।”

ফোনের অপরপাশের ব্যাক্তির কপাল কুঁচকে যায়। আঁখিজোড়া সংকুচিত করে সে শুধায়,
“আচ্ছা, অর্কর কোন বন্ধুকে বলতে হবে তা যদি বলতেন। খুব উপকার হতো।”

আচমকা রাফির কণ্ঠস্বরে হতবাক হয়ে যায় ইনায়া। ফোনটা কান থেকে সরিয়ে চোখের সামনে এনে স্ক্রিনে দেখে নিলো। না, সে তো অর্কর নাম্বারেই ফোন করেছে। ইনায়া ফোনটাকে আবার কানের কাছে নিয়ে বলল,

“যে ফোন ধরেছে তাকেই। এবার অর্ক ভাইকে দেন। আপনার সাথে কথা বলার সময় নাই।”

রাফি অবাক হয়ে যায়। তখন অর্ক এসে জিজ্ঞেসা করে,
“কীরে? কার সাথে কথা বলিস?”

রাফি আর কোনো বাক্য ব্যয় না করে অর্কর হাতে ফোনটা দিয়ে নিজের জায়গায় চলে যায়। অর্ক বিষয়টা বুঝতে পারল না। তারপর ফোনটা কানে নিয়ে হ্যালো বলা মাত্রই ইনায়া গর্জে ওঠল,

“আপনার ফোন আপনার বন্ধু ধরছে কেন?”

অর্ক খানিক থতমত খেয়ে যায়। সে জবাব দেয়,
“আমি বাথরুমে ছিলাম তো।”

“ওহ। এখন কোনো রকম ভণিতা ছাড়া জবাব দেন, যে আপনি কি আমার ফ্রেন্ডকে পছন্দ করেন?”

অর্ক কিছু বুঝতে না পেরে এবার ফোনের স্ক্রিণে নামটা দেখল। তারপর আবার ফোন কানে নিয়ে বলল,
“ওহ ইনায়া তুমি!”
“হ্যাঁ আমি। এবার জবাব দেন।”

অর্ক লম্বাশ্বাস নিয়ে বলল,
“দেখো সত্যি বলতে আরভির প্রতি আমার কোনো স্পেশাল ফিলিংস আসে না। কারণ আমি মেডিকেল প্রিপারেশনের সময় বুঝেছিলাম যে আমি নিজে ডাক্তার হলে পার্টনার তো ডাক্তার চাইবই না। আমার ধারণা ও চিন্তা-ভাবনার সাথে কারও কোনো সম্পৃক্ততা নাই। সবারই একটা নিজস্ব চিন্তা থাকে। আমার নিজেরই তো সময় থাকবে না। যা একটু ফ্রি টাইম থাকবে তখন যদি পার্টনারের ফ্রি টাইম না থাকে তবে? এটা সম্পূর্ণ আমার একান্ত ভাবনা। আমাদের দেশে কিন্তু ডাক্তার-ডাক্তারেরই বেশি বিয়ে হয়। আমি চাইনা আমার ওয়াইফ ডাক্তার হোক। সে জব করুক নো প্রবলেম। কিন্তু ডাক্তার না।”

ইনায়া আরভির দিকে তাকালো। আরভি কান্না থামিয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইনায়া হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“ঠিক আছে। আমি আরভিকে বুঝাব।”

“ধন্যবাদ ইনু।”

অর্ক কল কে’টে নিজের বিছানায় মাথা নিচু করে বসল। শুভ ও রাফি এসে ওর পাশে এসে বসল। শুভ বলল,
“তোর মনে কি সত্যি আরভির জন্য কিছু নেই?”

অর্ক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“নাহ্। আমি কখোনোই সেটা আনতে চাইনি। কারণ আমি জানতাম আমার কার সাথে বিয়ে ঠিক। তাই কাউকে নিজের জীবনে এনে মিথ্যে স্বপ্ন দেখানোর মানেই হয় না।”

রাফি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
“মানে?”

“আমার মামাতো বোন প্রীতিশা। নানুমনি মা*রা গেছেন দশ বছর হলো। যখন আমরা খুব ছোটো মানে স্কুলে ভর্তি হইনি। তখনকার একটা ঘটনা আমার মনে আছে। প্রীতিশা লাল শাড়ি পড়ে তার ছোটো ছোটো হাতে শাড়ির আঁচল ও কুঁচি ধরে আমার কাছে হেঁটে আসছিল। মুখে তার প্রাণখোলা হাসি। তখন বাড়ির সবাই ছিল। এক হুজুরও ছিল। আমি তখন বুঝিনি। আমাকে আবার পাঞ্জাবীও পড়ানো হয়েছিল। তখন আমার বয়স ছয় বছর। আর প্রীতিশার আড়াই বছর। গ্রামে ডিসেম্বরে শীতের সময় গিয়েছিলাম। আমার মা আমাকে এখনও নিজ খেকে সেই ঘটনার ব্যাপারে কিছু বলেনি কিন্তু কলেজে উঠার পর যখন ছুটিতে বাড়িতে গিয়েছিলাম তখন প্রীতিশাকে আবারও লাল শাড়ি পড়ে ছাদে আমার বোনের সাথে ছবি তুলতে দেখে ঘটনাটা আবছা মনে পরে। আমি শিউর না বলে কারও সাথে শেয়ার করিনি। কিন্তু আমার মন বলছে বিয়ে পড়ানো হয়েছিল। যদিও তখন আমরা দুজনেই নাবালক ছিলাম। এরকম অনেক সময় পরিবার করে রাখে। তাই ইচ্ছাকৃতই আমি আর কারও প্রতি ফিলিংস আনিনি। আমার মন বলছে মা যে পাত্রী ঠিক করে রেখেছে আর আমাকে বলছে, সারপ্রাইজ! সেই পাত্রীটা প্রীতিশাই।”

শুভ ও রাফি তন্ময় হয়ে সবটা শোনে। শুভ একটু হাসার চেষ্টা করে বলে,
“আমারও এখন ভয় হচ্ছে। ছোটোবেলাতে আবার কারও সাথে বিয়ে-টিয়ে দিয়ে রাখেনি তো? আমার রিনির কী হবে?”

শুভর কথায় রাফি কপালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে,
“এজন্যই বলি, প্রেম-টেম করে কী লাভ? যদি সে জীবনসঙ্গিনী না হয়!”

শুভ এবার রম্যস্বরে বলল,
“যাই অর্কর বিয়ে খবরটা মাশরিফ, রাতুল, রণিতকে দিয়ে দেই। ওরা এতক্ষণে মির্জাপুর পৌঁছে গেছে মনে হয়।”

চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।
কালকে আরেক পর্ব দেওয়ার চেষ্টা করব। গল্পটাতে এখনও কোনো রহস্য বা প্যাঁচ না আসলেও সামনে কিছুটা হলেও আসবে। এতো ঠান্ডা ঠান্ডা পর্ব আপনাদের জন্য স্বান্ত্বনা।☺️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here